নীল রংয়ের সাঁকো/৩
নীল রংয়ের সাঁকো/৩
শচীজেঠুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে দেখলাম সন্ধ্যে নামতে আর বিশেষ দেরি নেই। শীতকালের বেলা পলক ফেলতে না ফেলতেই ফুরিয়ে যায়। এই সময় কোনও নির্জন নদীর ধারে বসে থাকতে খুব ভালো লাগে। নদীর কথা ভাবতে ভাবতে গঙ্গার ধারে যাওয়ার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠল। ছোটবেলায় বাবা-মা'র সঙ্গে আউট্রাম ঘাটে বেড়াতে যেতাম। বড়ো হবার পরে একাও গেছি অনেকবার। শেষবার গিয়েছিলাম তিন বছর আগে। আমার মনের অসুখ ধরা পড়ার পর। সেদিন আমার সঙ্গে ছিল নয়না। আমার প্রথম এবং শেষ গার্ল ফ্রেন্ড। আমি মানসিক অবসাদে ভুগছি জানা সত্ত্বেও সেদিন নয়না এসেছিল ব্রেক আপের কথা বলতে। ওর বদ্ধমূল ধারণা ছিল যাদের মানসিক অসুখ হয় একদিন তারা পাগল হয়ে যায়। আমিও একদিন পাগল হয়ে যাব। তখন আমার কারোও সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগত না। সারাদিন বাড়ির কোথাও না কোথাও চুপ করে বসে থাকতাম। প্লেন ক্র্যাশের যে ভয়ংকর আওয়াজ আমার মাথার ভেতর সারাক্ষণ ঝনঝন করত, মনে হত একদিন আমি ওই আওয়াজের মধ্যে হারিয়ে যাব। আমার কাছে কেউ এলে আস্ত একটা প্লেন ভেঙে পড়ার বিকট শব্দে চমকে উঠবে।
গায়ে হাত রাখলে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে ঝলসে যাবে। আমি একটা ধ্বংসস্তূপ। কোনওদিনই এই পোড়া মাটিতে আর ক্রিসেনথিমাম ফুটবে না। তাই নয়নার কথার কোনও প্রতিবাদ আমি করিনি। শুধু তাকিয়ে ছিলাম ওর মুখের দিকে। দেখতে পাচ্ছিলাম আরও একটা সাঁকো ভেঙে পড়ল। নীল রংয়ের সাঁকো। কিছুক্ষণ পর কফির কাপ দুমড়ে মুচড়ে, দামি হিলের নীচে থেঁতলে নয়না গটগট করে চলে গিয়েছিল। মিলিয়ে গিয়েছিল হাওয়ায়।
নয়নার কথা মনে না পড়লেই ভালো হত। ওর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠা মাত্র গঙ্গার ধারে যাওয়ার ইচ্ছেটা সবুজ থেকে কেমন যেন হলুদ হয়ে গেল। না, আজ আর যাব না। ওখানে গেলে আবার নয়নার মুখটা চলে আসবে। তবে যেদিন বাড়ি থেকে পালাব সেদিন প্রথম দেখা করব নয়নার সঙ্গে। শুধু এইটুকু বলতে, আমি পাগল হইনি নয়না। কিন্তু একদিন আমি এই জীবনকে ভালোবেসে, এই পৃথিবীকে ভালোবেসে, পৃথিবীর কোনও এক নারীকে ভালোবেসে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাব। পাগল না হলে কি বাঁচা যায়?
প্রকাশ হাত-পা ছড়িয়ে এফএম রেডিওতে গান শুনছিল। আমি গাড়ির পিছনের দরজা খুলে বসলাম।
রেডিও বন্ধ করে প্রকাশ বলল, এইমাত্র ডাক্তারবাবু ফোন করেছিলেন। বললেন যে তুমি যদি কোথাও যেতে চাও তা হলে যেন নিয়ে যাই। কোথায় যাবে বলো?
কোথাও না। বাড়ি চলো।
অবশেষে আমি একটা কাজ পেলাম। না, কাজ বলব না, লক্ষ্য। আপাতত আমার জীবনের লক্ষ্য এই বাড়ি থেকে পালানো। কাল শচীজেঠুর কথা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি এরা স্বেচ্ছায় কোনওদিনই আমায় বেরোতে দেবে না। যে চিকিৎসক ঘন্টায় ঘন্টায় বলেন, তুই ভালো হয়ে গেছিস অনি। আর আমার কোনও চিন্তা নেই।--তিনি কোন যুক্তিতে আমাকে বাড়ির মধ্যে আটকে রাখেন, আমার জানা নেই।
আমার জানার দরকারও নেই। আমি পালাতে পারলেই খুশি। কিন্তু জেলখানার মতো কঠিন মনের বাড়ি থেকে পালানো খুব সহজ কাজ নয়। গেটে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকে নীলকান্ত ছেত্রী। রাত দশটায় ওর ছুটি। একতলার অপারেশন ইন চার্জ রতনকাকা। আর দোতলার মঞ্জুদি। এ ছাড়া শঙ্কর, প্রকাশদা, অভিরাম, রাঁধুনি শ্যামা পিসি--এরকম অনেকে আছে, যারা মূলত তিনজন জবরদস্ত
সিকিউরিটি অফিসারের অ্যাসিসট্যান্ট। এদের সকলের চোখে ধুলো দিয়ে সম্ভবত একটা মাছিও বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না। নিরাপত্তায় কোনও ফাঁক খুঁজে না পেয়ে হতাশ লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমি পারব না। আলোবাতাস না পেয়ে এই বাড়িতেই একদিন আমি মরে পড়ে থাকব।
শচীজেঠুর কথামতো রতনকাকা বা মঞ্জুদিকে সঙ্গে নিয়ে অবশ্য যাওয়া যায়। কিন্তু আমি কাউকে সঙ্গে নেব না। ভাবতে ভাবতে হঠাৎই একটা আইডিয়া মাথায় এল। অনেকদিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম৷ গল্পে আঠারো-উনিশের একটা ছেলে ঠিক এইভাবে বাড়ি থেকে পালিয়েছিল। অনেকক্ষণ ভাবলাম। মনে হল শচীজেঠু অ্যান্ড কোম্পানিকে বোকা বানানোর এটাই সেরা উপায়। হ্যাঁ, আমি এভাবেই পালাব। এভাবেই--
সন্ধ্যেবেলার চা আর জলখাবার নিয়ে মঞ্জুদি ঘরে এল, ও মা! একা একা তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ অনিবাবা?
মনে হল এই সুযোগ। এখনই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিই। কিন্তু সেটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অন্তত আজকের রাতটা ভাবা দরকার। মঞ্জুদির হাত থেকে জলখাবারের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করলাম।
সন্ধ্যেবেলার জলখাবারে লুচি আলুর তরকারি খাওয়ার চল এ বাড়িতে অনেকদিনের। বাবা-মা চলে যাওয়ার পরেও মঞ্জুদি সাবেকি চাল বজায় রেখেছে। খেতে খেতে গল্প করছিলাম। খেজুরে গল্প। যেসব কথা জানি সেগুলোই একটু ঘুরিয়ে জানতে চাইছিলাম। আমি যে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক সেটা বোঝানোই আমার উদ্দেশ্য। যাতে আমার ওপর থেকে বাড়িসুদ্ধ লোকের ফোকাস নড়ে যায়। আমিও পালাতে পারি সচ্ছন্দে।
উত্তেজনায় রাতে ঘুম এল না। আমি প্ল্যান নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি কোথায় যাব, এটাই আমার কাছে এখন সব থেকে বড়ো প্রশ্ন। ফাগুনকে আমি কখনও দেখিনি। ফোনে কথা হয়। ওর স্কুলের কথা, স্কুলের বাচ্চাদের কথা ফেসবুক থেকে জানতে পারি। আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয় যেন ফাগুনের পৃথিবীতে আমারও একটা জায়গা আছে। আমি হাত বাড়াইনি বলে ফাগুনের পৃথিবী ধরা দেয়নি। কিন্তু একে কি চেনা বলে? আমি কি ফাগুনকে চিনি? শুধু এই একটি কথা নিয়ে অনেকটা সময় পার করে ফেললাম। চোখে সয়ে গেলে মধ্যরাতের অন্ধকারও ফিকে লাগে। মনে হয় কে যেন ভারী অযত্নে আলগা হাতে খানিকটা আলো ফেলে গেছে। আবছা অন্ধকারে আমার দ্বিধা কেটে গেল। আমি ফাগুনের কাছেই যাব।
মৃগিচামীতেই আমার যাওয়া দরকার। হয়তো ওখানে গেলে শচীজেঠুরা আমাকে সহজেই ধরে ফেলবে। তখন যদি ফাগুন আমাকে জায়গা না দেয়, আমি আবার পালাব। খুঁজে নেব কার কাছে আমার ঘর আছে।
ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল আমি সত্যিই সুস্থ হয়ে গেছি। মাথা আর মন একসঙ্গে কাজ না করলে আমি এতক্ষণ ধরে ভাবতে পারতাম না। অথচ শচীজেঠু এখনও মাঝে মাঝে ভয় দেখায়, ঘুম যেন কোনওভাবে ডিসটার্বড না হয় অনি। রাতে আট ঘন্টা ঘুম না হলেই কিন্তু ডিপ্রেশন ধরবে।-- আজ আমি বুঝে গেছি রাতে না ঘুমোলেও কিছু হবে না। আমার সব থেকে বড়ো ওষুধ স্বাধীনতা। নিরাপত্তার এই প্রাণান্তকর আলিঙ্গন থেকে মুক্তি।
এ বাড়িতে সব কাজ ঘড়ি ধরে হয়। সাড়ে সাতটা বাজা মাত্র মঞ্জুদি ব্রেকফাস্ট নিয়ে ঘরে এল, আজ বুঝি তাড়াতাড়ি উঠেছ! রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
দারুণ ঘুমিয়েছি মঞ্জুদি। কাল তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম বলে আগে ঘুম ভেঙেছে।
সেটাই তো ভালো। ঘুম যদি আগে ভাঙে তা হলে তো আবার ব্যায়াম করা শুরু করতে পারো। যখন ব্যায়াম করতে কী সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল তোমার। এখন একটু ভুড়ি হয়েছে।
লজ্জা পেয়ে হাসলাম। আমি পরিকল্পনার সব থেকে জটিল অংশে ঢুকে পড়েছি। এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যাতে কেউ আমার ওপর নজর রাখা দরকার না মনে করে। আমার পড়া সেই গল্পের নায়ক এমনটাই করেছিল। খেতে খেতে বললাম, করব মঞ্জুদি। তুমি বরং রতনকাকাকে আমার জিম পরিষ্কার করিয়ে রাখতে বোলো।
বলব। ধীরেসুস্থে খাও। আমি কফি আনছি।
মঞ্জুদি চলে যাচ্ছিল, আমি ডাকলাম, মঞ্জুদি শোনো। মাসখানেকের জন্য যদি কোথাও বেড়াতে যাই, তুমি যাবে আমার সঙ্গে? কাল শচীজেঠুও তোমার কথা বলছিলেন।
ডাক্তারবাবু বললে কেন যাব না? তা, কবে যেতে চাও?
ধরো, পরশু--
পরশু! না না পরশু তো তোমার জন্মদিন। বাড়িতে পার্টি হবে। ওদিন হবে না।
জন্মদিনের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।-- হ্যাঁ হ্যাঁ, পরশু তো আমার আবার জন্মদিন। একদম মনে ছিল না। ঠিক আছে, তার পরের দিন?
না, পরের দিন আমার একাদশী। তার পর আবার শনিবার। অযাত্রা। রবিবার ঠিক আছে।
ওকে। রবিবারই যাব। আমি শচীজেঠুকে বলে দিচ্ছি।
মঞ্জুদি চলে যাবার পর আমি খুব হাসলাম। কারণ পরশুই আমি পালাব। নিজের বাড়ি থেকে পালানোর জন্য জন্মদিনের থেকে ভালো দিন আর কী হতে পারে!
মুক্তির আনন্দে বিভোর হয়ে ছিলাম, হঠাৎ ফোনটা বাজতে শুরু করল। অ্যাটর্নি আঙ্কলের ফোন। আমার ওপর নজর রাখার জন্য স্যাটেলাইট নাম্বার টু। ফোন ধরার ইচ্ছে ছিল না কিন্ত সাত-পাঁচ ভেবে ধরেই ফেললাম, হ্যালো--
কেমন আছিস অনি?
ভালো আছি আঙ্কল।
এই তো গলাটা বেশ তরতাজা শোনাচ্ছে। পরশু তোর জন্মদিন। বল কী গিফট চাই?
গিফট আবার কেউ চায় নাকি! আপনার যা ইচ্ছে তাই দেবেন।
চায় না মানে? ছোটবেলায় তো দিব্যি চাইতিস। মনে আছে একবার একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর চেয়েছিলি? তোর মা কুকুর পছন্দ করত না বলে দিতে পারিনি। এবার কি অ্যালসেশিয়ান নিয়ে যাব?
না না। আমার এখন কুকুর ভালো লাগে না।
তা হলে কী ভালো লাগে?
যা ভালো লাগে তা কি অ্যাটর্নি আঙ্কলকে বলা যায়? বললে যদি আমার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়! একবার ধরা পড়ে গেলে দুই স্যাটেলাইট মিলে নজরদারি এত বাড়িয়ে দেবে যে আমি হয়তো আর কোনওদিন বেরোতেই পারব না।
কী রে চুপ করে আছিস কেন! কিছু বল--
কেমন একটা জিদ চেপে গেল। মনে হল যা হয় হোক, আমি বলব।-- আজকাল আমার একটা জিনিসই ভালো লাগে।
কী সেটা?
ফ্রিডম।
অ্যাঁ?
ফ্রিডম। স্বাধীনতা।
তুই কি পরাধীন? ইচ্ছে করলেই তুই যেখানে খুশি যেতে পারিস। প্রকাশকে বললেই হবে। অসুখটা করার আগে তো যেতিস। মনে নেই? পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক স্টোরে বসে বই পড়তিস। সেটা তোর মতো ভালো ছাত্রের পক্ষে কোয়াইট ন্যাচারাল। এমবিএ করার পর তোর বাবা-মা, আমরা সবাই ভেবেছিলাম তুই কোনও মাল্টিন্যাশনালে চাকরি করবি। তারপর কী যে হয়ে গেল! যাক, সে কথা। গিফট আমি পছন্দ করে নিয়ে যাব'খন।
তা হলে এখন রাখি?
না শোন। আর একটা কথা আছে। জরুরি। আমার এক বন্ধুর মেয়ে অম্বা আজ সন্ধ্যেবেলায় তোর কাছে যাবে। শি ইজ আ জারনালিস্ট। একটা ইংরিজি খবরের কাগজে আছে। অম্বা মানসিক রোগীদের ওপর একটা আর্টিকল লিখছে। সেই ব্যাপারে তোর সঙ্গে কথা বলবে।
সরি আঙ্কল। আজ সন্ধ্যেবেলায় আমি একটু বেরোব। প্রকাশদাকে বলে রেখেছি। আপনি বরং ওকে পরশুর পরের দিন আসতে বলুন।
ঠিক আছে। তাই বলব।
হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়ে গেল। পরশুর পরের দিন অম্বা দেবী যখন আসবেন তখন অনির্বাণ বসু অনেক দূর চলে গেছে। এত দূরে যে আর হয়তো কোনওদিন দেখাই হবে না।
(ক্রমশ)