STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

5  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

দাম্পত্য

দাম্পত্য

7 mins
1.8K


'বিবাহ বন্ধন' কথাটা সমাজের কিছু মানুষের জন্য আস্তে-আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই পরকীয়ার মোহে জালে আটকে পরছে। বিবাহ একটি খুবই পবিত্র বন্ধন। বিবাহের পর অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ানোর আগে একবার ভাবা উচিত, যার সাথে সাত জন্ম কাটানোর কথা দিয়েছি, পরকীয়ার মোহে জালে আটকে তাকে কতটা অপমান করা হবে! ভালোবাসা, বিবাহের অদৃশ্য বন্ধনগুলোকে আঁকড়ে থাকলে জীবনটা অনেক সুখের হবে।


আজ সকাল থেকেই রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত বন্যা , সত্যর পছন্দের সব খাবার তৈরি করছে নিজের হাতে। করবে নাই-বা কেন? আজ সত্য - বন্যার বিবাহের ৩ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সত্য চৌধুরী কলকাতার এক কর্পোরেট অফিসে উচ্চ পদে কর্মরত। বন্যা রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর। ভালোবেসেই বিয়ে হয় তাদের, ছোটবেলার ভালোবাসার সম্পর্ক বিয়ের পরিণতি পেয়েছিল, দুজনেরই বসতবাড়ি উত্তরবঙ্গে , কিন্তু কর্ম সূত্রে কলকাতার এক ফ্ল্যাটে থাকতে হয় দম্পতিকে। প্রতি বছর আজকের দিনটাতে বন্যা নিজের হাতে রান্না করে সত্যর জন্য, বন্যার হাতের মটন-কষা আর পোলাও সত্যর খুব প্রিয়। প্রতিদিন ব্যস্ততার কারণে বন্যার সময় হয়ে ওঠে না রান্না করার। তবে আজকের দিনটা হাজার ব্যস্ততা সত্যেও ছুটি নিয়ে একসাথে সময় কাটায় দুজনে। কিন্তু এই বছর সত্যর অফিসে বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে জরুরি মিটিং থাকায় ছুটি পায়নি সত্য।। সন্ধ্যায় বন্যা একটা কালো রঙের জামদানি শাড়ির সাথে সোনালী রঙের স্লিভ-লেস ব্লাউজ পড়ে, যা সত্যর দেওয়া উপহার, সাথে খোঁপায় জুই ফুলের মালা। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে ডিপ মেরুন লিপস্টিকের সাথে অসাধারণ মানিয়েছে বন্যাকে। বন্যা এমনি সুন্দর, খুব একটা সাজগোজের দরকার পরে না ওর। কিন্তু যখন সাজে, ওর সৌন্দর্য আরও অনেকখানি বেড়ে যায়। ড্রয়িং রুমটাকেও লাল রঙের বেলুন, গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে সকাল থেকে নিজের হাতে। সত্যকে এইবার সে সারপ্রাইজ দিতে চায়, কারণ প্রতিবার সারপ্রাইজটা সত্যই দেয় বন্যাকে।


ঘড়িতে দশটা বাজতে যায়, বন্যা আর থাকতে না পেরে ফোন করে সত্যকে। এক ফাইভ - স্টার হোটেলের টেবিলে রাখা ফোনটা দু-তিনবার ভাইব্রেট হয়ে কেটে গেল।


"ফোনটা বাজছে তো তখন থেকে, রিসিভ করে নাও..." মেঘা সত্যকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে কথাটা বলল। সত্য মেঘাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে মেঘার নরম ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। মেঘাকে আস্তে-আস্তে কোলে তুলে নিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়। মেঘাও দু'হাতে সত্যকে কাছে টেনে নিলো। সত্য মেঘার কপালে চুমুর পরশ এঁকে দিলো, মেঘা সত্যর বুকের ওপর মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর সত্য বলল, "মেঘা তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?"


"হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?" মাথাটা সামান্য তুলে সত্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল মেঘা ।


"আহা! বলোই না!"


"কতটা জানি না, তবে ভালোবাসি," মেঘা হালকা হেসে জবাব দিলো।


" আমাকে বিয়ে করবে মেঘা ?"


"কি বলছো এসব? তোমার তো বিয়ে হয়ে গেছে!" মেঘা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।


"সে আমি সব ঠিক করে দেবো.. তুমি বলো না, আমায় বিয়ে করবে?"


মেঘা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে উঠলো, " উফ: ছাড়তো এসব কথা, এসব কথা পরে হবে," বলে সত্যকে জড়িয়ে ধরলো। ওদিকে অপেক্ষা করতে-করতে টেবিলের ওপর মাথা রেখে কথন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও টের পায়নি বন্যা ।


মেঘা এখন ফাউন্টেন বারে কাজ করে। সত্যর এক পুলিশ বন্ধু অভিরূপ মেঘাকে আগে থেকে চিনতো, সে-ই এই বারে কাজের সুযোগ করে দিয়েছিল। ছোট বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর গরিব অসুস্থ মা আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য মেঘাকে এমন সব পথেই চলতে হয় সংসার চালানোর জন্য। সত্য অভিরূপ - এর সাথে একবার এই বারে এসেছিলো, তখনই মেঘার সাথে ওর প্রথম আলাপ। সাহায্য থেকে শুরু হয়েছিল ওদের সম্পর্ক প্রায় এক বছর আগে। কিন্তু মেঘার কষ্টগুলোর কথা শুনে-শুনে সত্য মেঘার প্রতি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।


পরেরদিন সকালে কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় বন্যার ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখে কাজের মাসি এসেছে।


"বাবু আজকেও ফেরেন নি?" বন্যাকে ওই অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করে সে । বন্যা কোন উত্তর না দিয়ে বলে, "টেবিলটা পরিষ্কার করে নিও আগে, আমি স্নান সেরে আসছি।"


আজ রবিবার, বন্যার অফ ডে। বাড়িতে টুক - টাক কাজ কর্ম করে ফোনটা হাতে নিয়ে বিছানায় বসে। ফোনটা হাতে নিতেই দেখে সাত্যকির ম্যাসেজ, "সরি বন্যা , রিয়েলি সরি। কাল বাড়িতে আসতে পারিনি, হঠাৎ করে কাজ এসে যাওয়ায় কলকাতার বাইরে আসতে হয়েছে। আমি আজ রাতের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাবো। তুমি সাবধানে থেকো।"


হঠাৎ করে বন্যার সেই দিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো যখন ও প্রথম সত্যর ফোনে মেঘার মেসেজ দেখতে পায়। হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন, বন্যা সবটাই জানে সত্যর আর মেঘার সম্পর্কের ব্যাপারে। তাও ও মুখ বন্ধ করে সবটাই মেনে নিয়েছে, শুধুমাত্র একটাই আশায় যে, সত্য একদিন-না একদিন নিজের ভুল বুঝতে পেরে ঠিক ওর কাছে ফিরে আসবে। তবুও সব কিছু জেনে, না-জানার ভান করতে-করতে মাঝে-মধ্যে ভেঙে পরে সে।


খাটে মাথাটা ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে কানে হেডফোন লাগিয়ে নিজের পছন্দের এক বিদেশি গায়ক Harry Styles-এর গাওয়া Falling গানটা শুনতে থাকে। এটা ওর খুব প্রিয় গান,

"I'm in my bed and you're not here and there's no one to blame But the drink in my wandering hands. Forget what I said..."


গানটা শুনে বন্যার চোখ থেকে ক্রমশ নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়েছে।


রাত আটটা, বন্যা পরীক্ষার খাতা চেক করছে টেবিলে বসে। সত্য ধীরে-ধীরে ঘরে ঢোকে বন্যার চোখটা এক হাতে বন্ধ করে আর এক হাতে হীরের নেকলেসের বক্স বন্যার সামনে ধরে। হঠাৎ করে সত্যর ছোঁয়ায় বন্যা সামান্য কেঁপে ওঠে। চোখ থেকে হাত সরাতেই বন্যা নেকলেসটি দেখতে পায়। বক্সটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বন্যা হালকা হাসি মুখে সত্যর হাতে ওটা দিয়ে বলে, "এটা আমার লাগবে না গো।"


সত্য বন্যাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, "তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?"


"না না, রেগে থাকবো কেন? এতো দামী উপহারের আমার দরকার নেই, আমি তোমার কিছুটা সময় পেলেই খুশি। যদি আমায় কোনও দিন উপহার দিতে চাও, তোমার মূল্যবান সময়টা দিও। ওটাই আমার কাছে যথেষ্ট।"


বন্যার কথা গুলো সত্যর বুকে গিয়ে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে সত্যর মধ্যে। সত্য কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে যায় মাথা নীচু করে। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সত্যর মাথায় নানারকম চিন্তা ভাবনা ঘুরতে থাকে, "আমার কি বন্যাকে সবটা বলে দেওয়া উচিত? আর কতদিন এভাবে মাথা নিচু করে থাকবো? ও তো কোনও অন্যায় করেনি, ওকে এভাবে অন্ধকারে রাখা কি আমার উচিত? না না, আমি কালই আমার আর মেঘার ব্যাপারে সবটা জানিয়ে দেবো। সময় এসেছে একটা পথ বেঁচে নেওয়ার, সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।"


"কিগো, ডিনার রেডি। তাড়াতাড়ি আসো খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।" বাথরুমে দরজায় নক করে বলে বন্যা।


"আসছি..."


ডিনার টেবিলে নীরবতা ভেঙে সাত্যকি হঠাৎ বলে ওঠে, "বন্যা, কাল তোমার ক্লাস শেষ হলে আমার সাথে দেখা করবে আমাদের পছন্দের ক্যাফেটেরিয়াতে?"


"হঠাৎ!!"


"তোমাকে কিছু বলার আছে।"


কথাটা শুনেই বন্যার বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে এটা ভেবে যে, "ও কি এমন কিছু বলবে যেটা আমি শুনতে চাই না?"


না চাইতেও মাথা নেড়ে বন্যা বলে, "আচ্ছা যাবো।"


সকাল থেকেই বন্যার মনে একটা ভয় কাজ করছে, ক্লাস নিতেও অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল তার। কোনভাবে ক্লাসগুলো শেষ করে ক্যাফের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে।


প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ফোনটা আয়নায় ছুড়ে মারে সত্য। মাটিতে বসে পড়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে অনবরত, "কেন করলে মেঘা ? এটা কেন করলে আমার সাথে?"


সত্য গেছিলো মেঘাকে হোটেল থেকে আনতে, ভেবেছিল মেঘাকে সাথে নিয়ে দাঁড়াবে বন্যার মুখোমুখি, সবটা খুলে বলে দেবে যে, ও না চাইতেই মেঘাকে ভালোবেসে ফেলেছে। সবটা স্বীকার করে নেবে, মেঘাকে সমাজের সামনে আপন করে নেবে। কিন্তু রুমে ঢুকে মেঘাকে খুঁজে না পেয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়ে দেখতে পায় টেবিলের ওপর একটা চিঠি রাখা। তাতে লেখা ছিল,

"সত্য কাল তুমি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে আমি তোমায় বিয়ে করবো কি না? সত্যি কথা বলতে, আমি তোমাকে কোনদিন ভালোই বাসিনি। তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছো, মায়ের অসুখের সব খরচ তুমি দিয়েছো। তার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি তোমার কাছে সেদিন পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিলাম মনে আছে? সেটাই তোমার কাছ থেকে শেষ উপকার চাওয়া ছিল। আমি দিল্লি চলে যাচ্ছি সারাজীবনের মতো। প্লিজ আমার সাথে কোনও যোগাযোগ করো না। আমাকে ক্ষমা করে দিও পারলে। ভালোবাসা, বিয়ের বন্ধনে আমি বিশ্বাস করি না। যদি সত্যিকারের ভালোবাসা আজও এই পৃথিবীতে থাকত তবে তুমি তোমার স্ত্রীকে ছেড়ে আমার কাছে আসতে না। পারলে নিজের ভুলগুলো শুধরে নিও..."


ক্যাফেটেরিয়াতে অনেকক্ষণ বসে থেকে বন্যা বাড়ি চলে গেলো, সত্যর ফোনটা ভেঙে যাওয়ায় ফোন করেও পায়নি তাকে। একদিকে যেমন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সে, অন্যদিকে সত্যর জন্য দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়তে লাগল তার।


ব্যালকনিতে পায়চারি করছে বন্যা, হঠাৎ দরজা দিয়ে সত্য প্রবেশ করলো।। ক্লান্ত উদভ্রান্ত ভেঙে পড়া চেহারা দেখে সত্যর দিকে ছুটে গেল বন্যা , "একি কি হয়েছে তোমার?? কোথায় ছিলে এতক্ষণ? ফোন তুলছিলে না কেন?"


অনেকক্ষণ জিজ্ঞেস করার পর নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সত্য, "আমি তোমাকে ঠকিয়েছি বন্যা ,ঠকিয়েছি তোমাকে। অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি আমি, অপরাধী আমি তোমার। তাই সাহস পাচ্ছিলাম না তোমার সামনে আসার... কোন মুখ নিয়ে তোমার সামনে আসবো। আমি..."


সত্যর এই অসহায় অবস্থা দেখে বন্যা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, "প্লিজ কিছু বলো না, আমি জানি সবটা, সব জানি আমি। তুমি যদি বলো আমি তোমাদের মাঝখান থেকে সরে যাবো কথা দিচ্ছি।"


বন্যাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ওর চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সত্য। বলল, "বন্যা...! তুমি সবটা জেনেও??"


বন্যা : "কি করবো বলো... তোমাকে বড্ড ভালোবাসি যে। তুমি তো জানো সেই ছোট থেকে আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসে এসেছি। তুমি ছাড়া আর কোন পুরুষকে আমার জীবনে আসতে দিই নি। এত সহজে হাল ছেড়ে দিই কি করে?? কিন্তু তোমার খুশির জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি।"


সত্য বন্যাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে, "আমাকে ক্ষমা করতে পারবে বন্যা ?"


"আমি তোমার ওপর রেগে নেই একদম... রাগটা নিজের ওপর। আমিই হয়তো তোমায় সুখী করতে পারিনি..."


"না এতে তোমার কোনও ভুল নেই। সব দোষ আমার, আমিই তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মেঘার কষ্টের কথা শুনে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম ওর প্রতি, নিজের অজান্তেই ভুল পথে চলে গেছিলাম। আচ্ছা আমি যদি আবার ফিরতে চাই, সব ভুলে গিয়ে আমাকে আপন করে নেবে? নতুন করে সংসার শুরু করবে আমার সাথে?"


"হ্যাঁ! করবো। তুমি কথা দাও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না?"


সত্য বন্যার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলল, "না, আর কোনদিন কষ্ট দেবো না তোমায়। এভাবেই যতদিন বাঁচবো তোমার পাশে থাকবো কথা দিলাম।"

সত্য বন্যার বুকে মাথা রেখে শান্তিতে চোখ বন্ধ করল।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational