আত্মার স্তরীয় বিচরণ
আত্মার স্তরীয় বিচরণ
"এই আকাশ, কিরে? কী এতো মন দিয়ে পড়ছিস?"
"দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা কেস।"
"কী রে?"
"তুই নিচে নেমে আয়, বলছি। এতো তাড়াতাড়ি ঘুম আসছে তোর?"
আকাশের কথায় চলন্ত দূরপাল্লার ট্রেনের উপরের বার্থ থেকে তড়াক করে নিচে নেমে এলো কলেজ বন্ধু বিশ্ব। ট্রেনে সবাই লাইট অফ করে শুয়ে পড়াতে, বাধ্য হয়েই সাইড আপারে উঠে গিয়েছিল সে। তার উপর পাশের সিটের এক আঙ্কেল আলো জ্বাললেই একটু খিটখিট করছিলেন। পাছে ওদের কথায় বিরক্ত হন উনি, তাই শুয়ে পরার চেষ্টা করা। কিন্তু ঘুমের দেখা এই বয়সের হাফ নিশাচরদের চোখে সচরাচর এসময়ে আসেনা। তখন বিশ্ব নিচে নেমে আসাতে পা গুটিয়ে বসে ধীরে ধীরে গল্প শুরু করল দুই বন্ধুতে মিলে। আকাশ বলল,
"নিউজে এসেছে, ইউ পিতে একজন বয়স্ক লোক নাকি মারা যাওয়ার পর আবার বেঁচে উঠেছেন আর ওনার এই মৃত্যু ও পুনরায় ফিরে আসার মাঝের কয়েক সেকেন্ডের অভিজ্ঞতাও বলেছেন তিনি।"
"বলিস কি? কী বলেছেন বল?"
বিশ্বের চোখ উৎসাহে জ্বলজ্বল করে উঠল অন্ধকারেও।
"বলেছেন উনি নাকি যমদূতকে দেখেছেন। কেমন একটা উড়ন্ত পরীর মতো। উনি তখন সূক্ষ্মাকারে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছিলেন। আর নিজের স্থূলদেহটাকেও দেখছিলেন হাত বাড়িয়ে ওর সাথে সংযোগ স্থাপন করার অভিপ্রায়ে হাহুতাশ করছে। কিন্তু কি একটা ভুলে যেন, টাইম মিস ম্যাচড হয়ে গিয়েছিল। তাই আবার ফিরতে হল ওকে ... আবার সেই স্থূলদেহে।"
"সে আবার হয় নাকি?"
"হতেই পারে। আমার কী মনে হয় জানিস তো, এটা একটা রিমোট কন্ট্রোলড সিস্টেম। আর উপরের কন্ট্রোলারের হাতে বোতাম প্রেস হলে, এখানের দেহ মধ্যস্থ আত্মা এক্সিট সিগনালিং এ সাড়া দেয়। আর তাতেই দুই জগতের যোগসূত্র স্থাপন হয়ে দেহের মৃত্যু হয়। তারপর শরীর থেকে আত্মাটা বেরিয়ে যায়। ওই মানুষটার ক্ষেত্রে দুতরফের মধ্যস্থ সময়ের কোনো মিসম্যাচিং হয়ে গিয়েছিল বোধ হয়।"
বিশ্ব খুব মন দিয়ে ব্যাপারটা শুনে ভাবলো কিছুক্ষণ। এই একটা বিষয়, যা নিয়ে ওরা সময় হলেই বিস্তর আলোচনায় বসে পড়ে। তারপর হঠাৎ বিশ্ব বলল, "আচ্ছা, তুই প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করিস?"
"আরে আমার খুড়তুতো দাদারা তো তিনজন মিলে করেছিল"!
"তাই নাকি? কার?"
"মিতুদির। ওর প্রিয় দিদির।"
"এসেছিল?"
"না"!
"তার মানে, বোগাস এসব?"
"না, তা নয়। ব্যাপারটার উপর এতো সহজে মন্তব্য করাটা ঠিক নয়। এর অনেক গভীরতা আছে।"
"যেমন?"
"যেমন এই যে আমাদের দেহ পৃথিবীর প্রতি মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেন্দ্রিক আকর্ষিত হয়। আত্মার ক্ষেত্রেও কতকটা সেরকমই কনসেপ্ট আছে।"
"মানে? একটু ভেঙে বল।"
"মানে ধর, আমরা যখন বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস পড়ি, তাতে বিবিধ স্তর থাকে তো ... যেমন ট্রোপোস্ফিয়ার, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার, আয়োনোস্ফিয়ার, এক্সোস্ফিয়ার, ম্যাগনেটোস্ফিয়ার। তেমনি আত্মাকেও দেহ হতে মুক্তির পরবর্তী সময়ে বিবিধ স্তর ভেদ করে দেহ ও দেহকেন্দ্রিক মায়ার জগৎ হতে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হতে হয়। তবে সেই স্থানান্তরকরণ সেই আত্মাটির ষড়রিপুজনিত কারণে বা অতৃপ্তিজনিত কারণেও বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। আরও খুলে বলতে গেলে বলব, প্রতিটি জীবের জীবিতকালীন অবস্থায় দেহের সমস্ত কোষকে সচল রাখে যে শক্তি, তার সমষ্টি কখনোই এক মূহূর্তে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে না। কারণ শক্তির কোনো বিনাশ হয় না। শক্তি কেবলমাত্র এক রূপ হতে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয় মাত্র। সেই অনুযায়ী, যখন কারুর মৃত্যু হয়, তখন তার অন্তরস্থ সেই সমষ্টিগত শক্তি অদৃশ্য আত্মারূপে দেহের বাইরের প্রথম স্তরে বেরিয়ে ভ্রাম্যমাণ থাকে। যদি বায়ুমণ্ডলের ট্রোপোস্ফিয়ারের সমতুল বলে ধরে নিই সেই প্রথম স্তরকে, তাহলে বলব, সেই আত্মা তখন নিজ মৃতদেহের চতুর্দিক কেন্দ্রিক কান্নাকাটি, শোক, তাপ, মায়াজনিত বেড়িকে স্পষ্ট অনুভব করতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সে মায়ার মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে উপরের স্তরে উন্নীত হয়। এই স্তরটিকে যদি, স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের অনুরূপ ধরি, তো এখানে মায়াজাত ঝড়ঝাপটা কম। এই দুটি নিচের স্তরে থাকাকালীন অবস্থায় যদি কেউ বিশেষ পদ্ধতিতে সেই আত্মাকে অন্তর দিয়ে ডাকে, মানে প্ল্যানচেট করে, তো সে সাড়া দিতেও পারে। কারণ তখনও তার কর্মের আয়নিক বিশ্লেষণ শুরু হয়না।"
"আয়নিক বিশ্লেষণ মানে?" বিশ্ব বিস্মিত প্রশ্ন করে।
শান্ত স্বরে আকাশ উত্তর দেয়, "বলছি"। বলে শুরু করে,
"আগে তার পূর্বের ব্যাপারটা সম্বন্ধে আরো কিছু বলি। এই যে স্তরে থাকাকালীন অবস্থা, সেটা শুধু একজনের নয়। সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার জনের হয়। কিন্তু যাকে প্ল্যানচেটকারীরা ডাকবে তার হয়তো সেই মূহূর্তে স্তর পরিবর্তন হচ্ছে, আর সে সেই বার্তা পেয়েও তখন পেছনে ফিরতে ইচ্ছুক নয়। তখন সেই বার্তা অন্য কাউকে, মানে অন্য কোনো আত্মাকে পাঠিয়ে দিলেই মুশকিল। তবে ভুলবশত সে গিয়েও সেখানে হাজির হতে পারে। তাতে অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। অথবা এমনও হতে পারে যে, যেই ব্যক্তিকে ডাকছে সেও সেই মায়ার পথে গিয়ে ফিরে নিজ একাকীত্ব কাটাতে কাউকে কাছে টানার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে। অনেককিছুই হতে পারে। মন বড্ড জটিল বিষয়। তা, জীবিত হোক বা মৃত। আর এটি হল প্রাণ ও প্রাণহীন অবস্থার মধ্যবর্তী মনস্তত্ত্ব কেন্দ্রিক ব্যাপার। তাই প্ল্যানচেট খুবই জটিল বিষয়। তবে হ্যাঁ, এই দুটি স্তরের পরবর্তী স্তরে একবার আত্মা উন্নীত হয়ে গেলে, সে আর প্ল্যানচেটে সাড়া দেয় না। কারণ এই স্তরে তার সদ্য ছেড়ে আসা জীবনের মায়াখানি, মনের টানের চেয়ে স্মৃতির অভ্যাসগত বিচরণে বেশি থেকে যায়। আর বায়ুমন্ডলের আয়োনোস্ফিয়ারের মতো এই স্তরে সেই আত্মার সারা জীবনের সকল কর্মের পজিটিভ ও নেগেটিভ আয়নগত বিচার হয়। সেই অনুযায়ী প্রত্যেকের একটি আয়নিক নাম্বার আসে। আর সেই নাম্বারটিই ম্যাগনেটোস্ফিয়ারের মতো অন্তিম স্তরে যোগসূত্র স্থাপন করে পরবর্তী স্থানকেন্দ্রিক জন্মের অবস্থানের সাথে। আর সেই অবস্থানের সাথে আয়ন ভিত্তিক আত্মার চৌম্বকীয় টানে এক শক্তির অন্য শক্তিতে রূপান্তরকরণ ঘটে। অর্থাৎ কিনা আত্মা আরেক নতুন দেহ পায়। এসব আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ যদিও ...।"
আকাশের কথাগুলো হাঁ করে গিলতে থাকা বিশ্ব এবার সম্বিত ফিরে বলল "তাহলে ওই ব্যক্তি আবার ফিরে এলো কিকরে বলতো? মানে কোন স্তর থেকে?"
"সঠিক বলতে পারবো না, তবে মনে হয় যেই স্তর হতে আত্মা প্ল্যানচেটে সাড়া দেয়, সেই স্তর হতে ফিরে এসেছে। কারণ, তারপরের স্তরে তো কর্মের বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায়। কোনোকিছুর বিশ্লেষণ তখনই হয়, যখন সেদিকের আর পরিবর্তন সাধনের প্রসঙ্গ থাকে না।"
দুজনের কথোপকথনকে চুরচুর করে ঠিক তখনই ট্রেনের প্রচণ্ড দুটো ঝাঁকুনিতে হঠাৎ নড়ে উঠল সব। মূহূর্তে বিশ্ব অনুভব করল চারদিকে এক বায়ুময় স্তর। ভীষণ হাল্কা লাগছে তখন তার নিজেকে। অনাথ হওয়ায় সে কাউকে তেমন মনে করতে পারছে না। কিন্তু আকাশকে বড্ড মনে পড়ছে তার। তখন জোর করে চোখ খুলতেই দেখলো আকাশ ওর কিছুটা পাশেই অচৈতন্য হয়ে শুয়ে আছে। চারপাশে আরো কিছু লোক কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। বড্ড অন্ধকার চারদিকে। দূরে কয়েকজনকে সোরগোল করে হ্যারিকেন নিয়ে এদিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। ওদের আলোতে ট্রেনটার অস্পষ্ট দুমড়ানো চেহারাটা দেখে আঁতকে উঠল বিশ্ব। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল শরীরটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে আছে একটা লোহার রডের টুকরোতে। তার কাঁপা কাঁপা অস্তিত্বটা আকাশের নাকের কাছে গিয়ে অনুভব করল, মৃদু বায়ু বইছে সেখানে। এবার শুধু আরেকবার দেখা হওয়ার জন্য এই স্তরে আরো কিছুদিন প্রতীক্ষা করবে বিশ্ব। বন্ধুটা যদি সুস্থ হয়ে উঠে প্ল্যানচেট করে ... যদি বিশ্ব তার অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে আকাশের অসীম চিন্তা জগতে একবার প্রবেশ করতে পারে। তখনই বিশ্বর খেয়াল হল, ওর কাছেধারের বাতাসে কেমন যেন ডানাওয়ালা একটা প্রাণীর মতো অস্তিত্ব ঘুরছে। ঠিক যেন একটা স্বপ্নজগতের পরী।
ঠিক সেসময়, কে যেন পাশ থেকে উপরে পরীটার দিকে দ্রুত চলে যেতে যেতে বলে গেল "এসো হে ছোকরা"। গলাটা যেন চেনা লাগল বিশ্বের। হ্যাঁ মনে পরেছে, ওই খিটখিটে আঙ্কেলের গলাটা না!
(সমাপ্ত)