Partha Pratim Guha Neogy

Romance

2.8  

Partha Pratim Guha Neogy

Romance

অনামীর প্রতীক্ষায়

অনামীর প্রতীক্ষায়

11 mins
463


নিজের একাকীত্ব আর সোশ্যাল মিডিয়ার জাদু বুঝতে প্রায় সাড়ে চার বছর পর নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে চোখ রাখল অচিন । কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলে সে। তারপর নূতন জিনিসের আকর্ষণে প্রথম কয়েক সপ্তাহ অনেকটা করে সময় দিয়ে কলেজের বন্ধুদের অ্যাড করে। সাথে কলেজের বিল্ডিং, ক্যান্টিন, খেলার মাঠ, ক্লাস রুম, কমন রুম, বিজনদা’র চায়ের দোকানে আড্ডা- যা পেরেছে সব ছবি তুলে ফেসবুক ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একই জিনিস কতদিন ভালো লাগে,মাস ছয় কাটতে না কাটতেই ফেসবুক কেমন যেন একটা একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করল, কারণ এটা যেন একটা নাটকের মঞ্চ আর সবাই কারণে-অকারণে নিজেদের কান্ড-কারখানা দিন-ক্ষণ মিলিয়ে গোটা ব্রহ্মান্ডের সামনে তারস্বরে প্রচার করছে। ধীরে ধীরে অচিন নিজেকে ফেসবুকের একঘেয়ে জগৎ থেকে বের করে নিজের পুরানো বাস্তব জগতে নিয়ে এলো। কিন্তু ততদিনে বাস্তব যে নিজেই ফেসবুক আর ইন্টারনেটের মায়াজালে আটকা পড়েছে এবং যতদিন যাচ্ছে সেই জালের জট আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারল না। যখন নিজের বন্ধুগুলোকে সামনাসামনি কথা না বলে শুধু মাত্র ঘাড় নিচু করে ফোনের মধ্যে ডুব দিতে দেখল আর মুখ তুললেই কে কটা লাইক আর কমেন্ট পেল তার হিসাব করতে শুনল, তখন তার সামনে বর্তমান বাস্তব একেবারে পদ্ম পাতায় ধরা জলের মতো টলটল করে ভেসে উঠল। বন্ধুদের কাছে অন্তর্জাল যেখানে অক্সিজেন হয়ে উঠল আর তার কাছে এই ভার্চুয়াল দুনিয়াটা ফাঁসের দড়ি মনে হতে লাগল। তাই দ্বিতীয়বার ওই আন্তর্জালের জগতে নিজের অন্তর আর ধরা দিল না। বন্ধুরা যত নিজেদেরকে জালের জটে জড়িয়েছে, অচিনের সাথে বন্ধুত্বের সুতো ততই পাতলা হয়েছে । একাকীত্ব কাটাতে গিয়ে গল্প কবিতা উপন্যাসের উপর তার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল। ‘বই মানুষের সব থেকে ভালো বন্ধু’ – এই কথাটা দেখতে দেখতে অচিনের জীবনে সার্থক হয়ে উঠল।


আজ অনেক বছর পর ফেসবুক খুলে দেখল প্রচুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আর ইনবক্সে উপছে পড়া মেসেজের ভিড়। প্রোফাইল ঘুরে পুরানো ছবি দেখতে দেখতে তার কলেজের দিনগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠল। কত সময় পেরিয়ে গেছে তবু মনে হচ্ছে সব কিছু যেন কালই ঘটেছে- সেই ক্যান্টিন-আড্ডা-বন্ধু। ফ্রেন্ডলিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে দেখল বন্ধু সংখ্যা একশো আট হয়ে আছে। একটু মুচকি হেসে মনে মনে ভাবল,-“ ইন্টারনেটের দৌলতে সত্যিই বন্ধুত্বের একশো আট।”


অনেকের প্রোফাইল ঘুরে জানতে পারল বিয়ে হয়ে গেছে, অনেকে বিদেশে আছে- কত সব বাহারি ছবি সাথে কতকিছু লেখা। কেউ আবার প্রেম করছে আর ফলাও করে তার ছবি সহ রবির গান লেখা-


‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম। 

নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী-সম॥‘


কে একজন সেই ছবিতে কমেন্ট করেছে – ‘এই ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই’।


কমেন্টটা পড়েই হা হা করে হেসে উঠল অচিন । অচিনের হাসি শুনে বারান্দা থেকে অচিনের মা বলে উঠল,-“কি রে ! একা একাই হাসছিস! ব্যাপার কি? উঠবি না নাকি? সেই সকাল থেকে কম্পিউটারে মুখ গুঁজে পড়ে আছিস। স্নান খাওয়া করবি, নাকি কোনও ইচ্ছা নেই?”


মায়ের গলা শুনে স্ক্রিনের নীচে ডান দিকের কোণায় তাকাল। ফুটে ওঠা সময় তখন ১১:৫৭ AM।


সময় দেখেই অবাক হয়ে অচিন বলে উঠল,-“এই রে। এতো বারোটা বাজতে চলল। সাধে কি আর বলে যে ফেসবুক করলে সময়ের কোনো জ্ঞান থাকে না। কোথা দিয়ে যে তিন ঘন্টা কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না!”


তাড়াতাড়ি করে গান বন্ধ করে ফেসবুক লগ আউট করতে যাবে তখনই টুং করে একটা শব্দ হল আর সাথে সাথে ইনবক্স লাল হয়ে 1 দেখাল। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টেও লাল হয়ে 1 দেখাচ্ছে।


বেশ কিছুটা কৌতুহলী হয়ে মেসেজ খুলল। একটা হাত নেড়ে হাই জানাচ্ছে অনামী সাহা । তাড়াতাড়ি করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট খুলে সেখানেও দেখল অনামী সাহার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। অনামী সাহার প্রোফাইলে যাওয়ার আগেই টুং করে আরও একটা শব্দ করে অনামিকার দ্বিতীয় মেসেজ ঢুকল-


“অচেনাকে চেনার আশায়

নতুন পথে পাড়ি,

হাতের মধ্যে হাত রেখে

আমি কি বন্ধু হতে পারি? ”


বারান্দা থেকে অচিনের মা আবার বলে উঠলেন,- “ওরে এবার স্নান করে আয়। অবেলায় স্নান করলে আবার তোর ঠাণ্ডা লাগবে।”


তাড়াতাড়ি করে মেসেজটা দেখে প্রথমে লগ আউট তারপর কম্পিউটার বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল অচিন । কম্পিউটার ছেড়ে উঠে আসলেও ফেসবুক থেকে বেরতে পারল না সে। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকল,- “কে এই অনামী সাহা ?” সাথে তার লেখা চার লাইনের ছড়ার শেষ লাইনটা – “আমি কি বন্ধু হতে পারি?”


“প্রোফাইল পিকচার থাকলেও সেটা কোনও মানুষের ছবি না। তার জায়গায় আছে এক গাদা বইয়ের স্তুপাকার ছবি। অনামী নামে কোনো বান্ধবী বা ক্লাসমেট কেউ ছিল বলে মনে পড়ছে না। বন্ধুদের মুখে ফেক প্রোফাইলের কথা অনেক শুনেছি। তবে কি এটাও একটা ফেক প্রোফাইল ? যদি তাই হবে তাহলে অমন একটা ছড়া লিখে পাঠাল কেন বন্ধু হওয়ার জন্য? প্রোফাইলটা ভালো করে ঘুরে দেখতে হবে -কে এই অনামী ।”- এই সব সাত-পাঁচ চিন্তা অচিনকে বেশ কিছুটা অস্থির করে তুলল।


মনের মাঝে চাপা অস্থিরতা নিয়ে তাড়াতাড়ি স্নান করে এসে খাবার টেবিলে বসল। অন্যান্য দিন খাবার টেবিলে বসে মায়ের সাথে নিজের নতুন চাকরী, নতুন জায়গা নিয়ে নানা রকমের অনেক গল্প করে। কিন্তু আজ খাবারের থালা থেকে মুখ তুলল না একবারও। প্রায় গোগ্রাসে থালায় দেওয়া খাবার গুলো গিলতে থাকল। মায়ের নানাবিধ কথায় দু-একবার হুঁ-হ্যাঁ বলে উত্তর দিয়ে তড়িঘড়ি খাবার শেষ করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। তাড়াতাড়ি করার কারণ অচিন বলল,-“একটা আর্জেন্ট মেল এসেছে। একটু কাজ করতে হবে অফিসের।”


নিজের রুমে এসে কম্পিউটার অন করতেই ঢং করে একটা ঘণ্টা বাজিয়ে দেওয়াল ঘড়িটা দুপুর একটা বাজার জানান দিল। একটুও সময় নষ্ট না করে সরাসরি ফেসবুক খুলে বসল বিজন। ইতি মধ্যে আরও কয়েকটা মেসেজ এসেছে অনামীর- ‘অন আছো , আমার মেসেজও দেখছ তবুও কিছু উত্তর দিলে না। এটা আত্মমর্যাদা নাকি ভীরুতা? নাকি একটা মেয়ে নিজে থেকে কথা বলছে বলে নিজের ঘ্যাম বাড়িয়ে নিচ্ছ?’


এর মধ্যে কোনোটাই যে নয় সেটা বলবে কি করে সেটাই বুঝে উঠতে পারল না অচিন । অনামীর মেসেজে লাস্ট সিন দেখাচ্ছে ১২.৩০ pm। তার মেসেজ বক্সের সবুজ আলোটা এখন আর জ্বলছে না। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে তাকে লিখে পাঠাল,-‘তোমায় চিনতে পারছি না ? কে তুমি? এই ভাবতে ভাবতেই সময় চলে গেল।’


চেয়ারের উপর একটু শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে অনামীর প্রোফাইল দেখতে শুরু করল অচিন । যদিও সেখান থেকে অচিন খুব বেশি কিছু জানতে পারল না অনামীর সম্পর্কে। কলকাতা থেকে পড়াশুনা করেছে। সমবয়স্কাই মনে হচ্ছে। অনেক ছবি আছে কিন্তু একটাও তার নিজের ছবি নেই। প্রায় সব ছবিতে প্রচুর প্রচুর লাইক আর কমেন্ট। সেগুলো দেখতে দেখতে কখন যে তার চোখ বুজে এসেছিল নিজেই তার টের পায়নি।


ঢং ঢং করে দু-বার দেওয়াল ঘড়িটা বেজে উঠতে অচিনের ঘুম ভাঙল। কম্পিউটারটাও তার সাথেই ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। মাউসটা একটু নাড়া পেতেই জেগে উঠল আবার। মেসেজ বক্সের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হল অচিন। অনামীর লাস্ট সিন ১০ মিনিট আগে দেখাচ্ছে। অনামী তার মেসেজ দেখেছে অথচ কোনও রিপ্লাই দেয়নি। অচিন লিখে পাঠাল,-‘একটু চোখটা বুজে এসেছিল আর সেই সুযোগেই তুমি মেসেজ পড়ে চলে গেলে। নিঃশব্দে! তবে সব সময় সফল হবে না।’ তারপর একটা স্মাইলি পাঠিয়ে দিল। আরও কিছুটা সময় কেটে গেল ফেসবুকের দিয়ে চেয়ে। এই চৈত্রের অবসন্ন অপরাহ্ন যেন বড়ই দীর্ঘ। আবার একটা অস্থির ভাব তার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুই করার নেই এখন। একটু রোদ পড়লে বিকালের দিকে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার। কিন্তু বিকাল হতে এখন অনেক দেরি। পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখল মা ঘুমাচ্ছে। কিন্তু এখন আর নিজের ঘুম আর আসবে না। কম্পিউটারে হালকা করে কিশোর কুমারের গান চালিয়ে দিয়ে শরৎরচনাবলী তুলে নিল। কিছুটা পড়ল-কিছুতা অন্যমনস্ক হয়ে অনামীর কথা ভেবে সময় কাটাল।


বিকাল হতেই প্রথমেই ক্লাব ঘর তারপর চায়ের দোকানে একটু আড্ডা দিয়ে রাত ন’টার দিকে বাড়ি ফিরল অচিন । রাতের খাবার খেয়েই আবার ফেসবুক খুলে বসল। না- তার শেষ মেসেজটা দেখেনি অনামিকা। তার নামের পাশে সবুজ আলোটা জ্বলছে না। এখন সবে পৌনে দশটা। আরও একটু দেখা যাক। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁতে না ছঁতেই সবুজ আলো জ্বলে উঠল। সাথে সাথে একটা মেসেজ ঢুকল।


-আমায় সফল হতে দেবেনা কিভাবে? নজরবন্দী করে রাখবে বুঝি।


অচিন এবার আর দেরি করল না। তাড়াতাড়ি লিখল- নজরবন্দী নয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই যে এখন ধরে ফেলেছি।


-ওত পেতে বসেছিলে বুঝি ধরবে বলে?


- অনেকটা সেরকম ভাবতে পার। তবে ওত পাতে যারা তারা শিকারী আর বন্ধুরা করে অপেক্ষা।


- ও তাই বুঝি। তাহলে বন্ধু বলে স্বীকার করলে।


-অচেনাকে চেনার জন্য কিছু একটা দিয়ে শুরু করতে হয়। আমাদের না হয় বন্ধুত্ব দিয়ে শুরু হোক।


-আচ্ছা এতো বছর পর আবার ফেসবুকে আসার কারণ কি?


-তেমন কোনো কারণ নেই। অনেকদিন পর ইচ্ছা হল তাই। অকারণটাই কারণ হিসাবে ধরে নাও।


- ধরেই যদি নেবো তাহলে জিজ্ঞাসা করলাম কেন?


-আসলে, আফিসে একটা স্কুল ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। সেই জিজ্ঞাসা করল ফেসবুকে আছি কি না। তাই একটু উঁকি মারা। তা তুমি কি করে জানলে আমি অনেক বছর পর ফেসবুকে এসেছি?


-তোমার লাস্ট আপডেট দেখাচ্ছে july 2015। সেই লাস্ট ছবি দিয়েছো। তারপর আর কোনো কিছু নেই।


-বাঃ বাঃ! তোমার তো দেখছি বেশ গোয়েন্দা প্রতিভা আছে। ক্রাইম প্যাট্রোল থেকে ডাক এলো বলে। 


-আচ্ছা। আমাকে আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে?


- কেন? তোমারটা বুঝি অন্য কিছু ছিল?


অনামীর রিপ্লাই দেখে মুচকি হাসল অচিন । উত্তরে কি বলবে কিছু খুঁজে পেল না। একটু ভেবে নিয়ে লিখল,- তোমার কোনো ছবি নেই প্রোফাইলে। তুমি আসলে কে সেটা বুঝবো কি করে?


-তোমার প্রশ্নটা ঠিক এটা নয়। তোমার আসল প্রশ্ন আমি মেয়ে না ফেক প্রোফাইল থেকে চ্যাট করছি?


-বুঝেই যখন গেছ তাহলে উত্তরটা দিয়ে দাও।


প্রায় মিনিট পাঁচেক কোনো উত্তর এলো না অনামীর দিক থেকে। তারপর একটা অডিও ফাইল পাঠাল সে।


অডিও ফাইলটা প্লে করতেই একটা মেয়েলী কন্ঠে গান বেজে উঠল-‘লাগ যা গলে’।


গানের প্রথম দুটো লাইন শেষ হওয়ার পর একই কন্ঠ বলে উঠল-‘হাই অচিন । এবার বিশ্বাস হল তো।’


অচিন মোহিত হয়ে আবার প্লে করল অডিও ফাইলটা। ওদিক থেকে রিপ্লাই এলো-“ কি হল? কোথায় হারিয়ে গেলে?”


-তুমি কি রোজ রসগোল্লা খাও?


-এটা কেমন প্রশ্ন? গান শুনে বুঝি রসগোল্লার কথা মনে পড়ল?


-অনেকটা তাই। শিব যেমন বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হয়েছে তেমনই হয়তো তুমি রসগোল্লা খেয়ে এমন মিষ্টি কন্ঠ বানিয়েছ।


-ইস্। এমন উপমা শোনালে আমার এখন রসগোল্লা খেতে ইচ্ছা করছে। দেখি ফ্রিজ থেকে কিছু ঝাঁপা যায় কি না।


-তুমি ফ্রিজ থেকে এখন রসগোল্লা চুরি করতে যাচ্ছ ? ধরা পড়লে একেবারে কেলেঙ্কারি কেস।


-ওরে আমার সাধু পুরুষ রে, নিজে যেন কোনো দিন বাবার পকেট থেকে টাকা ঝাঁপেনি। আর আমার বাবার ফ্রিজ থেকে চুরি করছি, অন্যের বাবার নয়।


-অল দা বেস্ট। তা আমার শেয়ার দেবে না ?


-ধরা পড়লে যেটা পাব সেটা পুরোটা তোমায় দেব। খুশি তো?


-থাক। তোমার রসগোল্লা তুমি খাও আমি গান শুনেই খুশি।


মিনিট দুই নীরবতার পর অনামী লিখে পাঠাল- “মিশন সাক্সেস। দুটো মেরে দিলাম।“


-বাঃ। তোমার তো দেখছি বহুমুখী প্রতিভা। তা আর কি কি প্রতিভা আছে?


- বাকি প্রতিভা ক্রমশ প্রকাশ্য। আপাতত নিদ্রাদেবীর স্মরণাপন্ন হতে হবে।


- এতো তাড়াতাড়ি ! এইতো সবে কথা শুরু হল এর মধ্যেই বিদায়ের সুর।


- ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো। বারোটা বাজল বলে। এখন না ঘুমালে আমার ঘুমের বারোটা বেজে যাবে।


সময়টা দেখে অচিন একটু চমকে উঠল। এতো তাড়াতাড়ি দু-ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারল না। বুঝতে পারল আজ আর কথা হবে না। তাই লিখে পাঠাল,- “আবার কখন কথা হবে ?”


-আজ যেমন হল।


একে অন্যেকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল। অচিন কম্পিউটার বন্ধ করে বিছানায় এলো। ভালো সময় কেন যে এতো তাড়াতাড়ি কেটে যায় সেটাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।


সকালে উঠে ফেসবুক খুলে সুপ্রভাত জানাল অনামীকে। কিন্তু সারাদিন কেটে গেল অনামীর কোনো দেখা নেই। একটা চাপা অস্বস্তির মধ্যে সারাদিনটা কেটে গেল। যথারীতি রাতের খাওয়া সেরে ফেসবুক খুলে বসল অচিন । ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁতেই অনামীর চ্যাট বক্সের সবুজ আলোটা জ্বলে উঠল। সাথে সাথে একটা মেসেজ এলো- “শুভ সন্ধ্যা”


- ভেবেছিলাম সুপ্রভাতের উত্তরে শুভরাত্রি পাবো।


- একটা চাপা রাগের আভাস পাচ্ছি। সারাদিন বুঝি অপেক্ষা করছিলে?


- কেন? তুমি বুঝি চাও যে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করি?


- ঈশ্ ! অভিমান দেখছি আকাশ ছুঁয়েছে। সারাদিন কাজের পর এতক্ষণে যে সময় পেলাম।


- রাত দশটার সময় যদি সন্ধ্যা হয়ে থাকে আর সেটা যদি চন্দ্র সূর্য জানতে পারে তাহলে এখুনি তারা ধর্মঘট করবে ধর্মতলার মোড়ে।


- তাই বুঝি ! তাহলে তাদের স্লোগান কি হবে ? “ধর্মতলার মোড়ে, একফালি চাঁদ আটকে গেছে ইলেক্ট্রিকের তারে।“


-তা জানি না। তবে তোমায় ইলেক্ট্রিক শক্ দেওয়ার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবে না।


- কেন? আমি বুঝি তাদের আটকে রেখেছি?


- অবশ্যই। গায়ের জোরে রাতকে সন্ধ্যা বলে সময়কে আটকে দিয়েছ।


- বাঃ রে! কবি লেখকরা নিজেদের লেখায় সময় থমকে দাঁড় করিয়ে দেয় তখন কিছু হয় না আর আমি করলেই দোষ?


- আচমকা একরাশ অনুভূতির টানাপোড়েনের ভিড় মানসিক ভাবে স্থাবর করে দিলে তখনই সময় থমকে দাঁড়ায়। এবার বল এরমধ্যে তোমার কোনটা হয়েছে ?


- আমার তো কিছুই হয়নি। যা হওয়ার তোমার হয়েছে।


- কি রকম ?


- এই যে সারাদিন অপেক্ষা করার পর দশটা বাজার সাথে সবুজ আলো জ্বলে ওঠা, একটা মেসেজ আসা, সব মিলিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভিড় করা অনুভূতির টানাপোড়েন- সময় যে সেখানেই থমকে গিয়েছিল তোমার কাছে, তোমার অজান্তে।


-তুমি দেখছি আমার মনের খবর আমার আগে পড়ে ফেলছ। কি নিয়ে পড়াশুনা করেছ তুমি- সাইকোলজি?​


- কিছু কৌতূহল অপূর্ণ থাকাই ভালো। সব জেনে গেলে যে জানার আগ্রহ শেষ হয়ে যায়।


- তা ঠিক। কিন্তু কিছুই যে জানা হয়নি তোমার সম্পর্কে।


- নাম, ধাম, গোত্র, বাসস্থান, কর্ম আর কর্মস্থান। নিজের মতো বসিয়ে নাও। ঠিক-ভুলটা আপেক্ষিক। আজ যা ভুল, কে জানে কাল হয়তো তা ঠিক। সময় যে প্রবাহমান।


-হুঁ। আর তুমি সেই প্রবাহমান সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছো।


- অবশ্যই। কেন তুমি বুঝি দাও নি ?


-না। আমার সময় যে থমকে গেছে ঘড়ির কাঁটার দশটায়।


- শুনেছি, রাত বাড়লে নেশা বাড়ে। তোমার দেখছি নেশা মাথায় চড়ে বসেছে।


- তোমার বুঝি রাত হয়েছে? এই না বললে সবে কলির সন্ধ্যা।


- কাল যে সোমবার। কাজ নেই বুঝি?


- কালটা কাল বুঝবো। আজ যে আছো তুমি।


- যদি কাল না থাকি কি করবে তুমি?


- রাত জাগা তারা হয়ে অপেক্ষা করব এক অন্য কালের জন্য যেখানে থাকবে তুমি।


- তুমি বড়ই কল্পনাপ্রবণ। বাস্তব কিন্তু অনেক আলাদা।


- স্বপ্ন না থাকলে সেটা সত্যি করার ইচ্ছাটাও যে থাকে না।


- তা কি স্বপ্ন দেখছ?


- আমার স্বপ্নে এসো। নিজ চোখে দেখে নাও।


- ভারি তোমার স্বপ্ন। বয়ে গেছে আমার দেখতে।


- আমন্ত্রণ পত্র প্রত্যাখ্যান করছো। বিনা পত্রে প্রবেশ নিষেধ – সেটা জানতো ?


- তোমার স্বপ্ন বুঝি সার্কাস শো? টিকিট কাটলে তবেই দেখতে পাওয়া যাবে?


- অনেকটা তাই। আমন্ত্রণ পত্র বল আর টিকিটই বল, ওটা না থাকলে অনুভূতির স্রোতে গা ভাসাতে পারবে না যে।


- আমি সাঁতার জানি না। স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে ভরা ডুবি হয় যদি?


- স্বপ্নে মানুষ বাঁচে, তাই ডুবে গেলেও মরে যাবে না।


- আশার আলো দেখাচ্ছো তাহলে। লাইটম্যান হয়ে গেলে নাকি?


- শুধু আশা নয়, ভরসার হাতও বাড়িয়ে দিলাম। 


- হাত যখন বাড়িয়েছো আলোটা বন্ধ করে দাও আর নিদ্রাদেবীর স্মরণাপন্ন হও। সময় বলছে সোমবারের একটা ঘন্টা শেষ হতে চলেছে।


- উফ্! তোমার সাথে কথা বলতে এলেই ঘড়িটা ঘোড়া হয়ে যায়। যাই হোক, কাল আসবে তো ? আমি অপেক্ষায় থাকব একই সময়ে।


- জানি না। কিছুটা অনিশ্চিত থাক। সব কিছু নিশ্চিত হয়ে গেলে মজাটাই হারিয়ে যায় যে।


- তবুও ?


- শুভরাত্রি।


- শুভরাত্রি ও সুপ্রভাত।


অনামীর চ্যাট বক্সের আলোটা আরও কিছুটা সময় সবুজ হয়ে রইল। তারপর সেটা নিভে যেতে অচিন নিজের রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। সারা সপ্তাহ কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও রাত দশটার সময় ফেসবুক খুলতে ভুল করেনি অচিন । কিন্তু অনামীর কোনও সাড়াশব্দ পেল না। অধীর অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকল উইক এন্ডের আশায়। কিন্তু সেখানেও অনামীর দেখা নেই। কয়েকটা মেসেজ পাঠিয়েছিল অচিন । কিন্তু সেগুলো অদেখা হয়েই পড়ে আছে চ্যাট বক্সে। কিছু না জানিয়ে এভাবে অনামীর চলে যাওয়াটা অচিন মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। একটা অন্যমনস্কতা সারাক্ষণ তাকে ঘিরে থাকত। অনামীর পাঠানো গানটা বার বার শুনত। সারাদিন অপেক্ষা করত রাত দশটা বাজার। আর রাত দশটা বাজলেই সব কিছু ছেড়ে ফেসবুক খুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত অনামীর চ্যাট বক্সের আলোটার দিকে- সবুজ হয়ে জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়।


এক দুই করে দেখতে দেখতে প্রায় ছ’টা উইক এন্ড কেটে গেল কিন্তু অনামীর চ্যাট বক্সের আলো আজও ফ্যাকাশে। রাতের খাবার খেয়ে কিছু একটা ভেবে তাড়াতাড়ি অনামীর প্রোফাইল খুলে দেখতে লাগল বিজন। অনামিকার শেষ আপডেট অঞ্জন দত্তের একটা গান শেয়ার করা। শেয়ার করার ডেট ও টাইম দেখে বুঝল যে রাতে শেষ কথা হয়েছিল অনামিকার সাথে সেই সময় শেয়ার করেছিল। গানটা প্লে করার সাথে সাথে ঢং ঢং করে দেওয়াল ঘড়িটা দশটা ঘণ্টা বাজিয়ে রাত দশটার সংকেত দিল। অচিন চেয়ারের উপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। বাতাসে অঞ্জন দত্তের গলায় ভেসে এলো – “আমি আসবো ফিরে, ফিরে আসবো তোমার পাড়ায়।”


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance