নীল রংয়ের সাঁকো/৪
নীল রংয়ের সাঁকো/৪
আজ আমার জন্মদিন। এবং আমি সকলের চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। আমার ভাগ্য আজ ভালো বলতে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখলাম মঞ্জুদি ব্যস্ত। সারা বাড়ি ধুয়েমুছে একেবারে ঝকঝকে করে তোলা হচ্ছে। মঞ্জুদি দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করাচ্ছে। নীচে রতনকাকা বাজারে গেছে। শঙ্কর তখনও আসেনি। নীলকান্ত ছেত্রী নিজের ঘরে। সম্ভবত স্নান করছে। এর থেকে বড়ো সুযোগ আর কী হতে পারে। আমি তৈরি হয়েই নীচে নেমেছিলাম। পলাতকের সঙ্গে বেশি লটবহর থাকে না। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। আমার লাগেজ বলতে কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ। তাতে আছে গোটাচারেক জামাকাপড়ের সেট আর দুটো জ্যাকেট। জীবনের অচেনা ক্যানভাসে নিজেকে দেখার জন্য এর থেকে বেশি উপকরণ আমার দরকার নেই।
আমার ট্যাক্সি স্ট্র্যান্ড রোড পার করে হাওড়া ব্রিজে ঢুকে পড়ল। বাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে কয়েক পা যাবার পরেই ট্যাক্সিটা পেয়ে গিয়েছিলাম। কাল রাতে নেটে দেখে
নিয়েছি সাড়ে আটটায় পুরুলিয়া যাবার একটা ট্রেন আছে। এখন আটটা দশ। আর বড়োজোর পাঁচ মিনিট। তারপর... উফ! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে কাউকে বোঝাতে পারব না। আরও ভালো লাগছে কারণ আমি নয়নাকে ক্ষমা করতে পেরেছি। কাল রাত পর্যন্ত ঠিক ছিল নয়নার সঙ্গে দেখা করার পর আমি কলকাতা ছাড়ব। আজ সকালে মনে হল, না থাক। যে যেখানে আছে সবাই ভালো থাক। নয়না আমাকে পাগল ভাবে তো কী হয়েছে! আমি তো আর সত্যি পাগল নই। তার থেকেও বড়ো কথা নয়না যদি আমি একদিন পাগল হয়ে যাব ভেবে সেদিন চলে না যেত তা হলে আমরা বিয়ে করতাম। নয়না প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী। টাকাপয়সা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। বিয়ের পর নয়না নির্ঘাত বসু পরিবারের বৈভবের ভুলভুলাইয়াতে হারিয়ে যেত। আমি বিবাহিত জীবনের খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতাম। আজকের দিনটা আমার জীবনে কোনওদিনই আসত না। পৌষের সকালে গঙ্গার মন কেমন করা হাওয়ার বুক ভরে শ্বাস নিয়ে মনে হল, নয়না ওর মতো করে বাঁচুক, আমি আমার মতো। আমরা কেউ কারোর খাঁচা হব না। জীবন যদি অনেকদিন পর অচেনা কোনও পথের বাঁকে মিলিয়ে দেয় তা হলে আমি ওর বাচ্চার গাল টিপে আদর করে দেব। কারণ দাদুর অনেক আগে নয়না আমায় উড়িয়ে দিয়েছিল। কাজে লাগবে না বলে ফেলে দিয়েছিল।
ভাগ্যিস দিয়েছিল। তাই আজ আমি আজকের এই ঝকঝকে নীল আকাশ খুঁজে পেলাম।
টিকিট কেটে উঠে পড়লাম পুরুলিয়ার ট্রেনে। যাত্রী বেশি নেই। আমার দুটো সিট পরে একজন মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। বাকিরা দূরে দূরে। সবারই হাতে মোবাইল। মনে পড়ে গেল ফাগুনকে একটা ফোন করতে হবে। সারপ্রাইজ দেব বলে কাল ফোন করিনি। এখন একবার বলা দরকার, আমি আসছি। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা অনির্বাণ বসুকে ও যদি জায়গা দিতে রাজি না হয় তা হলে পুরুলিয়াতে আজকের দিনটা থেকে কাল আমি অন্য কোথাও চলে যাব। বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে আসার পর সারা পৃথিবীই এখন আমার ঠিকানা।
কিন্তু ফাগুনকে ফোন করা হল না। পকেট থেকে বের করা মাত্র মোবাইল বেজে উঠল। বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে কেউ ফোন করেছে।--হ্যালো
ওপাশ থেকে কাঁদো কাঁদো গলায় মঞ্জুদি বলল, তুমি কোথায় অনিবাবা?
আমি ট্রেনে। কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি।
এ তুমি আমাদের কী সর্বনাশ করলে বলো তো? ডাক্তারবাবুকে আমরা কী জবাব দেব?
তোমাদের কোনও জবাবই দিতে হবে না। আমার ঘরে টেবিলের ওপর একটা খাম পাবে। শচীজেঠু এলে ওকে ওটা দিয়ে দিয়ো। চিঠিতে আমি সব লিখে এসেছি।
তুমি কবে ফিরবে?
জানি না। তবে ফিরব। একদিন নিশ্চয়ই ফিরব।
মঞ্জুদি ফোন রেখে দিল। ফাগুনকে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওর ফোন সুইচড অফ। আমার মন বলছে ফাগুন মুখ ফিরিয়ে নেবে না। মন খারাপের দিনে ওকে কতবার ফোন করেছি। কথা বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ফাগুন কোনওদিন বলেনি, অনি এবার রাখো। আমার কাজের ক্ষতি হচ্ছে। আজ আমি নিজেকে খুঁজতে বেরিয়েছি। জেল থেকে পালানো কয়েদির মতো আমারও আজ আশ্রয় দরকার। ফাগুন ছাড়া আশ্রয় আমাকে কে দেবে! ফাগুনও সেটা জানে। আর জানে বলেই আমাকে ফেরাবে না।
ভায়ার যাওয়া হবে কদ্দুর?
ফাগুনের ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিলাম। ভাবনার সুতো ছিঁড়ল অচেনা কণ্ঠস্বরে। দেখলাম সেই খবরের কাগজ পড়া ভদ্রলোক, তাকিয়ে আছেন আমারই দিকে। দু'চোখে হাসির ঝিলিক। যেন আমাকে চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকতে দেখে বেশ মজা পেয়েছেন। বললাম, পুরুলিয়া।
পুরুল্যে! খাসা জায়গা ভায়া। যেমন ঠাণ্ডা তেমনি গরম। ক'বার গেছি কিনা! তা, কাজে না বেড়াতে?
ভদ্রলোকের কথা বলার ধরনটি বেশ। কলকাতার লোকেরা এরকম সহজ প্রাণখোলা সুরে কথা বলতে পারে না। কিন্তু কী বলি ওকে? কাজে যাচ্ছি না বেড়াতে! অন্য মানুষের কাজে লাগতে পারে এমন কোনও কাজ কি আমি জানি? বললাম, বেড়াতেই বলতে পারেন।
এই তো চাই! এই বয়েসে বেড়াবেন না তো আর কবে বেড়াবেন! আমাদের মতো বয়েসে তো বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা হবে। আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লাগছে ভায়া। মনে হচ্ছে যেন ফিরে গেছি ওই বয়েসটায়। যাক সে কথা। আমার নাম অসিত বরণ পোদ্দার। থাকি ঝাড়গ্রামে। ওখানে আমার একটা দোকান আছে। এখন অবশ্য যাব খড়্গপুরে। একটা ছোট কাজ সেরে বাড়ি ফিরব। তা ভায়া, আপনার নামটা তো জানা হল না?
আমার নাম অনির্বাণ বসু।
অনির্বাণ! খাসা নাম। চেহারাটিও রাজপুত্তুরের মতো। তা বলছি কী, বেড়াতে যখন এত ভালোবাসেন, একবার আসুন না ঝাড়গ্রামে। গরিব দাদার বাড়িতে দু'দিন খারাপ লাগবে না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এত অল্প পরিচয়ে কেউ কি আজকাল কাউকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে? জানি না। কিন্তু মন ছুঁয়ে গেল ওর ডাক। অসিত বরণ পোদ্দারই জেলখানার বাইরে আমার অজানা পৃথিবীর সেই লোক যিনি আমাকে প্রথম স্বীকৃতি দিলেন। গ্রহণ করলেন আমায়। বললাম, নিশ্চয়ই যাব।
গল্পে গল্পে জমে উঠল আমার পলাতক জীবনের প্রথম পর্ব। কিছুক্ষণের মধ্যেই অসিত বরণ হয়ে গেলেন আমার অসিতদা। আমি ভালো কথা বলতে পারি না। স্বভাবেও লাজুক। তাই আসরের মূল সুরটি ধরে রাখলেন অসিতদাই। আমি শুধু মাঝে মাঝে বিলম্বিত লয়ে ঠেকা দিলাম। মজার কথা বলায় জুড়ি নেই মানুষটির। বিশেষ করে বউদির কথা বলার সময় ওর রস যেন উথলে পড়ে। নয়নার কথা মনে পড়ছিল। নয়নার সঙ্গে বিয়ে হলে আমি কি পারতাম কোনও এক্সপ্রেস ট্রেনের কামরায় পুরুলিয়ায় বেড়াতে যাওয়া এক সদ্য পরিচিত যুবকের সঙ্গে এইভাবে ওর কথা বলতে? বোধহয় পারতাম না। কারণ বউদির কথা যা শুনলাম তাতে মনে হয় নয়না ওরকম নয়। নয়নারা সম্পদ যতটা বোঝে সম্পর্ক তত বোঝে না।
খড়্গপুর এসে গেল। নেমে যাওয়ার আগে অসিতদা বললেন, মনে থাকে যেন ঝাড়গ্রামে যাবে বলে কথা দিয়েছ। আজ বাড়ি ফিরেই বউকে বলব, তোমার একজন দেওর পেয়েছি। একেবারে কাত্তিক ঠাকুরের মতো চেহারা। সে আসবে বলেছে। দেখো, এলে যেন আমাকে আবার ভুলে যেয়ো না।
হাসতে হাসতে অসিতদা ট্রেন থেকে নেমে গেলেন। সে হাসির রেশ অনেকক্ষণ আমার মনে লেগে রইল। কিন্তু তারপর একটা অবসাদ পেয়ে বসল আমাকে। মনে হল যেন আমি হারিয়ে ফেললাম অসিতদাকে। আর কখনও দেখা হবে না আমাদের। ফোন নাম্বার সেভ করে রেখেছি ঠিকই কিন্তু সব ডিলিট হয়ে যাবে একদিন। সময় মুছে দেবে সব। ঠিক যেভাবে আমার দাদু, বাবা, মা, নয়না ডিলিট হয়ে গেছে।
এই অবসাদ আমি চিনি। আর হয়তো কয়েক মুহূর্ত তারপরই আমার চারপাশে নেমে আসবে একটা ঝাপসা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ভেঙে পড়বে একটার পর একটা নীল রংয়ের সাঁকো। আমি নিজেকে বোঝালাম, তুমি ভালো হয়ে গেছ অনি। তোমার অসুখ সেরে গেছে। এরপরও যদি তুমি অন্ধকারে ডুবে যাও তা হলে ফাগুন কোন ভরসায় তোমাকে আশ্রয় দেবে? মুখ তোলো অনি। জানলার বাইরে আকাশটা একবার দেখো। সোনালি রোদ্দুরে ভরে গেছে চারপাশ। কোথাও কোনও অন্ধকার নেই। মন শক্ত করো। সাঁকোগুলো আবার তৈরি করতে হবে। ওপারে যেতে হবে তোমায়। ওপারেই তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে। দাদুর কথাগুলো তোমার মনে নেই? দাদুই তো বলেছিল নীল সাঁকোর কথা। বলেছিল, সব মানুষের স্বপ্নেই নীল সাঁকোরা আসে। কিন্তু কেউ কেউ সাঁকো বলে চিনতে পারে। দাদু পেরেছিল। তুমিও পারবে। নিশ্চয়ই পারবে।
আবছা একটা ঘুমের ঘোর আমাকে জড়িয়ে ধরছিল। কিন্তু আমি এখন ঘুমবো না। জানি, ঘুমিয়ে পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবুও না। খোলা জানলা দিয়ে হাওয়ার ঝাঁক এসে আমায় জাগিয়ে রাখল। এই প্রথম দেখলাম আলোয় ধুয়ে গেল অন্ধকার। প্লেন ক্র্যাশের আওয়াজ মিলিয়ে গেল একটু একটু করে। আবার আমি ফিরে এলাম ট্রেনের কামরায়। আনন্দে আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু হঠাৎ সেতার বাজানোর শব্দ শুনে অবাক হয়ে গেলাম। চলন্ত ট্রেনে কে বাজাচ্ছে সেতার? আশ্চর্য তো! একটু পরে রহস্যটা পরিষ্কার হল। না, ট্রেনে কেউ সেতার বাজাচ্ছে না। সেতার বাজছে আমার মাথার ভেতর। কারণ আমি দাঁড়িয়ে আছি বাবার মিউজিক রুমের চৌকাঠে। পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছি ঘরের ভেতরটা। বাবা চোখ বুজে বাজাচ্ছে। এখন বাবার রেওয়াজের সময়। আমার বাবা, অনলদেব বসু ভারত বিখ্যাত সেতারি। সারা বছর দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠান। হাততালির শব্দ। বাবার মুখে তৃপ্তির হাসি। বাড়িতে থাকলে সুযোগ পেলেই একটাই কথা আমার কানে গুনগুন করত বাবা, তোকে আমার থেকেও বড়ো শিল্পী হতে হবে অনি। কিন্তু সেতার আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত গান। রবীন্দ্রনাথের গান। শরীর ভালো থাকলে মা গাইত, আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী। সেই বয়েসে আমি জানতাম না মা কার প্রেম বা কার কলঙ্কের কথা বলছে। বড়ো হয়েও বুঝিনি, কেমন সেই প্রেম যার জন্য সবার কলঙ্কভাগী হওয়া যায়।
সবুজ রংয়ের একটা অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল জানলার পাশ দিয়ে। পাখির ডাকের নীচে চাপা
পড়ল সেতারের সুর। অত বড়ো মিউজিক রুম একবার
কেঁপে উঠে হারিয়ে গেল কোথায় যেন। ভালোই হল। আমি এখন অতীতের কথা ভাবতে চাই না। এখন কোনও অন্ধকার নেই, ঘুম নেই, হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া কোনও বিকট শব্দ নেই--জানলার বাইরে লাল মাটির রাস্তাঘাট, ঝুপসি বাড়িঘর, দূরে দূরে প্যাস্টেলে আঁকা পাহাড়-- আমি অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি। এখনও অনেকটা যেতে হবে। পথের ছবি মনের কোণে উদয় হওয়া মাত্র আমার মন মুহূর্তের মধ্যে একটা এগারো বছরের বালক হয়ে গেল। তারপর ট্রেন থেকে নেমে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করল। আমি চিৎকার করে বললাম, দিগন্ত পেরিয়ে তোকে আরও বহুদূরে যেতে হবে। পারবি তো? ডানহাতটা আকাশে তুলে ও বলল, পারব।
(ক্রমশ)

