Gopa Ghosh

Inspirational

5.0  

Gopa Ghosh

Inspirational

সন্তান

সন্তান

4 mins
890


 সামন্ত বাড়ির ছোট্ট রানি যেনো সত্যিকারের রানিকেও হার মানাবে। আপেলের মত গায়ের রং, সুন্দর চাঁদের মত মুখ, সর্বোপরি মিষ্টি কথায় তার জুড়ি মেলা ভার। যেনো জিবন্ত একটি ডল পুতুল, তাকে দেখলে যে কেউ ভালোবাসতে বাধ্য। বাবা হরি সামন্তের এক কালে নুন আনতে পান্তা ফুরোলেও এখন নির্দ্বিধায় তাকে ধনীর পর্যায়ে ফেলা যায়। মেয়ে হওয়ার এক বছরের মধ্যে বালি সিমেন্টের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠে। তবে তার জন্য পাড়ার ভুবন বাবুর কৃত্বিত বেশ অনেকটাই। ভুবন মাল হলো পাড়ার মাথা, আর একটি নির্দিষ্ট রঙের প্রতি অনুগত, তাই তার হাত যার মাথায় থাকবে সে ফুলে ফেঁপে উঠবে এতো জানা কথা। ভুবন যখনই হরির বাড়ি আসে, রানিকে কোলে নিয়ে আদর করবেই। ভুবনের আট বছর বিয়ে হলেও সন্তান হয় নি। হরি বোঝে রানিকে কোলে নিয়ে একটু সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করে। হরি অনেকবার বলেছে ভালো ডাক্তার দেখাতে, ভুবন যে চেষ্টা করে নি তা নয় কিন্তু ঈশ্বর কৃপা করেন নি মাল দম্পতিকে। হরি খুব কৃতজ্ঞ ভুবনের কাছে, সেটা কথায় বা আচরণে বারবার জানিয়ে দিতে ভোলে না। কিন্তু একদিন ভুবন এসে হরিকে যা বললো তাতে হরির মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। ভুবন কোনরকম ভনিতা না করেই বলল "হরি, তোকে আমি অনেক উপকার করেছি, সেটা তুইও বারবার বলেছিস, তাই আজ তোর থেকে একটা জিনিষ ভিক্ষা চাইছি দিবি তো?" হরি বেশ খোশ মেজাজেই উত্তর দিলো "ভিক্ষে বলছো কেনো, তোমার জন্য আমি আমার প্রাণটাই বলি দিতে পারি, শুধু একবার বলে তো দ্যাখো কি চাই তোমার?" ভুবন খুব শান্ত গলায় খুব ছোট্ট করে উত্তর দেয় "রানিকে"। চমকে ওঠে হরি। "কি বলছো, মাথা ঠিক আছে তো তোমার, রানি আমার সন্তান কি করে দিয়ে দেবো তোমায়?" এবার ভুবন হরির কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনার সুরে বলে ওঠে "আমি জানি, তোর আর বউয়ের খুব কষ্ট হবে, কিন্তু তোর তো আরো একটা সন্তান আছে, হোক সে ছেলে কিন্তু আমার তো একটাও সন্তান নেই, তোর কোনো চিন্তা নেই, রানি এখানের থেকেও অনেক ভালো থাকবে আমার কাছে, প্লিজ তুই বউকে একটু ভালো করে বোঝা"। আদেশের মত শোনালো, হরির মাথায় তখন আগুন, সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারে না রানিকে অন্য কাউকে দান করবে। সোজা ভুবনের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বলে উঠলো "তুমি চলে যাও, নইলে কিন্তু আজ তোমার গায়ে হাত উঠে যাবে, উপকারের প্রতিদান না পেয়ে শেষে মার খেয়ে বাড়ি যাবে"। হরির বউ চেঁচামেচি শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে। বউকে দেখে হরি বলে ওঠে "দেখেছো উপকারের কি প্রতিদান চাইছে, বলছে আমাদের রানি কে নাকি দিয়ে দিতে হবে"। বউ এই একটা কথাতেই সব বোঝে, মাথা ঠাণ্ডা রেখে হরিকে বলে "তুমি এত মাথা গরম করছো কেনো, দাদা বলেছে মানে রানিকে তো নিয়ে চলে যাচ্ছে না"। এবার ভুবনের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে "দাদা, ও যদি কোনো দোষ করে থাকে ক্ষমা করবেন, আসলে রানিকে প্রাণের থেকেও বেশি ভালোবাসে তাই ওই কথা শুনে মাথার ঠিক রাখতে পারে নি"। ভুবন এতক্ষণ একটিও কথা বলে নি, এবার বলে উঠলো "তোমার স্বামীকে বোঝাও, না হলে এই এলাকায় আর ব্যবসা পাতি করতে হবে না"। শেষের কথাগুলো দিয়ে যে শাসিয়ে গেলো হরিকে, এটা জলের মত পরিষ্কার। হরি অনেক চিন্তা করে দেখলো কিন্তু কূল পেলো না। নিজের বাড়িতে থেকে ব্যবসা চালাতে গেলে ভুবনকে প্রয়োজন, আবার এলাকা ছেড়ে গেলে খাবে কি, ছেলে মেয়েকে মানুষ করবে কি ভাবে। বউ হরির কষ্টটা বুঝলেও তার কিছু করার উপায় ছিল না। কিন্তু ভুবনের লোক প্রায় দুদিন ছাড়া হরিকে ডেকে যায় ভুবনের সাথে দেখা করার জন্য। এক সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকেই পরাজিত করতে বাধ্য হয় হরি। তার প্রাণ প্রিয় রানি কে আইনত দত্তক নেয় ভুবন। প্রায় সপ্তাহ খানেক মেয়েকে পাঠিয়ে মুখে অন্ন তোলে নি স্বামী স্ত্রী। এদিকে ভবানীর বাড়িতে উৎসব। সন্তান হারা দম্পতি রানীর মত ফুটফুটে মেয়ে পেয়ে যেনো আনন্দে আত্মহারা। একটা একটা করে দিন যায়, হরি আর বউ একটিবার রানিকে দেখার জন্য উতলা হয়ে ওঠে। হরি আর আগের মত ব্যবসার কাজ দেখাশুনা করতে পারে না। দোকানের কর্মচারী পলাশের হাতেই সব দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। ক্রমশ অসুস্থ হয়ে এক সময়ে বিছানা নেয়। ছেলে এত বড় হয়নি যে ব্যবসা সামলাবে। ফলে যা হবার তাই হলো, ব্যবসা লাটে উঠলো। আবার সেই আগের মত নুন আনতে পান্তা ফুরোনর অবস্থা হলো। হরি মাঝে মাঝেই বউকে বলে "আমাদের ঘরের লক্ষ্মী চলে গেছে, তাই এই অবস্থা"। ভুবন কিন্তু লোক মুখে সব শুনতে পায়, তবু আর সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না। আসলে ভুবন ভাবে হরিকে দেখলে রানি যদি বাবার কাছে ফিরে যেতে চায়, তার চেয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকাই ভালো। কিন্তু ঈশ্বর যা স্থির করে রেখেছেন তা খন্ডাবে কার সাধ্য। হঠাৎ তিনদিনের জ্বরে ভুবনের স্ত্রী মারা গেলো। ভুবন এই শোক সামলাতে না পেরে বিছানা নিলো। খবর পেয়ে হরি অসুস্থ শরীরেও ভুবনের বাড়ি গেলো। বিছানায় শোয়া ভুবনের যন্ত্রণা কাতর মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠলো "আমি সব শুনেছি, তোমাকে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা আমার নেই....." হরির কথা শেষ হওয়ার আগেই ভুবন কাঁপা কাঁপা হাতে হরির হাত দুটি ধরে বলে উঠলো "আমাকে ক্ষমা করিস হরি, তোর প্রাণ কেড়ে নিয়েছেলাম তাই ভগবান আমার প্রাণ কেড়ে নিলেন, তুই রানিকে নিজের কাছে নিয়ে যা, আমি বলছি"। শেষের কথাগুলো বলে কান্নায় ভেংগে পড়ে ভুবন। হরির চোখও শুকনো থাকলো না। রানি আবার ফিরে এলো তার বাবা মায়ের কাছে। হরি ক্রমশ সুস্থ হয়ে আবার আগের মত ব্যবসায় মন দিল। দান করা মেয়েকে ফিরে পেয়ে সামন্ত দম্পতির আর খুশির অন্ত রইলো না।



Rate this content
Log in