Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

5  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

রক্তময়ী বিপ্লবী

রক্তময়ী বিপ্লবী

6 mins
567


১৫ জানুয়ারি,১৯১৯ - সৈন্যরা যখন রোজা লুক্সেমবার্গকে ধরে নিয়ে যাবার জন্য দরজার কড়া নাড়ছিল তখন তিনি শেষ এই কথাগুলো লিখে গিয়েছিলেন-


Order prevails in Berlin! You foolish lackeys! Your “order” is built on sand. Tomorrow the revolution will “rise up again, clashing its weapons,” and to your horror it will proclaim with trumpets blazing:


I was, I am, I shall be!


ঘুটঘুটে অন্ধকার, শীতের রাত। শেষ প্রহর। ১৯১৯ সাল, ১৫ জানুয়ারি। বার্লিন। হত্যা করা হলো জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা রোজা লুক্সেমবুর্গ এবং কার্ল লিবক্রেস্ট-কে।


ইতিহাসে উল্লেখ, হত্যাকারী ‘রিঅ্যাকশনারি ট্রুপস’। কারা এই ট্রুপসে আছেন ? রিঅ্যাকশনারি ট্রুপসের আসল চালনাকারী হোতা কে? দোষী হিসেবে কিছু নাম বলা হয়, তথ্যে গোলমাল। ফলে বিভ্রান্তিও। রাশিয়াকেও দায়ী করেন কেউ-কেউ। যেমন করেছে বহুমান্য সাপ্তাহিক ‘ড্যের স্পিগেল’। করলেও ‘যথাযথ’ প্রমাণের ‘অভাব’। সঠিক কিছু বলা হয়নি।


জার্মান নারীবাদীর তিনিই প্রতীক এখন। তিনিই ‘ব্লাডি’ (ব্লুটিগে) নারী। ওনাকে কুর্নিশ।


রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন উনিশ শতকের প্রতিভাবান এক অসাধারণ বিপ্লবী যিনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছিলেন। সময়টা উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরুর কথা, “জার্মানির বুর্জোয়া সমাজ তখন ক্রস রোডে দাঁড়ানো ছিল, হয় তাদের সেখান থেকে সোশ্যালিজমের দিকে যেতে হবে নয়তো তারা বর্বরতার দিকে যাবে’’। এই কথাগুলো তখন খুব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল চারদিকে, যা রোজা লুক্সেমবার্গের রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। তিনি সেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় এমন দাগ ফেলেছিলেন যা এখন পর্যন্ত মুছে যায় নি। তিনি ছিলেন আলোড়নসৃষ্টিকারী বিপ্লবী এবং অনেকটাই বেপরোয়া। সেই সময় নারী নেতৃত্বের সংগ্রামও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর চারপাশে তাঁর কাজ এবং লক্ষ্যকে আটকানো কিংবা দেয়াল তৈরি করা লোকের সংখ্যা ছিল অগণিত। তবে রোজা থেমে যান নি কিছুতেই, উনিশ শতকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাশীলদের তিনি একজন।


রোজার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা ছিল সমাজের পুঁজিবাদী ও শ্রমিকশ্রেণির বিভাজন কমিয়ে সুবিচার এবং সুসমবন্টন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এই বিষয়টি সেই সময়কার পুরো জার্মান সমাজব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সারা পৃথিবীতে তাঁর চিন্তা ও বিপ্লব লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। রোজা লুক্সেমবার্গ সম্পর্কে যে কথাটা খুব প্রচলিত তা হলো তিনি তাঁর সময়ের এক অসাধারণ প্রতিভাবান নারী বিপ্লবী ছিলেন যার রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক অবস্থান সবকিছুতেই কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন পোলিশ, ইহুদী, অভিবাসী, রাজনৈতিক উদ্বাস্তু এবং শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ নন। রোজার জীবনের এই সবগুলো শব্দকে পাশ কাটিয়ে সমাজ, রাজনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে নিজেকে শক্ত অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করা সহজ বিষয় ছিলনা। এমন মানুষদের সাথে তিনি টক্কর দিয়েছেন যারা সমাজে প্রভাবশালী এবং রোজাকে তারা নীচুস্তরের মানুষ ভাবতেন। শ্রেণি বিভাজন সেই সময় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল।


রোজা লুক্সেমবার্গ (জন্ম মার্চ ৫, ১৮৭০/৭১, মৃত্যু জানুয়ারি ১৫, ১৯১৯) ছিলেন জন্মসূত্রে পোলিশ মার্কসবাদী তাত্তিক, সমাজ দার্শনিক ও বিপ্লবী । তিনি পোল্যান্ড সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তাত্তিক ছিলেন । পরে তিনি জার্মান সোশাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এসপিডি)সাথে জড়িয়ে পড়েন । ১৯১৮ সালের নভেম্বরে তিনি ডি রোটে ফাহরে (বাংলা: লাল পতাকা) পত্রিকা চালু করেন । এসপিডি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সমর্থন দেবার পর তিনি কার্ল লিবটকেনেখট-এর সাথে স্পার্টাসিস্ট লীগ (জার্মান : স্পার্টাকুসবুন্ড ) নামক এক বিপ্লবী দল গঠন করেন যেটা পরে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিতি লাভ করে । লুক্সেমবার্গ ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে এক ব্যর্থ অভ্যুথানের নেতৃত্ব দেন । অভ্যুথান ব্যর্থ হবার পর রোজা লুক্সেমবুর্গ, কার্ল লিবটকেনেখট সহ হাজার হাজার বিপ্লবী ধরা পড়েন ও তাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ।


রোসা লুক্সেমবুর্গ ৫ মার্চ ১৮৭১ সালে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত পোল্যান্ডের সামোসক নামক স্থানে এক ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর তার নাম রাখা হয়েছিলো রোজালিয়া লুক্সেমবার্গ । রোজা লুক্সেমবুর্গ ঠিক কত সালে জন্মেছিলেন তা নিয়ে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে । পুরনো নথীপত্র থেকে এর পেছনে যে কারণটা পাওয়া যায় সেটা হলো তিনি তার স্কুলের সার্টিফিকেট ও জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফর্মে দু'টি ভিন্ন তারিখ লিখেছিলেন । তাঁর পরিবার জার্মান ভাষা এবং জার্মান ভাষায় কথা বলতে পারে এবং লাক্সেমবার্গ রুশ ভাষা ভাষাও শিখত। এই মহীয়সী নারী শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে জন্মালেও সেটা তার জীবনে কোন প্রতিবন্ধক হিসেবে দাড়াতে পারেনি ।


রোসা লুক্সেমবুর্গের পরিবার তার ৯/১০ বছর বয়সে ওয়ারশ'তে স্থায়ী হন । সেখানেই মাত্র ১৫-১৬ বছর বয়সেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন । নিষিদ্ধ ঘোষিত বামপন্থী দল প্রোলেতারিয়েতে যোগ দেন তিনি ।এরপর বছর দুই পর গ্রেফতার এড়াতে তিনি সুইজারল্যান্ড পাড়ি জমান । সেখানে রোজা জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ।

রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন:

দর্শনগত দিক থেকে রোজা বৈপ্লবিক মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী ছিলেন । প্রথম জীবনে তিনি এসপিডির রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী থাকলেও ১৮৯০ সালে বিসমার্ক যখন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন তখন থেকে এসপিডি আস্তে আস্তে ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় আলাদা রাজনৈতিক প্লাটফর্মের কথা চিন্তা করতে থাকেন তিনি । এরই মধ্যে ১৮৯৮ সালে রোজা জার্মান নাগরিকত্ব পান গুস্তাভ লোয়েবেক নামের একজনকে বিয়ে করে । এর পরপরই মধ্যে রাজনৈতিক কর্মপন্থা নিয়ে এসপিডির উচ্চপর্যায়ের সাথে সরাসরি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন । বিতর্ক বিরোধীতায় রূপ নেয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর । যুদ্ধের অর্থসংস্থানে এসপিডি ক্ষমতাসীনদের সমর্থন দিলে রোজা ও তার সঙ্গীরা দলত্যাগ করেন । বিরুদ্ধ আচরণের দায়ে এরপর তাকে আড়াই বছরের কারাবাস দেয়া হয় । জেলে বসেই তিনি কলম চালাতে থাকেন যুদ্ধরত সরকারের বিপক্ষে । এসময়ই তিনি কিভাবে একটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র একনায়কতন্ত্র হয়ে বসে সেটার একটা তাত্তিক কাঠামো দাড় করান । যেটার বাস্তব রূপ পরে হিটলারের উথথানের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাওয়া যায় ।


রোজার জেল মেয়াদ শেষ হবার সময় জার্মানির উত্তরের শহর কিল - এ এক গণআন্দোলন দানা বেধে ওঠে । ৪ নভেম্বর ১৯১৮ তারিখে জার্মানির উত্তরাঞ্চল ৪০ হাজার সৈন্য ও আন্দোলনরত জনতারা দখল করে ফেলে । এরকম একটা উত্তাল সময়ে ৮ নভেম্বর জেল থেকে ছাড়া পান রোজা । বের হয়েই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি । সমমনা সকল বামপন্থী দলগুলো নিয়ে গঠন করেন জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি । অধিকৃত অঞ্চলে ততকালীন সোভিয়েত আদলে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ শুরু করেন তারা । এদিকে সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে কঠোর ব্যবস্থা নেয় । ফ্রাইকর্প নামে পরিচিত কট্টর জাতীয়তাবাদী মিলিশিয়াদের লেলিয়ে দেয় তারা । তাদেরই হাতে ১৫ জানুয়ারি ১৯১৯ সালে সপরিবারে রোজা লুক্সেমবার্গ নিহত হন । তার মৃতদেহ পরে নদীতে ফেলে দেয়া হয় ।


বর্তমান রাজনীতিতে প্রভাব:


বিপ্লব ব্যর্থ হলেও জার্মানি তথা সারা বিশ্বের বাম রাজনীতিতে রোসা লুক্সেমবার্গ একটি স্মরনীয় নাম । জার্মানির বার্লিন শহরে তার একাধিক স্মৃতিসোধ ও রাজপথের নামকরণ করা হয়েছে । এছাড়াও শহরের প্রানকেন্দ্রে একটি উ-বান (পাতাল রেল) স্টেশন তার নামে নামকরণ করা হয়েছে ।

কার্টুনিস্ট কেইট ইভান্স রোজার জীবনী কার্টুন তৈরি করেছেন, তিনি বিবিসিকে বলেছেন, কেন রোজা আজকের প্রতিবাদকারীদের আদর্শ।


১. 'আমি ধনীদের চেতনা ভারাক্রান্ত করে দেব ভোগান্তি আর গোপন, তিক্ত ব্যথার অশ্রু দিয়ে'


১৮৮০ সালে ওয়ারশতে স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থাতেই রোজার এমন ভাবনা ছিল, মানুষে মানুষে বৈষম্য এবং দারিদ্র তাকে পীড়া দিয়েছিল।

২. 'পুঁজিবাদ পুরো বিশ্বকে ঘিরে ফেলছে, তবু সে নিজে টিকে থাকতে পারে না, এর অন্য অর্থনীতির ওপর ভর করার দরকার হয়।'


অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন রোজা। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, পুঁজিবাদ মৌলিকভাবে অস্থিতিশীল এবং চূড়ান্তভাবে এটি বিপর্যয়কর। ২০০৮ সালে পুরো বিশ্ব তার কিছুটা নমুনা দেখেছে।


৩. রোজা লুক্সেমবার্গের বিখ্যাত উক্তি ছিল "সমাজতন্ত্র নাহয় বর্বরতা"


রোজার স্থিরবিশ্বাস ছিল পুঁজিবাদ সংকটে পড়লে কেবল একটিমাত্র উপায়ই খোলা থাকবে।


৪. সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, আর সেজন্য তিনি মানুষকে নিজের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন বরাবর।


৫. মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে শক্ত অবস্থান ছিল রোজার।


তিনি বলেছিলেন, কেবল নিজের সমর্থকদের জন্য যে স্বাধীনতা তা আসলে কোন স্বাধীনতাই না। স্বাধীনতা মানে অতি অবশ্যই বিরোধীদের মত প্রকাশের অধিকার।


তিনি আবার একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।


৬. যুদ্ধবিরোধী ছিলেন রোজা


তার ভাষায় যুদ্ধ হচ্ছে একটি পদ্ধতিগত, সংগঠিত এবং বড় ধরণের হত্যাকাণ্ড।


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন বিরোধী হিসেবে তিনি জেলও খেটেছেন।


৭. পৃথিবী বদলানোর জন্য কোন অজুহাতেই পিছিয়ে যাওয়া সমর্থন করেননি তিনি।


একজন শরণার্থী, নারী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মত বড় বাধা নিয়েও তিনি নিজে সে কাজটি করে গেছেন।


সমাজে যত রকম বাধাই থাকুক না কেন, একজন মানুষের উচিত তা কাটিয়ে সামনে এগুনো---সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন।


তিনি বিশ্বাস করতেন সবক্ষেত্রে সকলের সমঅধিকার পেলেই সমাজের সব অসামঞ্জস্যতা কমে আসবে এবং একদিন হয়ত তা বিলুপ্ত হবে। তিনি বলেছিলেন – “that humanity has an inherent yearning for freedom one which cannot be put down with rifles.” (অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার আকাংখা রাইফেল দিয়ে আটকানো যায় না)।


রোজা লুক্সেমবার্গকে বাঙালি পাঠককুলে বিশদ পরিচয় করিয়েছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিশেষত, রোজার পত্রগুচ্ছ অনুবাদ করে।


পৃথিবীব্যাপী হানাহানি, যুদ্ধ আর পুঁজিবাদের দৌড়াত্ম্য বেড়েই চলেছে। বাড়ছে অশান্তি, নৈরাজ্য এবং কট্টোরবাদীদের প্রভাব। সামাজিক বৈষম্য কমেনি, বরং নানারূপে নানাভাবে এসেছে। গত ১০০ বছরে বিশ্ব হয়তো উন্নয়নে এগিয়েছে অনেকদূর কিন্তু সত্যি কোথাও কি সেই অর্থে সমতা এসেছে? ১০০ বছর আগে এমন এক বিপ্লবী নারীকে প্রাণ দিতে হয়েছিল সমাজ এবং মানুষে মানুষে অসমতা কমানোর লড়াই করবার জন্য। হয়তো অসমতা কিংবা পুঁজিবাদের বিস্তার যাতে কেউ রুখতে না পারে তাই রোজা লুক্সেমবার্গের মতো সাহসী প্রাণগুলোকে থামিয়ে দেয়া হয় এভাবেই।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational