Sheli Bhattacherjee

Drama Action

1.5  

Sheli Bhattacherjee

Drama Action

উলুখাগড়ার দল

উলুখাগড়ার দল

6 mins
1.4K



হাওড়া স্টেশনে পিলপিল করে বয়ে চলা পিপড়ের স্রোতের মতো অবিশ্রান্ত জনস্রোত দেখে কাকানের হাতটা আরেকটু ভরসার জন্য সজোরে ধরে থাকে ছোট্ট নয় বছরের পিকলু। আর মাঝেমধ্যেই কাকানের মুখের দিকে চেয়ে নীরবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, এ কোন জায়গা কাকান? আমাদের গ্রামের হাটেওতো এতো লোকের ভিড় হয় না। এমনকি বটতলার চাটুজ্জেদের দূর্গামন্ডপে খিচুড়ি দেওয়ার লাইনেও এতো লোক থাকে না। তবে এ কোন জায়গা? এতো লোক কি এখানে আনন্দ পেতে আসে নাকি খেতে আসে? এ শহর এতো জনকে খাবার দেয়?


গ্রামে মেলা হলে বা চাটুজ্জে বাড়ুজ্জ্যেরা খাবার বিলোলেই একমাত্র পিকলু লোকের ভিড় দেখে। নেংটি পড়া বাচ্চা থেকে গোঁফে তা দেওয়া গ্রামের বামুনগুলোও গাদাগাদি করে সেখানে সেদিন। কাকান পিকলুকে বলেছিল একবার 'পেটের টান আর মনের টান বড় দায় রে। আনন্দ করতে যেমন লোক মেলায় জোটে তেমনি পেট ভরতেও লাইন লাগায়।'

তাই পিকলুর সরল স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগছে এখন, এখানে কিসের টানে এতো লোক এসেছে?


"নিবারণ, তোমার নাম নিবারণ তো?" হঠাৎই পিকলুর হাওয়াই চটি পড়া রুক্ষ পাদুটো থমকে দাঁড়ায় কাকানের সাথে। কাকানকে উদ্দেশ্য করে সামনে দাঁড়ানো পরিপাটি চেহারার অল্পবয়সী লোকটা ওদের পরিচয় জানতে চাইছে। নাকি আগে থেকেই জানত কাকানকে? কাকানতো এর আগেও কবার এসেছিল এখানে। তাই বোধ হয় কাকানের নাম ধরে ডাকল। কথাগুলো খেলতে থাকে পিকলুর মাথায়।


"আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই নিবারণ মন্ডল।" একগাল আকর্ণবিস্তৃত হাসির সাথে উত্তর দেয় নিবারণ। অত:পর লোকটার চোখ পিকলুর দিকে গেলে তার ভ্রুযুগলে জিজ্ঞাসাভিত্তিক ঈষৎ ভাঁজ পড়ে। 

তার প্রশ্ন করার পূর্বেই নিবারণ ইতস্তত করে বলে "ও আমার দাদার ছেলে। আমার বাঁহাতটাতে চোট লাগার পর, আমি রঙতুলি একা হাতে সামলাতে পারি না তেমন। তাই ও হাতে হাতে যোগাড় দেয়। বড্ড করিৎকর্মা ছেলে দাদা। আঁকার হাতও ভালো। এই বয়সেই এতো ভালো ... " নিবারণের কথাটাকে একরকম মাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠল লোকটা

"ঠিক আছে, ঠিক আছে। চলো তোমাদের দাদার আস্থানায় পৌঁছে দিয়ে আমায় আবার অন্য কাজে বেরতে হবে। আর এখন হয়তো রঙতুলি না ধরলেও হবে।"

নিবারণ কথা থামিয়ে অবনত মস্তকে বশ্যতা স্বীকার করার মতো আনুগত্য দেখায়। আর পিকলুর হাত ধরে চলতে থাকে লোকটার পিছু পিছু। এই স্টেশন চত্বর থেকে বেরতোই যে কতজনের সাথে ধাক্কাধাক্কি হয় পিকলুর, তা গুণে বলার নয়।

লোকটা পথে যেতে যেতে নিবারণকে বোঝাতে থাকে "এবার আর ভোটের আগে যেমন এই চাই ওই চাই করে লিখতে, তেমন নয়। একটু অন্যরকমভাবে ছড়া লিখতে হবে। তোমার ছড়া এবার দেওয়ালে নয়, বড় পোস্টারে সাটানো হবে। কাল রেজাল্ট বেরোবে। এক্সিটপোল বলছে, দাদা জিতবে। তাই বিকালেই সভা বসবে। খবর আছে, বিরোধী পার্টির হাওয়ার মধ্যে দাদাই একমাত্র জিতবে এখানে। তোমার সাথে হরেন দা আগে অনেক কাজ করেছে শুনেছিলাম। তাইতো এবার ভোটের আগেও হরেনদাকে দিয়ে অনেক ছড়া লিখিয়ে নিয়েছিলাম তোমায় দিয়ে। আসলে গ্রামের মাটি থেকে আমাদের দাদাও একদিন উঠে এসেছিল। সেইদিনের আদর্শবোধ, শিক্ষা নিয়ে এই শহরের বুকে এখনো লড়ছে দাদা। অনেকগুলো নির্বাচন লাগল দাদার এই গ্রাম্য পার্টিকে শহরের মানুষের কাছে গিয়ে বোঝাতে। তোমাদের গ্রামে হরেনদারা যত সহজে জিততে পারে, এখানে তা নয়। দেখেই তো বুঝতে পারছো, কত শিক্ষিত লোকের ভিড় এখানে। তাদের যুক্তিতর্ক দিয়ে সব বোঝাতে হয়। তাই, তোমার ছড়াগুলো দিয়ে দেওয়াল লেখা হয়েছিল, ছেপে লিফলেট বিলি হয়েছিল। 

এখানের কেউ আমাদের মতো ছোটো দলের হয়ে কাজ করতে চায় না। শহুরে লোক ঠাটবাটের দলের চ্যালা হয়ে ঘোরে। তেলা মাথায় তেল দেয়। তাছাড়া সবাই তো দাদাকে এখানে গ্রাম্য কবি হিসাবে চিনেই ... যাইহোক, আমি যাই এখন।" নিজের কথার স্রোতে নিজেই বাঁধ দিল লোকটা। নিবারণ সবকথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। কিছু বুঝছিল, কিছু বুঝছিল না। 

"কাল দাদার সভার জন্য কটা ছড়া লাগবে। হয়তো সাংবাদিকদের কথার মারপ্যাঁচে তখনই দরকার হতে পারে, তাজা তাজা ছড়া বা একটু বড় কবিতা।

তোমার হাতের গ্রাম্য ভাষা দাদার মুখে গ্রামের মানুষের পরিচয় দেয়।"

নিবারণ এবার কিছুটা বুঝল ওর এই জরুরি তলবের প্রয়োজন। আর ঘাড় নেড়ে বলল "আমি আমার তরফ থেকে চেষ্টা করব দাদা।"


লোকটা পার্টির দাদার তিনতলা বাড়ির পেছনের দিকের একটা ছোট্ট গুদামের মতো ঘরে নিবারণ আর পিকলুকে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রস্থান করে। যাওয়ার আগে নিবারণকে বুঝিয়ে দিয়ে যায় ছড়ার রসদগুলোকে। কাল রেজাল্ট। সবার চোখেমুখে কেমন একটা উশখুশ করা অবস্থা। ঠিক যেমন নিবারণের প্রথম আর শেষ বোর্ডের পরীক্ষা মাধ্যমিকের রেজাল্টের দিন হয়েছিল। 


সারারাতের অপেক্ষার পরও নিবারণদের সাথে দেখা হয় না তথাকথিত পার্টির দাদার। তবে রাতের খাবারে বেশ গরম গরম মাছের ঝোল জোটে। সাথে কড়কড়ে বেগুনি, আর সোনা মুগ ডাল। পিকলুটাতো চেটেপুটে সাবাড় করেছিল সবটা।


পরেরদিন সকাল থেকে বাড়িতে লোকের আসা-যাওয়া চলতে থাকে। কারো হাতে আবির তো, কারো হাতে মিষ্টির প্যাকেট। নিবারণ বুঝতে পারে পার্টির দাদা জিতছে। আর জিতলেই, লোকটা বলেছে নিবারণের একটা ব্যবস্থা করে দেবে এ শহরে। থাকা খাওয়া ফ্রি। সাথে মাসে মাসে টাকা পাবে। সে টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দিলে, পিকলুটাকে দাদা আরও পড়াতে পারবে। ভাবতেই ভবিষ্যতের দিনগুলোকে উজ্জ্বল দেখায় নিবারণের আগাম দৃষ্টিতে। পিকলু জিজ্ঞেস করে কাকানকে "ওরা কি পাস করে গেছে কাকান?"

"এখনও পুরোটা জানা যায়নি বোধ হয়। নইলে আবির খেলা হত।"

কাকানের উত্তরে অবাক হয়ে তাকায় পিকলু "সে আবার কি? আমাদের রেজাল্ট তো একবারেই বেরিয়ে যায়। আধখানা জানা যায় নাকি, যে পুরোটা পরে বেরোবে বলছ?"

পিকলুর কথায় হেসে ফেলে নিবারণ। আর ওর মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বলে "ধূর বোকা, একি স্কুলের পরীক্ষা নাকি? এ হল গিয়ে রাজা হওয়ার পরীক্ষা। দেশের এতো প্রজা ভোট দিয়েছে, তার সব গোনাগুনতি হবে। অনেক সময় লাগবে।"


"নিবারণ, ছড়াগুলো দাও তো।" এমন সময় ত্রস্থ পদে ঢোকে কালকের লোকটা। বলতে থাকে "ব্যানার করতে হবে। দাদা জিতবে। আপাতত ট্রেন্ডতো তাই বলছে।"

নিবারণ লোকটার শেষ কথার খেই ধরতে পারে না। শুধু রাতে বসে লেখা ছড়াগুলোকে লোকটার হাতে তুলে দেয়। 


বিকালের দিকে বাড়ির সামনের চওড়া পাকা উঠোনে কিছু লোক আবির নিয়ে এ ওর মুখে লেপতে থাকে হাসিমুখে। কোলাকুলি করতে থাকে। ভোট উঠসবের শেষে বিজয়া চলছে যেন। নিবারণ আনমনে তৃপ্তিতে পিকলুকে বলে "আমার একটা হিল্লে হয়ে গেল বোধ হয়।"


অত:পর সভার জন্য স্টেজ তৈরি হতে থাকে। স্টেজের পেছন জুড়ে বড় পোস্টারে টাঙানো হয় পার্টির দাদার ছবি। নিচের দিকে ডাইনে বাঁয়ে লেখা থাকে নিবারণের লেখা ছড়া। নিবারণ এই প্রথম দর্শন করে তার প্রভু তথা রাজাকে। আর সেই সাথেই নিজের কবি হওয়ার স্বপ্নগুলোকে বড় বড় অক্ষরে জ্বলজ্বল করতে দেখে রঙিন পোস্টারের নিচের দিকে। শুধু কবির নাম নেই সেখানে। তবুও মনটা আশা আর তৃপ্তির আলোয় ঝকঝক করে ওঠে। পিকলু বলে ওঠে 

"ও কি রাজা নাকি কাকান?"


"হ্যাঁ রে। ওঁই রাজা।" নিবারণ যেন কল্পনায় রামের মতো মুকুট দেখতে পায় সেই পার্টির রাজার মাথায়। ওর মনে হয় যেন তার রাজ্যাভিষেক হবার আয়োজন চলছে।


"আর আমরা কি প্রজা?"


পিকলুর প্রশ্নটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে একটা বিকট শব্দে ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ঝাপসা হয়ে যায় সামনের স্টেজটা। মুহূর্তে সবাই হইহই করে আতঙ্কে বলতে থাকে 'পালাও, পালাও।' পিকলু ভীষণ ভয়ে কাকানের হাত আঁকড়ে ধরে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় নিবারণ সেই ধোঁয়াশার চাদর পেরিয়ে দেখে, কিছু লোক পার্টির দাদাকে নিরাপদে স্টেজ থেকে নামিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কে একজন ওদেরকেও ঠেলে বলে গেল যেন 'পালাও, পালাও। অপনেন্ট পার্টি বোম ছুঁড়েছে, পালাও।'


নিবারণের কেমন যেন অদ্ভুত লাগে এ ভেবে যে, শহরে গ্রামে সব নিয়মকানুনই কম বেশি এক। শুধু ওখানের ভয় দেখানো রাজার সিপাইদের রক্তচক্ষুগুলো এখানে হাতে বোম তুলে নিয়েছে। ভয়ে পিকলুকে পাঁজা করে কোলে তুলে নেয় নিবারণ। আর বাকিদের অনুসরণ করে দৌড়াতে থাকে নিরাপদ দিকে। এমন সময় দেখে স্টেজের একপাশে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে কালকের লোকটা। কাঁপতে কাঁপতে ঈষৎ নড়াচড়া করছে ওর ধূলিকণাময় শরীরটা। আজ বা কাল নাম জানা হয় নি লোকটার। তাই নিবারণ একে ওকে ঠেলে বলতে থাকে "ওকে বাঁচাও, ও নড়ছে এখনো। প্রাণ আছে।"


পার্টির দাদাও একবার নিবারণের চিৎকারে পেছন ফিরে দেখল তখন। তারপর এক মুহূর্ত সেখানে না দাঁড়িয়ে ফিরে গেল নিজের পথে। নিবারণের এক ঝলক সে রাজার দিকে চেয়ে মনে হল তখন, মুকুটবিহীন দশানন যেন। 

লঙ্কাপুরীর মতো এদিকওদিক জুড়ে পোড়া আতঙ্কিত স্থান ত্যাগ করে সবাই তখন রাজার পিছু পিছু ছুটে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। কারো এতো সময় নেই এখানে, নিজের প্রানের নিরাপত্তার বাইরে কিছু ভাববে। এমনকি ফিরে তাকানোর জন্য সময়টুকুও নেই। 

অত:পর নিবারণ কিভেবে লোকটার দিকে কয়েক পা এগোতে গেলেই, আবার সেই কানফাটানো আওয়াজ হেসে এলো। তবে এবার স্টেজ হতে একটু দূরে। পিকলু চিৎকার করে কেঁদে উঠল এবার। তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়না সেখানে নিবারণ। পিকলুর দায়িত্ব রয়েছে ওর সাথে। শুধু একবার কালো হয়ে যাওয়া ছেঁড়াখোড়া পোস্টারটার দিকে চেয়ে দেখে নিবারণ। ওর মনে হয় যেন সেখানে লেখা আছে ... 


'রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়,

উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।'


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama