লোভে পাপ
লোভে পাপ
#লোভে পাপ
#শেলী ভট্টাচার্য
"আর কতক্ষণ ঠাকুরঘরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? জলখাবারে কিছু পাবো নাকি?" দশটার সময় ঘুম থেকে উঠে গনগনে মেজাজে বলে উঠলো শঙ্কু। এলাকায় প্রতাপশালী প্রোমোটার রবীনের ডানহাত সে।
"এইতো আসছি" ক্ষীণকণ্ঠে উত্তর দেয় সরমা। তারপর আধা ঘন্টার মধ্যে লুচি তরকারি এনে স্বামীর সামনে পরিবেশন করে দ্বিধাগ্রস্ত মনে দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। সারাটা দিন লোক চড়িয়ে খাওয়া শঙ্কুর চোখে আড়াল হতে পারেনা সরমার সরল চিন্তিত মুখাবরণটি। সে তার স্বভাবসুলভ ঝাঁঝালো গলায় বলে ওঠে "মনের মধ্যে না রেখে বলেই ফেলো, যা বলতে চাও। শেষে বেরোনোর সময় প্যানপ্যানানি শুরু করলে আমার মটকা গরম হয়ে যাবে।"
স্বামীর ধমক খেয়ে একটু আমতাআমতা করে বলতে শুরু করে সরমা "বলছি কী, আমরা একটু মুনিয়াকে নিয়ে সাইবাবার মন্দিরে যদি যাই ... "
"কেন?"
"গত পরশু মিনুদি এসে বলছিল, ওর দাদার অসুখটা ওখানে গিয়ে এক্কেবারে সেরে উঠেছে। খুব জাগ্রত নাকি ..।"
"সারাটাদিন ঠাকুরঘর, কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর আর হাজার মানতে তো তোমার ওই বোবা মেয়ের মুখে একটা বুলিও ফুটল না। আর তারপর একটা সুস্থ বাচ্চাও হল না। তোমার নাকি কিসব আজব অসুখ। শালা ... যত্তসব জুটেছে আমার কপালে।" পাশের ঘরে মেয়ের কোঁকানি শুনে সরমা যেতে গিয়ে পেছন থেকে ওর কানে ভেসে আসে শঙ্কুর কথাগুলো "মরেও না শালা"।
জানলার পাশে কাঠের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সরমার মনে পড়তে থাকে অতীতবেত্তাগুলো। মা-বাপ মরা মামারঘর থেকে যখন শঙ্কুর ঘরে দুবেলা খাওয়াপরার জন্য এসেছিল সে, তার তখন নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। তারপর রাজ্যে গদি বদল হল, আর রাতারাতি শঙ্কুর কুটিল শঙ্কিল রূপ প্রস্ফুটিত হয়ে উঠলো দুর্নীতিগ্রস্থ কাজের মধ্য দিয়ে। টাকার লোভে হেন কাজ নেই, যাতে শঙ্কুর ছোঁয়া লাগল না। নরক ঘাটতে ঘাটতে গুয়ের কীটের মতো একটা পচনশীল ভনভনে ভাষা এখন সবসময় ওর চোখেমুখ দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। প্রতিবাদের জন্য একটু মুখ খোলার সাহস দেখালেই, স্ত্রীয়ের মন ও শরীরের উপর চড়াও হয় সে।
তিন বছর আগেই এক রাতে নেশাগ্রস্থ শঙ্কুর চরম অত্যাচারে সরমাকে অজ্ঞান হতে দেখে দুবছরের মেয়েটা আৎকে বোবা হয়ে গিয়েছিল। তারপর সরমার জরায়ুতে ধরা পড়ল দুরারোগ্য রোগ। মাঝেমধ্যে সরমার মনে হয় বাজারের পাশের বস্তিগুলোর আগুনে পোড়া সংসারের হাহাকারগুলোই আজ সরমার সংসারে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে নীরবে। সেই জায়গায় এখন শঙ্কুর নেতৃত্বে বড় বড় বিল্ডিং উঠে গেছে। ইঁট বালি সুরকির উদ্ধত ইমারতগুলোর দেখভাল করা আর তার পেছনের লাখ লাখ টাকার হিসাবকে বেহিসাবি করার মতো কঠিন কাজ এখন শঙ্কুর কাছে জলভাত। এসব চিন্তা করে সরমা যখন চোখের জলের অঞ্জলি দিয়ে সিংসাহনের সামনে বসে, তখন আতঙ্ক আর অটুট বিশ্বাসের সাথে আরাধ্য দেবতার পায়ে লুটিয়ে পড়ে স্বামীর সুমতি কামনা করে সে।
সন্ধ্যার দিকে দরজার কলিং বেল বেজে উঠলে ছোট্ট মুনিয়া গিয়ে দরজা খুলতেই বিনু হাঁফাতে হাঁফাতে বলে ওঠে "তোর মা কোথায় রে? তোর বাবা নতুন সাততলা ফ্ল্যাটটার ছাদ থেকে মাথা ঘুরিয়ে নিচে পড়ে গেছে। বোধ হয় বাঁচবে না।"
মুনিয়ার ডাক শুনে ঠাকুরঘরের দিক থেকে ছুটে আসে সরমা। হাত পা কাঁপতে থাকে তার মুহুর্তের বিহ্বলতায়। তারপর মেয়ের হাত ধরে ছুটতে থাকে সে ঘটনাস্থলের দিকে। উঁচু বিল্ডিং ঘিরে অদূরের থিকথিকে ভিড় ওর মনে অশনিসংকেতের আভাস দেয়। তারপর সেই জনস্রোতের প্রাচীর ডিঙিয়ে সরমা সামনে এগিয়ে যেতে যেতে চারপাশের গুঞ্জন শুনতে পায় 'লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। দেখোগে, পার্টির অন্য কেউ একে আজ সরিয়ে দিল।'
কেউ আবার বলে 'নিজের সুবিধার্থে পরের জন্য গাড্ডা খুরলে, নিজেকেই সেই গাড্ডায় পড়তে হয়।'
এতো কথার কোলাহল পেরিয়ে সরমা যখন সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছাল, তখন সায়াহ্নের সূর্য অস্তমিত। সরমা দেখতে পেল, আলো আঁধারিয়া কংক্রিটের মধ্যখানে এককালীন অনেক মানুষের হাহাকারের কারণ এখন নীরবে অস্তমিত হয়েছে।
(সমাপ্ত)