সোপান
সোপান
বিভাগ-গল্প
শিরোনাম-সোপান
কলমে-সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
মোহিনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে খদ্দের ডাকছে নন্দা। কেউ কেউ ওর পাশে মাছি ভন্ ভন্ করার মতো ভিড় জমাচ্ছে। দরে পোশালে নন্দার চোখের ইশারায় ঐ কপাল ফেরা খদ্দের নন্দার পেছন পেছন ওর এক চিলতে ঘরে ঢুকে যায়। রোজ এই একই দৃশ্য সহ্য হয় না কপাল মন্দ হরিমতির কারণ ওর বয়স পড়ে এসেছে। মাছি ভন্ ভন্ কেন, একটা মাছিকেও গলাতে পারে না। তাই মুখে চলতে থাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ-"আ মোলো কত গর্ব দেখ, মর মর বদ মেয়েছেলে, তোরও একদিন এই দশা হবে।"
পাশ থেকে বাংলাদেশ থেকে আসা সোনামণি বলে ওঠে "গালমন্দ করনে কাম নাই গো হরি দিদি ঐ স্নো পাউডারের ছেরাদ্দ বাড়াও...হা হা হা।"
হরিমতি গর্জে ওঠে-"মর মর তোরা সব কটাতেই মর।"
দালাল শম্ভু কোথ থেকে এক ঘাটের মড়াকে ধরে এনে হরিমতিকে উদ্ধার করে-"এই লাও গো মাসি, আজ তুমার লাগর।"
হরিমতি-"তুই আমার কোন্ বংশের বোনপো রে, খবরদার মাসি ডাকবি না।" শম্ভু আর হরিমতির কথোপকথনে সোনামণির হাসির বেগ বেড়ে যায় আর সেই সঙ্গে ওর ঘরে আজকের বাবু জুটে যায়। ঘর ভাড়া, দালাল দিয়ে হরিমতিদের বেঁচে থাকাই কষ্টকর।
তবুও যাবেই বা কোথায়, ফেলে আসা সংসারে ঠাঁই মিলবে না। নতুন পেশায় গেলেও কেউ না কেউ ঠিক চিনে পুরোনো পেশায় ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। তবে ঐ মহল্লায় নন্দাকে কেউ বোঝে না, নন্দাকে দেখে ওদের ওকে উচ্চশিক্ষিত বলে মনে হয়। কেউ যে নন্দাকে জোর করে বা ফুসলিয়ে এই মহল্লায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে সে দৃশ্যও কেউ দেখে নি। ও এখানে একটা কুহেলিকার মতো। যে কুহেলিকা ভেদ করার চেষ্টা শম্ভু বা ওর মতো দু একজন দালাল করে এমন শিক্ষা পেয়েছে যে ওদিকেই আর ঘেঁষে না। তবে নন্দার খদ্দেরের লিস্টে উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিরা যেমন আছে সেরকম সমাজবিরোধী-কুখ্যাত আসামীরা। এর মাঝামাঝি ওর মধ্যবিত্ত মানসিকতার লোকজন না পসন্দ। ওর ঘরে যে একবার ঢুকেছে সে এমন পাঁড় মাতাল হয়ে ফিরেছে যে ওর সঙ্গলাভের কোন কথাই মনে রাখতে পারে না। তবু আলোর পানে ধাওয়া পতঙ্গের মতো ওর পানে ছুটে যায়। এ নিয়ে হরিমতির বক্তব্য-"ও মেয়ে ভাল মতো তুকতাক জানে, দেখে নিও তোমরা, এ আমি বলে রাখলুম।" এই যেমন আজ ভিড়ের মধ্যে থেকে নন্দা বেছে নিয়ে গেছে এক ওষুধের ডিলারকে। ডিলার লতিফ খান গদগদ হয়ে দুটো প্রেমের কথা বলবে ভাবছে তখনই নন্দা পেগের পর পেগ হুইস্কি ঢেলে দেয় লতিফের গ্লাসে। সাথে চলতে থাকে কথা-" তা লতিফ মিঞা ব্যবসাটা তোমার এক নম্বরি না দু নম্বরি?"
লতিফ-"সুন্দরী তোমার এ খোঁজে কী দরকার?"
নন্দা-"না এক নম্বরি হলে আমার এক রেট আর দু নম্বরি হলে আর এক।"
লতিফ-"চিন্তা নেই আমি তোমায় দু-নম্বরির রেটই দেব, এখন কাছে এসো দেখি নি।"
নন্দা এরপরও কথা চালিয়ে যায় আর লতিফ না চাইতেও সব গড়গড় করে বলে যায়। আর খদ্দের গভীর ঘুমে না চলে যাওয়া পর্যন্ত এ পর্ব চলতে থাকে। তবে এ নিয়ে যে নন্দা কোন ব্ল্যাকমেইলের ব্যবসা ফেঁদে বসে তা কিন্তু নয়। তাহলে কী? তা জানার জন্য যে আরো কথা বাকী পড়ে আছে। সোনামণি নন্দাকে বেশ পছন্দ করে, ভালোবেসে দিদি ডাকে, দরকার মতো সুপরামর্শ নেয়। নন্দা কাছে থাকলে সোনামণির বাংলাদেশে ফেলে আসা ওর আপন দিদির কথা মনে পড়ে। এই যেমন সেদিন সোনামণি সবে স্নান সেরে উঠেছে, নন্দার ঘরে গিয়ে দেখল ও কী সুন্দর পরিপাটি করে রান্না করছে।
সোনামণি বলে উঠল-"দিদি তুমার রুসিডা খুব ভাল, তুমাকে এহানে এক্কেবারেই মানায় না। কীসের লাইগ্যা তুমি এই নরকে আইস্যা পড়লে।"
নন্দার চোখ উজ্জ্বল হল, মুখে বলল-"কী করতে? সে তোকে একদিন বলব ক্ষণ। এখন তুই বল তো কারা, কীভাবে তোকে এখানে এনে তুলল?"
সোনামণি হেসে-"অমা তুমি এ কথা জেনে কী করবা বল? তুমি কী পুলিশ? পুলিশ আইলেও আমি বলতাম না, ওসব পুলিশি ঝামেলায় পড়তামই না। ওতে হিতে বিপরীত হইয়ে যায়।"
নন্দা হাসতে হাসতে-"কে বলল তোকে? সে সব চক্করও কাটা হয়ে গেছে বুঝি।"
সোনামণি বিজ্ঞের মতো বলল-" না গো দিদি, এহানে আসি আর এ অভিজ্ঞতা খান হবে না। হাতকাটা কানু,আর অয়ে পাগলা জোশেফরা তো এহানেই আচ্রয় নেয় আর ওদের খুঁজবার লাগি পুলিশও এহানে আইয়া পড়ে।"
নন্দা বিড়বিড় করে-"এদের সবার সঙ্গে আমার হিসেব বাকী আছে।"
সোনালি কথাটা শুনে ফেলেছে তাই অবাক হয়ে বলল-"তুমি হিচেব নিবা ঐ ছব খতরনক মনিষ্যিদের। থাউক ঐ ছব সর সোট্টার সঙ্গে পাঙ্গা লওয়া সহজ কাজ না, ওসব মাথার থেইক্যা বের কইর্যা তুমিও ছান্তি পাও আর মোদেরও ছান্তি খান দাও।"
নন্দা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে-"সোনামণি বল তো আর কত নরকের শান্তি পাবি, ইচ্ছে করে না ভালোভাবে বাঁচতে? পঁচে মরতেই কী ভাল লাগে?"
সোনামণি-"দেখ তুমার মতো কইরে ভাববার পারি না, খাইতা পারসি পরতে পারসি ব্যস।"
নন্দা আর তর্ক চালায় না, ওর হাতে আজ অনেক কাজ, আজ সত্যিই ওই হাতকাটা কানুর আসার কথা। নন্দার অনেক হিসেব বাকী আছে, অনেক কিছু জানার আছে। একটু বেশী রাত করেই হাতকাটা কানু হাজির হল সোনামণিদের মহল্লায়। শম্ভু নন্দার ঘরে এসে পীড়াপীড়ি করতে লাগল হাতকাটা কানুকে রাতটা নন্দার ঘরে থাকতে দেওয়ার জন্য।
নন্দা-"কী বলতে চাস তুই শম্ভু, আমি ছুঁচো ঢুকিয়ে আমার ঘরটা গন্ধ করব।"
ওদিক থেকে হরিমতি বেরিয়ে এসে-"বলেছিলাম না ও মাগির বড় দেমাক, শম্ভুদা তুমি আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও, আমার কোন অসুবিধে হবে না।"
নন্দা দাঁত কিড়মিড় করে বলল-"পাঠিয়ে দিস, বুঝে নেব, দেখব ছুঁচোটার কত দম।"
সোনামণি বুঝে গেছে আজ হাওয়া গরম তাই নন্দার কাছে বিশেষ ঘেঁষছে না। এদিকে কানুর কী গতি হয় তা জানার জন্য উদগ্রীব। হরিমতির আফসোস ওর হাতে গরমাগরম টাকা আসা ফসকে যাওয়ায়। তবে সবাইকে চমকে দিয়ে পুলিশের জিপ এসে হাতকাটা কানুকে ওর নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে তুলে নিয়ে গেল।
কানু পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে শম্ভুকে শাসিয়ে গেল-"আমি তোদের সব কটাকে দেখে নেব। শালা আমায় ধরিয়ে দেওয়া,ছাড়ব না কাউকে।"
হরিমতি-" আরে এরাই তো আমাদের লক্ষ্মী, কে এতো বড় সর্বনাশটা করলে। পার পাবে না, রক্ত বমি হয়ে মরবে।"
শুধু সোনামণি কোন হিসেব মেলাতে পারছে না। পুলিশ চলে গিয়ে গোলমাল মিটে যাওয়ার পর পা টিপে টিপে সোনামণি হাজির হয় নন্দার ঘরে, সটান নন্দাকে বলল-"কী ব্যাপার কও তো, হাত কাইট্যা কানুর খবরডা কেডায় দিল পুলিচকে?"
নন্দা-"কিচ্ছু চিন্তা করিস না, পাপের নাশ হচ্ছে। চোখের সামনে যত পাপ দেখেছিস না সারাজীবন তার বসন-ভূষণ একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে। তুই আবার তোর দিদিকে দেখতে পাবি।"
সোনামণি- "কী যে কও তুমি কিস্সু বুজি না।"
নন্দা- "অত বুঝে কাজ নেই, হ্যাঁ রে তুই বাংলাদেশে থাকতে মাধ্যমিক পাশ করেছিলি না?"
সোনামণি ঠোঁট উল্টে বলল-"কী যে কও, এডা কী ওসব কথা কওনের সময়, হ্যাঁ দিসিলাম তো পাস।"
নন্দা সোনামণিকে আশ্বস্ত করে-"হয়তো দেখলি এই কথাটাই তোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হয়ে গেল, কে বলতে পারে।"
রাত বাড়ছে, এবার সোনামণিকে রান্না চাপাতে হবে, তারপর রুজির জন্য শিকার পাততে হবে তাই নন্দার এই হেঁয়ালি আর সোনামণির ভাল লাগে না, ও ফিরে যেতে যেতে বলল-"রাইত হইসে আমি সললাম, তুমি তুমার অদ্ভুদ-বেবাক সিন্তা লয়ে থাইকো।"
নন্দা সোনামণির তড়বড়ানি দেখে হেসে ফেলে আর ল্যাপটপ টেনে নিজের কাজে বসে যায়। এরপর থেকে শহরে গুণ্ডাদের ধরপাকড় করা বেড়ে যায়। পাগলা জোশেফ-ও গ্রেপ্তার হয়। শহরে ছড়িয়ে থাকা জাল ওষুধের ব্যবসা, মেয়ে পাচার চক্রের রোমহর্ষক কাহিনী সংবাদ পত্রে উঠে আসতে থাকে। একদিন এইভাবে সোনামণিদের ঠেকেও পুলিশি তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ ধরা পড়ে কেউ বা পালায়, সোনামণির পালানোর মুহূর্তে নন্দা ওর হাতে একটা চিরকুট ধরায়। কেউ আর আলাদা করে কারো খবর রাখতে পারে না। যে যেদিকে পারে পালিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। সোনামণি দুদিন পথেঘাটে ঘুরে অবশেষে ঐ চিরকুটের স্মরণাপন্ন হয়। কাগজে লেখা ঠিকানা অনুযায়ী শহরের নামকরা জায়গায় একটা বাংলোয় এসে হাজির হয়। গেটে দ্বারোয়ানের কাছে নিজের নাম লিখে পাঠায়। খানিকক্ষণ পরে ভেতর থেকে ডাক আসে,ঘরের পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে যায় সোনামণি। তাদের মহল্লার নন্দাদি, সম্পূর্ণ অন্য পোশাকে, বিরাট ব্যক্তিত্বে। তাহলে এটাই নন্দাদির আসল পরিচয়।
নন্দা-"অবাক হচ্ছিস,বসে পড়। হ্যাঁ রে ছোটবেলায় যখন আমার দিদির অপহরণ হয়েছিল তখন আমি নেহাতই ছোট। কিচ্ছু করতে পারি নি তখন। তারপর নিজেকে একটু একটু করে তৈরী করে আজ এ জায়গা এসে পৌঁছেছি। নিজের সাধ্যমতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। কখনো জিততে পারি,কখনো বা হেরে যাই। হেরে গিয়ে আবার নতুন উদ্যমে চেষ্টা শুরু করি।"
সোনামণি অস্ফুটে বলে ওঠে-"দিদি, তুমি যে মোদের ধারা নও তা জানতাম। তা বলি এত্তো টা।"
নন্দা-"আর দেরী করিস না, তোর জন্য একটা সম্মানজনক কাজের ব্যবস্থা করেছি। তোর নিজেরটা ভালোমতোই চলে যাবে। যা যা লেগে পর, এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে।"
সোনামণি নন্দাকে একটা প্রণাম করে চোখের জল মুছে বেরিয়ে পড়ে ভবিষ্যতের পথে।