শেষের স্পর্শ
শেষের স্পর্শ
নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জল। আকাশে উড়ছে কত পাখি। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে মত্ত সাদা মেঘ। নীল আকাশটাকে লালচে করে ঢোলে পড়েছে সূর্য। নদীর জলের শব্দ, পাখিদের কলরব, হাওয়ায় পাতার খস খস আওয়াজ- সব মিলিয়ে কেমন মায়াবী পরিবেশ তৈরি করেছে যেন আজ। আগে তো তেমন কোনোদিনও অনুভব হয়নি। বা হয়তো তেমন খেয়াল করে নি। এই নিস্তব্দতায় বোধহয় বেখেয়ালি জিনিষ গুলো বেশি খেয়ালে আসছে।
নদীর পাড়ে সবুজ ঘাসে বসে আছে সুজয়। নদীর ওপার পেরিয়ে কি যেন দেখছে। ওর পাশে, একটু জায়গা ছেড়ে বসে আছে রানি। এই দূরত্ব কি পরিস্থিতি তৈরি করেছে? নাকি ওদের অদৃষ্ট? রানি আকাশে উড়ন্ত পাখিগুলোকে দেখছে। কি জানি হয়তো এটাই ভাবছে যদি কোনোদিনও ওই আকাশে খেলে বেড়ানো পাখিগুলোর মত ওরও ওরকম স্বাধীনতা থাকতো।
সুজয়ের দিকে মুখ ফেরালো রানি। বলল, "অন্য দিন তো অনেক কথা বলো। আজ কেন চুপ?"
আবার সব নিস্তব্দ। কানে আসতে লাগলো প্রকৃতি। তারপর গম্ভীর শান্ত গলায় সুজয় বলল,"বোধহয় আজই শেষ বলে একটু বেশি চুপচাপ।"
রানি কিছু বলল না। ও বুঝতে পারছে সুজয়ের ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে। সুজয়ের ওকে ছাড়া তো কেউ নেই। নিস্তব্দতা কাটিয়ে এবার সুজয় বলল,"মনে আছে? এখানে প্রথমবার যেবার এসেছিলাম?"
"সে কি ভোলা যায়? কি সুন্দর সেদিন পাখিতে গান গাইছিল। চারিদিকে ঠান্ডা হাওয়া যেন শান্ত করে রেখেছিল জায়গাটাকে। উদ্দাম নদীর জলস্রোত। সেদিন আকাশ কালো ছিল। হটাৎ বৃষ্টি নামলো। ঝম ঝম করে আমাদের ভিজিয়ে দিল বৃষ্টির এক একটা কনা। নদীর মাছগুলো কেমন উঠে আসতে চাইছিল যেন। আকাশের পাখিগুলো নিজেদের ঘর খুঁজছিল। পায়ের নিচের ঘাসগুলো যেন কতদিন পর তৃপ্তি পেলো। আর এইসবের সাক্ষী ছিলাম আমরা।"
"তারাও তো আমাদের প্রথম স্পর্শের সাক্ষী।"
রানি মাথা নিচু করল। বলল,"মেঘের প্রতিটা টুকরো আমাদের গা স্পর্শ করছিল। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমি দেখছিলাম তোমায়। হটাৎ যেন মাথার ওপরে অনেকগুলো ঝাড়বাতি একসাথে জ্বলে উঠলো, পরক্ষণেই আবার নিভে গেল। আকাশের কোন প্রান্তে যেন মেঘ চিৎকার করে উঠলো। একবার। আরো একবার। আমি ভয় পেলাম। আমি তোমায় জোরে চেপে ধরলাম। তুমি তোমার শক্ত হাতে আমায় তোমার বুকে টেনে নিলে। আমার মনে হলো যেন আর কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি সব বিপদের থেকে সুরক্ষিত। আমার ক্ষতি করে কোন পাগলে। তুমি আমার মাথায় তোমার হাত রাখলে। আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে। কি নরম সেই অনুভূতি। এক নিমেষে সব ভয় যেন কোথায় হারিয়ে গেল। আমি তোমার দিকে তাকালাম। তুমি আস্তে আস্তে আমার মুখের দিকে এগোলে। আমি অপেক্ষা করছিলাম তোমার সেই ছোঁয়ার। চোখ বুজে এলো। সব অন্ধকার। আমি অনুভব করলাম আমার ঠোঁটে একটা নরম স্পর্শ। আমার বুকটা ছড়াৎ করে উঠলো। সেটা ভয়ের অনুভূতি ছিল না। ওটা আনন্দের অনুভূতিও ছিল না। কি ছিল সেটা? আজ মনে করি নিশ্চয়তার।"
"বেশ সাজিয়ে কথা বলো তুমি। এর পরেও বলবে?"
"হ্যাঁ। যদি তোমার সাথে আবার দেখা হয় কখনো।"
"আবার কি দেখা হবে?"
"যদি আমার মন খারাপ করে কোনোদিনও, আমি আসবো, এই জায়গাটাতে। জানি তুমি থাকবে না। হয়তো তখন বুকে জড়িয়ে ধরে 'আমি আছি তো' বলার কেউ থাকবে না। তবুও আসবো। জায়গাটা বড়ই শান্ত। বড়ই আপন, সুজয়।"
সুজয় কোনো কথা বলল না। আবার দূরে কিসের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। রানি বলে উঠলো,"আমরা পালিয়ে গেলে..."
সুজয় কোনো কথা বলতে দিল না আর। রানির কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠলো,"না রাই। তা হয় না। তোমার বাবা অনেক কষ্টে সব প্রস্তুত করেছেন। এখন এইসব...না রাই।"
"কিন্তু আমাদের স্বপ্ন?"
"মানুষ তো বেঁচে থাকেই স্বপ্নের হাত ধরে। যেখানে স্বপ্ন মৃত, মানুষও মৃত। বা কিছু সম্পর্ক। আমরা আমাদের স্বপ্নের আঙ্গুল ধরেই তো বেঁচে ছিলাম এতদিন। এখন সেই স্বপ্নকে মিথ্যে করে দিয়েছে তোমার বাবার স্বপ্ন। তাই আমাদের সম্পর্কেরও যে মৃত্যু ঘটলো রাই।"
"আমি তো চাইনা সুজয়, আমার বাবার কথা মত..."
এবারেও রানির কথা শেষ হলো না। সুজয় বলে উঠলো,"তা কীকরে হয় রাই? তোমার বাবা তোমার ভালোর জন্যেই এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেন। আমিও চাই তুমি ভালো থাকো। আমি কে? এই দু পয়সা রোজকার করে তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করার ক্ষমতা আমার কুলোবে না রাই।"
"আমার যে তোমাকে ছাড়া আর কোনো ইচ্ছে নেই লক্ষ্মীটি।"
"জানি। কিন্তু আমি তোমার সুখের মাঝে বাধা হয়ে থাকতে চাই না। তুমি তার কাছে ভালো থাকবে।"
"আমার সুখ যে তুমিই লক্ষ্মীটি।"
"আমায় অত মান দিয়ো না। আমি তার মর্যাদা রাখতে পারবো না। একদিন তোমায় বলেছিলাম চাকরি পেয়ে বিয়ে করবো। আজ সেটা জুটতে এত দেরি হয়ে গেল যে..."
নিস্তব্দতা আবার নেমে এলো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। কিন্তু এ যন্ত্রণার সাক্ষী হবে অনেক এমন সন্ধ্যে।
"তুমি সত্যিই চাও আমি আমার বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করি?"
"হ্যাঁ। এতে তুমি সুখী হবে।"
"আর তুমি?"
"আমি না হয় বেঁচে থাকবো তোমার মনখারাপের অপেক্ষায়? এখানে? এমন ভাবেই, যেমন ভাবে আমরা আমাদের সোনালী সময়গুলো এখানে কাটিয়েছি।"
"তোমার কষ্টের জন্যে দায়ী আমি।"
"না। তুমি ঠিক নও। আমার কষ্টের জন্যে দায়ী আমিও। আমাদের এই সমাজ। আমাদের চিন্তাধারা। আমরা আমাদেরই বন্দী, রাই। এই খাঁচার থেকে মুক্তি নেই। হয়না।"
রানি সুজয়ের দিকে বিস্ময় তাকিয়ে রহিল। ওদের মাঝে দূরত্ব যেন আরো কত দীর্ঘ হয়ে গেল। রানি বুঝতে পারলো ওদের সাজানো স্বপ্নের ইতি আজই, এখানেই। সুজয় দূরের দৃষ্টি রানির মুখের ওপর ফেললো। বলল,"আজ শেষবারের মতন তোমায় একবার ছুঁতে পারি, রাই?"

