শহরটা বদলেছে, আমিও
শহরটা বদলেছে, আমিও
পটভূমি:
দশ বছর পর নিজের পুরনো শহরে ফিরে এসেছে অনিরুদ্ধ।
রেলস্টেশন থেকে রিকশায় চড়ে সেই পুরনো গলিতে ঢোকে—যেখানে ছিল তার ছেলেবেলার বাড়ি, স্কুল, প্রেম, আর অনেক না বলা কথা।
রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করে:
— “কোথায় নামাবো, দাদা?”
অনিরুদ্ধ হেসে বলে:
— “ওই পুকুরটার কাছে... জানো তো? লালটিপ মোড়।”
রিকশাওয়ালা চুপ করে রিকশা চালায়। পুকুরটা এখন আধা ভরাট। পাশের গলি, যেটা একসময় কাঁচা রাস্তা ছিল, এখন পেভার ব্লক পাতা।
অনিরুদ্ধ ভাবে—
“শহরটা তো আগেও বদলাচ্ছিল, আমি বুঝিনি।”
পুরনো দোকানটা নেই, যেখানে তারা বিকেলে চা খেত, এখন সেখানে মোবাইল শোরুম।
দেয়ালে চোখ পড়ে—একসময় যেখানে লেখা ছিল "রিনা ও অনিরুদ্ধ", এখন সেখানে সাদা রং।
সে ভাবে—
“আমার হাতের লেখাগুলোও মুছে গেছে। যেমন রিনার মুখের স্পষ্টতা হারিয়ে গিয়েছে স্মৃতির ঘোলাটে কাচে।”
বাড়ির গেট খোলা দেখে ডাক দেয়:
— “মা... আমি এলাম।”
এক বৃদ্ধা বাইরে এসে থেমে যায়।
চোখে চেনার ঝলক।
— “অনিরুদ্ধ? তুই?”
— “হ্যাঁ মা, তোর ছেলেটা ফিরল।”
মা জড়িয়ে ধরে।
কিন্তু সেই আলিঙ্গনে যেন একরাশ অপরিচয় জমে আছে।
রাতে ছাদের কার্নিশে বসে অনিরুদ্ধ আকাশ দেখে।
তার মনে হয়,
“এই শহর একসময় আমার ছিল, এখন সে আমাকে চিনে না।
আর আমিও তো আগের মতো নেই।
আমরা দুজনেই বদলে গেছি, একে অপরের স্মৃতি হয়ে।”
শহরটা বদলেছে, আমিও... শুধু স্মৃতির কিছু ভাঙা জানালা এখনো খুলে যায় মাঝেমধ্যে।
রাত্রি:
অনিরুদ্ধ ছাদের কার্নিশে বসে।
সামনের মোবাইল টাওয়ারের আলো চোখে লাগে। সেই ছাদ, যেখানে একদিন রিনা তার হাতে এক কাপ কফি দিয়ে বলেছিল,
— “তুই গেলে শহরটা নিঃশব্দ হয়ে যাবে অনি।”
আজ অনিরুদ্ধ ফিরেছে,
কিন্তু শহরটা নিঃশব্দ নয়—
এখন ওভারব্রিজে হর্ন বাজে, লোক চলাচল আগের চেয়ে দ্বিগুণ।
ঘরের ভেতরে ঘড়ি টিক টিক করে চলছে।
অনিরুদ্ধ চোখ বন্ধ করে… আরেক শহর খুলে যায় মনে।
সেই শহর, যেখানে সন্ধে মানেই পাড়ার ফুচকা দোকানে ভিড়। যেখানে মিষ্টির দোকানের দাদা চিনে যেতো, আর বলতো, “আজ ছানার জিলিপি এনেছি তোমার জন্য।”
যেখানে বাসস্ট্যান্ডে রিনা দাঁড়িয়ে থাকতো—
ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, শুধু একবার দেখা হবে বলে।
মায়ের হাতের রান্নায় সেই পুরনো স্বাদ খুঁজে পায় না অনিরুদ্ধ।
মা বদলায়নি, তবুও কিছু যেন অনুপস্থিত।
সে ভাবে—
“আসলে বদল শুধু শহরের নয়, বদল সময়ের।
আমরা সবাই একেকটা ক্যামেরার ফ্রেমে আটকে যাই,
কিন্তু জীবন থেমে থাকে না।"
স্মৃতির শহরে আজও আছে—
একটা কাঁচা রাস্তায় রিনার খালি পা,
চটচটে স্কুলব্যাগ,
আর সেই ফেলে আসা অঙ্ক বই,
যার পেছনের পাতায় অনিরুদ্ধ লিখেছিল—
“I’ll come back.”
সে ফিরে এসেছে।
কিন্তু এখন কেউ পড়ে না সে বই,
কেউ অপেক্ষা করে না ওই রাস্তার মোড়ে।
"বাস্তব শহরটা বদলে গেছে... কিন্তু স্মৃতির ভেতর যে শহর রয়ে গেছে,
সেটা আজও আগের মতো—নীরব, আশ্রয়দাতা, আর কাঁপা কাঁপা এক ভালোবাসায় পূর্ণ।"
