বিজয়িনীর দ্বিতীয় পর্ব
বিজয়িনীর দ্বিতীয় পর্ব


খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে বিজয়িনী হারিয়ে যাচ্ছে তার সাম্প্রতিক অতীতের দুরন্ত অসম লড়াইয়ের সেই ময়দানে।
একটা গোল্ডেন জুবিলী ওয়েডিং অ্যানিভার্সারি কেকের অর্ডার ছিলো সেদিন। একই দিনে বিজয়িনীর জয়ী'জ কেকশপেরও দশ বছরের পূর্ণ হবার দিন। কী আশ্চর্য সমাপতন! জয়ী দু'টো কেকই বেক করেছে আজ নিজে হাতে। কারোর ওপরে ভরসা করে ছাড়তে পারে নি, মিক্সিং, বেকিং, ডেকরেশন সবটাই নিজে করেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেকিং টেবিলে ট্রেতে রাখা অর্ডারের কেকটার আইসিং করার সময় Happy 50th Anniversary, লেখার সময় বিজয়িনী মনে মনে ভাবলো, "আহা, ক'জনের হয় এমনি সৌভাগ্য! সুদীপের আর আমার গোল্ডেন জুবিলী তো দেরী আছে, তবে আসছে যে এই সপ্তাহের শেষেই পনেরোতম, এই অ্যানিভার্সারি কেকটাও দারুণ করে বানাবো।" নিজের মনেই হেসে ফেললো, আর ওয়াই-এর লেজটা পাকিয়ে টানার সময় হাতটা একটু কেঁপে গেলো বিজয়িনীর। "ইস্, কী করি এবার..." ভাবনাটা পুরো শেষ হতে পারে নি তখনও বিজয়িনীর তলপেটে পাক দেওয়া তীব্র মোচড়ানো ব্যথা, আর মাথাটা টলে ওঠায় আইসিং কোণটা হাত থেকে ছিটকে মেঝেয়। চোখদুটো অন্ধকার হয়ে মুখ গুঁজরে পড়লো বিজয়িনী অর্ডারি কেকটার ওপরেই। ব্ল্যাক আউট।
কয়েক সেকেন্ড না কয়েক মিনিট ব্ল্যাক আউটে, সেটা বিজয়িনী হিসেব কষে দেখার সুযোগ আর পায় নি। বিরাট হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড! বিজয়িনীর স্বামী সুদীপ ট্যাক্স কন্সালটেন্ট, নিজস্ব ফার্ম আছে, নিজের বসতবাড়িতেই, গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ভাগ্যিস তাই ছিলো, তাইই অযথা সময় একফোঁটাও নষ্ট করে নি সুদীপ। কোনো ঝুঁকি না নিয়ে, সাথে সাথেই অ্যাম্বুলেন্সে করে সোজা দক্ষিণ কলকাতার সম্পন্ন প্রাইভেট হসপিটালে অ্যাডমিট করানো হয় বিজয়িনীকে, এবং কল দেওয়া হয় বিজয়িনীর ডাক্তার, গায়নোকলজিস্ট ডাক্তার চক্রবর্তী ম্যাডামকে। অ্যাম্বুলেন্সে বিজয়িনীকে সর্বাঙ্গ ঢেকে তুলতে হয়েছে। তাও সামলানো যায় নি, রক্তাক্ত জামাকাপড়। বিজয়িনীর এই চাপা মুখচোরা স্বভাবের জন্যই অনেক দুর্ভোগ ওকে পোহাতে হয়েছে এযাবৎকাল। গত বেশ কয়েকমাস ধরে যে বিজয়িনীর মাসের পাঁচটি দিন বাদেও যখন তখন যেখানে সেখানে হঠাৎ হঠাৎ করে প্রবল ধারাস্রোতের মতো ব্লিডিং হচ্ছিলো, এই কথাটা ও বেমালুম চেপেই রেখেছিলো। শুধু ব্লিডিংই নয়, সঙ্গে বীভৎস পেটে ব্যাথা এবং মাথা ঘুরে যাওয়া। বিজয়িনী সব চেপে রেখেছিলো, ভেবেছিলো ও সব আপনা আপনিই ঠিক হয়ে যাবে। কে বোঝাবে ওকে? আপনা আপনি কিছু ঠিক হয়? ছোট্ট থেকেই এই বদস্বভাব। হয়তো ভাবে ওকে নিয়ে কেউ যেন বিব্রত না হয়। অথচ নিজের বয়স্ক বাবা মা, কিশোর ছেলে... তাদের কথা ভেবেই তো নিজে সতর্ক হতে হোতো। তা না...! যাক, শুধু শুধু এখন আর এসব বলে লাভ কি? ডাক্তারের অভিমত তাইই।
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিজয়িনীর চিকিৎসা চলছে।
একের পর এক টেস্ট চলছে। বিজয়িনীর ডাক্তার ক্লিনিক্যালি চেক করে, বিজয়িনীর সাথে কথা বলেই অনেক কিছু বুঝে নিয়েছেন, বিজয়িনীর সমস্যার মূল পর্যন্ত। বিজয়িনী কাউকে যেমন বলে নি ওর এই অনিয়মিত অস্বাভাবিক পিরিয়ডের সমস্যা বা হঠাৎ হঠাৎ তীব্র পেট ব্যাথা বা মাথা দুলে ওঠার কথা, তেমন কাউকে বলে নি সুদীপের সাথে শারীরিক মিলনে বিকট যন্ত্রণার কথা, এমনকি কখনো কখনো তাতেও ব্লিডিঙের কথা, বলে নি ব্লিডিং যখন থাকছে না তখনও দুর্গন্ধ হোয়াইট ডিসচার্জের কথা। কিচ্ছু বলে নি, কাউকে বলে নি, এমনকি স্বামী সুদীপকে পর্যন্ত না। বলে নি হয়তো সঙ্কোচে, দাম্পত্যের গোড়া পেরিয়ে সন্তানধারণের সমস্যার চিকিৎসার সময় সুদীপের অসহিষ্ণুতা দেখে আর কিছু নিজের কথা, সমস্যার কথা বলতে ভরসাই পায় নি হয়তো।
তবে সমস্ত রিপোর্ট হাতে আসার পর, ডাক্তার চক্রবর্তীর মতামত জানার পরে সুদীপও কেমন একটা অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেছে। সুদীপ তো জানতো, ছেলে হবার সময় থেকেই বিজয়িনীর একটু এক্সট্রা কেয়ার দরকার ছিলো, ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু সব ঠিকঠাক চলছে সংসার ধর্ম, কোনো সমস্যা থাকলে কী বিজয়িনী সব কিছু হাসিমুখে একলাই সামলাতে পারতো? অর্থাৎ বিজয়িনী ভালোই আছে, কোনো সমস্যাই নেই, এই ভাবনাটাই হয়তো কাল হোলো, সুদীপ ভাবছে। পেটের যন্ত্রণা আর ব্লিডিং সাময়িক কমানোর জন্য ওষুধ আর ইঞ্জেকশনের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে কেবিনের বেডে পড়ে আছে বিজয়িনী। সুদীপ দেখলো বিজয়িনীকে বড্ডো শুকনো দেখাচ্ছে। ইদানিং বেশ রোগা হয়ে যাচ্ছিলো দেখে, বিজয়িনীকে মশকরা করে সুদীপ বলেছিলো, "বাহ্, ডায়েটিং? হেলথ কনশাসনেস? ভালো, খুব ভালো!" যথারীতি আমতা আমতা করে বিজয়িনী বলেছিলো, "না, মানে, ইয়ে... ঐ আর কী!" তাতে কিছু পরিষ্কার হয় নি, কিন্তু সুদীপ নিজেও তো খেয়াল রাখে নি, বিজয়িনীর ওজন কমছিলো। আফশোষ হোলো।
বিজয়িনীর সার্জারি হবে, কমপ্লিকেটেড মেজর অপারেশন। ওভারিয়ান সিস্ট মোটামুটি কন্ট্রোলে ছিলো ছেলে হওয়ার পরের দু'বছরের চেক আপ পর্যন্ত। তারপর আর বিজয়িনী প্রয়োজন মনে করে নি, যে বছরে একটা অন্ততঃ চেক আপ করিয়ে আসে ডাক্তার চক্রবর্তীর কাছে গিয়ে। সুদীপও খেয়াল রাখার প্রয়োজনীয়তা ভুলে গিয়েছিলো। এখন তারই খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা পরিবারকে একসাথে। বিজয়িনীর ওভারিয়ান সিস্ট বেড়েছে আবার কিছুটা, সঙ্গে ইউটেরাসে বিরাট এক টিউমার, ছড়িয়েছে সারভিক্স পর্যন্ত, ম্যালিগন্যান্ট। ক্যান্সারাস, বিরাট থ্রেট হয়ে দেখা দিয়েছে। পুরো রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেম অ্যাটাক করেছে। সার্জারি করে ইমিডিয়েটলি সব রিমুভ করতে হবে, ওভারি থেকে সারভিক্স পর্যন্ত, সবটা, কিচ্ছু রাখা যাবে না স্তন বাদে নারীত্বের চিহ্নমাত্র। তারপর অঙ্কোলজিস্ট পরবর্তী চিকিৎসা কন্টিনিউ করবে।
বসন্ত আসছে, বসন্ত ভারী প্রিয় বিজয়িনীর, কী সুন্দর রঙে রঙে ভরা সর্বত্র। পাহাড় জঙ্গল সমতল সবাই রঙীন সাজে সেজে ওঠে, কী রমণীয়! বাড়ীতে ফিরতে ইচ্ছে করছে বিজয়িনীর। কিন্তু এখন ছুটি পাবে না। সার্জারির দিনটাও পড়লো ওদের ঠিক পনেরোতম অ্যানিভার্সারির দিনটাতেই। সকাল সাড়ে সাতটায় অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে বিজয়িনীকে। তার আগেই বাড়ির লোকের সাথে দেখা করানোর কথা। খুব ভোর থেকেই বিরাট হুড়োহুড়ি চলছে যেন, সবাই ব্যস্ত, কারুর যেন সময়ই নেই একটু বিজয়িনীকে বুঝিয়ে বলবে ঠিক কিসের পরে কী হতে চলেছে। পাঁচতলায় ওর কেবিন থেকে হসপিটালের ছড়ানো বাগানটা পরিষ্কার দেখা যায়, ফায়ারবল গাছগুলো টকটকে লাল ফুলে ভর্তি। দূরে লম্বা লম্বা দেবদারু গাছে কচি পাতাগুলো হালকা সবুজ, চকচকে। বিজয়িনীর চোখের সামনে দিয়ে একটা মিছিলে... হানিমুনে কাশ্মীরের রঙ-বেরঙের টিউলিপ, একবছরের অনীককে নিয়ে ওরা দুজনে দাঁড়িয়ে দার্জিলিঙের রডোডেনড্রনের আগুনে ছায়ায়... তারপরই কানে ভেসে এলো বিসমিল্লাহ্ খাঁয়ের সানাইয়ের সুর। বিজয়িনী আর সুদীপের বাঁধা পড়ার দিন, ওদের বিবাহবার্ষিকী।
বাড়ি থেকে সবাই এসে গেছে তখন, বিজয়িনীর খুব ইচ্ছে হোলো অনীকের কপালে একটা চুমো খায়, মায়ের গায়ের গন্ধটা একবার শোঁকে, বাবাকে গলা জড়িয়ে ধরে একটা ফাইভস্টার খেতে চায়, সুদীপের বুকে একবার মাথাটা রাখে... কিন্তু সিস্টাররা ছুঁতেই
দিলো না কাউকে। স্টেরিলাইজেশন হয়ে গেছে, দূর থেকেই কথা বলতে হবে। তারপর সিস্টাররা আর ওটির ব্রাদাররা মিলে ট্রলিতে তুলে দিলো। ট্রলি চলছে, চাকার ঘরঘর আওয়াজ তুলে, বিজয়িনীর বাড়ির লোকেরা পেছন পেছন আসছে। ফিসফাস করছে, তবে বিজয়িনী শুনতে পাচ্ছে না, দেখতেও পাচ্ছে না। দু'চোখের কোণ দিয়ে অবাধ্য গরমজল হুড়হুড় করে নামছে, বিজয়িনী লুকোতে পারছে না, হাতদুটোতে কতরকমের কিছু নলপত্র লাগানো, চোখ মোছে কী করে? চশমাটাও ছাই খুলে নিয়েছে, কী যে করে না এরা! প্রাণপণ চোখ বড়োবড়ো করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলো হসপিটালের সিলিংটা সরতে সরতে এসে একটা ইয়াব্বড়ো পেল্লায় লাইটের তলায় থেমে গেলো। চিনতে পেরে গেছে বিজয়িনী, ওটি, অপারেশন থিয়েটার। পরক্ষণেই শুরু হোলো ডাঃ চক্রবর্তী, ডাঃ বাসু সমেত পাঁচজন ডাক্তারের টিম আর সিস্টারদের তৎপরতা। ডাক্তার চক্রবর্তী বিজয়িনীর মাথায় হাত ছুঁইয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, "ভয় করছে?" প্রাণপণ মাথা নেড়ে বিজয়িনী "না" জানালো। তারপর অ্যানেসথেসিস্ট বললেন, "আমি আপনাকে একটা ইঞ্জেকশন দেবো, একটু লাগবে, পিঁপড়ে কামড়ের মতো!" বিজয়িনী মনে মনে ভাবছে, "আচ্ছা, এরা আমাকে কী পেয়েছে? ছোট বাচ্চা নাকি আমি?" ভাবতেই ভাবতেই তলিয়ে গেলো বিজয়িনী, গভীর অচৈতন্য ঘুমে।
পরে শুনেছে, জ্ঞান আসার পরে... পাঁচ ঘন্টা পরে ওটি থেকে বের করে নাকি ওকে আইসিইউতে দেওয়া হয়েছিলো। দু'দিন সেখানেই, তারপর কেবিনের বেডে। তারপর আরো পনেরোদিন হসপিটালেই। তারপর ক'দিনের জন্য বাড়িতে ফিরলো। তারপর থেকে প্রতিমাসে যেতে হবে হসপিটালে একবার, দু'দিনের জন্য। অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ বাসু সেভাবেই শিডিউল সেট করে দিয়েছেন। আবার অন্য চিকিৎসা শুরু। আরো ছ'মাস এই রুটিনই চলবে। কেমোথেরাপি, শরীরে বিষ ঢোকা শুরু, ওষুধ হিসেবে, ক্যান্সারের কোষ যদি অপারেশনের পরেও আরো কোথাও থেকে গিয়ে থাকে, তাদের মেরে ধ্বংস করার জন্য। কী যন্ত্রণাময় ছ'টা মাস। হাতের পায়ের সব জয়েন্টগুলোতে কোনো জোর নেই। অসহ্য ব্যাথা, প্রায় সর্বাঙ্গে। বিজয়িনী একটা চামচ পর্যন্ত ঠিক করে ধরতে পারে নি অতদিন ধরে। প্রতি মুহূর্তে ভেবেছে, "আবার কী কেকের মিক্সিং, আইসিং, ডেকরেশন করতে পারবো? অনীকের প্রজেক্টের খাতায় আঁকায় হেল্প করতে পারবো? সুদীপের প্রিয় চিকেন কাটলেট আর ভাপা ইলিশ বা চিংড়ি রান্না করতে পারবো? বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য প্রতি শীতের বরাদ্দ মাফলারটা বুনতে পারবো তো আবার? আমার আঙুলগুলো সচল হবে তো?"
শেষ হয়েছে কেমোথেরাপি, সুরূপা বিজয়িনী কুরূপা হয়েছে। তাতে কী? বিজয়িনী আর আয়নার সামনে দাঁড়ায় না। প্রাণ আগে না রূপ আগে? বিজয়িনীর নিজের কাছেই এখন ওর প্রাণের দাম অমূল্য। এখনো কতকিছু কাজ বাকী, কতকিছু পাওয়া বাকী, কতকিছু দেওয়া নেওয়া বাকী! অত সোজা বুঝি, অনীকের ছেলে মেয়েকে বুকে না জড়িয়ে চলে যাওয়া? ধূর, আর ভয় পাবে না বিজয়িনী। ভয়কে জয় করে কী করে একটা লড়াই জিততে হয় সেটা শিখে গেছে নরমসরম বিজয়িনী। অনুভব করছে এখন, বিজয়িনীরা হারে না, হারতে জানে না, কক্ষণো বিজয়িনীরা হারবে না।
অনীকের স্কুলে পেরেন্ট টিচার মিটে যাচ্ছে আজ বিজয়িনী, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় উইগটা পরে নিলো। সুদীপ কিনেছে নিউমার্কেটে ওকে নিয়ে গিয়েই। আর ল্যাকমের আইকনিক পেন্সিল দিয়ে আইব্রোতে হালকা টাচ আপ করে নিলো। কাল থেকে কেকশপেও বসবে, তেমনই প্ল্যান। সুদীপ নীচ থেকে গাড়ির হর্ণ বাজিয়েই যাচ্ছে, এই এক লোক বটে! গুর্জরির দোপাট্টাটা কাঁধে ফেলে বিজয়িনী অনীকের হাত ধরে গিয়ে গাড়ির সামনে পৌঁছেছে। সুদীপের চোখের মুগ্ধতা মুখে, "ইউ আর অলওয়েজ গ্রেসফুল!" গাড়ি এগোচ্ছে সামনে। বিজয়িনীও নিজের সংসার নিয়ে সামনে এগোচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বেও জিততেই হবে ওকে শেষ পর্যন্ত, ও যে বিজয়িনী!!