গোল্ড ফিশ
গোল্ড ফিশ
(১)
ঘেমে নেয়ে রীতিমতো ছুটতে ছুটতে কফি হাউসের মোড়টা ঘুরল সমৃদ্ধি। তখনই চোখে পড়ল চিরন্তনকে। সাদা শার্টের সাথে ফেডেড ব্লু জিন্সে নিজের ছয় বছরের পুরানো বয়ফ্রেন্ডকে দেখে সমৃদ্ধির প্রেমটা যেন হঠাৎ করেই ছটফটিয়ে উঠল। ঠিক যেন শীতের রুক্ষ শুষ্কতার পর বসন্তের পলাশ রাঙা আমেজ ছড়াল ওর হৃদয় জুড়ে। তার উপর, এরই মাঝে দুজনের মধ্যে চার মাসের বিরতি ছিল। সবমিলিয়ে ওর মন বলছিল, ডুবে যাই ওই বুকের ভালোবাসার ঘ্রাণে।
"এই সময় হল তোর?" আদুরে গলায় ঝাঁঝিয়ে উঠল চিরন্তন।
"আগে আমায় তো দেখ ঠিক করে, তবে তো কারণটা বুঝবি" হেয়ালি করে উত্তর দিল সমৃদ্ধি। ওর ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমিষ্টি হাসি পেরিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসল গজদাঁতের সৌন্দর্য। তাতে মোমের মতো গলে যেতে দেরি হয় না চিরন্তনের। তবু নিজের মিথ্যে রাগটাকে আগলে রেখে বলল "নতুন করে কী আর দেখব? শুধু একটু মুটিয়ে গেছিস বলে মনে হচ্ছে। আইবুড়ো ভাত জব্বর খাচ্ছিস নাকি? তাই আজকাল চলতে ফিরতে এমন দেরি হচ্ছে ...!"
কথাটা শেষ হতে না হতেই চিরন্তনের পিঠে পাকা পেয়ারার মতো আদুরে মুষ্ঠির আঘাত পটাপট শব্দ সহযোগে নেমে এলো।
"সবসময় আমার পেছনে লাগা না তোর?" অভিমানী সমৃদ্ধি হাতের সুখ সেরে মুখ ঘোরাল।
"আহা! পেছনে না লাগলে, আজ এই মিষ্টি মেয়েটাকে বাগাতে পারতাম নাকি?" চিরন্তনের কথায় এবার আড়চোখে তাকাল সমৃদ্ধি। মুহূর্তে চিরন্তনের মনে হল, এই দৃষ্টির সাগরে বারবার ডুবে যেতে পারে ও। দিগন্তরেখার মতো কাজলের টান সেই সাগরকে আরো গভীর আকর্ষণীয় করে তুলেছে যেন। আর কত অপেক্ষা! ভেবে চোখে চোখ রেখে মধ্যস্থ দূরত্ব কমাতে থাকল চিরন্তন। ওর উষ্ণ শ্বাসের ছোঁয়া পড়তে থাকল সমৃদ্ধির কান ঘেঁষে। দুহাত দিয়ে চিরন্তনের বুকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে লজ্জিত মুখে বলে উঠল সমৃদ্ধি "এটা রাস্তা মিস্টার। ভেতরে যাওয়া যাক!"
এরপর কফি হাউসে বসে পায়ের উপর পা রেখে বেশ আমেজের সাথে সমৃদ্ধি একটা লম্বা চওড়া লিস্টের নাম সহ বর্ণনা দিতে শুরু করল। আর আড়াই মাস পর ওদের বিয়ে। দিল্লী থেকে চিরন্তন মাত্র পাঁচ দিনের ছুটিতে এসেছে কলকাতায়। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই সমৃদ্ধি প্রথম বন্ধুর বাড়ি মনে করেই ঢাকুরিয়াতে চিরন্তনের বাড়িতে গিয়েছিল। তার কিছু মাস পর চিরন্তন এসেছিল সমৃদ্ধিদের দমদমের ফ্ল্যাটে। তারপর প্রেমের কাহিনিতে যেভাবে স্ক্রিপ্ট এগোয় আর কী! ওরাও সেভাবেই এক পা দু পা করে এগিয়ে চলেছিল একটা অদৃশ্য টানে। থার্ড ইয়ারে গিয়ে ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে চিরন্তন সব বন্ধুদের সামনে প্রোপোজ করেছিল সমৃদ্ধিকে। সেটা যদিও একটা অফিসিয়াল স্টেপ ছিল। দুজনের মনের মধ্যে প্রেমের মনুমেন্টটা তার বহু আগেই পাকাপোক্ত হয়ে গেঁড়ে বসেছিল। তবে তার ভিত স্থাপনের পারফেক্ট দিনটা অজানা ছিল। এইভাবেই কিছু সম্পর্ক শুরুর ইতিহাসে সাল তারিখ উহ্যই থেকে যায় সারাটা জীবন জুড়ে।
"আর ইউ ম্যাড? আকাশ থেকে গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো আছড়ে পড়ল চিরন্তন। "আমি সেই সুদূর দিল্লি থেকে এসেছি, তোর এই স্বাস্থ্যবান লিস্ট উদ্ধার করতে? সারা কলকাতায় ওলা ছুটিয়ে লাঙল চষে এসব দ্রব্যাদি খুঁজতে হবে এখন?"
"প্লিজ চির, এবার একটু সিরিয়াস হ। কদিন পর বিয়ে করবি, একটু দায়িত্বজ্ঞান নেই তোর? তোর বৌ কি পরবে, কি দিয়ে সাজবে ... এগুলোতে তোর কোনো চয়েস থাকবে না?"
অভিমান ও পরিস্থিতিকে ম্যানেজ করতে, সমৃদ্ধির নারীসুলভ মার্কেটিং উত্তেজনার সামনে মাথা নিচু করে চিরন্তন নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে উঠল "ওহে প্রিয়ে, তোমায় আমি বহুপূর্বেই জানাইয়া দিয়াছি, আমি তোমার লাগি মত্ত। এরপর তুমি লোহিত বর্ণের বেনারসী না মলিন ছেঁড়া ন্যাতা পরিধান করিয়া আমার সম্মুখে আসিবে, সে বিষয়ে আমার কোনোই মতামত নাই।"
ফলতঃ আবার একপ্রস্ত আদুরে কিল বর্ষণ হল। তারপরও সমৃদ্ধি অনড়। ও পুনরায় নিজের হাতে তৈরি লিস্টে মগ্ন হল। চিরন্তন এবার বিড়বিড়িয়ে বলেই বসল "কোথায় ভাবলাম, এতোদিন পর দেখা হয়েছে, একটু সিনেমা দেখব, একটু ইয়ে ..."... সমৃদ্ধির বড় বড় চাউনি দেখে চিরন্তনের অসমাপ্ত কথা পথ ভুলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
"তার জন্য পরশু তো আছে।"
"পরশুদিনটাকে তো এই অখাদ্য কাজগুলোর জন্যও বরাদ্দ করা যেত" চিরন্তনের মুখ ভার করা প্রস্তাব।
"বেশ, চল কী সিনেমা দেখবি বল। আজ মার্কেটিং অফ।" সমৃদ্ধি পুজোর ফর্দর মতো লিস্টটাকে গুটাতে গুটাতে বলল।
"মাই সুইট হার্ট" বলে সমৃদ্ধার গালের কাছে মুখটা হাল্কা এগিয়ে দিল চিরন্তন। এর দু সেকেন্ডের ব্যবধানে গম্ভীর গলায় সমৃদ্ধির সতর্ক বার্তা জানান দিল "পাব্লিক প্লেস।"
অগত্যা পূর্বের অবস্থানে নিজেকে সংযত করল চিরন্তন।
এরপর মুভির টিকিট কেটে দুজনে সোজা চলে গেল আইনক্সে। মুভির তখনও শুরু হয়নি। এড দেখাচ্ছে।
চিরন্তনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল সমৃদ্ধি "আরেকটা কথা আছে ...।" সমৃদ্ধির কথাতে চিরন্তন ভুরুযুগল উঁচিয়ে শ্বাস বন্ধ রেখে এমনভাবে ওর দিকে তাকাল যে, তাতে রীতিমতো হেসে ফেলল সমৃদ্ধি।
"ভয় নেই। কেনাকাটার বিষয়ে নয়। অন্যকথা বলব।" প্রেমিকার কথায় আশ্বস্ত হয়ে শ্বাস ছাড়ল চিরন্তন।
ইতস্ততভাবে সলজ্জ চোখ নামিয়ে সমৃদ্ধি বলল "ইয়ে মানে মা বলছিল, আমাদের দুজনকেই একটু সিভিলাইজড হতে।"
সমৃদ্ধির কথায় চারদিকে ইতস্তত দৃষ্টি বুলিয়ে পারস্পরিক দূরত্ব কমিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল চিরন্তন
"আমরা এখনো তো সেভাবে অসভ্য হয়ে উঠিনি। আন্টি কি জ্যোতিষ চর্চা করছে এখন? আমি এখন তোর সাথে কি করতে পারি, তা আগের থেকে জেনে গিয়েই কি ..."
কথাটাকে সম্পূর্ণ হতে না দিয়ে, সলজ্জ ঠোঁটে হাসির রেখা এঁকে চিরন্তনের জামার হাতাটা খেঁমচে ধরল সমৃদ্ধি।
"যত্তসব বদবুদ্ধি তোর মাথায়। মা বলছিল, আমাদের তুইতোকারিটা বন্ধ করতে। বুঝলি?"
"বুঝব এবার ..." বলে চিরন্তন হঠাৎই নিজের ঠোঁটজোড়া দিয়ে চেপে ধরল সমৃদ্ধির ঠোঁটদুটোকে। বাতানুকূল প্রেক্ষাগৃহের হাল্কা আলোতে তখন ডুবে যাচ্ছিল দুটো তৃষার্ত প্রেম। চিরন্তনের জামার হাতাটাতে আঁচড়ের গাড়ত্ব জানান দিচ্ছিল সেই পিপাসার টানকে।
(২)
"পেটে জব্বর টান পড়ছে। চল অ্যামিনিয়া যাই।" সিনেমা হল থেজে বেড়িয়ে চিরন্তন ওলা বুক করার চেষ্টা করতে করতে বলল।
"ছাতা আনি নি রে।" ঈষৎ মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে ঠোঁট উলটে বলল সমৃদ্ধি।
"এটা সাংঘাতিক ব্যাপার কিন্তু। যতটুকু জানি মেয়েদের ব্যাগে ছাতা, ছোট আয়না, চিরুনি, জলের বোতল আর টুকটাক মেকয়াপ আইটেম সহ প্রায় কোয়াটার পরিমাণ সংসার থাকে। তুই তার মানে আজ একটু বেশিই ইক্সাইটেড ছিলি আমার জন্য। তাই সব ভুলে মেরে দিয়েছিস" চিরন্তনের খোঁচা দেওয়া হাসি।
"মোটেই না। তাড়াহুড়োতে মিস করে গেছি। আর তুই যে দেখছি একেবারে লেডিস স্পেশালিষ্ট হয়ে উঠেছিস। ভিন রাজ্যে কি কোনো ভিনভাষী জুটেছে?"
"এ রাজ্যের আদি অন্ত নাহি জানো রাণী,
এ তবু তোমার রাজধানী ... " একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বেশ কবি কবি সুরে রবীন্দ্র ভাষায় জবাব দিল চিরন্তন।
"আবার কাব্যি ফুটছে দেখছি ... " বলতে বলতে কথার তাল কেটে হঠাৎ উত্তেজনায় বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠল সমৃদ্ধি "গোল্ড ফিশ, গোল্ড ফিশ।"
থতমত খেয়ে প্রশ্ন করল চিরন্তন "কী? কোথায়?"
"আরে, ওই দেখ! লোকটা কাচের বাউলে করে বিক্রি করছে। শিগগির চল চির। আমায় কিনে দে গোল্ড ফিশ।" ছটফটিয়ে উঠে শিশুসুলভ বায়নাক্কা জুড়ে দিল সমৃদ্ধি।
এদিকওদিক চেয়ে এতোক্ষণে রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে চোখ পড়ল চিরন্তনের। ছেলেটার হাতে একটা কাচের বাউলে দুটো কমলা রঙের ছোটো মাছ দিব্যি খেলে বেড়াচ্ছে। আর পাশে মাটিতে আরো এরকম কয়েকটা কাচের বাউলে ওরকম রঙিন মাছ রাখা আছে। দেখে বেশ লাগল চিরন্তনের। ততক্ষণে সমৃদ্ধি এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার সাথে দরদস্তুর করা শুরু করে দিয়েছে।
"একটা কাচের বাউল, দুটো গোল্ড ফিশ আর এই খাবারের প্যাকেট ... ঠিক করে বলো কততে দেবে?"
অবশেষে মাছ সহ জার প্যাক করা বাক্সটা নিয়ে আর অ্যামিনিয়া যাওয়া হয় না ওদের। পেট পুজো সারতে কাছাকাছি একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকে পড়ল দুজনে। চিরন্তন সেখানে বসে দেখল, সমৃদ্ধির মেনু চয়েসের কোনো আগ্রহই নেই। বরং ভীষণ একটা তৃপ্তিতে বারবার বাক্সটা খুলে ওর মধ্যে উঁকি দিচ্ছে ও। খেতে খেতে সমৃদ্ধির গোল্ড ফিশের প্রতি এতো আকর্ষণের গল্পটা শুনল চিরন্তন। যদিও জিজ্ঞাসা করতে হল না, সমৃদ্ধি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলতে শুরু করল ...
"জানিস, কেন নিলাম আজ এটা? বড় জ্যেঠিমার খুব প্রিয় এই গোল্ড ফিশ। ছোটো থেকে দেখে এসেছি, জ্যেঠিমা গাছের যত্ন নিত আর গিনিপিগ, মাছ এসব পুষত। বাবাদের চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল জ্যেঠু। নিসন্তান এই দম্পতির সারাটা দিন কাটত বাড়ির বাকি ছেলেপুলেদের নিয়ে। তারপর এক এক করে আমরা মফস্বলের বিরক্তিকর অসুবিধাগুলোকে এড়াতে শহুরে সহজলভ্যতায় ফ্ল্যাট নিলাম। ওরা পুরানো বাড়ি আর সম্পর্কের স্মৃতির শেকড় আগলে ওখানেই থেকে গেল। জ্যেঠিমা বলত, আমরা এখানে আছি বলেই না তোরা সবাই পুজোতে এক জায়গায় এসে উঠিস। অদ্ভুত সেন্টিমেন্ট ওদের। সবাই বেরিয়ে যেতে, সেই খালি বাড়িতে জ্যেঠিমা এসব পোষ্য এনে তুলেছিল। ওরা যেন ওর সন্তান ছিল। জ্যেঠিমা আমায় বলেছিল, গোল্ড ফিশ নাকি লাভিং কাপলদের ঘরের জন্য খুব লাকি। এই ফিশ রাখলে নাকি ভালোবাসায় সহজে কোনো নেগেটিভিটি ক্রিয়েট হয় না। হলেও এই মাছ সেটাকে অ্যাবজর্ভ করে মরে যায়। তাছাড়াও গোল্ড ফিশের অদ্ভুত এক আচরণের কথা শুনেছিলাম তখন। ওদের জোড়ার একটা মাছ মরে গেলে, বাকি মাছটা নাকি খাওয়া বন্ধ করে দেয়। আর এক দুদিনের মধ্যে সেটাও মরে যায়। কী অদ্ভুত টান না!"
"সত্যি?" থমকে গিয়ে বলে ওঠে চিরন্তন।
"হ্যাঁ রে, সত্যি বলছি। জ্যেঠিমার ঘরে তিন তিন বার হয়েছিল এরকম। কিন্তু জ্যেঠিমা জার খালি রাখত না। একটা মাছ মরলেই আরো দুটো আগে থেকে নিয়ে আসত। কোথাও যেন একটা একা হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করত ওর মনে। কী জানি কেন?" বলে অন্যমনস্ক হল সমৃদ্ধি।
"তোর জ্যেঠু কেমন আছেন এখন?"
"ভালো নয়। বয়সটা আধুনিক চিকিৎসার সাথে পাল্লা দিতে পারছে না রে। এখানে চিকিৎসা করাতে আসার আগে নাকি জ্যেঠিমা পাশের বাড়ির মিনু কাকিমার কাছে পোষ্যগুলোকে রেখে এসেছে। এখন রোজ দুবেলা ফোন করে ওদের খবর নেয়। আজ এই গোল্ড ফিশ দেখলে, জ্যেঠিমা খুব খুশি হবে বল?"
সমৃদ্ধির সম্পর্ক শব্দটাকে ঘিরে এসব সরল অনুভূতিকে হৃদয় দিয়ে উপভোগ করে চিরন্তন। ও চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে হেসে ওকে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়। আর মনে মনে ভাবে, তুই এমন করেই থাকিস। সম্পর্ক শব্দটার বিস্তৃতিকে এভাবেই অনুভব করিস সারাটা জীবন ধরে।
(৩)
বাড়িতে ফিরেই প্রথমে উত্তেজনায় বড় জ্যেঠিমাকে হাকডাক দিতে থাকল সমৃদ্ধি। তারপর এক্কেবারে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে ড্রয়িং রুমে বসাল জ্যেঠিমাকে। উত্তেজনা সহ প্যাকিং খুলতে খুলতে বলতে লাগল "এই দেখো, তোমার প্রিয় জিনিস এনেছি।"
কিন্তু কাচের বাউলে রঙিন পাথরের ভূমির উপরের স্বচ্ছ জলে এমন সুদৃশ্য ভালোবাসার জীব দুটোকে দেখেও কেমন যেন মুষড়ে পড়ল জ্যেঠিমা। ওঁর মুখেচোখে একটা আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। চাপতে না পেরে বলেই বসল "এতো ছোটো জারে আরো গোল্ড ফিশ রাখা যাবে কী করে?"
"মানে?" অবাক প্রশ্ন সমৃদ্ধির।
দুদিকে অস্থিরভাবে মাথা নাড়িয়ে জ্যেঠিমা বলল "আমি যে দুজোড়া মাছ সবসময় রাখতাম, যাতে একটা জোড়ার কিছু হলেও জারটা খালি না হয়ে যায়। তাতে যে ..." বলে একটা বিষন্ন মুখে থেমে গেল ওঁ।
"আরে নো চাপ। সেরকম কিছু হলে, আরেক জোড়া নিয়ে আসব।" সমৃদ্ধি কথাটা বলে দেখল জ্যেঠিমা অন্যমনস্ক হয়ে কোনো এক গভীর চিন্তায় যেন ডুবে যাচ্ছে। ও বুঝল, জ্যেঠিমার মনে অন্য কোনো হিসেব চলছে তখন। কিন্তু ও সেটা সঠিক বুঝতে পারছে না।
পরের দিন সমৃদ্ধির পাকা কথা উপলক্ষ্যে ঘরে বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন এলো। সারাটা দিন হৈ হৈ করে কেটে গেল। মাস্টার্ড ইয়েলো ল্যাহেঙ্গা আর ডার্ক মেরুন কাঁথাস্টিচের কাজ করা পাঞ্জাবির যুগলবন্দীর প্রচুর সেল্ফি তুলল সমৃদ্ধি। সবার মাঝখানে থেকে ও চিরন্তনের একান্ত ব্যক্তিগত স্পর্শটা না পেলেও, বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিকতাকে ঘিরে নিজেদের প্রথম সামাজিক স্বীকৃতি পেল দুজন। বিকেলের দিকে রেজিস্ট্রার এলো। এক ফাঁকে সমৃদ্ধি একবার গম্ভীর গলায় চিরন্তনকে জিজ্ঞাসাও করেছিল "এমন দিনে উপহার ছাড়া দিব্যি ড্যাং ড্যাং করে চলে এলে? এই বুঝেছো তুমি নারীদের?"
উত্তরে নীরব রহস্যময় চোখের হাসিতে যেন অনেক ইঙ্গিত দিয়েছিল তখন চিরন্তন।
অনুষ্ঠানের শেষে বাড়ি হাল্কা হতে থাকলে, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত বোধ হচ্ছিল সমৃদ্ধির। এই যেন ওর মেয়েবেলা শেষ হয়ে গেল। একদিকে নতুন জীবন সাগর পাড়ে ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসের মতো যেমন দুহাত বাড়িয়ে অবিরাম ডাকছিল, তেমনি অন্যদিকে পুরানো স্মৃতি ধুয়ে যাওয়া বালিয়াড়ির মতো বিষন্নতায় ঢেকে দিচ্ছিল একান্ত আপনজনেদের সঙ্গসুখকে। সবশেষে সেদিন যাওয়ার পথে ওর হাতে একটা চিরকুট গুঁজে দিয়ে চিরন্তন আবার সেই রহস্যময় হাসিটা হেসেছিল। সবাই চলে গেলে একাকী ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়ে সমৃদ্ধি সযত্নে খুলল সেই চিরকুটটাকে। মুহূর্তে ভেতরে রাখা সুমিষ্ট জুঁই ফুল কটা সারাটা ঘর জুড়ে ছড়িয়ে দিল সমৃদ্ধির ভালো লাগা এক স্নিগ্ধ গন্ধ। নিবিড়ভাবে ফুলগুলোর কাছে নাক গুঁজল ও ... আরো আরো ডুবতে সেই প্রেমের উপহারের অনুভূতির সাগরে। তারপর চোখ গেল চিরকুটের লেখাটায় ...
'তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শতরূপে শতবার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছো সে উপহার।'
তারিখঃ ২৮/১১/১২
তারিখে চোখ পড়তেই ভালোলাগার আবেশে ভারী হয়ে এলো সমৃদ্ধির দুটো চোখের পাতা। ঝাপসা পর্দায় স্মৃতির রিল অতীত চলচিত্রে ডুবে গেল। ইউনিভার্সিটির ফাংশনে, লাল সাদা শাড়ির আটপৌরে সাজের সাথে খোপায় জুঁইফুলের মালা লাগিয়েছিল সেদিন সমৃদ্ধি। স্টেজের পেছনে বার বার নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছিল পারফর্ম করার আগে। অন্যদিকে তখন ওর গলায় রবি ঠাকুরের 'অনন্ত প্রেম' কবিতার আবৃত্তির সাথে তাল মিলয়ে যে আরেকজন চুপিসারে বীজ বুনে চলেছিল সেদিন ... তা এতোদিন পর আজ জানল সমৃদ্ধি। এরপর যদিও এক বন্ধুর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল ওদের বন্ধুত্বটা। কিন্তু বেশিদিন নয়, তিনমাসের মধ্যেই নিজেদের মধ্যের বোঝাপড়াগুলোর পুটলিকে প্রেমের গিট বেঁধে সামলে নিয়েছিল দুজনে।
স্মৃতিচারণের আবেশে ডুবে সমৃদ্ধি ফোন করল চিরন্তনকে। ফোন তুলতেই তৃপ্ত ভেজা গলায় বলতে থাকল ও ...
'যত শুনি সেই অতীত কাহিনী
প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে
দেখা দেয় অবশেষে ... '
'অনন্ত প্রেম' আবৃত্তিকে মাঝপথে থামিয়ে সমৃদ্ধি কান পাতল বাতাসে। পাশের ঘর থেকে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ যেন ভেসে এসে পৌঁছল ওর কানে।
(৪)
ডাক্তার হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিলেন। রীতিমতো সময় গুনতে বলেছেন। সমৃদ্ধি দেখল, চোখে মুখে দুহাত চাপা দিয়ে সোফায় বসে কেঁদে চলেছে বাবা। জ্যেঠিমা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই আর জানায় নি। এখন জানিয়েই বা কী হবে? শোকে সারাটা রাত জেগে বসে থাকবে, মা বলল। এদিকে মেঝ জ্যেঠুর ছেলে, মিতুলদাকে খবর পাঠানো হয়েছে। ও পুনাতে থাকে। এই বংশের বড় ছেলে।
মুহূর্তে মনটা তেতো হয়ে গেল সমৃদ্ধির। ধীর পায়ে বড় জ্যেঠিমার ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ও। নাইট বাল্বের আলোয় জ্যেঠিমার মুখে চোখ পড়তেই একটা কান্নার দলা ডুকরে নড়েচড়ে উঠল ওর বুকে। মনে পড়ে যাচ্ছিল জ্যেঠু জ্যেঠিমাকে নিয়ে বলা সবার একসময়ের হাস্যকৌতুকগুলো। জায়েরা রীতিমতো 'রোমিও জুলিয়েট' বলে ক্ষেপাত ওদের আদর আবদারের বড়দিকে। ঝাপসা চোখটা মুছতেই সমৃদ্ধির চোখ পড়ল পাশের টেবিলে রাখা কাচের বাউলের উপর। মুহূর্তে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ও। দ্বন্দ্ব কাটাতে আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখল, একটা মাছ সত্যিই নড়াচড়া করছে না। আড়াআড়িভাবে মুখ হাঁ করে ভাসছে। আর আরেকটা মাছ তাকে কিছুক্ষণ পর পর এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কেমন যেন একটা চাপা আতঙ্ক গুমরে উঠল ওর মনের মধ্যে। কাচের বাউলটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলো ওই ঘর থেকে। পাছে সকালে উঠে জ্যেঠিমা এসব দেখে আরো কষ্ট পায়। তাই, মনে মনে ঠিক করল, কাল সকালে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, কাছাকাছি কোথায় পেটস শপ আছে। আরেক জোড়া গোল্ড ফিশ আনতে হবে।
(৪)
পরেরদিন ভোর হতে না হতেই বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। রাতে মরা মাছটাকে ফেলে দিয়ে এসে অনেকক্ষণ বসে বাউলের একা মাছটাকে দেখছিল সমৃদ্ধি। ঘুম আসতে দেরি হয়েছিল তাই। কান্নার শব্দে কাঁচা ঘুমের ঘোর কাটিয়ে ধীরে উঠে বসল ও। মনটা মোচড় দিয়ে উঠল ভেবে ... জ্যেঠুর বুঝি অন্তিম খবর এসেছে ...। এমন সময় ওর মা ঘরে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল "বড়দি আর নেই সুমি। কাল রাতে হঠাৎ অ্যাটাক হয়ে নাকি ঘুমের মধ্যেই ..."
নিজের কানকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না সমৃদ্ধি। জ্যেঠিমাকে তো রাতে দিব্যি দেখে এলো। সুস্থ মানুষ, অঘোরে ঘুমাচ্ছিল। মাথার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল ওর। সব যুক্তিগুলো কেমন যেন শোকের সুনামিতে ভেসে যাবে বলে মনে হল। পাশে চেয়ে দেখল, বাউলের মাছটা অদ্ভুত রকম ভাবে কম নড়াচড়া করছে। ঠিক যেমন ঝড়ের আগে পাখিদের সতর্কতা একটা থমথমে ভাব জানান দেয়।
খবর পেয়ে ফ্লাইটে করে দুপুরের দিকে মিতুলদা কলকাতায় এলো। জ্যেঠিমা বাইরের ঘরে ফুল আর ধূপধুনো ঘেরা শয্যায়। জ্যেঠুর কাছে খবর দেওয়া না দেওয়া সমান। এসবের মধ্যেই সমৃদ্ধি সকালে এক ফাঁকে মাছটাকে খাবার দিতে গিয়ে চমকে উঠেছিল, মাছটা খাবারের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু খাচ্ছিল না। অবশেষে রাতের দিকে মানে জ্যেঠিমার মৃত্যুর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জ্যেঠুর খবরটা আসল। সবাই ভেজা গলায় গুঞ্জন করতে লাগল 'এমন ভালোবাসার টান বিরল। একজন যেন না বলে কয়ে তার প্রাণের মানুষের অপেক্ষায় আগে থেকেই পথে বেরিয়ে গিয়েছিল।'
খবর পেয়ে চিরন্তনরাও আসল সমৃদধিদের বাড়িতে। সমৃদ্ধি ঘরে একান্তে বসে ছিল গুম হয়ে। ওর চোখ পড়েছিল জলহীন শুষ্ক কাচের বাউলটার দিকে। চিরন্তন ঘরে ঢুকে ওর মাথায় হাত বোলাতেই ও ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল 'আর কাচের বাউল নেব না। দুটো গোল্ড ফিশ মরে দেখ কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে জারটা। আমায় একটা মস্ত বড় অ্যাকুরিয়াম কিনে দিবি তুই। ওটাকে রাখব আমি আমাদের ঘরে। আর তাতে অনেক অনেক জোড়া গোল্ড ফিশ রাখব আমি। যাতে কোনোদিন সেটা ফাঁকা না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দিবি তো চির? বল না, দিবি তো?"
নিজের ভালোবাসাকে দুই বাহুবন্ধনীর মধ্যে আগলে যথাসম্ভব সামলাতে থাকল চিরন্তন। অত:পর ধীরে আশ্বস্ত গলায় বলল "তুই যা চাইবি, সব দেব আমি।"
দূরে কোথা থেকে যেন বাতাসে ভেসে আসছিল কবিগুরুর কটা লাইন ...
'আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
যুগলপ্রেমের স্রোতে,
অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে।'