স্বাধীনতার ছদ্মবেশ
স্বাধীনতার ছদ্মবেশ


গল্প - স্বাধীনতার ছদ্মবেশ
কলমে - সায়নদীপা পলমল
১
"আরে দাঁড়া দাঁড়া… বলি এই ছুঁড়ি এ কি পোশাক পরেছিস?"
"কেন ঠাম্মা! জিন্স আর টপ খারাপ কি?"
"তোর ওড়না কোথায়? আর এসব চোঙা প্যান্টেলুন পরে কি বেরোচ্ছিস? ছিঃ!"
"ওহ ঠাম্মা তুমিও না! টপের সাথে ওড়না লাগে না আর এটা জিন্স, এটা এরকমই হয়।"
"হয় বললেই হল! আমাদের বাড়ির মেয়েরা এসব পোশাক পরে না।"
"ঠাম্মা প্লিজ, আমার সব বন্ধুরা পরে…"
"কিন্তু তুই পরবি না। অরুণ এই অরুণ কোথায় গেলি, তোর মেয়ে কি পোশাক পরেছে দেখে যা।"
"এ পোশাক তুমি কোথায় পেলে?"
"বাবা… পুজোতে যে টাকা দিয়েছিল দাদু তার থেকে কিনেছি। আমার সব বন্ধুরা পরে।"
মুখে আর একটাও কথা বলেন না অরুনেশ রায়, একটা শীতল দৃষ্টি নিয়ে তাকান মেয়ের দিকে। মেয়েটা চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে যায়। অরুনেশও সরে চলে যান নিজের কাজে। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চটি জোড়া পায়ে গলিয়ে হাঁটা লাগান নিভা দেবী। তিনি জানেন এবার তার নাতনীটি ঘর থেকে বেরোবে "ভদ্র পোশাক" পরে। উফফ আজকালকার মেয়েগুলো সব সুযোগ পেলেই মাথায় চড়ে বসে! তাদের পরিবারের একটা মান সম্মান নেই! আশেপাশের সাত গাঁয়ের লোক অরুণের বাবাকে এখনও এক ডাকে চেনে… এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হাঁটছিলেন নিভা দেবী। আচমকা মনে হল কেউ যেন কাঁদছে এক নাগাড়ে। আশেপাশে তাকাতেই মনে হল পুকুরের ধারে একটা মেয়ে যেন বসে আছে, সেই হয়তো কাঁদছে। নিভা দেবী আজকাল চোখে ভালো দেখেননা, তাও মনে হল মেয়েটার পোশাকটা অনেকটা তার নাতনীর মত--- গেরুয়া, সাদা, সবুজ রং তার গায়ে। তিনি দ্রুত পায়ে মেয়েটার দিকে এগোতে যেতেই মেয়েটা একটা ঝাঁপ দিল পুকুরে, ঝপ করে একটা শব্দ উঠল। তারপর আবার সব শান্ত… হতভম্ব নিভা দেবী স্থবিরের মত চেয়ে রইলেন সেদিকে।
২
"হ্যালো বাবা।"
"বল ক্লাস কেমন চলছে?"
"বাবা তোমার সাথে কথা ছিল।"
"বল সব ঠিকঠাক তো?"
"না বাবা।"
"কেন কি হয়েছে? হস্টেলে কোনো সমস্যা হয়েছে?"
"না বাবা কিন্তু…"
"তাহলে?"
"বাবা আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ভালো লাগছে না।"
"আহা এই তো সবে গেলি। আর কিছুদিন যাক…"
"বাবা প্লিজ আমার কথা শোনো, আর কিছুদিন গেলেও আমার ভালো লাগবে না। বাবা সপ্তক বলছিল এখনও নাকি বিভিন্ন জেনারেল কলেজে ভর্তি চলছে।"
"তো?"
"বাবা প্লিজ আমাকে বাংলা নিয়ে পড়তে দাও।"
"ইয়ার্কি হচ্ছে? কত টাকা দিয়ে তোমায় ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি করেছি জানো?"
"বাবা আমি সবই জানি কিন্তু…"
"ওসব বাংলা টাংলা পড়ে কোনো ফিউচার নেই।"
"কেন বাবা? তুমি তো সাফল্য পেয়েছো।"
"আমি কি সাফল্য পেয়েছি শুনি? ইস্কুলে বাংলা পড়াই ব্যাস। কত ইচ্ছে ছিল বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো, বিদেশে যাবো…"
"কিন্তু বাবা আমার তো সেটা স্বপ্ন নয়, বাংলা নিয়ে পড়ে গবেষণা করা আমার স্বপ্ন।"
"চুপ… একদম চুপ। আর এইসব নিয়ে বকতে পারছিনা। তোমার সাথে আগেই সব আলোচনা হয়েছিল, তুমি রাজিও হয়েছিলে।"
"কিন্তু বাবা…"
"কোনো কিন্তু নয়, রাখলাম আমি।"
বিরক্ত মুখে ফোনের লাল চিহ্নটায় আঙ্গুল চেপে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অভিরূপ সেন। আর কত বোঝাবেন ছেলেটাকে যে জেনারেল লাইনে পড়ে কিচ্ছু হবেনা! তাঁর সেই ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল তিনি ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তিনি পারেননি তো কি হয়েছে ছেলেকে তিনি ইঞ্জিনিয়ার বানাবেনই। ফোনটা খাটে ছুঁড়ে দিয়ে ওপরের দিকে তাকালেন অভিরূপ সেন, আর তাকিয়েই তার শরীরের রক্ত জল হয়ে গেল। এ কাকে দেখছেন তিনি! ফ্যানের সাথে ওটা কে ঝুলছে! তাঁর ছেলের মতোই না অনেকটা, গায়ের পোশাকটা গেরুয়া, সাদা, সবুজ…!
৩
"কাকে ভোট দিলে?"
"আমি!"
"তা নয়তো কে? কোন চিহ্নে ভোট দিলে?"
"আমি... মানে… "
"কি হল এতো আমতা আমতা করছো কেন?"
"না মানে আমি ***** তে দিয়েছি।"
"কি! তোমাকে যে অতবার করে বলে দিলাম ***** চিহ্নে ভোট দিতে তাও কেন দিলে না? আমাদের ফ্যামিলি বরাবর ***** এই দলকে ভোট দেয়।"
"কিন্তু আমি ওদের নীতিতে বিশ্বাস করিনা। আমার ভালো লাগেনা ওদের মত। আমার তো যাকে ইচ্ছে ভোট দেওয়ার অধিকার আছে তাই না?"
"না নেই। মেয়েরা আবার রাজনীতির কি বোঝে! ভালো মন্দ বোঝো কিছু? যাকে ইচ্ছে দিয়ে দিলেই হল নাকি! এতবার করে বলার পরেও তুমি আমার কথা শুনলে না! আমার ইচ্ছে করছে…!"
দাঁত কিড়মিড় করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রতন প্রামানিক। রাস্তায় নামা মাত্রই দেখতে পেল তাকে। কি নিদারুণ ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে সে তাকিয়ে আছে রতনের দিকে! গেরুয়া, সাদা, সবুজ শাড়িতে কে ওই মেয়েটা…?
৪
"বাবা আমার সব বন্ধুরা তালপাড়ার বি.এড কলেজে ভর্তি হচ্ছে। ওটা সরকারি কলেজ বলে খরচাটা অনেক কম পড়বে?"
"তো?"
"তো মানে… বাবা পরশু কাউন্সেলিং ওখানে। আমার হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।"
"তো?"
"বাবা…"
"আমি কি ফর্ম ফিলাপ করতে বলেছিলাম?"
"না মানে…"
"শোনো ফর্ম ফিলাপ করেছিলে করেছিলে কিন্তু তোমাকে ওসব আর পড়তে হবে না।"
"কিন্তু বাবা আমার সব বন্ধুরা যে পড়ছে।"
"যে পড়ছে পড়ুক। আমাদের গ্রামে উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় সেখানে তোমাকে মাস্টার ডিগ্রি পড়তে দিলাম কিন্তু আর নয়।"
"তাহলে মাস্টার ডিগ্রিটাই বা পড়তে পাঠালে কেন? দু'বছর এতো কষ্ট করে যাতায়াত করে এতো পরিশ্রম কেন করলাম!"
"আমি আর এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চাইনা। তোমার বড় মামা কথা বলে ফেলেছে, সামনের সপ্তাহে তোমাকে দেখতে আসছে।"
"কি! আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলে না তোমরা?"
"বাব্বা শহরে দুদিন পড়তে গিয়েছো বলে আবার তোমার অনুমতি নিতে হবে নাকি?"
"বাবা…"
"গলা নামিয়ে কথা বলো।"
হনহন করে ঘরটা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন সমীর দাস। কিন্তু উঠোনে এসেই হোঁচট খেলেন তিনি। দেখলেন তিনরঙা পোশাক পরা একটা মেয়ে লুটিয়ে পড়ে আছে মাটিতে। হতভম্ব সমীর দাস তাকে তুলতে যেতেই হঠাৎ করে যেন অন্তর্হিত হল মেয়েটা আর সমীর দাস টাল সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে…
৫
"বাবান বাইরের দিকে কি দেখছো?"
"মাম্মাম দেখো ছেলেগুলো ফুটবল খেলছে।"
"হুমম। নাও তুমি এবার তাড়াতাড়ি টাস্কগুলো কমপ্লিট করো, সুইমিং এ যাওয়ার সময় হয়ে গেল।"
"মাম্মাম… ও মাম্মাম… আজ প্লিজ সুইমিং ক্লাসটা অফ করি।"
"মানে?"
"আজকে প্লিজ ওদের সাথে গিয়ে খেলি।"
"পাগল নাকি! সুইমিং ক্লাস অফ করা যাবেনা। জানো তো তোমার কোচ বলছিলেন তুমি খুব ভালো পারফর্ম করছো, আমি শিওর এই ইয়ারেই ওরা তোমাকে মেইন পুলে পাঠিয়ে দেবেন।"
"ও মাম্মাম…"
"না বাবু।"
"তাহলে তুমি ম্যাথ স্যারকে আসতে না বলে দাও, সুইমিং থেকে ফিরে সন্ধ্যেবেলা বাবার সঙ্গে খেলবো।"
"বাবু এরকম অন্যায় আব্দার মাম্মাম শোনে না জানো। আগে পড়া তারপর খেলা।"
ছেলের চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যান সোমা দেবী। আচমকা মনে হয় ফ্রিজের কোণে কে যেন একটা দাঁড়িয়ে আছে। একটা বাচ্চা ছেলে, ওনার ছেলের বয়েসীই হবে। ছেলেটার পোশাকটা অদ্ভুত … গেরুয়া, সাদা, সবুজ। ছেলেটাকে যেন ঘিরে রয়েছে একরাশ অন্ধকার। চমকে ওঠেন সোমাদেবী, ঘরের ভেতর ছেলেটা ঢুকল কিভাবে! দ্রুত পায়ে ফ্রিজের দিকে এগিয়ে যেতেই আচমকা ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে গেল ছেলেটা, শুধু ফেলে গেল গেল ওকে ঘিরে থাকা একরাশ অন্ধকার…
৬
"না না স্যার আর খেতে পারবো না।"
"সেকি! এই দুটো লুচিতেই তোমার পেট ভরে গেলো?"
"হ্যাঁ স্যার, আমাকে বাড়ি যেতে হবে।"
"আরে বাড়ি তো যাবেই। দেখো আজ ভাইঝির জন্মদিন তাই এভাবে পেট পুরে না খাইয়ে তোমাকে ছাড়বো না আমি।"
"কিন্তু বৌদি…"
শ্রীজা আর প্রতিবাদ করার আগেই সুষমা ওর থালায় আরও তিনটে লুচি আর খানিকটা আলুর দম দিয়ে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শ্রীজার ভেতর থেকে, মনে পড়ে যায় কাল সন্ধ্যের দৃশ্যগুলো। বাস পায়নি বলে স্কুল থেকে বাড়ি ঢুকতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। গিয়েই দেখতে পেয়েছিল শ্বশুরের থমথমে মুখ। তারপর নিজের রুমের কাছাকাছি আসতেই রুমের ভেতর থেকে শুনতে পেয়েছিল শ্বাশুড়ির কান্নাভেজা গলা, "দিনকে দিন ও তো আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। চাকরি করতে দিচ্ছি এই কি যথেষ্ট নয়? কটা বাজে দেখ একবার তুই, এটা বাড়ির বউ এর ফেরার সময়! ঘরের কাজ তো নাহয় আমি এই অসুস্থ শরীর নিয়ে করে ফেলবো কষ্ট করে কিন্তু আমরা তো একটা সমাজে বাস করি নাকি, লোকে তো অকথা কু কথা বলবে নাকি!"
শ্বাশুড়ির কথাগুলো শুনতে শুনতে শ্রীজার মনে পড়ে গিয়েছিল একমাস আগে রান্নার লোক রাখার কথা বলতেই শ্বশুর বলেছিলেন বাইরের লোকের রান্না তিনি খেতে পারবেন না। আর লোকের কুৎসা! আর বেশি ভাবতে পারেনি শ্রীজা। রাতুলও কাল থেকে মুখটা গোমড়া করে আছে, কথা বলেনি শ্রীজার সঙ্গে। আজ স্কুল ছুটির পর হেড স্যারের মেয়ের জন্মদিনে এসে আধ খাওয়া করেই ছুটল শ্রীজা, এই বাসটা ধরতে পারলে অন্ধকার নামার আগেই বাড়ি ঢুকতে পারবে সে।
শ্রীজাকে আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকতে দেখেই মনে মনে খানিক হেসে নিলেন মণি দেবী। কাল রাতুলের কাছে কান্নার অভিনয়টা ভালোই কাজ দিয়েছে তাহলে। শ্রীজা নিজের রুমে চলে যেতেই টিভির রিমোটটা তুলে চ্যানেল পাল্টাতে গেলেন মণি দেবী, কিন্তু একি! টিভির পর্দা জুড়ে একটা অচেনা মেয়ে, খানিকটা তার বৌমার বয়সী। পরনে তিনরঙা শাড়ি… মেয়েটার সারা শরীর মোটা শেকল জড়ানো, চোখে তার অবিরত নামছে জল। কে এই মেয়েটা! চশমা খুলে চোখটা ঘষে নিয়ে আবার তাকাতে কোথাও খুঁজে পেলেননা মেয়েটাকে, টিভির পর্দা জুড়ে শুধু no signal এর বার্তা।
৭
বড় রাস্তার পাশে থাকা জঙ্গলের মধ্যে পায়ে হাঁটা সরু পথ। ওই পথ ধরে খানিক এগোলেই দেখা মিলবে ওদের। দুটো শরীর পাশাপাশি শুয়ে। শরীরে স্থানে অস্থানে কুঠারের ঘাত। টাটকা রক্ত এখনও বেরিয়ে যাচ্ছে ওদের শরীর দিয়ে, দুটো শরীরের রক্ত গিয়ে একসাথে মিশছে কোথাও। মাটিটা লালে লাল…
লাখন সিং তার দলবল নিয়ে এলো ঝোরা পুকুরের ঘাটে। কুঠারে লেগে থাকা লাল রক্তটা আগে ধুয়ে সেটা একটা পাথরে রাখল লাখন। তারপর নিজে সন্তর্পণে নামল জলে। তার একমাত্র বোন আনন্দী কবে যে ওই বেজাতের ছেলেটার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কে জানে! পরিবারের সম্মানের কথা একবারও ভাবল না! নাহ পরিবারের সম্মানের সাথে "ছেড়খানি" লাখন কাউকে করতে দিতে পারেনা, নিজের আদরের বোনকেও না। ওদের কৃতকর্মের শাস্তি লাখন দিয়ে এসেছে।
পুকুর থেকে এক আঁজলা জল নিয়ে চোখে মুখে দিল লাখন। তারপর পুকুরের দিকে তাকাতেই আতঙ্কে দু'পা পিছিয়ে এলো সে। পুকুরের জলে ভেসে উঠছে একটা মেয়ের দেহ… পরনে তার গেরুয়া সাদা সবুজ কুর্তা। মেয়েটার শরীর থেকে অবিরত বেরোচ্ছে রক্তের ধারা, ঝোরা পুকুরটা হয়ে উঠছে লালে লাল…
৮
"বল্টু শুনে যা।"
"কি বাবা?"
"শোন তোর পিসা একটা বড় হোটেলে তোর জন্য কাজ ঠিক করেছে। খুব ভালো বেতন।"
"কাজ! হোটেলের কাজ কখন করব বাবা? আমার তো ইস্কুল আছে। স্যার বলেছেন এ বছর থেকে আরও অনেক বেশি করে পড়তে হবে।"
"কেলাস এইট তো পাস করে গেলি, আবার কি?"
"এবার তো মাধ্যমিক।"
"না না আর পড়তে হবে না তোকে। আর কি ফিরি তে পড়া যাবে! এবার তো পয়সা দিতে হবে। আমি পয়সা কোথায় পাবো?"
"কিন্তু বাবা মাধ্যমিক না দিলে চলে নাকি?"
"চলে খুব চলে। আমরা যে লেখা পড়া জানিনা কি হয়ে যাচ্ছে! শোন আগে পেটে খেতে পা তারপর লেখাপড়া। ওসব লেখাপড়া করা বড়লোকদের মানায়।"
"বাবা লেখাপড়া করলে আমি ভালো চাকরি পাবো, তখন তুমি দেখবে তোমাকে আর রাজমিস্তির কাজ করতে হবে না।"
"রাখ তো তোর এসব কথা। বল্টু তুই এখনও অনেক ছোটো, এ দুনিয়ার কিছুই বুঝিস না। লেখাপড়া করলেই চাকরি হয়না। এই তো এখন যাদের বাড়িতে কাজ করছি সেই বাড়ির ছেলেটা কি এইচডি না কি যেন পাস করে বসে আছে ঘরে। বাপের পয়সায় খাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে। আমার অত পয়সা নাই বাপু। মোদ্দা কথা হল কাল তোর পিসার সাতে গিয়ে হোটেলের বাবুর সঙ্গে কথা বলে আসবি। যা এখন।"
বল্টু ঘরের ভেতর চলে যায়। বাইরের কলে হাত পা ধুতে ধুতে রবি খেয়াল করে কিছুটা দূরে একটা ছেলে বই খাতা বুকের ওপর চেপে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবির দিকে। অন্ধকারেও ছেলেটার পোশাকের রংটা রবি বুঝতে পারে স্পষ্ট। রবি কিছু যেন বলতে যায় ছেলেটাকে কিন্তু তার আগেই ওর চোখের দিকে চোখ পড়তেই রবির বুকের ভেতর অবধি কেঁপে ওঠে মুহূর্তে…
৯
"আর নেওয়া যাচ্ছে না এসব, ইচ্ছে হচ্ছে গলায় দড়ি দিয়ে দিই।"
"ছিঃ তিন সন্ধ্যের বেলায় এমন অলুক্ষণে কথা বলতে নেই। কি হয়েছেটা কি?"
"তোমার পুত্রের কল্যাণে এবার দেখছি রাস্তাঘাটে বেরোনোই বন্ধ করে দিতে হবে। যেদিকেই যাই লোকে শুধু জিজ্ঞেস করে রায় বাবু ছেলে কি করছে ছেলে কি করছে!"
"আমি কি করব বাবা, চাকরির যা বাজার! আমি তো চেষ্টা করছি।"
"চেষ্টাই যদি করছো তো এতদিনেও কিছু পেলেনা কেন?"
"বাবা সরকারি চাকরিই কি পেতে হবে? ওটা কি এতোই জরুরি! আমার ইউ টিউব চ্যানেলটা ভালো রেসপন্স পাচ্ছে। এবার যদি একটা ভালো ক্যামেরা আর মাইক কিনতে পারতাম…"
"উঁ… ছেলের কথা শোনো! ইউ টিউব চ্যানেল! ওই করতে গিয়েই চাকরি হচ্ছে না। শুধু বাবার টাকায় ফুটানি। ওই চ্যানেল তোমাকে ক'পয়সা এনে দেয় শুনি? ওর পেছনে আবার খরচ করছে! লজ্জা করেনা তোমার? তোমার জায়গায় আমি থাকলে না…"
"কি করতে বাবা?"
"তোমার ছেলের আস্পর্ধা দেখছো বীণা! ভাবতে পারছি না আমি।"
"ছিঃ বাবু বাবার মুখে মুখে তর্ক করেনা, যাও ঘরে যাও।"
"কিন্তু মা…"
"যাও বলছি।"
নিজের রুমে ফিরে আসে রক্তিম। খাটের ওপর বসে থাকতে দেখতে পায় সেই ছেলেটাকে যে একটা তিন রঙা পোশাক পরে রক্তিমের কাছে আসে রোজ। ছেলেটার নামটা ভারী চমৎকার লাগে রক্তিমের; ছেলেটা বলেছে ওর নাম স্বাধীন। আজ ছেলেটা করুণ দৃষ্টিতে তাকাল রক্তিমের দিকে। রক্তিম তাকে জিজ্ঞেস করে উঠল, "তোমার আসল নামটা কি যেন?"
১০
বাসের ভীড়ে লোকটা আবার বুকটা স্পর্শ করল মৃদুলার। মৃদুলা সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। লোকটার মুখটা চেনা হয়ে গেছে, লোকটার কাজই এটা। ভীড়ের সুযোগে… সেদিন মৃদুলা প্রতিবাদ করতে যেতে উল্টে ওকেই বাসের কিছু লোক কথা শুনিয়ে দিয়েছে--- "আপনারা ফুটেজ খাওয়া মহিলা, সব পুরুষকে এক দলে ফেলেন। ভীড় বাসে বাই চান্স হয়ে গেছে, তাই নিয়ে ইস্যু ক্রিয়েট করার চেষ্টা করছেন…" ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারটা কথা। মৃদুলার ইচ্ছে করছে লোকটাকে চড় মারে কিন্তু…! আজ স্বাধীনতা দিবসের দিনও সকাল সকাল মনটা তেতো হয়ে গেল।
বাসের সিটে বসে কোলে থাকা ব্যাগটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরল অয়ন। বাবার শেষ সম্বলটুকুও তার জন্য দিয়ে দিতে হচ্ছে। লোকটা বলেছে এডভান্সটা ক্যাশে দিতে, তাই তো আজ যাচ্ছে অয়ন। আজ স্বাধীনতা দিবস; লোকটা কি সত্যিই চাকরিটা করে দিতে পারবে? লোকটা কি সত্যিই অয়নকে দিতে পারবে ওর কাঙ্খিত স্বাধীনতা?
বাসে ওঠার আগে মুহূর্তে বকুলের কানে ভেসে এলো টুকরো তিনটে শব্দ, "ম্যাডাম রেট কত?"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বকুল। এখন আর গায়ে মাখতে চায়না কথাগুলো কিন্তু তাও পারে কই। সপ্নীলের সাথে সম্পর্ক ভাঙার পর থেকে বকুল হয়েছে দুশ্চরিত্রা। বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলে যদি বা লোকের চোখে খানিক চরিত্রবান থাকা যেত কিন্তু বকুল চায়নি মা বাবা বা ভাইয়ের সংসারে গিয়ে উঠতে। ও চেয়েছিল নিজের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচতে, তাই ডিভোর্সের পর বাপের বাড়িতে না উঠে একা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি বলে বাসায় ফিরতে রাত হয় রোজ আর তাই পাড়ার লোকের ওকে নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই। প্রায়শই আবার অতি চরিত্রবান কিছু লোকের মুখ থেকে ভেসে আসে এ ধরণের মন্তব্য। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাসের রডটা ভালো করে চেপে ধরল বকুল, পাছে পড়ে যায়...
মায়ের শরীরটা কাল থেকে ভালো যাচ্ছে না। তাও আজ সংগ্রামকে বেরোতে হয়েছে বাড়ি থেকে। পার্টির নেতা রাহুল দা বলে দিয়েছে ওদের স্বাধীনতা দিবসের পদ যাত্রায় সংগ্রামকে যেতেই হবে। বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বলে রাহুল দার ডানহাত মনোজ ফোন করে বলল বাস ধরে ওরা এখন যেখানে আছে সেখানে চলে আসতে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সংগ্রাম। আজ স্বাধীনতা দিবস…
রাস্তায় জ্যামে বাসটা আটকে পড়তেই আশেপাশের কোনো স্কুল থেকে কোনো অজানা শিশুর গলায় ভেসে এলো স্বাধীনতা দিবসের গান,
"ভারত আবার জগত-সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে |
ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান্ হবে,
নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পুরবে!"
মৃদুলা, অয়ন, বকুল, আর সংগ্রামের মন একসাথে জিজ্ঞেস করে উঠল, "কবে?"
শেষ।