Sandip Chakraborty

Abstract Romance Tragedy

3  

Sandip Chakraborty

Abstract Romance Tragedy

নীল রংয়ের সাঁকো/৬

নীল রংয়ের সাঁকো/৬

6 mins
229



ফাগুন মিছিমিছি টেনশন করছে। মৃগীচামিতে কীভাবে যেতে হয় আমি জানি। ফাগুনের কাছ থেকে শোনার পর নেটে অনেকবার দেখেছি। এটাই আমার স্বভাব। কোথাও যাই বা না যাই, সেখানে কীভাবে যেতে হয় আমি নেট ঘেঁটে খুঁজে বের করি। এমনি করে অনেক জায়গায় আমার মনে মনে ঘোরা হয়ে যায়।


 পুরুলিয়া স্টেশনের বাইরে বাস এবং প্রাইভেট গাড়ির স্ট্যান্ড। বাসে যাওয়া যেত কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়ি ফাগুনের কাছে পৌঁছতে চাই। সুতরাং গাড়ি বুক করে উঠে বসলাম। ড্রাইভার ভদ্রলোক সম্ভবত অবাঙালি। বয়েস চল্লিশের ওপরেই হবে। আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক প্রয়োজনের বাইরে বাড়তি কথা একটিও বলেন না। ভাড়া নিয়ে কথাবার্তা হয়ে যাবার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, লাগেজ-ওয়াগেজ কুছু নেই?আমি বললাম, না। ব্যাস, ওখানেই শেষ আমাদের বাক্যালাপ। তারপর আধঘন্টা কেটে গেছে। লাল মাটির ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। এর মধ্যে আমি দু'বার মিররে ওর চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করেছি। যাতে ভদ্রলোক কিছু বলেন। কিংবা আমি কিছু বলার সুযোগ পাই। কিন্তু উনি দু'বারই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমিও আর মাথা ঘামাইনি।


 অনেকটা সময় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। পুরুলিয়া থেকে মৃগীচামীর দূরত্ব পঁচানব্বই কিলোমিটার। ঘন্টা দু'য়েক তো লাগবেই। কী করব এতক্ষণ? ধীরে ধীরে মন জানলার বাইরে প্রকৃতির ক্যানভাসে ডুবে গেল। আগে কখনও আসিনি এখানে। শহর ছাড়িয়ে যত দূরে যাচ্ছি ততই যেন প্রকৃতি রুক্ষ আর উদাসীন হয়ে উঠছে। রাস্তার দু'দিকে বিশাল মাঠ আর দূরের ওই ঝাপসা দিগন্ত কি কোথাও ফেরার কথা বলে? নাকি এই পথ মানুষকে ঘর ভুলিয়ে আদিগন্ত এক বিপুল উদাসীনতার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়? তারপর কী করে মানুষ? আমি জানি না। তবু ভালো এই রুক্ষতা সম্পূর্ণ রিক্ত নয়। কোথাও তার একটা ফাগুন আছে। ফাগুনের ভাবনা যত ভাবি আমার মন ততই নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে নিজেকেই প্রশ্ন করি, আমি কি ফাগুনকে ভালোবাসি? ভালোবাসি কি না জানি না। তবে একটা বন্ধন নিশ্চয়ই আছে। নয়তো বাড়ি থেকে পালিয়ে আমি ফাগুনের কাছে চলে আসতাম না।


 মিরগিচামি মে আপ কাঁহা যাইয়েগা সাব?


 আরিব্বাস! ভদ্রলোকটি তা হলে কথা বলেন! কিন্তু আমার হিন্দি খুবই খারাপ। বললাম, উধার বর্ণপরিচয় নাম কা এক স্কুল হ্যায় না? ব্যাস, উওহি স্কুল মে যানা হ্যায়।


 বরণপরিচয়! মতলব, ফাগুন ম্যাডাম কি স্কুল?


 ফাগুন কো জানতে হ্যায় আপ?


 জী। বহুত বঢ়িয়া কাম কর রহী হ্যায়। আদিবাসী বাচ্চো কো পড়াতি হ্যায়। আজকাল তো গাঁও মে পানি লানে কে লিয়ে ভি কোশিস কর রহী হ্যায়।


 পানি লানে কি লিয়ে মতলব? গাঁও মে পানি নেহী হ্যায় কেয়া?


 ইয়ে সব এরিয়া মে পানি কা বহুত তকলিফ হ্যায়। দূর দূর সে পানি লানা পড়তা হ্যায়। উও ভি মিলতা নেহী। ফাগুন ম্যাডাম কামিয়াব হো গয়ি তো সারা গাঁও বাঁচ যায়েগা।


 ফাগুনের প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। আমার বয়েসি একটা মেয়ে গ্রামের জলের সমস্যা দূর করার জন্য কাজ


করছে। ভাবা যায়! বললাম, ম্যায় ফাগুন কে পাশ হি যা রাহা হুঁ। উও মেরা বহুত আচ্ছে দোস্ত হ্যায়।


 ইয়ে তো বহুত হি খুশি কি বাত হ্যায়! আপ পড়েলিখে আদমি। আপ আগর সাপোর্ট দিজিয়েগা তো ফাগুন ম্যাডাম জরুর কামিয়াব হোঙ্গি।


 ফাগুনের পাশে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হচ্ছিল। ভদ্রলোক আমাকে সেই গ্লানি থেকে মুক্তি দিলেন। কিন্তু যে মেয়ে একা যুদ্ধে নামে সে কি আমার সাপোর্টের পরোয়া করে? ফাগুনকে জিজ্ঞাসা করে দেখব। ও যদি চায় আমি অবশ্যই সাহায্য করব।


 কথায় কথায় অনেকটা সময় কেটে গেল। ইতিমধ্যে বান্দোয়ান ছাড়িয়ে এসেছি। আধঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম মৃগীচামিতে। জলেজঙ্গলে ঘেরা শান্ত একটি গ্রাম। দূরে পাহাড়। গাড়ি পাকা রাস্তা ছেড়ে লাল মাটির রাস্তা ধরল। রাস্তার দু'ধারে জঙ্গল। কিছু দূর যাওয়ার পর কঞ্চির বেড়া দিয়ে ঘেরা বর্ণপরিচয়ের সামনে থামল গাড়ি।-- ইয়ে হি হ্যায় ফাগুন ম্যাডাম কি স্কুল। মেরা নাম সুরিন্দর সিং। ম্যাডাম কো মেরা নমস্তে কহিয়েগা।


 


  আপ ভি আইয়ে সুরিন্দরজী। ফাগুন কো আচ্ছা লাগেগা।


 নেহী সাব। বান্দোয়ান মে জরুরি কাম হ্যায়। ম্যাডাম কে পাশ মেরা নাম্বার হ্যায়। আগর জরুরত পড়ে তো ফোন কর দিজিয়েগা। ম্যায় তুরন্ত আ যাউঙ্গা।


 সুরিন্দর সিং গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। ভালো করে দেখলাম বর্ণপরিচয়কে। টালি দিয়ে ছাওয়া পাশাপাশি তিনটে ঘর। একটি ঘরের চালের ওপর সাইনবোর্ড। তাতে স্কুলের নাম। নীচে লেখা পরিচালনায় বর্ণপরিচয় চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। তিনটে ঘরই ফাঁকা। আজ স্কুল বন্ধ নাকি? কিছুক্ষণ পর চোখে পড়ল আঠারো-উনিশের একটি ঝাড়ু হাতে পিছন দিক থেকে এসে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। আমাকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলল, আজ ইশকুল ছুটি হইয়া গ্যাছেক। কারোর সনে দেখা হবেক লাই।


 আমার বেশ মজা লাগছিল। মেয়েটা স্থানীয় শবরদের মেয়ে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অদ্ভুত সরল মুখ। নকল যে গাম্ভীর্য মেয়েটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে সেটা একটুও মানায়নি। বললাম, ফাগুনকে বলো কলকাতা থেকে অনির্বাণ এসেছে।


 মুহূর্তের মধ্যে গাম্ভীর্য উধাও। হাতের ঝাড়ুটা ফেলে দিয়ে মেয়েটা চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, বড্ড ভুল হইয়া গেছেক গ। দিদি কইছিল বটেক। যান না, যান। পিছাড়ি দিয়া চল্ল্যা যান। দিদি ঘরকে আছেক৷


  তার মানে পিছনে আরও ঘর আছে। সামনে স্কুল বলে চোখে পড়ে না। স্কুলের পিছনে গিয়ে দেখলাম আরও দুটো ঘর। দেখতে একইরকম। তফাৎ শুধু ঘরের সামনে একফালি বারান্দায়, থুড়ি, রকে মেয়েদের জামাকাপড় শুকোচ্ছে। চৌকাঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম ফাগুনকে। তক্তাপোশের ওপর বসে নিবিষ্ট হয়ে খাতায় কী যেন লিখছে। দরজায় কেউ যে দাঁড়িয়ে আছে সে খেয়াল ওর নেই৷ চুরি করে দেখলাম আরও কিছুক্ষণ। ফেসবুকে ফাগুনের অনেক ছবি দেখেছি। জানি ও সুন্দরী। কিন্তু এতটা সুন্দর বুঝতে পারিনি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় কোনও এক নারী চরিত্রের বর্ণনায় তন্বী শ্যামা শিখরদশনা কথাটি পড়েছিলাম। ফাগুনের বেলায় বিশেষণটি একেবারে খাপে খাপে এঁটে যায়। সুন্দরী হওয়ার পাশাপাশি ফাগুন যথেষ্ট গুণীও। মাস কমিউনিকেশনে মাস্টার্স করেছে। চাইলে ও কলকাতায় কোনও খবরের কাগজে ভালো চাকরি করতে পারত। কিন্তু তা না করে এখানে এনজিওর কাজ সামলাচ্ছে। ফাগুনের কথা যত ভাবি ততই মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে


আসে।


 প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর মনে হল ফাগুন খাতা থেকে সহজে চোখ তুলবে না। আমাকেই ওর হুঁশ ফেরাতে হবে। বললাম, আমি এসে গেছি ফাগুন।


 ফাগুন চমকে দরজার দিকে তাকাল। দেখলাম ওর চোখে চক চক করছে বিস্ময় আর আনন্দ।--তুমি এসেছ! অনেকক্ষণ এসেছ নাকি? আমি বুঝতেই পারিনি। ফুলমণিকে বলে রেখেছিলাম তুমি এলে খবর দিতে। এই দেখো, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো না।


 তক্তাপোশেই বসলাম। এই ঘরেই বোধহয় ফাগুন থাকে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আসবাব বেশি নেই। তক্তাপোশ ছাড়া চেয়ার টেবিল আর একটা কাঠের আলমারি। সবকিছু পরিপাটি করে সাজানো।


 আমি ঘর দেখছিলাম। ফাগুন যে আমাকে দেখছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ ও বলল, আমার না বিশ্বাসই হচ্ছে না।


 কী বিশ্বাস হচ্ছে না?


 এই যে তুমি এসেছ। জানতাম আসবে। কিন্তু জানা আর নিজের চোখে দেখায় অনেক তফাৎ। শুধু যদি বাড়ির সকলকে জানিয়ে আসতে তা হলে আরও খুশি হতাম


 সেটা তো অসম্ভব ফাগুন। বাবা-মা থাকলে তাদের বলেই আসতাম। কিন্তু এখন যারা আছেন তারা তো বিশ্বাসই করেন না যে আমি তাদের হাত ছেড়ে কিছু করতে পারি।


 ফাগুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা ওসব কথা এখন থাক। আগে তুমি কোথায় থাকবে বলো। বান্দোয়ানে বাবা-মা'র সঙ্গে থাকতে পারো। ওখানে সব ব্যবস্থা কলকাতার মতো।


 তুমি কোথায় থাকো?


 আমি তো এখানেই থাকি। মাসে একবার-দু'বার বান্দোয়ানে যাই।


 আমি তোমার কাছে থাকব বলে এসেছি। সুতরাং আরাম না হলেও আমার চলবে।


 এখানে কত রকমের অসুবিধে তাই নিয়ে ফাগুন


ছোটখাটো একটা বক্তৃতাই দিয়ে ফেলল। কিন্তু আমি মনস্থির করেই এসেছি। আমার হারাবার কিছু নেই। ভয় পাবার মতনও কিছু ঘটেনি।--ব্যস্ত হয়ো না ফাগুন। আরামে থাকার মোহ থাকলে আমি বালিগঞ্জের বসু পরিবারের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে পালাতাম না। আমি এখানেই, মানে তোমার ভাষায় এই আনকমফোর্টেবল জায়গাটাতেই থাকব। তুমি যদি থাকতে না দাও তা হলে আমি কালই অন্য কোথাও চলে যাব কিন্তু বান্দোয়ানে থাকব না।


 তুমি না খুব জেদি! দেখবে দু'দিন পরেই মন পালাই পালাই করছে। যাক গে, অনেকক্ষণ কিছু খাওনি। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি ফুলমণিকে কিছু বানাতে বলি।


 কিচ্ছু বানাতে হবে না। তুমি এই সময় কী খাও?


 আমার তো মুড়ি নারকেল হলেই চলে যায়।


 আমিও তাই খাব। সঙ্গে চা। ব্যাস।


 ফাগুন হেসে ফেলল, উফ! তোমার সঙ্গে তর্ক করে পেরে উঠব না। তুমি যা চাও তাই হবে। এখন যাও, হাত-মুখ  


ধুয়ে এসো।


 


(ক্রমশ)


 


  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract