Himansu Chaudhuri

Inspirational

5.0  

Himansu Chaudhuri

Inspirational

আলোয় ফেরা

আলোয় ফেরা

5 mins
3.0K


রতনপুরে নতুন পোস্টিং হয়ে এসেছি সবে মাসদুয়েক হলো। অন্যান্য মফস্বল শহর যেমন হয়, তেমনই। বাসরাস্তার ধারটা বেশ জমজমাট। দোকানপাট, পান সিগারেটের গুমটি, ঠান্ডা পানীয়ের দোকান, লটারির টিকিটের দোকান, বিখ্যাত ডাক্তারের চেম্বার, মারণ-উচাটনসিদ্ধ জ্যোতিষীর চেম্বার, পীরবাবার থান, খানদুয়েক মন্দির, কাঁচা বাজারের জায়গা এইসব মিলিয়ে মিশিয়ে প্রায় শ'খানেক গজ রাস্তা ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে থাকে। তার মাঝে একটা চশমার দোকান আর একটা ওষুধের দোকানের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা উঠে গেছে। সেটা দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে প্রায় হাফ কিলোমিটার হেঁটে গেলে একটা ছোট টিলার উপর আমার হাসপাতাল। আর পাশেই কোয়ার্টার। 


প্রথম আসলে 'পরে যা হয়! জিনিসপাতি, টুকিটাকি আসবাবপত্র কেনাকাটা করতে আমাকে প্রায়ই নীচে বাজার মোড়ে আসতে হচ্ছিলো। আস্তে আস্তে অনেক লোকের সাথেই আলাপপরিচয় হলো। ব্লক হাসপাতালের ডাক্তারবাবু বলে লোকে একটু খাতিরও করে বৈকি! আশেপাশের সব গ্রামের লোকেরাই এই ব্লক হাসপাতালে আসে চিকিৎসার জন্য, তাই আমি না চিনলেও কিছুদিনের মধ্যেই সবাই আমাকে চিনে ফেললো। হয়তো দোকানদার অন্য সব খদ্দেরের আগে আমাকে ছেড়ে দিলো, বা কোন একটা জিনিস কোন দোকানে ভালো পাওয়া যাবে, সেই সন্ধান দিয়ে দিলো। চাকরিজীবনের প্রথম দিকে এতে বেশ অস্বস্তি বোধ করতাম, কিন্তু আস্তে আস্তে এগুলো অভ্যাস হয়ে যায়।


আমি রতনপুরে আসার পরেই দুর্গাপূজা এসে গেল। তারপরে লক্ষ্মীপূজা পেরিয়ে কালীপূজার সময় চলে এলো। ছেলেটা বায়না ধরেছে, ওর জন্য কিছু বাজি কিনবো বলে সেদিন বাজারে এসেছি। ষ্টেশনারী দোকানের অমূল্য বললো, "ডাক্তারবাবু, আপনি বাজারের পিছনে নান্টুর দোকানে যান। ওর মতো তুবড়ি আর রংমশাল কোলকাতাতেও পাবেন না, এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।"


তা গেলাম খুঁজে খুঁজে নান্টুর দোকানে। বাজারের পিছনে ঘুপচি মতো একটা জায়গায় সে তার পশরা সাজিয়ে বসেছে। দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে সবে বলেছি, "তোমার নাম নান্টু?", হঠাৎ দেখি নান্টু তীরবেগে দোকান থেকে নেমে এসে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করছে। তারপরে যখন হাস্যোজ্জ্বল কিন্তু পোড়া মুখটা তুলে ধরছে, তখন চিনতে পারলাম। এ তো আমাদের গালকাটা নান্টু।


"ডাক্তারবাবু, আপনে এখানে? শুনছিলাম বটে, নতুন ডাক্তার এসেছে হাসপাতালে, তা আপনেই তিনি বুঝতে পারি নাই।"


"হুঁ, এই তো মাসদুয়েক হলো। তা তুমি এখানে কতদিন?"


"সেবারের পরেই, ডাক্তারবাবু।" মুখ নীচু করে সে।


আগের পোস্টিংএ আমি যেখানে ছিলাম, সেই জায়গাটার নাম আর বলছি না। খালি এইটুকু জানিয়ে রাখি, জায়গাটা দক্ষিণবঙ্গের একটা সদর শহর, আর রাজনৈতিক ভাবে একটা বারুদের স্তুপের উপর বসে ছিলো সেই সময়। যুযুধান তিনপক্ষই 'লড়কে লেঙ্গে' গোছের, আর তাদের মধ্যে নিত্যি ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা লেগেই আছে, আর সেই ঝামেলা প্রায়শই পেটোবাজি বা বন্দুকবাজিতে গিয়ে শেষ হতো। সেই ছোট শহরে আমি কত যে গানশট ইনজুরি, বা বম্ব ব্লাস্ট ভিক্টিম দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। লেগেই থাকতো এইসব।


ডাক্তার আর উকিলের কাছে নাকি লোকে মিথ্যে কথা বলে না। এর একটা কারণ যদি সুচিকিৎসা বা সুবিচার পাওয়ার আশা হয়, তবে আরেকটা নিশ্চয়ই এই ভরসা যে, গোপন কথাটি রবে যে গোপনে, অর্থাৎ, কথাটা পাঁচকান হবে না। এইসব কারণে সকল রোগী এবং তাদের আত্মীয়পরিজন আমার কাছে অনায়াসে অনেক কথা উগরে দিয়ে যেত। এইভাবেই আমি সকল গুহ্য তথ্যও অনায়াসে জেনে যেতাম। এইভাবেই জানতে পেরেছিলাম, যে ঐ শহরে বোমা অনেকেই বানায়, কিন্তু শিল্পী একজনই, আর তিনি হলেন এই গালকাটা নান্টু। সব পার্টিই ওর কাছে বোম আর পেটোর অর্ডার দেয়, আর তিনি ওয়ান বাই ওয়ান সেগুলো সাপলাই করেন। রীতিমতো ইন্ডাস্ট্রি। সবধরণের পেটোই ওর কাছে পাওয়া যেতো। ছোট, বড়, শুধু আওয়াজআলা বা ধোঁয়াআলা, কাউকে টপকানোর দরকার হলে সেরকম পেটো, স্প্লিন্টার দেওয়া- আরো কত কি! ওকে দেখলে কিন্তু বোঝাই যাবে না যে ইনিই সেই গালকাটা নান্টু। রোগা পাতলা, পাঁচ ফুট চার, ম্যাক্সিমাম পঞ্চাশ কিলো ওজন, ক্রনিক আমাশায় ভোগা রোগীদের মতো চেহারা।। মুখে হাসি আর বিড়ি ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী। আর ডান চোখের নীচ থেকে প্রায় ঠোঁটের কোণ অবধি নেমে এসেছে একটা কাটা দাগ, যা ওর নামের আগে বিশেষণের হেতু। আর দাগের কারণটাও সবাই জানে, ছোট শহরে সবাই সবার হিসেব রাখে। নান্টু তার বৌ পূর্ণিমাকে ওর বাড়ি থেকে উঠিয়ে এনে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলো, সেই দিনই পূর্ণিমা ওর নিজের হাতের কাঁচের চুড়ি ভেঙে নান্টুর গালে ঐ দাগ উপহার দেয়। পরে অবশ্য তারা আদর্শ দম্পতি হয়ে ওঠে। 


একরাত্রে কোয়ার্টারে ঘুমোচ্ছি, রাত তখন প্রায় দেড়টা! হঠাৎ কলবুক এলো ওয়ার্ড থেকে, আর্জেন্ট! তিনজন বার্ন ভিক্টিম এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালাম। গিয়ে দেখি, নান্টু, তার বৌ আর মেয়ে, তিনজনেই বাড়িতে বিস্ফোরণ হয়ে পুড়ে গেছে। হয়তো মজুত করা বোমার বারুদেই বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রত্যেকেরই সিভিয়ার বার্ন। ব্লক হাসপাতালে চিকিৎসা করা অসম্ভব। আমি প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে, স্যালাইন চালিয়ে, তাদেরকে যতদূর সম্ভব স্টেবল করে জেলা হাসপাতালে রেফার করলাম।অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে যখন ওদের পাঠিয়ে দিচ্ছি, তখন, নান্টু শুধু আমার দিকে কৃতজ্ঞ-দৃষ্টিতে একবার তাকিয়েছিলো। 


দু'জন বেঁচে গেলো। নান্টুর মেয়ে আর নান্টু। পুর্ণিমার বাঁচা সম্ভবপর ছিলো না, প্রায় আশি শতাংশ বার্ন।


জেলা হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে আর নান্টুর কোন খবর পাই নি। সে যেন ঐ শহরের মানচিত্র থেকে একেবারে মুছেই গেল। তিনবছর পরে আমিও ট্রান্সফার হয়ে চলে এলাম এই রতনপুরে।


"ডাক্তারবাবু, আপনে বাজি কিনতে এসেছেন? দাঁড়ান আমি আপনারে দিচ্ছি বেছে। ইস্পেশাল তুবড়ি আর রঙমশাল আছে, এট্টু দাঁড়ান। ওরে ও চন্দ্রা, পিছন থেকে ঐ অর্ডারি মালের বস্তাটা বার করতো রে মা।"


এতক্ষণ খেয়াল করি নি, দোকানের পিছনে একটি বাচ্চা মেয়ে বসে ছিলো, সাত আট বছর বয়স হবে। সামনের দিকে ডাঁই হয়ে থাকা বাজি সরিয়ে গুটি গুটি একটা বড় ব্যাগ নিয়ে সে নেমে এলো। এই তাহলে নান্টু আর পূর্ণিমার মেয়ে চন্দ্রা! মেয়েটার মুখে আর গলায় কিছু পোড়া দাগ আর টানটান চামড়া রয়েছে, পোস্ট বার্ন কন্ট্রাকচার। 


"হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেকছিস কি?ডাক্তারবাবুকে প্রণাম কর শিগগিরি, উনি না থাকলে তোকে প্রাণে বাঁচাতে পারতুম নে। সেদিন আপনে অ্যাম্বুলেন্স এর বেবস্থা না করে দিলি ডাক্তারবাবু, কি যে হতো?মা তো গেছেই, মেয়েটারেও বোধ হয় বাঁচাতে পারতাম নি! আপনের দয়াতেই বেঁচে গেলো মেয়েটা।"


ঝুপ করে প্রণাম করে মেয়েটা। আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। নান্টুকে এখন বলা বৃথা, রেফার করা রুগির যদি অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন হয়, তবে তা জোগাড় করে দেয়া বিএমওএইচ এর দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।


"ডাক্তারবাবু, ওর এই পোড়া দাগটা যাবে নে? অপারেশন করলি? কারে আর বলি? আপনে এখন এখেনে এসেছেন, আমার আর কোন চিন্তা রইলো নি। আপনে একটা বেবস্থা করে দেবেন দয়া করি।"


প্লাস্টিক সার্জারি করলে কিছুটা সুরাহা হতে পারে বটে, নান্টুকে সেই কথাই জানাই। তারপরে জিজ্ঞেস করি, "তুমি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আর ওখানে যাও নি?"


বাজি বেছে বেছে একটা বড় ক্যারি ব্যাগে ঢোকাচ্ছিলো নান্টু। হঠাৎ ওর হাত থমকে যায়, মৃদু স্বরে বলে ওঠে,


"নাঃ, ডাক্তারবাবু, কি করতে আর যাবো? পুন্নিমাটারে নিজের দোষেই মেরে ফেললাম। বাড়িটাও পুড়ে গেছিলো। পুলিশের ঝামেলা। জানেন ডাক্তারবাবু, যখন আমার সময় ছিলো, তখন ন্যাতারা আমার পিছু পিছু ঘুরতো। আর আমার যখন দরকার হলো, তখন কেউ আমারে আর চিনতিই পারে না। ওখানে ফেরত গেলে আমার বিপদ হতো। মেয়েটা নিয়ে আর ওখানে যেতে মন সরলো না। এখন এই বাজির কাজ করি। মশলাপাতি তো সব জানাই ছিলো! কি বলেন ডাক্তারবাবু? এখন শুধু দেখতে হয়, যেন সব বাজিতে শুধু আলো হয়। রঙবেরঙের আলো। শব্দ আর ভালো লাগে না ডাক্তারবাবু। কালোয় ছিলাম, আলোয় ফিরিচি ডাক্তারবাবু।" বলে সস্নেহে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নান্টু।


আমি সেই আধো আলো আর অন্ধকারে দেখতে পাই, কেন যেন গালকাটা নান্টুর মুখের কাটা দাগটা চকচক করে উঠেছে।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational