Sandip Chakraborty

Abstract Romance Classics

3  

Sandip Chakraborty

Abstract Romance Classics

নীল রংয়ের সাঁকো/১০

নীল রংয়ের সাঁকো/১০

7 mins
234



বুকের ভেতর হঠাৎ জোরে ধাক্কা লাগল। মাথাটা ফাঁকা। মুহূর্তের মধ্যে নেমে এল অন্ধকার। তারপর কীভাবে জানি না আমি পৌঁছে গেলাম একটা হলুদ কালো শহরে। এই শহরের আকাশ হলুদ। কিন্তু বাড়িঘর রাস্তাঘাট সব কালো। মানুষগুলোও কালো। তারা যখন হেঁটে যায় রাস্তা দিয়ে, মনে হয় একদলা অব্ধকার হাঁটছে। বর্ণপরিচয়ের মাটির ঘর থেকে আমি এখানে এসে পৌঁছেছি। ওখানে যখন ছিলাম তখন রোদ্দুর ছিল। এখানে শুধু আবছায়া। এই শহরে আমার কোনও বন্ধু নেই। কার কাছে যাব জানি না। আমি মৃগীচামিতে ফিরতে চাই। ফাগুনের সঙ্গে কথা বলতে চাই। অসহায় লাগছে আমার। বুঝতে পারছি আমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ঠিক সেই আগেকার মতো। কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লে আগে আমি কী করতাম কিছুই আমার মনে পড়ছে না। ওষুধের নামগুলো পর্যন্ত বেমালুম ভুলে গেছি। বারবার শুধু একটা কথাই মনের মধ্যে চরকির মতো পাক খাচ্ছে। আমাকে এই হলুদ কালো গোলকধাঁধা থেকে বেরোতে হবে। নচেৎ আমি বাঁচব না। চিৎকার করে বললাম, আমি এখানকার কেউ নই, বিশ্বাস করুন। এখান থেকে কীভাবে বেরোব প্লিজ কেউ বলে দিন। কিন্তু কেউ কোন সাড়াশব্দ করল না।


সবাই ব্যস্ত। সবাই কোথাও পৌঁছবার জন্য উদগ্রীব। আমি আবার ওই একই কথা বললাম। বলতেই থাকলাম। শেষে হাজার হাজার অন্ধকার মুখ একজায়গায় জড়ো করে তাদের সামনে নতজানু হয়ে মিনতি করলাম, প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব। ওই হলুদ আর কালো রং আমাকে পাগল করে দেবে। আমি আর কোনওদিনই ফিরতে পারব না নিজের কাছে। নিজের কাছে না ফিরতে পারলে আমি নিজেকে পেরিয়ে যাব কী করে?


 কিন্তু এবারও কেউ সাড়া দিল না। বুকের ভেতর থেকে উঠে এল কান্না। শচীজেঠু কান্না ভুলিয়ে দেওয়ার ওষুধ জানে। এখন থাকলে ঠিক সেই ওষুধটা খাইয়ে দিত। আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। মঞ্জুদি থাকলে তো নির্ঘাৎ বলত, বাবা তোমার মনে আছে ছোটবেলায় তুমি মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতে। একবার তো পাঁচশো সীতাভোগ একাই খেয়ে ফেলেছিলে। ডাক্তারবাবু বর্ধমান থেকে আমাদের সকলের জন্য এনেছিলেন, মনে আছে তোমার? আমি এই হলুদ কালো শহর থেকে বললাম, আমি সত্যিই একা খেয়েছিলাম মঞ্জুদি? নাকি তুমি আমাকে ডাইভার্ট করার জন্য বানিয়ে বানিয়ে বলছ?


 

 

 কী হয়েছে তোমার অনি? একা একা কার সঙ্গে কথা

বলছ?


 বুকের ভেতর মাথা তুলতে থাকা পাহাড়টা হঠাৎই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। হলুদ-কালো সেই শহর থেকে লাট খেয়ে আমি একটা ইটের টুকরোর মতো টুপ করে এসে পড়লাম ফাগুনের ঘরে। চোখ তুলে দেখলাম ফাগুন তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। ওর চোখে টেনশন। সুন্দর গড়নের ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। যেন ও কিছু বলতে চায়। ও খুব ভালো কথা বলে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে ও তাকে চাঙ্গা করে দিতে পারে। কলকাতায় যখন অসুস্থ হয়ে পড়তাম--যখন আমার কারও সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হত--তখন ফাগুনকেই ফোন করতাম। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যেত ফাগুন। বিরক্ত হত না। দায়সারা মন্তব্য করে ফোন রেখে দিত না। যতক্ষণ না বলছি, 'আমার মন ভালো হয়ে গেছে ফাগুন'-- ততক্ষণ ও কথা বলতেই থাকত। সেই ফাগুন কি আবার আমার কাছে ফিরে এল?


 কী হল অনি? তোমার কী হয়েছে আমায় বলবে না?


 কী বলতে চেয়েছিলাম মনে করার চেষ্টা করলাম। সহজে মনে পড়ল না। একবার খেই হারালে এরকম হয়।


কিছুক্ষণ ভাবার পর চোখের সামনে ভেসে উঠল চায়ের দোকানটা। অশোক হালদারের মুখ। বললাম, মাওইস্টরা যদি আমার এখানে থাকা নিয়ে আপত্তি করে তা হলে তুমি আমায় এখান থেকে চলে যেতে বলবে, তাই না?


 ফাগুন অবাক হয়ে বলল, মাওইস্ট! হঠাৎ মাওইস্ট কেন?


 চায়ের দোকানে যা হয়েছে আমি সব বললাম। উত্তেজিত হয়ে পড়লে আমার কথা আটকে আটকে যায়। ফাগুন সেটা জানে। সব কথা এক নিঃশ্বাসে উগরে দিয়ে আমি যখন হাঁপাচ্ছি, ফাগুন আমার কাছে এসে পিঠে হাত রাখল, এক্সাইটেড হয়ো না অনি। এর মধ্যে এক্সাইটেড হবার মতো কিছু নেই। এখন বুঝতে পারছি কেন তুমি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। বাট মাই ডিয়ার, ডোন্ট টেক ইট সিরিয়াসলি। লোকটা মিছিমিছি তোমাকে ভয় দেখিয়েছে।


 মিছিমিছি ভয় দেখিয়েছে মানে? আমি তো ওকে চিনিই না।


 শোনো অনি, লোকটা কেন এই কথা বলেছে আমি জানি না। কারণ রিয়ালিটির সঙ্গে ওর কথার কোনও মিল নেই।


আমি বর্ণপরিচয়ের দায়িত্ব নিয়েছি তিন বছর হয়ে গেল। আমার আগে বাবা দেখত। তাও ধরো আরও তিন বছর। আমরা তো এখানকার লোক নই। কাজের সুবিধার জন্য বাবা বান্দোয়ানে একটা বাড়ি করেছে ঠিকই কিন্তু বেসিকালি তো আমরা কলকাতার লোক। অথচ এই ছ'বছরে কোনও মাওইস্ট লিডার আমাদের এসে বলেনি যে তোমরা আউটসাইডার। সুতরাং তোমরা এখানে কাজ করতে পারবে না। আর কেনই-বা বলবে! বর্ণপরিচয় একটা নন-পলিটিকাল অর্গানাইজেশন। আফটার অল, ওরাও ট্রাইবালদের উন্নতি চায়, আমরাও চাই। তা হলে বিরোধটা কোথায়?


 মনে হল এ যাত্রা বেঁচে গেলাম। ফাগুনের কথায় যুক্তি আছে। যতদূর জানি মাওইস্টরা আমার মতো নন-পলিটিকাল লোকেদের বিরক্ত করে না। ওদের লড়াইটা রাজনৈতিক। ঘুরেফিরে সেই একই ক্ষমতা দখলের লড়াই। হাতে ক্ষমতা না আসা পর্যন্ত ওদের অ্যাজেন্ডার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এসব আমার খবরের কাগজ পড়া বিদ্যে। প্রকৃত বাস্তব এরকমই কিনা আমার জানা নেই। আপাতত সংকট কেটে গেলেও একটা সংশয় কিছুতেই আমাকে ছাড়ছে না। বললাম, তোমার যুক্তি মানছি ফাগুন। তোমার কাজে ওরা কোনওদিন বাধা দেয়নি। কিন্তু কিছুই না করে আমি যদি এখানে চুপচাপ বসে থাকি


তা হলে তো ওরা আমাকে সন্দেহ করতে পারে। ওরা মনে করতে পারে আমি পুলিশের লোক। তোমার মাধ্যমে এখানকার খবর কালেক্ট করে আমি কলকাতায় পাঠাচ্ছি। অ্যাম আই টকিং এনিথিং রাবিশ?


 ফাগুন চুপ করে রইল। সম্ভবত ও কিছু ভাবছে। এখানে আসার আগে মাওইস্টদের কথা আমার মাথায় একবারও আসেনি। তার মানে এই নয় যে আমি ভয় পেয়েছি। না, ভয় আমার একটুও করছে না। জীবনে অনেক অন্ধকার দেখলেও আমার একটা বিশ্বাস সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায়নি। আমি যদি কারোর ক্ষতি না করি তা হলে কেউ কেন আমার ক্ষতি করবে? মানুষকে আমি সহজে অবিশ্বাস করতে পারি না। নয়নাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু সে আমার বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করি, নয়নার জায়গায় আমি থাকলে কী করতাম? মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত একটা ছেলেকে আমি কি ভরসা করতে পারতাম? আমার কি মনে হত না যে ভুল করছি? এই ভুল সংশোধন করতে চাইলে হয়তো অনি খুব কষ্ট পাবে কিন্তু ওকে কষ্ট দিতে পারব না ভেবে যদি ভুলটা আজ মেনে নিই তা হলে একদিন দুটো জীবন নষ্ট হবে। সেই নির্মম আত্মগ্লানির জন্য দায়ী হব একমাত্র আমি।


  এসব কথা যখব ভাবি তখন নয়নাকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করে। এভাবে ভাবতে ভাবতেই একদিন ওকে হয়তো ক্ষমা করে দেব।


 ফুলমণি চা আর খাবার দিয়ে গেল। ফাগুন আমার প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল, কথাটা তুমি ভুল বলোনি অনি। ক'দিন ধরে আমিও এই কথাটাই ভাবছি। তবে সেটা মাওইস্টদের ভয়ে নয়। আমার বন্ধু এখানে কতদিন থাকবে সেটা ওদের দেখার বিষয় নয়। আমি কথাটা ভেবেছি অন্য কারণে। তুমি তো এখানে বেড়াতে আসোনি। জীবন শুরু করতে এসেছ। অন্তত আমার তাই মনে হয়। জীবন শুরু করতে হলে একটা অবলম্বন চাই। কিন্তু তোমার যা হাইফাই পড়াশোনা তাতে এখানকার কোন কাজ তোমার পছন্দ হবে সেই চিন্তাতেই আমি অস্থির।


 টুংলির কথা মনে পড়ে গেল। ও আমাকে পড়ানোর কথা বলেছিল। বললাম, আমি যদি বাচ্চাদের পড়াই?


 ফাগুন হাসল, বাচ্চাদের পড়াতে গেলে অনেক ধৈর্য লাগে। বিশেষ করে বর্ণপরিচয়ের বাচ্চারা সবাই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার। ওদের পড়ানো অত সহজ নয়।


 আমি পড়ালে টুংলিরা খুব খুশি হত।


 ও তোমাকে পড়ানোর কথা বলেছে বুঝি? এখানে অল্পবয়েসি কেউ এলেই ও তাকে পড়ানোর কথা বলে। আমাদের তিনজন টিচার আছেন। তাদের মধ্যে ওদের ক্লাস নেন শশাঙ্কবাবু। ভদ্রলোকের বয়েস হয়েছে। বুড়ো মাস্টার টুংলির পছন্দ নয়। কিন্তু সেটা তো কাজের কথা নয়। টুংলির কথা শুনে তুমি যদি পড়াতে শুরু করো তা হলে তোমার প্রতিভার মিসইউজ হবে।


 আমার আবার প্রতিভা! একটা ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি ছাড়া কী আছে আমার? তাতে তো আর কারও ডানা গজায় না।


 না অনি। আই উওন্ট এগ্রি। পড়ানো তোমার কাজ নয়। একটা কাজের কথা বলতে পারি। আমার মনে হয় সেটা তুমি আমার থেকেও ভালো করবে।


 অবাক হলাম। জন্মাবধি আমার ওপর এতটা ভরসা কেউ কোনওদিন করেনি। আমি ভালো ছেলে। ভালো ছাত্র। কিন্তু যখনই আমাকে কোনও কাজের দায়িত্ব দেওয়ার কথা উঠত তখন সবার চোখে একটা প্রশ্নই চিরকাল ফুটতে দেখেছি, ও কি পারবে? আমি যতই  


বোঝাই না কেন, পারব-- কেউ বিশ্বাস করত না। এই প্রথম কেউ তার নিজের থেকেও আমাকে বেশি ভরসা করছে। একটা অদ্ভুত আনন্দে ভরে যাচ্ছে আমার মন। বাড়ি থেকে পালিয়ে এখানে আসা আমার ভুল হয়নি। বললাম, আমার জন্য কী কাজ ভেবেছ খুব জানতে ইচ্ছে করছে ফাগুন।


 তুমি তো জানো এখানে ড্রিংকিং ওয়াটারের সমস্যা মারাত্মক। আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু সময় দিতে পারি না বলে প্রোজেক্টটা ঠিকমতো এগোচ্ছে না। তুমি যদি দায়িত্ব নাও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি।


 মনে হল আমি বোধহয় এই মুহূর্তে হাত বাড়ালেই আকাশ ছুঁয়ে ফেলব। এত বড়ো দায়িত্ব আমি পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। কৃতজ্ঞতায় ডুবে গেলাম। বললাম, আমার ওপর তোমার বিশ্বাস দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি ফাগুন। কিন্তু তুমি কি সত্যিই মনে করো আমি এ কাজের উপযুক্ত?


 হ্যাঁ অনি, আমি তাই মনে করি। একটা অরগানাইজেশন চালাবার যোগ্যতা আমার থেকে তোমার অনেক বেশি। তোমার বুদ্ধি আছে, পরিশ্রম করার ক্ষমতা আছে, কোয়ালিফিকেশন আছে--এমনকী এখানকার গরিব মানুষগুলোর ভালো করার মতো হৃদয়ও আছে। শুধু


একটা জায়গায় আমি এগিয়ে। মানুষ চেনার ক্ষমতায়। আজ অবধি মানুষ চিনতে আমার ভুল হয়নি। এবারও হবে না। আমি জানি তুমি পারবে।


 কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম ফাগুনের দিকে। এই জোর ও কোথা থেকে পাচ্ছে আমি জানি না। একটা ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রির কি এই অসীম ক্ষমতা আছে? মনে হয় না। এ বোধহয় অন্তরের জোর। ভালোবাসার জোর। ফাগুনের ভালোবাসা বলছে, অনি তুমি পারবে।


 তাই আমাকে পারতেই হবে।


(ক্রমশ)


 


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract