Sandip Chakraborty

Abstract Romance Fantasy

2.8  

Sandip Chakraborty

Abstract Romance Fantasy

নীল রংয়ের সাঁকো/৯

নীল রংয়ের সাঁকো/৯

5 mins
234



সন্দীপ চক্রবর্তী



মানুষ যখন মানুষের কাছে এসে নিজেই নিজেকে চেনায় তখন সেই চেনার থেকে সত্যি আর কিছু হয় না। কথাটা বেশি খাটে বাচ্চাদের বেলায়। কলকাতায় বাচ্চা কিছু কম দেখিনি। কিন্তু তাদের বাইরের রূপের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে, মন বোঝার অবকাশ পাইনি। খুব কাছ থেকে বাচ্চাদের মন দেখার সু্যোগ হল ফাগুনের স্কুলে।


 তিরিশ জন বাচ্চা ফাগুনের স্কুলে পড়াশোনা করে। দুজন টিচার ওদের পড়ান। মাঝে মাঝে ফাগুনও পড়াতে বসে যায়। আমি যথারীতি বাইরে থেকে দেখি। আসলে একটা সংকোচ সবসময় আমাকে টেনে রাখে। ফাগুনকে ওরা আপন করে নিয়েছে। কিন্তু ফুলের মতো এইসব দেবশিশু কি আমাকে মেনে নিতে পারবে? আমি তো ওদের একজন হয়ে উঠতে পারিনি। বাইরে থেকে যত ওদের দেখি ততই যেন সংকোচ আমাকে চেপে ধরে। কিন্তু কাল একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল।


 এই ক'দিনে ওদের কয়েকজনের নাম আমার জানা হয়ে


গেছে। বিশেষ করে টুংলি, ঝুমুর, দ্রৌপদী, অর্জুন আর সনাতনকে আমি চিনি। স্কুল ছুটির পর টুংলি আমার সামনে এসে দাঁড়াল। গরিব শবরকন্যা। কিন্তু কী আশ্চর্য নিষ্পাপ চোখ! তেলহীন রুক্ষ চুলে দুটি বিনুনি। সামনের পাটির একটা দাঁত নেই। হাসলে ভারী মিষ্টি দেখায়। কোমরে হাত রেখে বেশ ভারিক্কী চালে বলল, তুমি কে বটে?


 আমার সংকোচ আরও বেড়ে গেল। কত বয়েস হবে টুংলির? ছয় কি সাত! এতটুকুন একটা মেয়েও কি বুঝে গেল যে আমি এখানকার কেউ নই? ওদের কেউ নই। সবাই যদি এমনি করে আমায় বহিরাগত ভাবে তা হলে এদের মাঝে আমার স্থান হবে কী করে! আমি কি শহুরে ট্যুরিস্টের মতো কিছুদিন এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে আর এখানকার মানুষজনের সঙ্গে শখের সেলফি তুলে ফিরে যাব কলকাতায়? না, তা হবে না। আমি যখন মানুষ তখন এই পৃথিবীর সর্বত্র আমার ঠাঁই আছে। মানুষের অন্তরে আশ্রয় পাবার জন্য আমায় পরীক্ষা দিতে হবে আমায়। টুংলি হয়তো তেমনই এক পরীক্ষক। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বললাম, আমি কে? আমি একটা কাকু।


 টুংলি কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকার পর বলল,


কাকু! কাকু ভালো বটে। তবে আমি ভাইবলাম তুমি আমাদের লতুন ম্যাস্টর।


 মুহূর্তের মধ্যে আমার মন খুশিতে ভরে গেল। টুংলি আমাকে নতুন মাস্টার ভেবেছে। বহিরাগত ভাবেনি। জিজ্ঞাসা করলাম, আমি পড়ালে তুই পড়বি?


 হ গো। বুড়া ম্যাস্টরটা খালি বকে। তুমি পড়হালে আমি লক্ষ্মী মেয়্যার মতো পড়ব।


 ঠিক আছে। তোর ফাগুনদিদি যদি পড়াতে দেয় তা হলে আমি তোদের নিশ্চয়ই পড়াব৷


 টুংলি মিষ্টি হেসে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেল। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। এখানে আমার একটা কাজ চাই। কিন্তু সেই কাজ কি বাচ্চাদের পড়ানো? জানি না পারব কিনা! কখনও কাউকে পড়াইনি। আমি পড়ালে ওদের যদি বুঝতে অসুবিধে হয়? তাতে তো ফাগুনের স্কুলের ক্ষতি। ফাগুনের ক্ষতি।


 আজকের দিনটা খুব সুন্দর। চমৎকার রোদ উঠেছে। পুরুলিয়া বীরভূম বাঁকুড়ার রোদের একটা বিশেষত্ব আছে। কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও এখানকার রোদ বেশ


প্রখর। স্কুল থেকে বেরিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি পাকা সড়কে চলে এসেছি। স্কুলের ক্লারিকাল কাজ করে যে ছেলেটি--নিরঞ্জন না কী যেন নামটা-- ফাগুন ওর সঙ্গে বসে কীসব কাজ-টাজ করছে। ফাঁক পেয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছি। কোথায় যাব জানি না। টুংলি আমার মনে হঠাৎ যে প্রত্যাশা জাগিয়ে দিয়েছে তারই ছোঁয়ায় আমার অন্যরকম কিছু করতে ইচ্ছে করছে।


 কিছুদূর যাবার পরেই একটা চায়ের দোকান। দরমার দেওয়াল আর টালির চালের ঘরের একপাশে দোকানি চা তৈরি করছে। শীতের সকালে চা-পিপাসু খরিদ্দার নেহাত কম নয়। সাত-আট জন অপেক্ষা করছে বাঁশের বেঞ্চিতে। আমিও এক কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম। এখানে ঠিক চা খেতে আসিনি। মানুষ দেখতে এসেছি। ফাগুন ফ্রি হলে ওর সঙ্গে আর এক কাপ খাওয়া যাবে।


 আমার পাশে বসে এক ভদ্রলোক হুশ হুশ শব্দ করে চা খাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে আড়চোখে আমাকে দেখছেন। ভদ্রলোক বোধহয় এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা নন। বেশ ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরে আছেন। কাঁধে চামড়ার ব্যাগও রয়েছে। বুকপকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে মোবাইল ফোন। আমাকে নিয়ে ওর কীসের এত কৌতূহল বুঝতে পারছি না।


 দোকানি চা দিয়ে গেল। সবে চুমুক দিয়েছি, হঠাৎ ভদ্রলোক বললেন, কিছু মনে করবেন না, আপনি বোধহয় কলকাতা থেকে এসেছেন, তাই না?


 অদ্ভুত লাগল। কে কোথায় থাকে সেটা তার গায়ে লেখা থাকে নাকি? বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু কেন বলুন তো?


 এমনি। আপনাকে দেখে কলকাতার বলে মনে হল। এখানে তো আপনার মতো শহুরে চেহারার লোক বেশি দেখা যায় না।


 আমার কথা বলতে ভালো লাগছিল না। গায়ে পড়ে যারা আলাপ জমানোর চেষ্টা করেন তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করি। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখেও কোনও হেলদোল নেই। বললেন, আমার নাম অশোক হালদার। বান্দোয়ানে এসডিও অফিসে চাকরি করি। মৃগীচামিতে কাজের সূত্রেই মাঝে মাঝে আসতে হয়। তা, আপনি এখানে বেড়াতে নাকি?


 বেড়াতেই বলতে পারেন।


 এই অজ পাড়াগাঁয়ে বেড়িয়ে কী সুখ পাবেন জানি না।


দু'চারদিনের বেশি থাকতে ইচ্ছে হবে বলে মনে হয় না। আর থাকাটা উচিতও হবে না।


 ভদ্রলোক পাগল নাকি! আমার কী উচিত কী অনুচিত উনি ঠিক করে দেবেন নাকি? জিজ্ঞাসা করলাম, উচিত হবে না কেন?


 আমার কানের কাছে মুখ এনে ভদ্রলোক ফিসফিস করে বললেন, মাওবাদীদের নাম শুনেছেন? এখানে ওদের খুব দৌরাত্ম্য। সরকারি অফিসে চাকরি করি তো, অনেক খবরই কানে আসে।


 অবাক হয়ে বললাম, আমি তো বেড়াতে এসেছি। মাওবাদীদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?


 সম্পর্ক কিছু নেই। কিন্তু ওরা বাইরের লোক পছন্দ করে না। কখন কী ঝামেলায় জড়িয়ে দেবে বুঝতেও পারবেন না। ঠিক আছে, আজ চলি। সাবধানে থাকবেন।


 ভদ্রলোক চায়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দাম মিটিয়ে হনহন করে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি কোনও প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না। চা খাওয়া হয়ে গেছে। উঠে পড়লাম। এখানে বসে থাকতে


আর আমার ভালো লাগছে না। রাজনীতি আমার পছন্দের বিষয় নয়। জন্ম থেকে দেখে আসছি মানুষের ভালো করার অ্যাজেন্ডা নিয়ে একদল লোক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে নামে। কিন্তু একবার ক্ষমতা হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ার পর মানুষের কথা আর তাদের মনে থাকে না। তখন দলের আর ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করাই তাদের একমাত্র কাজ হয়ে ওঠে। যতদিন না রাজনীতি মানুষ আর সমাজের সেবার ভাবনায় চালিত হয় ততদিন ওই কদর্য ইঁদুর দৌড়ে আমি নেই।


 স্কুলের ছুটি হয়ে গেছে৷ ফাগুন সম্ভবত আমারই জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে বলল, সক্কাল সক্কাল কোথায় গিয়েছিলে?


 এই তো কাছেপিঠেই। একটা চায়ের দোকান দেখলাম। এক কাপ চাও খেয়ে ফেললাম।


 বোঝো কাণ্ড! আমি ভাবছি সকাল থেকে চা খায়নি, হাতের কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেলি। এদিকে বাবুর চা-টা সব খাওয়া হয়ে গেছে।


 আরে ওটা তো দোকানের চা। বাড়িতে আর এক কাপ খাব। বেড়াতে বেরিয়ে চায়ের দোকান দেখে কি এমনি-

এমনি বসে থাকা যায়?


 বোসো। আমি ফুলমণিকে চা আর জলখাবারের কথা বুঝিয়ে দিয়ে আসি।


 হালকা কথাবার্তার আড়ালে অস্বস্তিটা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু হচ্ছে না। বারবার ফিরে আসছে অশোক হালদারের মুখটা। মাওবাদীরা কি সত্যিই বাইরে থেকে আসা মানুষজনকে পছন্দ করে না? কিন্তু আমি তো ওদের কোনও ক্ষতি করিনি। করবও না। তা হলে?


 অনেক ভেবেও কোনও কুলকিনারা পেলাম না। ফাগুনের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ফাগুনও যদি একই কথা বলে? হঠাৎ মনে হল আমি খুব একা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই না কেন একটা অদৃশ্য জেলখানা আমাকে অনুসরণ করে ঠিক সেখানে পৌঁছে যাবে। আমার কষ্ট দেখে ফাগুনও কষ্ট পাবে। কিন্তু কিছু বলবে না।


(ক্রমশ)


  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract