Souradip Rakshit

Romance

4.4  

Souradip Rakshit

Romance

পাঁচটা বাইশ

পাঁচটা বাইশ

11 mins
1.0K



                   ১


স্টেশনে ট্রেন থামতেই ভিড় উপচে পড়লো প্লাটফর্মে। এই সময়টায় এরকমই ভির হয়। পাঁচটা বাইশ বাজছে - হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো মাধবী। প্রায় দশ বছর পর সে এখানে এসেছে। নহিলে সৌম্যর সাথে দিল্লিতে থাকতো সে। সৌম্যর ট্রান্সফার দিল্লি থেকে কলকাতায় হওয়ায়, স্ত্রী মাধবী ও ছেলে অনির্বাণকে নিয়ে মনিরামপুরে শশুরবাড়ি এসেছে তিন দিনের ছুটি নিয়ে।


"দাড়াও তো", বলেই রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়লো মাধবী। "কতদিন পর বাড়ি যাচ্ছি, খালি হাতে গেলে হয় বলো?" এই বলে মাধবী কুড়িটা গরম রসগোল্লার অর্ডার দিয়ে দিল। 


"এই যে দিদিমণি। কুড়িটা রসগোল্লা। আপনার হলো ইয়ে - দুশো টাকা।"


বেশ চেনা-চেনা লাগলো গলাটা মাধবীর। ভালোভাবে লক্ষ করতেই তার বুঝতে বাকি থাকলো না যে ছেলেটা আকাশ! কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে ওর? গায়ের রং কালো হয়ে গেছে, মাথায় আগের মতন চুল নেই, চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে আর অনেক রোগা লাগছে ওকে। মাধবীর মনে হলে আকাশকে যেন দশ বছর পর নয়, পঞ্চাশ বছর পর দেখছে। আগের আকাশের সাথে এই আকাশের চেহারার আকাশ-পাতাল তফাৎ! নিজেকে আর সামলাতে পারছে না মাধবী। সব টলতে শুরু করেছে যেন। হটাৎ পাশে দাড়িয়ে থাকা সৌম্যর গায়ে হেলে পড়লো সে।


                   ২


এক লাফে ঘুম থেকে উঠে খাটে বসে পড়লো মাধবী।গায়ে মাথায় ঘাম। দুঃস্বপ্ন দেখেছে বোধয়। তাই হবে। নিজেকে সামলে নিয়ে খাট থেকে নেমে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মাধবী। বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে আজ। সেই হাওয়ার স্রোতে মুগ্ধ হয়েই বোধয় গাছে বসে থাকা পাখিগুলো গান জুড়েছে। বেশ ফুরফুরে ওয়েদার আজ।


কালীপুজোর এক সপ্তাহের ছুটির পর আজ আবার স্কুল শুরু হচ্ছে মাধবীর। ক্লাস টুয়েলভর এই ১৮ বছরের মেয়েটি পড়াশোনায় দারুন ভালো। ক্লাস ওয়ানের পর থেকে এমন একবারও হয়নি যে সে এক থেকে তিনের মধ্যে থাকে নি। তাকে দেখতেও তেমনই সুন্দর। তবে সংসারের অনটনের কারণে এবং খানিকটা নিজের ইচ্ছেতেই টিউশনি করে সে। ৩টে ছেলেকে পড়ায় মাধবী। মাস গেলে ১৮০০ টাকা আয় হয় তাতে। এই টাকাতেই মাধবী তার নিজের খরচ এবং সংসারের টুকটাক খরচ চালায়। 


স্কুল বাড়ির কাছেই, ফলে গাড়ি ভাড়া করে যেতে হয় না, হেঁটেই যাওয়া যায়। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এমন সময় পিছন থাকে কে যেন "মাধবী!" বলে ডাকলো। পিছন ফিরে তাকাতেই একটা ছেলেকে দেখতে পেলো মাধবী। বেশ সুদর্শন চেহারা ওর। ফর্সা গায়ের রং, মাথায় সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল, এক গাল দাড়ি, পরনে একটা জিন্স-এর প্যান্ট আর একটা সবুজ রঙের জামা। আর কাঁধে একটা ব্যাগ।


"হ্যাঁ বলো? কে তুমি?", বলল মাধবী।

"ইয়ে আমি আকাশ", বলল সেই ব্যাক্তি।

"হ্যাঁ বলো। তোমায় আমি চিনি? সরি মনে পড়ছে না তো কোথাও দেখেছি বলে..."

"না না। আসলে তোমার সাথে আমার আজই প্রথম কথা হচ্ছে। ইয়ে মানে তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো?"


মাধবী সময় সচেতন। হাতে সময় নিয়েই বেরিয়েছে সে। তাই বলল, "না না, বলো। কি হয়েছে?"


"ইয়ে মানে তোমায় একটা জিনিষ দেওয়ার ছিল আর কি..."

"কি জিনিষ?"

"ইয়ে মানে একটা-", বলেই ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে সামনের চেনটা খুলে একটা লাল রঙের খাম আর ২টো ডেয়ারী মিল্ক বের করে মাধবীর হতে দিয়ে বলল, "মাধবী, আমার তোমায় ভালো লাগে। তোমায় আমি এই কালীপুজোয় প্রথমবার দেখেই তোমার প্রেমে পরে যাই। Don't get me wrong, but আমি তোমায় ভালোবাসি। প্লীজ এই চিঠিটা পড়ে আমায় উত্তরটা জানিয়ো তোমার? প্লীজ?"


খানিকটা জোর করেই মাধবীর হাতে ওই চিঠিটা আর চকোলেট গুলো ধরিয়ে দিল আকাশ। মাধবী ওকে কি বলবে বুঝতে পারছিল না। এর আগেও অনেকেই প্রপোজ করেছে তাকে। কেউ গোলাপ দিয়ে, কেউ এরকম চিঠি দিয়ে, কেউ কেউ আবার আংটিও দিতে চেয়েছিল, তবে এদের সবাইকেই মাধবী প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে এইবার একটু নার্ভাস লাগছে কেন তার? কিছু না বলেই আবার স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগলো মাধবী। কেউ পিছন থেকে ডাকলোও না আর।


স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খাটে বসে আকাশের দেওয়া চিঠিটা খুলে দেখলো মাধবী। বেশ সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিটায় ছিল- 


প্রিয়,

    তোমায় আমি প্রথম কালীপুজোয় পুজোর মণ্ডপে দেখি। তখন থেকেই আমার তোমায় ভালো লাগে। তোমার সাথে আমি একটা সম্পর্ক তৈরি করতে চাই। কথা দিচ্ছি তোমার কোনো অসুবিধে হতে দেবো না আমি। তোমার অনেক খেয়াল রাখবো। তোমায় আগলে রাখবো। যতনে রাখব।

    তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম। 

                              -আকাশ


মাধবী কোনোমতেই কোনো relationship-এ যেতে চায় না কারণ ছোটবেলাতেই বিয়ের পাত্র ঠিক হয়ে গেছে তার জন্য। তার বাবার বাল্য বন্ধু শঙ্কর কাকার ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক করা আছে। মাধবী ক্লাস ১২ পাস করলেই তার বিয়ে দিয়ে দেবে বাড়ি থেকে। ফাইনাল পরীক্ষার আর দু মাস বাকি। নিজের মনে "একেও রিজেক্ট করে দেবো, করতেই হবে, কোনো উপায় নেই আর!" বলে স্নান করতে চলে গেলো মাধবী। 


পরের দিন স্কুলে গেল না মাধবী। হয়তো আকাশকে উত্তরে কি বলবে সেই ভয়ই। তবে তার পরের দিন স্কুলে যাবার সময় মাধবী দেখতে পায় আকাশ ঠিক সেই জায়গাটাতেই দাড়িয়ে আছে যেখানে আগের বার দেখা হয়েছিল। মাধবীকে দেখতে পেয়ে আকাশ মাধবীর দিকে এগিয়ে এসে বলে, "কাল এলে না? শরীর ঠিক আছে তো?" 

"হ্যাঁ। মানে না, কাল একটু খারাপ ছিল শরীরটা। তাই আসি নি আর।", বলল মাধবী

"এখন কেমন আছো?"

"ভালই।"

"আচ্ছা চলো এগোতে এগোতে কথা বলা যাক? তোমার দেরিও হবে না, আবার কোথাও হবে।"

হাঁটতে হাঁটতে আকাশ জিজ্ঞাস করলো, "তুমি ক্লাসে ১২ এ পড়ো তো?"

উত্তরে মাধবী বলল, "হ্যাঁ। ক্লাস ১২। আর্টস। তুমি কীকরে জানলে?"

"তোমার ক্লাসমেট রিয়া আমার আত্মীয় হয়। ওর সাথে আমি বেশ ফ্রাঙ্ক। ওর থেকেই জেনেছি।"

"ওঃ। আচ্ছা তুমি কি করো?"

"আমিও ক্লাস ১২ এই পড়ি। তবে কমার্স বিভাগের। তুমি কল্যাণীতে পড়ো তো?"

"হ্যাঁ। তুমি?"

"আমি শরৎচন্দ্রে। স্কুলে রিপেয়ারিং-এর কাজ হচ্ছে বলে এই সপ্তাহটাও ছুটি দিয়েছে আমাদের।"

খানিকক্ষণ দুজনেই একটু চুপ থাকার পর আকাশ বলে, "আচ্ছা তোমার নম্বরটা পাওয়া যায়?"

"আমার নম্বর? না মানে আমি কাউকে আমার নম্বর দি না। রিয়েলি সরি!"

"না না সরির কি আছে? ঠিকই তো! অচেনা কাউকে কেন কেউ নিজের নম্বর দেবে। আচ্ছা আমার চিঠিটা পড়েছিলে?"

এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিল মাধবী। মাধবী একটু চুপ থেকে বলল, "না, একচুয়ালি আমি একদম টাইম পাইনি। অনেক সিলেবাস বাকি। যাইহোক এখন স্কুল এসে গেছে, তুমি আর এসো না, লোকে অন্যকিছু ভাববে। টাটা।" 


এরপর প্রায়ই স্কুলে যাবার সময় দেখা হয় মাধবীর আকাশের সাথে। ওরা ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। কিন্তু হটাৎ আকাশের আর পাত্তা নেই। স্কুল যাবার সময়ই যা দেখা সাক্ষাৎ হতো তাদের। কিন্তু হটাৎ কি হলো আকাশের? ২ দিন হয়ে গেল দেখা করেনি ও। কোনো বিপদ-টিপদ? এইসব ভাবছে মাধবী তখনই হটাৎ ওর ফোনটা বেজে ওঠে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল? কে? ফোনটা হাতে নিতেই মাধবী দেখে আকাশ কল করছে ফেসবুক থেকে। ফোনটা তুলে "হ্যালো" বলতেই আকাশ এক নিশ্বাসে বলে গেল, "হ্যালো? মাধবী? সরি তোমার সাথে দেখা করতে পারছি না কদিন। আরে আসলে আমার স্কুল খুলে গেছে, আর স্কুলে এখন রোজ যেতে হবে অ্যাটেনডেন্স এর জন্য। নহিলে পরীক্ষায় বসতে দেবে না। আর তোমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো রাস্তাও ছিল না। তাই ফেসবুকে তোমার প্রোফাইল খুঁজে ফোন করলাম। Busy? ডিস্টার্ব করলাম?"

"আরে না না। ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার না। আর দেখা সাক্ষাৎ চলে যাচ্ছে নাকি? আবার দেখা হবে পরে। ভালো করে মন দিয়ে পড়াশোনা করো তুমি।"

"হ্যাঁ তবে তোমার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা কি পেতে পারি এবার? আমি ফেসবুক সেরকম ইউজ করি না। তাই আর কি..."

"আচ্ছা লেখো। নাইন এইট থ্রি টু জিরো থ্রি সেভেন ফাইভ সেভেন ফোর।"

"থ্যাংক ইউ।"

"ওয়েলকাম। রাখছি হ্যাঁ। কাজ আছে। টাটা।"

"টাটা।"


                   ৩


 বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে আকাশ আর মাধবী। ২জন ২জনের ব্যাপারে কত কিছু জেনেছে। আকাশ জেনেছে, মাধবী ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো, ওর প্রিয় রঙ লাল, প্রিয় খাবার মাংস ভাত, ইত্যাদি। তেমনি মাধবী জানতে পেরেছে যে আকাশের ওর বাড়ির লোকেদের সাথে সময় কাটাতে সব থেকে বেশি ভালোবাসে। আকাশের বাবার একটা মিষ্টির দোকান আছে, সেটার আর একটা শাখা আকাশ ক্লাস ১২ এর পর খুলবে ওর বাবার সাথে। আকাশ ক্লাসে rank করেনা ঠিকই, কিন্তু ও যদি কোনো কাজ করবে বলে ঠিক করে, তাহলে সেটা করেই ছাড়ে। আকাশ আর মাধবীর পছন্দ অপছন্দ প্রায় এক। মিউজিক টেস্টেও সেম-ই বলতে গেলে। তাই ওদের মধ্যে বনিবনাটাও বেশ ভালো। দুজন দুজনকে খুব ভালো বুঝতে পারে।


একদিন রবিবার মাধবী স্নান করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে এসে দেখে আকাশের মিসড কল। রিং ব্যাক করতে যাবে এমন সময় আকাশ নিজেই আবার ফোন করছে। 

"হ্যালো...", বলল মাধবী।

"হ্যালো মাধবী?", বলল আকাশ।

"হ্যাঁ বলো।"

"বলছি আজ তোমার বিকেলে তো কিছু থাকে না, দেখা করবে?"

"কখন? কোথায়?কেন?"

"না মানে এমনি। অনেকদিন দেখা হয়নি তো তাই। দেখা করবে? ওই ধরো সন্ধ্যে নাগাদ। ছ'টা?"

"কিন্তু কোথায়?"

"হুম, আসো না। ভেবে নেবো রাস্তায়।"

"আচ্ছা দেখছি।"

"দেখছি না। আসতেই হবে।"

"দেখছি দেখছি।", এই বলে ফোনটা রেখে দিল মাধবী আর বাড়িতে বলে দিল যে সন্ধ্যে বেলা রঞ্জনার বাড়ি যাবে।


মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠলো। পাঁচটা বাইশ বাজছে। দূরে স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল শোনা গেল। মাধবী বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ-টুক ধুয়ে নিয়ে জামা কাপড় পড়তে লাগলো। ঠিক পৌনে ছ'টায় মাধবী বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই জায়গায় গিয়ে হাজির হলো যেখানে আকাশের সাথে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল। আকাশ এখনো আসে নি। একটা ফোন করবে কি মাধবী? না থাক। চলে আসবে ঠিক। "একটু অপেক্ষা করি।", বলে রাস্তার পাশে একটা বট গাছের তলায় পাতা একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লো মাধবী। মিনিট দুই তিন পরই আকাশ এসে হাজির হল। এসেই দেরি করার জন্যে ক্ষমা চাইলো। তার পর দুজনেই হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক হলো গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসা হবে। প্রায় পাঁচ ছয় মিনিট হাঁটার পরই ওরা পৌঁছে গেল রামমোহন ঘাটে। এই ঘাটে ভিড় বেশি থাকে না। কেউ আসে না এই দিকে খুব একটা। আর আজ কোনো কারণে ঘাটটা একদমই নির্জন। ওরা ঘাটের সিড়িতে গিয়ে বসলো। "বাড়িতে সব ঠিক আছে তো মাধবী?", জিজ্ঞেস করলো আকাশ।

"হ্যাঁ। তোমার?", মাধবীর তরফ থেকে উত্তর এলো।

"হ্যাঁ হ্যাঁ। আমার বাড়িতেও সবাই ঠিকই আছে।"

"টেনশন হচ্ছে তোমার?"

"কিসের টেনশন? পরীক্ষার?"

"হ্যাঁ"

"আরে টেনশন কিসের? ভালো করে পড়লেই ভালো মার্কস পাওয়া যায়। আর তুমি তো পড়াশোনায় বেশ ভালো। Rank করো। তোমার চাপ কিসের?"

"না একটু তো লাগবেই! আর বেশিদিন নেই। Rank না করলে বাড়িতে মুখ দেখাতে পারবো না। সবাই ছি ছি করবে। সবাই বলবে যে যে মেয়েটা এত ভালো পড়াশোনায় ছিল, সে এই ভাবে ধেরিয়েছে! আর স্কুলে আমার একটা ইমেজ আছে, সেটাও নষ্ট হয়ে গেলে? স্কুলে শেষ বছর। একটা ইমেজ রেখে যেতেই হবে।"

"সবাই মানে করা?"

"সবাই মানে সবাই! পাড়ার লোক, আত্মীয় স্বজন সবাই!"

"আরে কে তোমায় কি বলবে সেই নিয়ে তুমি ভাবলে তো কিছুই করতে পারবে না। এর থেকে তোমার যা ভালো লাগে তাই করো। তোমায় কেউ আটকাবে না। তুমি একটা পাখির মতন। খোলা আকাশে নির্দ্বিধায় উড়ে যাও। তোমায় কেউ কিছু বলবে না। আর যারা বলবে তারা জীবনেও তোমার মতন উড়তে পারবে না। তারা উড়তে পারবে না বলেই তোমায় ডিমোটিভেট করে তোমায়ও উড়তে দেবে না। বুঝলে?"


বেশ খানিকক্ষণ সবাই চুপ হয়ে গেলো। তার পর আকাশ বলে উঠলো, "তুমি একা নও। আমি তোমার সাথে সবসময় আছি। তুমি যখনই উড়তে যাবে, আমি তোমায় সবসময় সাহায্য করবো, যাতে তুমি আরো বেশি দূর পর্যন্ত উড়তে পারো। I want to see you succeed in life।" মাধবী এবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ মাধবীর দিকে তাকিয়ে। দুজনের চোখ একে ওপরের চোখে আটকে গেছে। আকাশ ওর হাতটা মাধবীর গালে হাত রেখে বলল, "আমি আছি সবসময় তোমার পাশে।" আকাশ এবার মাধবীর দিকে এগোলো। চোখ বুজে এলো দুজনেরই।


                  ৪


ঘাট থেকে বেরিয়ে এসে আকাশ মাধবীকে একটা ফুলের দোকানে নিয়ে গেলো। "দাদা একটা গোলাপ কত? দিন তো একটা।" দোকান ছেড়ে একটু এগিয়ে হটাৎ রাস্তাতেই হাঁটু গেড়ে বসে প্রপোজ করলো আকাশ। মাধবী বেশ অপ্রস্তুতে পরে গেলো তখন। মাধবী বলল, "দেখো আকাশ, আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো, কিন্তু তোমায় অ্যাকসেপ্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব না। হয় না এটা।" আকাশ এবার উঠে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন? হয়না কেন?" মাধবী বলল, "সে অনেক কথা। এখন তুমি বাড়ি যাও। আমারও দেরি হয় যাচ্ছে।"


বাড়ি ফিরে মাধবী দেখে বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছে। মাধবী যে রঞ্জনার বাড়ি যাই নি আর তার বদলে একটা ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছে, সেটা একজন চেনা পরিচিত এসে বাড়িতে বলে দিয়ে গেছে। আর এমনকি এটাও বলেছে যে মাধবী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ওকে সংযত রাখা দরকার। 


আকাশের ব্যাপারে সব কিছু জেনে গেল মাধবীর বাড়িতে। এর পর মাধবীর বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিল ওর বাড়ি থেকে। এমন কি পড়াশোনাও বন্ধ করে দিয়েছে মাধবীর। টিউশনগুলোও বন্ধ হয়ে গেলো। ওর থেকে ওর ফোনটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। 


এই ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই মাধবীর বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে যায়। শাড়ি, গয়না, তত্ত্ব, ইত্যাদি সব কেনাকাটি শুরু হলো। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। আগামী ১৮ই ফেব্রুয়ারি। কার্ড চাপানো হলো "Madhobi Weds Soumaya"। আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ পর্বও শেষ হয়ে গেল। এর মধ্যে আকাশের সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি মাধবীর। হবেই বা কীকরে? মাধবীর ফোন নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর একা বেরোতেও দেওয়া হয়না ওকে কোথাও। 


বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ বাকি। হটাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা রিয়া এসেছে মাধবীর সাথে দেখা করতে। মাধবীর ঘরে গিয়ে বসলো ওরা দুজনে। রিয়া বলল, "এই মাধবী। শোন। তুই একবার একটু manage করে বেরোতে পারবি? এখন? খুব দরকার। Urgent! দেখ না রে।"

"এখন? ইমপসিবল! আমায় বেরোতেই দেয়না এখন একা। আমার ফোনটাই নিয়ে নিয়েছে ওরা। আমি আমার কোনো বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করতে পারি না আর। হবে না রে। সরি।", কাঁপা, ভারী গলায় উত্তর দিল মাধবী।

"আরে তোর জন্যেই বলছি। আমায় আকাশ বলেছে তোকে নিয়ে যেতে। একবার চল প্লিজ।"

"না রে। সম্ভব নয়। তবে আকাশকে-", বলেই মাধবী একটা কাগজ আর পেন বের করে কি একটা লিখতে লাগলো। 


আকাশ, 

জানি তোমার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া খুব কঠিন, কিন্তু তোমায় এটা মেনে নিতেই হবে। তুমি আমার সব থেকে ভালো বন্ধু ছিলে। তোমার সাথে কাটানো সময় গুলো কোনোদিনও ভুলে যাবো না। তুমিও একটা নতুন জীবন শুরু করো। 

                                ইতি

                                মাধবী


চিঠিটা লিখে রিয়ার হতে দিয়ে মাধবী বলল, "এই চিঠিটা আকাশকে দিয়ে দিস। আর বলিস আমি ভালো আছি।"


রিয়া চলে যাবার পর ঘরে এসে হাউ হাউ করে কেঁদেছে মাধবী। এই কদিনে সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে সত্যি করেই আকাশের প্রতি একটা অনুভুতি জন্মেছিল ওর মধ্যে। কীরকম অনুভূতি তা বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। কিন্তু হাজার চেষ্টা করলেও এখন আর কিছুই করা যাবে না। আকাশের সাথে শেষ দেখাটাও আর হল না মাধবীর।


                    ৫


চোখ মেলতেই মাধবী বুঝতে পারে বিছানায় শুয়ে আছে সে। বিছানার পাশে বসে ঘুমাচ্ছে সৌম্য। কিছুই ঠিক করে মনে পরছে না মাধবী। খুব ক্লান্ত লাগছে। মাথাটাও ধরে আছে। শরীরটা কীরকম ভারী হয়ে আছে। আসতে আসতে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো সে। সৌম্যর ঘুমটাও হটাৎ ভেঙে যায় এবার। মাধবীকে এরকম অবস্থায় দেখতে পেয়ে ওকে আবার শুইয়ে দেয় আর বলে, "শুয়ে রেস্ট নাও এখন। তোমার শরীরটা ভালো নেই না! চুপ করে শুয়ে রেস্ট নাও। কোনো কিছু দরকার হলে আমায় বলো, আমি দিচ্ছি। আমি আছি তো তোমার সাথে সবসময় নাকি?" 

"কি হয়েছিল আমার?", জিজ্ঞেস করলো মাধবী।

"ও কিছু না। এতটা জার্নি করে এসেছ বলে একটু মাথা ঘুরে গিয়েছিল। এই যা।"

"কতক্ষন অজ্ঞান ছিলাম আমি?"

"আরে বেশিক্ষণ না গো। এই তো দশ পনেরো মিনিট। তুমি চিন্তা করো না তো। কিচ্ছু হয়নি তোমার। একটু রেস্ট নাও তো তুমি। একটু পরেই চাঙ্গা হয়ে যাবে দেখবে।"


বাড়ি ফেরার দিন মাধবী সেই মিষ্টির দোকানটা আবার খেয়াল করলো। ওপরে হোডিংয়ে লেখা ছিল "মাধবী মিষ্টান্ন ভান্ডার" তার নিচে ছোট্ট করে একটা নাম লেখা, "আকাশ" আর ভিতরে সেই ছেলেটা।।


                  সমাপ্তি

           - Mr. Zimba


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance