প্রতিবাদী ভালবাসা
প্রতিবাদী ভালবাসা
প্রতিবারের প্রাক - নির্বাচন পদ্ধতির বিধিসম্মত সতর্কিকরনের কারণে গত রাতে বিবেককে বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। তাই আজ ক্যাম্পাস একদম ঠাণ্ডা। কেউ তার রুম থেকে বের হচ্ছে না। তবে তার মানে এই নয় যে ছেলেরা হাতে হাত রেখে বসে আছে, ওরা নিজেদের ভেতরে মিটিং ঠিকই করে চলেছে। এদিকে গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি তার সভা ডেকেছে। যেতে হবে বিপ্লবকে । আজকাল বহ্নিকে একদম সময় দিতে পারছে না সে। তাই বহ্নির মন খারাপ। কড়া ভাষায় বিপ্লবকে বলতে লাগল তোমাকে এসব মিটিং মিছিলে যেতে হবে না। দেখনি তোমার ঐ প্রাণের বন্ধুকে পুলিশ কিভাবে পেটাল? আমি নিজেই তার অবস্থা দেখেছি। ওর অবস্থা খুবই করুণ! তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কি হবে? বিপ্লব বহ্নিকে শান্ত ভাবে বলল, তুমি দুশ্চিন্তা কর না, আমার কিছু হবে না। তুমি প্রার্থনা কর যেন আমরা দেশে এই গণতন্ত্রের দাবি অর্জন করতে পারি। এই বলে বিপ্লব তড়িৎ গতিতে লাইব্রেরি থেকে মিটিংরুমে চলে গেল। বিপ্লব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আর বহ্নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই অবস্থিত মেডিকেল কলেজের । বহ্নির বাবা একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি । সরকারের বহু প্রকল্পের সাথে তিনি যুক্ত। কিন্তু তার মেয়ে বহ্নি এ ব্যাপারে বাবার পক্ষে নেই । কারণ, মানুষের যদি ব্যক্তিগত গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষিত না হয়, তাহলে কি এই সেবামূলক প্রকল্প গুলো শুধুই কি শক্তিমান শাসকের দয়ার দান?কিন্তু বিপ্লবের সঙ্গে তার প্রেম সেই প্রথম দেখা থেকেই। তবে বহ্নির বাবার ছড়ানো ছিটানো গুপ্তচরদের জন্য তাদের এই প্রেম জমে না! তার ওপর বিপ্লব যোগ দিয়েছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে। বিপ্লব অবশ্য শুরু থেকেই অন্যায় অবিচার বিরোধী, সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে ।
বিবেক নামের ছেলেটাকে অহেতুক পিটিয়েছে দেশেরই পুলিশ। রাস্তায় নেমে গণতন্ত্র রক্ষার কথা বলে চিৎকার করাটাই কাল হলো তার! দেশটার যে ভবিষ্যত কি হবে তা ভগবান জানে! সরকার তো সাফ বলে দিয়েছেন এই দেশে কোনরকম বিশৃঙ্খলা, কর্ম দিবস নষ্ট কোনভাবেই বরদাস্ত করা হবে না । এটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায়ে নির্বাচিত সরকার । আবার এটাও বলেছেন যে দেশে অস্থিরতা বন্ধ করে সুস্থির পরিস্থিতি রক্ষার ব্যাপারে যে বা যারা বিরোধিতা করবে তাদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। যার যা ইচ্ছে সেভাবে দেশ চলতে পারে না, কিছু শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে । বহ্নি কাল রাতের কথাগুলো ভাবছে। বহ্নির বাবা বাসায় রাতের খাবার খাওয়ার সময় মার সঙ্গে গল্প করছিলেন যা সবই শুনেছে বহ্নি ! সরকার শান্তিরক্ষকদের আদেশ দিয়েছেন গণতন্ত্র আন্দোলনকারীরা যদি বাড়াবাড়ি করে তাহলে গুলি চালাতে। দু-একটা লাশ পড়লে আন্দোলন এমনিতেই ঠান্ডা হয়ে যাবে। বহ্নির কানে এই কথাগুলো যেতেই ভয়ে কেঁপে উঠল। বিপ্লবের যদি কিছু হয়ে যায়? সে তো বিপ্লবকে অনেক ভালবাসে। তাই সে নিজের মনেই সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক বিপ্লবকে এই আন্দোলন থেকে দূরে রাখবে। আজ দেশের শান্তিরক্ষক তো সরকারের গোলাম হয়ে গেছে। বহ্নির মন কেন যেন বলছে এবার খুব রক্তক্ষয় হবে। যত দিন যাচ্ছে ততই প্রতিবাদী হয়ে উঠছে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। এর মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে সরকারের পুলিশ। বাবার আদেশ ঘর থেকে বেরোতে পারবে না বহ্নি । গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনকারীদের রুখতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কেউ যেন সভা সমাবেশ করতে না পারে। কি করবে বহ্নি ? কিভাবে আটকাবে বিপ্লবকে ? দিনরাত এই চিন্তায় পড়ে গেল সে। আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। আজ তার সাথে দেখা হল বিপ্লবের ।
বেশ কয়েকদিন হলো বিপ্লবের সঙ্গে দেখা নেই বহ্নির। মেডিক্যালের কিছু মেধাবী ছাত্রদেরও পুলিশ ক্যাম্পাস থেকে আটক করেছে। তারা আন্দোলনে সাহায্য করছিল বলে। তার পরও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সভা সমাবেশ চলছে। মাঝে মাঝে পুলিশ কাঁদানো গ্যাস ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দিলেও ছাত্ররা পুনরায় আন্দোলনে নামছে। বহ্নির বাবা তার জরুরী কাজে বাইরে গেলে এই সুযোগে চুপিসারে সে বাসার বাইরে এলো। যে করেই হোক বিপ্লবের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কয়েকজনের সাহায্যে অবশেষে বিপ্লবের সঙ্গে দেখা হলো। বিপ্লবকে লোকসমাগম থেকে আড়ালে এনে বহ্নি বুকে জড়িয়ে নিল। অশ্রুসজল চোখে বহ্নি বিপ্লবকে বলতে লাগল। গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের এই সভা সমাবেশ ও মিছিলে তুমি যেও না। আমি বাবার কাছে শুনেছি পুলিশ তোমাদের ওপর গুলি চালাবে। বিপ্লব বলে উঠল। যাইহোক না কেন,আমরা আর পিছাতে পারব না । আমি আমার অন্য ভাইদের সঙ্গে আগামীকাল রাজপথে মিছিলে যাব এই কার্ফু ভেঙ্গে। এই দেশ আমার মাতৃভূমি , আজ আমাদের প্রকাশ্যে সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ব্যক্তি শাসনের দাস হয়ে থাকতে হবে। বহ্নি বলল আমি অতসব বুঝি না, আমি এইটুকুই জানি যে আমি তোমায় ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি অস্তিত্বহীন। তুমি এই আন্দোলনে যাবে না এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। বিপ্লব বহ্নির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল আমি এটা পারব না। আমরা যদি একে একে সবাই পিছিয়ে যাই তাহলে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে কে? অধিকার আদায়ের লড়াই করবে কে? নাহ,বহ্নি ক্ষমা কর আমায়। এই বলে বিপ্লব সেখান থেকে চলে গেল। আর বহ্নি কান্নাভরা চোখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। বিপ্লব ও অন্য সবাই একযোগ হয়ে জড়ো হয়েছে। কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মিছিলে যোগ দেবেন। সারা রাত ধরে অসংখ্য প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন বানানো হলো।
তাতে লেখা হলো আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চাই। বহ্নির জন্য খারাপ লাগছে বিপ্লবের। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি কিছু করার নেই। সময় মতো সব বুঝিয়ে ঠিকঠাক করে নেবে বিপ্লব । নয়নকে অনেক ভালবাসে সে তাই এত চিন্তা তার। সকাল হলো। আজ সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন । গাছে কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে। ক্যাম্পাসের একটি গাছে চোখ পড়তেই বহ্নির কথা মনে পড়ে গেল বিপ্লবের । কৃষ্ণচূড়া ফুল খুব পছন্দ করে সে। অবশেষে সবাই ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে গণতন্ত্রের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের স্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ত্যাগ করে রাজপথে উঠল। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হলো চারপাশ। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল অগ্রসর হতে লাগল ধর্মতলার দিকে। মিছিলের পেছনের সারিতে রয়েছে বিপ্লব । হঠাৎ কেন জানি না বিপ্লবের মনে হলো বহ্নি আছে তার আশপাশে! ঠিক হলো তাই! বহ্নির হাতেও তখন সুস্থ গণতান্ত্রিক অধিকার চাই ব্যানার। বিপ্লব বহ্নিকে দেখে খুশি হলো। হালকা মুচকি হেসে তারা দু’জনই একসঙ্গে স্লোগান দিতে লাগল। হঠাৎ করে গুলির শব্দ! ছোটাছুটি পড়ে গেল মুহূর্তেই। প্রথম সারিতে যারা ছিল তারা সবাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তাৎক্ষণিক শহীদ হলেন কয়েকজন। চিৎকার চেঁচামেচি আর গুলির শব্দে আকাশ ভারি হয়ে উঠল নিমেষের মধ্যে । বিপ্লবের এক বন্ধু বিপ্লবকে তার হাত ধরে সজোরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। চল পালা, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, অনেকেই মারা গেছে। বিপ্লব তখন বহ্নিকে খুঁজছিল! আচমকা বিপ্লবের চোখ পড়ল রাজপথে পরে থাকা বহ্নির রক্তমাখা লাশের দিকে। আর মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। মনে হতে লাগলো -
এবার একলা পথে আমি
আর শূন্য ঘরে ফেরা ।
ঘরটা হল মিছে –
তাই আবার হারিয়ে যাওয়া।
[বিঃ দ্রঃ এই গল্পটি পুরোটাই কাল্পনিক। ]