বাজলো তোমার আলোর বেণু
বাজলো তোমার আলোর বেণু


বাজলো তোমার আলোর বেণু
লেখক:- জলি বসু ঘোষ
দৃশ্য ১
কুমোরটুলি পটুয়াপাড়া, কলকাতা
প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী তথা স্বনামধন্য আর্টিস্ট দিবাকর পাল এন্ড সন্সের কর্মশালা
১০ই আশ্বিন, ১৪২৬ (২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯),
রাত ১০:০৫ মি:
কাল মহালয়া, পটুয়াপাড়ায় অন্য সব কর্মশালার মত দিবাকর বাবুদের ও ব্যস্ততার শেষ নেই। সেক্রেটারি রাজেশ এসে দাঁড়ালো, ওনার সামনে। দিবাকর বাবুর ডান হাতে তুলি, বাঁ হাতে ছোট্ট একটা রঙের পাত্র। এই মূর্তিটার শেষ পর্যায়ের কাজ চলছে। এখনো এই ষাট বছর বয়সেও কি হাতের টান !! রাজেশ মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখছিল। অসুরের বুকে বল্লমের খোঁচায় রক্ত বেরোচ্ছে, এত জীবন্ত, রাজেশ তন্ময় হয়ে দেখে। কাজটা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে। তুলিটা রাখার সময় খেয়াল করে দিবাকর, কিছু বলবে রাজেশ?
চমকে তাকায় রাজেশ, হ্যাঁ মানে, আপনার ফোন এসেছিল বাড়ি থেকে, কখন ফিরবেন?
দিবাকর: আজ ইচ্ছে করছে বুঝলে, থেকেই যাই এখানে। একেবারে কাল তর্পণ করে ফিরবো,দাও দিকি ফোনটা বলে দিই।
রাজেশ: সে আপনি থাকুন স্যার, খাবার ব্যবস্থা করছি, কিন্তু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বেন। কাল সারাদিন অনেক ধকল যাবে।
ঠিকই বলেছে রাজেশ, প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী তথা দেশে বিদেশে পুরস্কার প্রাপ্ত স্বনামধন্য আর্টিস্ট এই দিবাকর পাল। তাই এই মহালয়ার দিন খুবই ব্যস্ততা থাকে।
প্রতিবার তিনি গঙ্গা স্নানের শেষে উপবাস করে মায়ের চক্ষুদান করেন। শোভাবাজার রাজবাড়ীর জৌলুসে অন্য বনেদি বাড়ির সম্মন্ধে সবাই অবগত না হলেও এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বনেদি বাড়ির ও অতিপ্রাচীন কিছু সর্বজনীন দুর্গাপূজা হয়। তার বেশ কয়েকটি মূর্তি দিবাকর পালের তত্ত্বাবধানে হয়।
কিছু বাড়ির চন্ডী মন্ডপেই হয়, আবার কিছু বাড়ির ঠাকুর দিবাকরের কর্মশালায় হয়। যেমন মিত্র বাড়ি, পাল বাড়ি এদের বাড়িতে গিয়ে ঠাকুর গড়ার রীতি এখনো বজায় আছে। প্রাথমিক কাজগুলো সব দিবাকরের অধীনে অন্য পটুয়ারা করলেও, চক্ষুদান দিবাকর নিজেই করবেন।
বেশ কয়েকটি বাড়িতে যেতে হবে, ব্যস্ততা প্রচুর। কুমোরটুলির ঘাটে তর্পণ করে প্রথমে বাড়ি যাবেন, তারপর বাড়ির সিদ্ধিদাতা গণেশ ও বাল গোপালের পূজা করে গরদের ধুতি আর উত্তরীয় পরে গাড়িতে উঠবেন। রং, তুলি বা অন্যান্য উপকরণ রাখাই থাকে গাড়িতে।
এ ব্যাপারে তাঁর ছায়া সঙ্গী ভোলার কোনো জুড়ি নেই। কোনো ভুল হবার উপায় নেই। ওনার পুরোনো চাকর পাঁচু দেশে যাবার আগে ওকে দিয়ে গেছে। পাঁচু মাস খানেক বাদে ফিরবে। মধ্যবয়স্ক লোক, কিন্তু দিবাকর বাবুর সঙ্গে ছায়ার মত লেগে থাকে। ভীষণ যত্ন করে। পাঁচুও খুব ভালো, অনেক দিনের পুরোনো, কিন্তু ভোলার জবাব নেই।
দিবাকর ফোনের বোতাম টিপতে টিপতে সস্নেহে তাকালেন রাজেশের দিকে, ছেলেটা খুব চিন্তা করে ওর কথা। বললেন, আচ্ছা বাবা তাই হবে।
রাত্রি ১২টা
একটা খচ খচ শব্দ হচ্ছে কোথায়, দিবাকরের কর্মশালায় শেষের দিকে ওর শোয়ার ঘর, ছোট্ট একটা রুম, ওনার ছেলে আবার এ.সি লাগিয়ে টাগিয়ে আধুনিক করে ফেলেছে। মাঝে মাঝে ওনার ছেলে অর্কও থাকে এখানে।
শব্দটা মনে হয় ঘরের বাইরে থেকেই আসছে, সামনের দিকে তো সবাই কাজ করছে। যাই হোক, উঠে দরজা খুললেন, কি একটা পড়ে রয়েছে রাংতার মত, একটা খাম, নিচু হয়ে তুললেন তিনি, একটা রাংতার কাগজের খাম, মধ্যে কিছু একটা আছে, খুলে বের করলেন।
একটা ছবি, এই জায়গাটা বেশ অন্ধকার, দিবাকর ফিরে এসে খাটে বসলেন, চশমাটা পরে দেখলেন একটা দুর্গার ছবি, আরে এটা তো পালবাড়ির দুর্গার ছবি, কি ব্যাপার বুঝতেই পারছেন না। ছবিটা উল্টোলেন দিবাকর, কি একটা ছড়া আঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখা আছে...
"তুহার বুকের সাহস দেখি,
বড্ড ভালো লাগে,
মায়ের চোখটো আঁকবি পরে,
পরান বাঁচা আগে।
এক দুগ্গার চোখের পানির,
খপর মা কি রাখে?
অন্ধ সাজি থাকুক মা আজ,
শাস্তি দিবো তোকে।
মুর জীবনের চোখের জলের
দামটো দিবার পালা,
রাত পুহালেই জলের তলায়,
অসুর নিধন পালা।"
একটু অবাক হলেন দিবাকর, কোন পাগলের কান্ড এটা কে জানে! যাক অনেক রাত হয়েছে, কালকে অনেক কাজ, সকালে ভাবা যাবে এসব নিয়ে।তিনি চুপচাপ শুয়ে পড়লেন।
১১ই আশ্বিন, ১৪২৬ (২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯),
ভোর ৪:০৫ মি:
ভোরের আকাশ এখনো আলসেমির আড়মোড়া ভাঙছে, দিবাকর পালের কর্মশালার পাশের শিউলি গাছটা থেকে ঝরে পড়া শিউলিফুলের গন্ধ, বেশ কিছু জায়গা থেকে ভেসে আসছে রেডিওতে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই অপূর্ব পাঠ....
"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা;
প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমন বার্তা।
আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নব ভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।
তাই আনন্দিতা শ্যামলীমাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।
আজ চিৎ-শক্তিরূপিনী বিশ্বজননীর শারদ-স্মৃতিমণ্ডিতা প্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।
শিউলিফুলের সুবাস মেখে মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনতে শুনতে বেরিয়ে এলেন দিবাকর।
কুমোরটুলির ঘাটে তুলনামূলক কম ভিড় থাকে অন্য ঘাটের তুলনায়। তাই উনি এই ঘাটটাই পছন্দ করেন তর্পণের জন্য।
প্রায় চল্লিশ বছর আগে তুলি ধরা, কিন্তু আজও চক্ষুদানের ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন থাকেন। মায়ের পুরো মুখই বদলে যেতে পারে ওনার একটু ভুলে।
কুমোরটুলি স্ট্রিট ধরে যখন তিনি ঘাটের দিকে এগোলেন শুনতে পেলেন রেডিও তে বাজছে....
বাজলো তোমার আলোর বেণু,
মাতলো যে ভুবন।
আজ প্রভাতে সে সুর শুনে
খুলে দিনু মন...
কুমোর টুলির ঘাটের একটি অন্ধ বাচ্চা বসে, দিবাকর গঙ্গা স্নানে এলে ওর থেকেই ফুল নেয়।
বাকি কুঁচোকাঁচা যাঁরা ফুল ও পূজার সামগ্রী বিক্রি করে কেউই আসেনি এখনও।
আজও তর্পণের আবশ্যিক সামগ্রী নিয়ে গঙ্গার ঘাটের দিকে এগোলেন। কাল রাতের ঘটনাটায় এখনো কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, তবে আকাশের ওই হালকা লালের আভা গঙ্গায় পরে অপূর্ব লাগছে।
কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলেন উনি, সূর্য উঠতে এখনো একটু দেরি আছে। ঘাটের সিঁড়িটায় গিয়ে বসলেন তিনি....দূরে বাজছে আগমনীর সুর.....
ঠিক তখনই কেউ একজন তাঁর পিঠে হাত রাখলো।
দৃশ্য ২
স্থান চড়িদা গ্রামের সুবল সূত্রধরের বাড়ি,
পুরুলিয়া
মাটির দোতলা বাড়ি, সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে উঠোনটার সোজাসুজি বসত ভিটে, বাম দিকে রান্নাঘর, ডানদিকে একটা পুরোনো ধানের গোলা। ধানের গোলার ঠিক নীচে ছোট্ট একটা ঘরের মত। ওখানে মা শীতলার থান। তার পাশেই
একটা গুদাম ঘর, তাতে ভর্তি ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির জিনিসপত্র।
উঠানে সব বিভিন্ন ছাঁচের মুখ ছড়িয়ে রাখা
সুবল বসে বসে মাটি লেপছে ছাঁচের উপর। বয়স সত্তর মত হবে। পাশে বসে নাতনি সাঁঝলি।
কাপড়ের মধ্যে ছাই লেপছে।
সুবল : ইবারে বুঝলি সারামবিসি লদীটায় টুকুন জল লাই। তাই বুরুডি থেইক্যে মাটি লিয়ে আইসলাম, দ্যাখ কেনে মাটিটো তে আঠা বেশি লাগে, মুর পরানে ডর লাগে, সুকালি পর ফাটি যেতি পারে। ও সাঁঝলি মা দৈড়ায় যা দিকিন, লোটাটা কৈরে জল আনি এই সানকিটোয় ঢাইল্যা দে দিকিন।
সাঁঝলি : মু পারবোক লাই দাদু, দেইখতে পাও না মুর হাইত জোড়া জুঠা। মায়েরে বইলতে পারবিক লাই, সক্কাল থিকে রান্নাঘরেই পরি থাকে। এদিকে ম্যালা কামটো পড়ি আছে। একটু সাহায্যি করলি তো পারেক।
বাপটা তো অনেকগুলান ছাঁচ বানায়ে রোদ্দুরে দি গেছে। হগলগুলি তো শুকাই কাইঠ্যা পানা হই গেছে, আইজ - কাইলের মধ্যি খপরের কাগজগুলান সাটতি হবেক, যা গা জ্বালানি তাপ দিতেছে, চড়চড় করি ফাইট্যা না যায়। কাইল সাইঝের ব্যালায় উহার ছুটো বুইন বিন্তিরে বইললো কাগজ গুলি ফালি কইরতে, করে নাই নাকি!!
সুবল: ভিতর পানে চেয়ে, ও বড় লাটের বিটি, সগলে কি কানে ঠুলি দিহা বইস্যা থাকবেক, না টুকুন জল মিইলবে?
ছিদ্যামের বউ কুসুম ভাতটা চাপিয়ে কলমি শাক কুটছিলো।
আজ সক্কাল থেইক্যে মরদ টার লাইগ্যা পরানডা কেমন টাটাইতেছে ক্যান কে জানে! আগেও তো গেছে সাঁঝলির বাপ কামের লগে, তখন তো পরানে এমন আকুলি বিকুলি করে নাই। হেই যেবার মাঠাবুরু পাহাড়টোকে পাখি পাহাড় বানাইবার কাম মিইললো, কত্ত দিন পরে আইলো তক্ষনও তো এমনডা হয় নাই, মা শেতলা দেইখ্যা রাইখো মানুষটারে। প্রণাম করলো দুই হাত জোড় করে।
এমন সময় শ্বশুরের ডাকে চমকে উঠলো, ভাতের ফ্যান গড়ায়, মাইলসাটারে নামায় দি এক লোইট্যা জল লিয়ে ছুটলো।
সাঁঝলি : মা, বিন্তিরে পাঠায় দিস না, কাগজ গুলি সাটুক, আঠা জাইলে বসায় দিইলি?
কুসুম: জিভ কেটে বললো এক্কেবারে ভুলি মারছি দ্যাখছোস, টুকুন খাড়া আমি হেই গেলুম আর এলুম। অ বিন্তি , দিদি ডাইকতেছে ইদিক পানে আয় দেহি মা।
সুবলের ছেলে ছিদাম গেছে কইলকাতায়। কি একটা বড় ম্যালা হইবেক, উখানে গেরামের মাইনষ্যের তৈরি জিনিস বিচা কিনা হবেক।
অনেকগুলি মুখোশ লিয়ে গেছে।
এই তো কয়দিন আগের কান্ড। ভাদর মাসের পথ্যম সপ্তাহ হবেক, সক্কাল সক্কাল সেই কইলকাতার খপরের কাগজের বাবুরা আইলো, সে একখান জবর কান্ড বটেক।
কিসব ফুকনলের পারা যন্তর লিয়ে, কি নাকি ভিডিও ক্যমরা না কি যেন আজব পানা নাম, ওইটা দিয়ে খুটুস খুটুস করি ফটোক তুইললো।
তারপর একখান কালোপানা লাঠির মুইখ্যে আবার কালো মতন ন্যাকড়া জড়ানো, সিটা ধরি কততো পেস্ন বাপরে বাপ, হেইসব নাকি খপরে ছাইপবে তাঁদের দুখের কতা, টিভিতেও তো দেইখ্যে ছিল...
ছিদাম ছেনি লিয়ে ছাঁচ গুলো তৈয়ার করছিলো সেই দিন, সুবল তো আর আগের মতন জোয়ান লয়, তাই কাঠের উপর হাতুড়ি ঠুইকতে হাঁপ ধরে।
ছিদ্যামের সাথেই বেবাক কতা বইললো, মেলায় যাওয়ার কতা ওরাই তো বইলে গেলো।
তার শরীলটা নিয়ে ব্যাটায় খুব চিন্তা করে গত বৎসর ওই শিমুলতলায় ক্যাম্পটো হলো, শহর থিকে সব কত বড় বড় ডাগদার বাবুরা আলেন, সঙ্গে সব ফর্সা পানা বিটিছেইল্যারা আইলো,তকন দেখাতি গিয়েছিল সুবল, ছিদাম জোর কইরা ধইরা বাইন্ধা লিয়ে গেইলো তারে।
একটু গতর লারলেই বুক খানিতে যেন হাঁপর পানার মতন উঠানামা করে, কয়েক রাত্তিরে তো বেইদনাও হইলো। ছিদ্যামের মায় তেইল দিয়া বুকে ডইলা দিলি পর টুকুন পরানে শান্তি মিললো।
ডাগদার বাবুরা কি সব দাওয়া নিকে দিলো, আর ফটোক তুইলতে বললো বুকের। সুবল তো হাঁ করি তাকাই রইলো, ইসব আবার কি, মিথ্যি বলবেক লাই একটুসখানি ডর ও ছ্যালো পরানে। ও তো শুইনছে হসপিটালি গেলি সুঁই ফুটায়।
তাপ্পর ম্যালা পয়সা গ্যালো, পাথরডি হাসপাতালে ফটোক তুইললো, হেইখানের ডাগদার সাব বইললেক বুকের অসুখ। ম্যালা পয়সার ব্যাপার।
খপরের কাগজওয়ালারা সব আইলো উহাদের গেরামে মেলা কথা বইললো। কইলকাতায় নাকি এইসগল মুখোশের মেলা কদর,দুগ্গা মা, কালী মা। কি একটো বড় পাব্বন হইবেক, মেলা বইসবেক, ম্যালা লোক আইসবেক, সব গেরামের জিনিস বিচা কিনা হবেক, ছিদ্যামের কাছে টেলিফুনের লম্বরটা দি গেল।
ব্যাস ব্যাটাও ওমনি নাইচতে নাইচতে চলি গ্যালো, কতক দিন হই গ্যালো। ঠাকুর জানে ক্যামন আছে তার বাপধন?
সগল চলি গ্যালো, এই একটাই এসি ঠেকিছে, তাঁর সবেধন নীলমণি বাপধন, একখান বেটি ছেলো......তারেও তো টানি নিলো ভগমান।
মেয়েটোর কতা বলেনা ছিদামরে, বুইনের কথা বললে তাঁর চোক্ষে আগুন ঝরে...বলে পোতিশোধ আমি নেবই বাপ।
দৃশ্য ৩
২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯
শ্যামপুকুর থানা
বেলা ১১টা
বড়বাবু সুনীল পাড়ুই বসে আছেন, তাঁর হাতে ধরা একটা কাগজ, তাতে লাল রঙে লেখা,
"গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবত্ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।। '
সুনীল পাড়ুই মনে মনে বললেন, এটার তো মানে হলো
“রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধু পান করি ততক্ষণ তুই গর্জন কর। আমি তোকে বধ করিলে ইন্দ্রাদি দেবগণ এইস্থানে শীঘ্রই আনন্দধ্বনি করিবেন।”
তার মানে কেউ ওনার পাপের শাস্তি দিতে চাইছে।
কিন্তু কি এমন পাপ? যার জন্য এমন নাটকীয় ভঙ্গিতে খুন করলো, আর মুখোশটা রেখে যাবার মানে কি?
সুনীল বাবুর পুরো মাথাটাই ঝিমঝিম করছে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন কাগজটাকে, সাধারণ একটা কাগজ, যেমন রশিদের বইগুলো হয়, ওরকম ধরণের, কার্বন পেপারের একটা হালকা ছাপ আছে পাতাটাতে।
সামনে একজন লোক কাঁচুমাচু মুখ করে বসে আছে।
বড়বাবু : তুমহারা নাম?
রামখিলায়ন বাবু।
বড়বাবু: ইয়ে ডেডবডি কে বারেমে ক্যায়া জানতে হো?
রামখিলায়ন: হামি বাবু সুবাহ ছে বাজে সে রিকশা চালাতা হুঁ। রিক্সা কো লেকে ও পটুয়া গললি সে নিকাল কে গঙ্গা কি তরফ যা রাহা থা। রোজই সুবাহ গঙ্গা মে নাহানে কে বাদ ম্যায় রিক্সা চালানা শুরু করতা হু।
আজ সুবাহভি ওহি গঙ্গামে নাহানে কে লিয়ে ঘাট পে গ্যয়ে, তভি দেখা এক আদমি আধা শরীর উসকা পানি কে অন্দর অউর আধা শরীর ঘাটকি ধাপ মে। অউর ইয়ে চিজ পরা হুয়া থা বলে একটা মা দুর্গার ছৌ নাচের মুখোশের দিকে নির্দেশ করে।
ইসকে ইলাবা মুঝে কুছু নেহি মালুম সাব।
বড়বাবু: আস পাস কিসিনে নেহি দেখা?
রামখিলায়ন : নেহি বাবু পহলে হাম দেখা, উসকি বাদ ম্যায়নে বাকি লোগোকো বুলায়া। উস বখত তো এইসা শুনা শুনা হি রহেতা হ্যায়।
বড়বাবু: ইয়ে কাগজ তো ইয়ে আদমি কা পকেট মে থা, দেখা নেহি তুমনে?
রামখিলায়ন : নেহি বাবু হনুমানজী কি কসম।
বড়বাবু: ইস আদমিকো পহেচন তে হো? বহুত ই বড়িয়া আর্টিস্ট হ্যায়, " দিবাকর পাল"
রামখিলায়ন : নেহি বাবু, ও পটুয়া মহল্লা মে তো বহুত আর্টিস্ট কাম করতে হ্যায়। হামে মালুম নেহি ইয়ে কৌন।
বড়বাবু: আচ্ছা তুম যা সকতে হো, আগার জরুরত পরে ফিরসে বুলাউঙ্গা,ঠিক হ্যায়??
রামখিলায়ন : জরুর হজৌর।
কাগজটা রেখে মুখোশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো, ছৌ নাচের মুখোশ, মা দুর্গার, কি অপূর্ব হাতের কাজ।
কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, দিবাকর বাবুর মত এত স্বনামধন্য মানুষের অনেক শত্রুই থাকা সম্ভব, কেসটা কোনদিক থেকে শুরু করবেন কোনো তল পাচ্ছেন না। নাহ একবার দিবাকর বাবুর বাড়ি আর কর্মশালায় যেতে হবে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলে কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যাবে। যদিও প্রাথমিক তদন্তে গলার দাগ দেখে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু মনে হচ্ছে, তারপর জলে ফেলা হয়েছে।দেহে কিছু ধস্তাধস্তির চিহ্নও বর্তমান।
বেলা ২টো
স্থান: দিবাকর পালের কর্মশালার অফিস ঘর
পটুয়া পাড়ায় এক অদ্ভূত নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে, এই আকস্মিক মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছে না।
অর্কবাবু বাড়িতে, তাই এখানে রাজেশ বাবুর সাথেই কথা বললেন বড়বাবু।
বড়বাবু: আপনার নাম?
রাজেশ: রাজেশ সূত্রধর স্যার।
বড়বাবু: কোথায় থাকেন?
রাজেশ: আমরা এই শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রীটে থাকি, অনেক বছরের পুরনো বাসিন্দা।
বড়বাবু: ভাড়া না নিজেদের বাড়ি?
রাজেশ: পৈতৃক বাড়ি স্যার।
বড়বাবু: কিন্তু রাজেশবাবু শুনলাম আপনার পৈতৃক ভিটে পুরুলিয়ায়?
রাজেশ: হ্যাঁ....সে তো দেশ পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি তে, তবে এখন সেখানে কেউ থাকেনা।
বড়বাবু: কাল দিবাকর বাবু রাতে ছিলেন এখানে?
রাজেশ: হ্যাঁ।
বড়বাবু: উনি কি কাজ চলাকালীন এখানে থাকেন রাতে, না বাড়িতে থাকেন?
রাজেশ: না স্যার, সাধারণতঃ উনি বাড়ি চলে যান ১০টার মধ্যেই। তবে এবার মহালয়ার আগের দিন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল কাজ করতে করতে, আমাকে বললেন, রাজেশ আজ এখানেই থেকে যাই।
বড়বাবু: ওনার আচরণে কোনো অসঙ্গতি?
রাজেশ: না তো স্যার, হাসিখুশি ছিলেন, এমনি তো উনি একটু কম কথা বলেন, সেদিন একটু ঠাট্টা করছিলেন, সবার সঙ্গে।
বড়বাবু: কেন?
রাজেশ: এমনি, সেরকম কিছু নয়, নতুন কয়েকজন কারিগর এসেছে, বাচ্চা ছেলে,
তাঁদের পিছনে লাগছিলেন ।
বড়বাবু: ওনার কোনো শত্রু?
রাজেশ: কি যে বলেন স্যার, এমন অমায়িক মানুষের কোনো শত্রু থাকতে পারে?
বড়বাবু: আপনি কাল কোথায় ছিলেন?
রাজেশ: আমি স্যার ১১টা নাগাদ বাড়ি চলে যাই। কালও চলে গিয়েছি।
বড়বাবু: আচ্ছা একবার এখানে ওনার শোয়ার ঘরটা দেখবো।
রাজেশ: নিশ্চই স্যার, আসুন।
দিবাকর বাবুর ঘরটা ছোট, কিন্তু সাজানো গোছানো। আসবাব খুবই অল্প, একটা সিঙ্গেল খাট, তাঁর পাশে একটা ছোট্ট টেবিল, তাতে একটা খালি জলের গ্লাস। খাটের পাশে একটা কাঠের আলমারি, খুলে দেখলেন সুনীলবাবু। কিছু জামাকাপড়, নিচের তাকে, কিছু রং, তুলি, বই এসব। আলমারিতে একটা ছোট্ট ড্রয়ার, সেটা টেনে খুললেন, কিছু টাকা পয়সা আর একটা রাংতার কাগজের খাম। ভুরুটা কুঁচকে উঠলো সুনীল বাবু, খামটা খুলে ফটোটা বের করে আশ্চর্য হলেন।
কবিতাটা পড়ার পর রাজেশ বাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন , ওনার কাছে কোনো চিঠিপত্র এসেছিল?
রাজেশ: না তো স্যার, ওনার তো সব বাড়িতেই আসে।
বড়বাবু: আচ্ছা চলুন যাওয়া যাক, আপনি দয়া করে কলকাতার বাইরে যাবেন না কদিন।
রাজেশ: আজ্ঞে না স্যার।
ওখানের থেকে সুনীল বাবু, দিবাকর বাবুর বাড়িতে গেলেন না।
পুলিশ থেকে এখনও বডি দেয়নি, পেতে পেতে কাল সকাল হবে। অর্কপ্রভ বাবুর সঙ্গে দেখা হলেও ওনার মেয়ে এখনও এসে পৌঁছান নি, তাই একেবারে কালই যাবেন।
দৃশ্য ৪
১১ই আশ্বিন, ১৪২৬ (২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০১৯)
দিবাকর বাবুর বাড়ি হলো,কুমারটুলি স্ট্রিটের যে সমান্তরাল রাস্তা আছে দুর্গাচরণ ব্যানার্জি স্ট্রিট আর কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটের সংযোগ স্থলে যে ব্যাংকটা আছে তার উল্টোদিকে।
দিবাকর বাবুর একছেলে অর্কপ্রভ আর এক মেয়ে অর্চিশা। ছেলে অর্কপ্রভ বিবাহিত, তাঁর একটি মেয়ে দ্যুতি, ডাকনাম বিন্নি, পাঁচ বছর বয়স মোটে, ওকে নিয়েই দিবাকর ফেরার পর সময় কাটায়।
দিবাকর বাবুর মেয়ে দিল্লিতে পড়াশোনা করছে।
দোতলা বাড়ি, ওনার বাবা সূর্যকান্ত পাল এই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। ঢুকেই বড় উঠোন, তাঁর সোজাসুজি ঠাকুর দালান।বাড়িটা অনেকটা U আকৃতির।
নীচের তলায় ডানদিকে চারটি ঘর, একটা রান্নাঘর, একটা খাবার ঘর, একটা বড় শোবার ঘর যেটি দিবাকর বাবু নিজে ব্যবহার করেন, তাঁর ঘরের পাশেই ছোট্ট একটা ঘরে ওনার ছায়া সঙ্গী ভোলা থাকে।
রান্নার বামুন বৈজু আর তাঁর বউ ফুলমতী রান্নাঘরেই শোয়। আর বাঁদিকে বৈঠকখানা, স্টুডিও আর লাইব্রেরি।
ঠাকুর দালানের দুই পাশ দিয়েই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।
দোতলায় ঠাকুরদালানের ঠিক উপরে খাবার ঘর এবং রান্নাঘর। বাঁ দিকে তিনটে ঘর, এই দিকটা অর্করা ব্যবহার করে, একটা বসার ঘর, আর দুটো শোয়ার ঘর, একটা অর্কদের আর একটা ওর মেয়ে বিন্নির। ওনার মেয়ে এলে ডানদিকের শোয়ার ঘরটা ব্যবহার করে, বাকি দুটো ঘর তালা বন্ধ থাকে।
ছেলে অর্ক খুবই নাম করেছে ইতিমধ্যে আর্টিস্ট হিসেবে। আজকালকার থিম পুজোর concept দিবাকরের মাথায় ঢোকেনা। তিনি এখনও সেই সাবেকি দুর্গাতেই পরে আছেন। ওই থিম পুজোর ডিজাইন থেকে শুরু করে পুজো কমিটিগুলোর অদ্ভূত অদ্ভূত কল্পনা অর্কই সামলায়। ওর নিজস্ব একটা দল আছে, ওদের বাড়ির স্টুডিওতে প্রাথমিক কাজগুলো যেমন ডিজাইন, ক্লায়েন্ট মিট এই সব করে, বাকি কাজ করার জন্য নিজস্ব একটা স্টুডিও ঘর করেছে। বাড়ির কাছেই, রবীন্দ্র সরণির উপর।
দিবাকর বাবুর বাড়ির বৈঠকখানা:
সকাল ১০টা
বড়বাবু: অর্কপ্রভ বাবু, আপনি কখন জানতে পারলেন বাবা বাড়িতে নেই?
অর্ক: আমি তো ছিলাম না কাল রাতে, রাতভর স্টুডিওতে ছিলাম আমার পুরো টিম নিয়ে, জানেনই তো এই সময় আমাদের নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। বাবাও কাল আমাদের পটুয়া পাড়ার অফিসে থেকে গেছে।
সকালে আমার স্ত্রী দেখে চা দিতে গিয়ে দেখে বাবা ঘরে নেই। কাল রাতে আমার মেয়ে আর স্ত্রীকে ফোন করেছিল বলেছিলো একেবারে তর্পণ করে ফিরবে। বাবা মাঝে মাঝেই ওখানের থেকে গঙ্গা স্নানে যান বলে জামাকাপড় রাখাই থাকে। তাই আশ্চর্য হয় নি ওরা।
বড়বাবু: আচ্ছা আপনার স্টুডিওটা কোথায়? বাড়িতে নয়?
অর্ক: না, আসলে অনেক অর্ডার তো বাড়ির স্টুডিওতে হয় না। তাই রবীন্দ্র সরণির কাছে একটা স্টুডিও ভাড়া নিয়েছি।
বড়বাবু: আচ্ছা, আপনার বাবার ঘরটা একবার দেখা যায়?
অর্ক: নিশ্চই, আসুন।
ঘোরানো বারান্দা পেরিয়ে ওঁরা উল্টোদিকের একটা বড় ঘরে এলো, সামনে একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছে, আর সমানে কেঁদে চলেছে।
সুনীলবাবু এক নজর দেখে বললেন তুমি একটু দাঁড়াও তোমার সঙ্গে কথা আছে।
ঘরটাতে ঢুকলেন ওঁরা, পুরনোদিনের ঘরের সঙ্গে আসবাবগুলোও প্রাচীনত্বের নিদর্শন বহন করছে। ঘরের মাঝে একটা বড় পালঙ্ক, তার পাশে ছোট্ট একটা টেবিলের উপর টেবিল ল্যাম্প, পালঙ্কের পাশেই একটা বড় আলমারি, ঘরের পিছনের দিকে দেওয়ালে একটা দরজা, ঐটা বাথরুম, বাথরুমটা বেশ বড়, ঘরে ঢুকেই ডানদিকে একটা টেবিল আর চেয়ার,খাটের সঙ্গেই একটা আরাম কেদারা।
সবই খুঁটিয়ে দেখলেন। দেওয়ালে কয়েকটা ছবি টানানো। একটা তো একজন ভদ্রমহিলা, অর্ক বাবু বললেন ওনার মা, দুবছর আগে মারা গেছেন।আরেকটা ফ্যামিলি ফটোগ্রাফ, সামনে দিবাকর বাবু আর ওনার স্ত্রী, দিবাকর বাবুর কোলে ওনার ছোট্ট নাতনী, পিছনে অর্ক বাবু আর তার দুই পাশে অর্কবাবুর বোন আর স্ত্রী।
আরেকটা ফটো খুব পুরোনো সাদা কালো, একটু ঝাপসা, অনেক জন ছেলে মেয়েদের গ্রুপ। নীচে লেখা "গভঃ আর্ট কলেজ, ১৯৭৮",নিচে সবার নাম লেখা। সুনীলবাবু বুঝলেন এটা কলেজ জীবনের ছবি।
নাহ সেরকম কিছুই পেলেন না।
বড়বাবু: অর্ক বাবু আপনার স্ত্রীর সাথে একটু কথা বলবো।
অর্ক: হ্যাঁ নিশ্চই, বারান্দায় বেরিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, ভোলাদা একটু তোমার বৌদিকে ডাকো তো।
একটু পরে বছর তিরিশের এক মহিলা ঢুকলেন ঘরে, চোখ মুখ ফোলা ফোলা, বোঝা যাচ্ছে অত্যন্ত শোক পেয়েছেন।
বড়বাবু: আপনার নাম?
বৃষ্টি পাল।
বড়বাবু: কাল আপনি কখন শুনলেন ঘটনাটা?
বৃষ্টি: ১১টা নাগাদ, পুলিশই জানায়।
বড়বাবু: তার আগের দিন কখন আপনার শ্বশুর মশাই ফোন করেন?
বৃষ্টি: এই রাত দশটা নাগাদ, বলেন সকালে ফিরবেন ।
বড়বাবু: তারপর সকালে যখন ফেরেন নি খোঁজ খবর করেননি?
বৃষ্টি: হ্যাঁ সাতটা অবধি দেখে রাজেশ বাবুকে ফোন করি। বাবার তো ফোন বেশি সময় হয় অফিসে বা বাড়িতে ফেলে যান, মনে থাকেনা।
বড়বাবু: তারপর?
বৃষ্টি: রাজেশ বাবু বললেন বাবা কাজ করছেন তখনও। ফোনটা অফিস ঘরে ছিল। কিছু পরে বাবা নিজেই ফোন করে বললেন কাল ফিরবো।
আমার মেয়ে বায়না করছিল বলে ওর সাথেও কথা বললেন। বললেন দিদিভাই কাল তোমাকে একটা বড় চকোলেট দেব.....কোথা থেকে যে কি হয়ে গেলো...(বৃষ্টি আঁচল চাপা দিলো মুখে)।
বড়বাবু: আচ্ছা আপনি আসতে পারেন, একটু অর্ক বাবুর বোনকে পাঠিয়ে দেবেন।
বৃষ্টি: আসলে ও খুব ভেঙে পড়েছে, এখনই কথা না বললে হয় না?
বড়বাবু: বুঝতে পারছি, আচ্ছা থাক, ওনার সাথে পরে কথা বলবো। ও একবার ভোলাকে ডাকুন তো।
ভোলা ঘরে ঢুকলো...
বড়বাবু: একবার ভোলাকে পাঠিয়ে দিন তো?
ভোলা ঘরে ঢুকলো চোখ মুছতে মুছতে...
বড়বাবু: এসো ভোলা, তোমায় দুচারটে কথা জিজ্ঞাসা করবো। কোনো ভয় নেই।
বড়বাবু: তোমার নাম ?
ভোলা: ভোলা মাহাতো।
বড়বাবু: গ্রাম কোথায়?
ভোলা: আইগ্যে নিবাস ছড়াডুমডুমি, পুরুলিয়া
বড়বাবু: পুরুলিয়া!! সবাই পুরুলিয়ার বাসিন্দা, অদ্ভূত। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, বাবুর সাথে ছেলের সম্পর্ক কেমন ছিল?
ভোলা: হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো, হামি কেমন কৈরে বোলবেক, তুহাদের কৈলকেতায় হামি তো এক্কেবারে লতুন। ভাদর মাইসের পথ্যমে এলুম হিথায়।
পাচুদাদাটো লিয়ে এলো, দ্যাখ কেনে কেমনে বিপদটোর মধ্যি পড়ি গেলাম।
বড়বাবু: তুমি বলো, ভয় নেই কোনো।
ভোলা: এমনি তো কত্তারে কুনোদিন রাইগত্যে দেখি নাই, হেই দুইদিন আগে রাইতে টুকুন দুধ দিইত্যে গ্যেইলাম, ফটকটার বাইর হইত্যেই উহার গলা শুনতি পাইলাম। ছোট বাবুরে ডাইটতে ছেলেন। অবিশ্যি কি নিয়ে কতা বৈলতেছেলো শুনি নাই।
বড়বাবু: আচ্ছা তুমি এসো। পরে দরকার হলে ডাকবো। একটু অর্কবাবুকে ডেকে দাও তো...
অর্ক ঘরে এসে ঢুকলো।
বড়বাবু: একটা কথা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসে গেছে। পিছন থেকে আঘাত করে তারপর শ্বাসরোধ করে মৃত্যু। আন্দাজ ভোর ৪:৩০ টা থেকে ৫:৩০টার মধ্যে মৃত্যু। দেহে কোনো বিষের চিহ্ন নেই। আপনারা গেলেই বডি হ্যান্ডওভার হবে।
অর্ক: আচ্ছা দারোগাবাবু, আমরা যাচ্ছি একটু পরে।
বড়বাবু: আরেকটা কথা আপনার সাথে আপনার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিলো?
অর্ক: মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?
বড়বাবু: কোনো অশান্তি ছিল কি? শুনলাম মৃত্যুর দুদিন আগে আপনাদের কথা কাটাকাটি হয়েছে।
অর্ক: মানে কি এসবের? বাবা ছেলের মধ্যে হয় না?
বাবার খুবই পরিমিত জীবনযাপন। আমি এই রাতের পর রাত বাড়ি ফিরিনা, এসব পছন্দ করতো না। সেই নিয়ে তর্ক হত প্রায়ই, বাবা চাইতেন আমি কাজের সংখ্যা কমিয়ে বাড়িতে সময় কাটাই, অবাস্তব সব চিন্তাধারা।
বড়বাবু: শুধুমাত্র কি এই কারণ? আপনি তো এত বিখ্যাত একজন শিল্পীর সন্তান, অথচ বাবার সাবেকিয়ানা অনুসরণ না করে থিম পূজার দিকে ঝুঁকলেন, এটাও কি আপনাদের মধ্যে মন কষাকষির কারণ নয়?
অর্ক: এই কারণে কি ছেলে বাবাকে খুন করতে পারে?
বড়বাবু: না, আপনার বাবাতো আপনার একজন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি আসুন।
বেশ কিছুদিন পরে....
দৃশ্য ৫
কালীঘাট পটুয়াপাড়া, কলকাতা
২রা কার্তিক, ১৪২৬ (২০শে অক্টোবর, ২০১৯)
তারক কুন্ডু এন্ড সন্সের কর্মশালা
বাতাসে দুর্গাপূজার গন্ধ এখনো লেপটে আছে, শিউলিগুলো এখনো ফুটছে গন্ধ ছড়িয়ে। ঠাকুর দালানে এখনো ঝুলে রয়েছে ছেঁড়া রঙিন শিকলি, বেদীতে আটকানো তেল সিঁদুর মাখা মার্বেল পেপার। তার পাশে পড়ে আছে ভাঙা ধুনুচি, উল্টানো ছোট ঘট আরো কত কি! মা এখনো স্মৃতি ছড়িয়ে রেখেছে মানুষের মনে।
পটুয়া পাড়ায় ও এখনো দুর্গাপূজার বায়না না হওয়া কাঠামো, ঠাকুরের পিছনের চালি, ছেঁড়া জরির টুকরো, ভেঙে পড়ে থাকা ইঁদুর, পেঁচা যারা মায়ের সঙ্গে যেতে পারলো না, এসব কিছু পূজা শেষের স্মৃতি বহন করছে।
তবে পটুয়াদের বিশ্রাম নেই। বাতাসে দুর্গা ঠাকুরের রেশ কাটতে না কাটতেই আসে লক্ষ্মী পুজো, কালী পুজো। লক্ষ্মীপুজোয় বড় রকমের অর্ডার না থাকলেও মা কালীরপুজায় বেশ কিছু বড় মূর্তির বায়না হয়। হাতে সময় ও কম থাকে।
পটুয়া পাড়ায় তারক বাবুর কর্মশালায় প্রায় জনা দশেক লোক কাজ করে। তারকবাবুর দুই ছেলে সঞ্জয় আর শঙ্কর।
সঞ্জয় মূর্তি গড়ার বাইরে অন্যদিকগুলো পরিচালনা করে। যেমন বায়না ধরা, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যোগান এইসব দেখা শোনা করে।
শঙ্করের ভাগে পড়েছে কর্মশালা পরিচালনার দায়িত্ব। পটুয়াদের দিয়ে কাজ করানো থেকে শুরু করে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া, তাদের সুবিধা অসুবিধা, খাওয়া থাকার ব্যবস্থা সবই শঙ্করের দায়িত্ব।
তারক কুন্ডুর এখানে কালীপুজোর সময় সারারাত কাজ করার প্রয়োজন বড় একটা হয় না। মোটামুটি সকাল ৭টায় সবাই উঠে পড়ে, আটটার মধ্যে কাজে লেগে পড়ে সবাই।
কর্মশালার মধ্যে ছোট্ট অফিস, ওরা দুই ভাই আসে অবশ্য প্রায় সকাল ১০টা নাগাদ।
তারক বাবুর বাড়ি মহিম হালদার স্ট্রীটে।
ওনার বয়স হয়েছে প্রায় বাষট্টি। আজকাল আর রোজ আসেন না, ছেলেরাই সামলায়।
তবুও মূর্তির চক্ষু দানের সময় আর ঘরে থাকতে পারেন না। বয়সের ভারে হাত কাঁপে, তাই উনি আর করেন না চক্ষুদান। ওনার ছেলেদের মধ্যে বড়ছেলে তো ওসবের মধ্যেই নেই, তার খালি ব্যবসা বাড়ানোয় উৎসাহ।
ছোটছেলে তাও ভালোই পারে এসব কাজ, সরকারি আর্ট কলেজ থেকে পাস করেছে, তাই কিছু মূর্তির চক্ষুদান সেই করে।
স্থান : তারকবাবুর বাড়ি
সময় রাত ১১টা
রাতে খাবার হয়ে গেছে সবারই। ছেলেরাও ফিরে যে যার ঘরে চলে গেছে। তারকবাবুর বউ গত হয়েছেন বছর পাঁচেক হলো। রাতে শোয়ার আগে তাঁর ছোট নাতনি আসে আদর করতে।
তারকবাবুর ঘর একতলায়, দোতলায় বড়ছেলে সঞ্জয় থাকে আর তিনতলায় ছোটছেলে শংকর থাকে।
ওনার স্ত্রী গত হওয়ার পরও এখনো হেঁসেল আলাদা হয় নি। তাঁদের দুই ভাইয়ে খুবই মিল। এমনকি বৌমাদের মধ্যেও খুবই সদ্ভাব। বড় ছেলের দুই ছেলে, একজনের বয়স ষোলো আরেকজনের দশ। ছোট ছেলের একটাই মেয়ে পাঁচ বছর বয়স । তারকবাবুর দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে ছোট নাতি নীলাভ ওরফে নীলু আর ছোট নাতনী তিয়ারা ওরফে তিতলি নিয়ে। তিতলির খুব পুতুল গড়ার শখ, দাদুভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝেই দাদুর ঘরেই workshop বানিয়ে ফেলে। এরপর ঘরের যা অবস্থা হয়...তারপরেই তার পিঠে পরে, তারকবাবুর খুব খারাপ লাগে, বলতেও পারেন না।
আজ তিতলি যখন আদর করে গেলো তখন রাত প্রায় ১১টা। সে চলে গেলে দরজা বন্ধ করে মশারির ভিতরে ঢুকে গেলেন তারকবাবু।
নিচের তলাটা নিঃঝুম পুরী, ওনার দুটো ঘর পরে বাড়ির চাকর রামু শোয়, তারকবাবুর বিছানার পাশেই কলিং বেল আছে, যেটা রামুর ঘরে বাজে।ছেলেরাই জোর করে এইসব ব্যবস্থা করেছে।
রাত্রি ১২টা :৩০ মি:
তারকবাবুর ঘুম খুব পাতলা, নাতনির কথা ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম নেমে আসছিল, এখন আবার নতুন বায়না একটা গনেশ ঠাকুর বানাতে হবে, কাল থেকে আবার বাড়িতে ঝামেলা শুরু।
কিরকম একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেলো, ওনার ঘরের সামনে কেউ হাঁটছে মনে হচ্ছে, তারকবাবু হাঁক দিলেন, " কে ওখানে"। শব্দটা থেমে গেলো, কি জানে বিড়াল হবে হয়তো।পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন তিনি। মিনিট পাঁচেক পর দরজায় কেমন একটা শব্দ, কি ব্যাপার উঠে বসলেন তারকবাবু। টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালালেন।
উঠে এসে দরজাটা খুলে বারান্দায় এলেন, হালকা কুয়াশার চাদরে সামনের উঠোনটা মুড়ে রয়েছে। হালকা একটা ঠান্ডার আমেজ। নাহ কেউ কোত্থাও নেই। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে কিছু একটা পায়ে লাগলো, একটা খাম, "এটা আবার কি?" বলে খামটা তুলে নিয়ে দেখলেন।
খামটা নিয়ে এসে টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ধরলেন, ভিতরে একটা কিছু আছে, কৌতূহল বশে খুলেই ফেললেন খামটা, ভিতরে একটা ছবি, আশ্চর্য্য হলেন, ওনাদের কর্মশালায় করা রক্ষা কালীর ছবি। গতবার প্রাইজ পেয়েছিলো, এর মানে কি! এত রাতে কে রসিকতা করছে!!
খামের উপরে তো কিছু লেখা নেই, কিন্তু ছবির পিছনে কিছু লেখা আছে, ঘরের লাইটটা জ্বেলে চশমাটা পরে নিলেন, লাল কালিতে লেখা কয়েক লাইনের ছড়া...
"শ্যামা মায়ের রূপটো দেইখ্যে,
ভুইললি নাকি মোরে,
মোর পরানে জ্বইলছে আগুন,
জুড়াইন কেমন করে?
"ও বাবু তুই ভুইললি নাকি,
মোর পরানের ব্যাথা,
ঝলমলাইছে তুহার বাড়ি,
আন্ধার মোদের গাঁথা।
আইজকে যে তাই জ্বইলবে জানিস,
তুহার সাধের স্বপন।
পরানডা আইজ জুড়াই যাবে,
খুঁজিস মায়ের চরণ।
সাধ্যি থাকে একলা আসিস,
বাঁচাস তুহার মাকে,
শাস্তিটো তো পেতেই হবে,
যতই ডাকিস মাকে।"
তারকবাবু কয়েকবার পড়লেন, প্রথমে বুঝতে পারলেন না, তারপর হঠাৎ মনে হলো তবে কি তার কর্মশালার কথা বলছে, কে লিখছে এসব? তাহলে কি সত্যি তাঁর স্বপ্নের কর্মশালার উপর কোনো বিপর্যয় আসতে চলেছে? তারকবাবু হন্তদন্ত হয়ে দরজা খুলে রাস্তায় বেরোলেন।
মহিম হালদার স্ট্রীট থেকে যদু ভট্টাচার্য লেনে যখন পড়লেন, কয়েকটা কুকুর ছাড়া রাস্তায় আর কেউই নেই, শীত না পড়লেও রাতে বেশ ঠান্ডার একটা আমেজ আছে। ওনার কর্মশালা কালীঘাট রোডে। ওনার বাড়ি থেকে মিনিট দশেকের পথ । জোরে জোরে হাঁটার জন্য বেশ ঘাম হচ্ছে।
কালীঘাট রোডের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেন 'তারা মা' পানের দোকানটা বন্ধ করছে। অত রাতে তারকবাবুকে দেখে পানের দোকানের মালিক নিতাই একটু অবাকই হয়েছে। তবে মুখে কিছু বললো না। তিনি জোরে পা চালালেন।
ওনার কর্মশালায় ঢোকার গলির মুখে পিঠে কেউ হাত দিলো... ভয় পেয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি...রাস্তার নিয়ন ল্যাম্পগুলো চুয়ে চুয়ে পড়া শিশির বিন্দুকে গ্রাস করে রাতকে আরো রহস্যময় করে তুলেছে....
আবছা আলোয় মুখটা স্পষ্ট নয়, আগন্তুক বললো" কি বাবু চিনতে পারলি মুকে ?"
কয়েক সহস্র বছর পিছনে ফিরে যাচ্ছেন যেন তিনি... পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে যাচ্ছে....
দুটো শব্দই অস্ফুট স্বরে বলতে পারলেন তিনি...."ছেড়ে দাও..."
দৃশ্য-৬
স্থান : যাদবপুর রেল স্টেশন, কলকাতা
২২শে অক্টোবর, ২০১৯
সময় : রাত ১১টা ৪৫মিঃ
প্ল্যাটফর্মের আলোগুলো শীতের কুয়াশার সঙ্গে আলো আঁধারী খেলা খেলছে। 34757 লক্ষীকান্তপুর শিয়ালদহর শেষ লোকালটা চলে গেলো।
ঘন কুয়াশা ভেদ করে দুজন যাত্রীকে প্ল্যাটফর্ম ধরে এগোতে দেখা গেলো। দুজনেই একটু অপ্রকৃতিস্থ। সোনারপুর স্টেশন রোডে দোকান দুজনেরই।
একজন ফর্সা বেঁটে খাটো গোলগাল, অনেকটা গোপাল ভাঁড়ের মত দেখতে। লোকটার নামও সেরকম নন্দ গোপাল গুছাইত। রেল লাইনের ধারে মুদি দোকান। তা পদবীর মত ব্যবসাটাও ভালোই গুছিয়ে নিয়েছেন। পরনে হাফ হাতা ফতুয়া আর মালকোচা মারা ধুতি। বয়স বছর পঞ্চাশ হবে।
ওনার সঙ্গে যেই সিরিঙ্গে পানা লোকটি আসছে, অন্ধকারে দেখলে ভূত বলে মনে হলে আশ্চর্য হব না। লাল ফুল ফুল ছাপার শার্ট আর জিনসের প্যান্ট। তিরিশ পেরোলো সবে, ওর নাম বাপি পাল, সবাই ওকে কেলে বাপি বলে। নন্দ বাবুর তিনটে দোকান পরেই স্টেশনারি গুডস আর বই খাতার দোকান ওর। তা নন্দ বাবুর মত রমরমা না হলেও রোজগারপাতি খারাপ নয়।
এদের দুজনের বাড়ি বিজয়গড় কলোনীতে। তাই মোটামুটি একসাথেই ফেরে। মাঝে মধ্যে দোকান বন্ধের পর একটু মাল টাল টেনে ফেরে। বেশিরভাগই শেষ ট্রেনে ফেরে, বিশেষ করে যেদিন একটু ফুর্তি জাগে মনে।
প্ল্যাটফর্ম থেকে যেই জায়গাটা নিচু হয়ে জমিতে মিশেছে ওইখানে নেমে রোজ লাইন ধরে হেঁটে যায় ওরা। আজও ওখান দিয়ে দুজন হেঁটে নামছিল।
বাপির মেজাজ বেশ ফুরফুরে আজ, আজ এক্কেবারে লক্ষ্মী, সরস্বতী দুইয়েরই সমাগম।
সক্কাল সক্কাল সোনারপুর হাই স্কুলের একটা বড় অর্ডার এলো। আর বিকেলে সে ও এলো, তাঁর দিল কি রানী, তাঁর চাঁদনী, চন্দু মানে চন্দ্রিমা যখন দোকানে এলো, বড্ড ভিড়, স্কুল ছুটির পর কচি কাঁচাদের ভিড়। সামলাতে হিমসিম খায় ও।
তখনই সেই সুন্দর আওয়াজ, মনে হলো বুকের মধ্যে জলতরঙ্গ বেজে উঠলো, " বাপিদা একটা প্লাস্টিক ফাইল হবে? ও তো প্রায় বাচ্চাদের ভিড় ঠেলে ফাইলটা বাড়িয়ে দিলো। সেই থেকেই মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে। গুন গুন করে গান গাইছে...
"চাঁদনী ও মেরে চাঁদনী..."
গাইতে গাইতে হঠাৎ করে কিসে একটা ঠোক্কর খেলো...পড়ে যাচ্ছিলো আরেকটু হলে, সামলে নিলো। নন্দদা পিছন থেকে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলো, কিরে চাঁদনীর কথা ভাবতে ভাবতে একটু বেশি টেনেছিস আজ.....
বাপি নিচু হয়ে দেখলো কি এটা বস্তার মত? এখানে আলোটা বড় কম , বুঝতে পারছে না সঠিকভাবে, পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টর্চটা জ্বালালো, আর তারপর যা দেখলো....!!!
দৃশ্য ৭
২৩শে অক্টোবর
সকাল ১১টা
স্থান : যাদবপুর থানা
সাব ইন্সপেক্টর সমীক দত্ত বসে আছেন, সামনের চেয়ারে নন্দগোপাল বাবু আর বাপি পাল বসে আছে। দুজনের চোখে মুখেই আতঙ্কের ছাপ।
ইন্সপেক্টর সাহেবের হাতে একটা চিরকূট, আর তাতে একটা ছড়া লেখা।
সমীক : তা আপনারা বলছেন, মৃতদেহ যখন দেখতে পেলেন তখন আশেপাশে কেউ ছিলো না।
নন্দ: (হাত জোড় করে) বিশ্বাস জান স্যার, আমাগো দুই জনেরই তহন মাথার ঠিক আছিলো না, বাপি তো ভিরমি খাইয়া যায়। কোনো মতে অরে তুইল্যা লইয়া স্ট্যাশন মাস্টারের ঘরে গ্যালাম।
সমীক এবার বাপির দিকে ঘুরে, তারপর আপনি বলুন ঠিক কি দেখেছিলেন।
বাপি: রোজকার মত আমি আর নন্দদা শেষ ট্রেনে ফিরেছি, শীতের রাতে ঘন কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে হোঁচট খেলাম, তারপর নিচু হয়ে দেখলাম একটা বস্তা আর তার পাশে একটা মা কালীর মুখোশ পড়ে আছে। অত ঘন কুয়াশার মধ্যে বোঝা যাচ্ছিলো না, মুখোশের ওই জরির উপরে আলো পরে চিকচিক করছিলো, তাই নিচু হয়ে মুখোশটা টানতে গেলাম আর তখনই বুঝলাম ওটা কারোর মাথায় জড়ানো আছে। বস্তাটা একটু ফাঁক করতেই বুঝলাম একটা মৃতদেহ, আর বুকের উপর থেকে ওই কাগজটা পেলাম স্যার, কেউ আঠা দিয়ে সেঁটে দিয়েছে। তাও আমরা দেখিনি স্যার, ওই স্টেশন মাস্টার বাবুই দেখেছেন।
ইন্সপেক্টর দত্ত: হ্যাঁ স্টেশন মাস্টার সাধন বাবু বলেছেন আমাকে।
ইন্সপেক্টর দত্ত ফোন করলেন লালবাজারে, কিছুদিন আগেই একটা ঘটনা ঘটেছিল, একই রকম, খবরের কাগজেও বেরিয়েছিল। একই ধরনের খুন, ছৌ নাচের মুখোশ আর একটা করে ছড়া। দেখা যাক কোনো সূত্র পাওয়া যায় কিনা।
দৃশ্য: ৮
কালীঘাট থানা
২৪শে অক্টোবর, ২০১৯
সকাল ৯টা
বড়বাবু পুলকেশ সান্যাল লালবাজার গেছেন, বিশেষ তলব পেয়ে পরপর একই রকম খুন হয়ে চলেছে। বিখ্যাত সব মৃৎশিল্পীরা খুন হচ্ছেন।
কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। খুনির মোটিভ কি? কেনই বা শুধু বেছে বেছে শিল্পীদের খুন করছেন বোঝা যাচ্ছে না, মনে তো হচ্ছে সিরিয়াল কিলার।
তরুণ সাব ইন্সপেক্টর রাজা সেন, সদ্য দুই মাস হলো যোগদান করেছেন এই থানায়। ইতিমধ্যে পুলকেশ বাবুর খুবই প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছে সে, বেশ কয়েকটা case এ ওনাকে assist করেছে সে।
গতকাল লালবাজার থেকে জানায় যে যাদবপুরের রেল স্টেশনের ধারে একটা ডেডবডি পাওয়া গেছে মা কালীর মুখোশ পরা, তখনও ওরা বোঝেনি ওটা তারকবাবুর।
একটা অদ্ভূত ব্যাপার তারকবাবুর বডি কিন্তু পটুয়াপাড়া থেকে বেশ অনেক দূরে পাওয়া গেছে। যাদবপুর রেল লাইনের ধারে, বস্তা বন্দি অবস্থায়। দুইজন স্থানীয় লোকের চোখে পড়ে।
গত পরশু রাত থেকে তারক বাবু নিখোঁজ। ওনার বাড়ির লোকেরা গত কাল সকালে থানায় রিপোর্ট করেছেন। গতকাল গভীর রাতে যাদবপুরের রেলস্টেশনের ধারে ওনার ডেড বডি পাওয়া যায়, ওনার ছেলেরা মর্গে গিয়ে সনাক্ত করে এসেছেন।
এই কেসটাও রাজার কাছে খুব আকর্ষণীয় লাগছে। মা কালীর ছৌ নাচের মুখোশটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল। অপূর্ব মুখোশটা, শিল্পীর হাতের প্রশংসা না করে পারলো না।
তারকবাবুর বুকে একটা চিরকূট পাওয়া গেছে। তাতেও লাল কালিতে একটা
মাকালীর পূজার মন্ত্র লেখা....
"ওঁ ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হিং হিং দক্ষিণে কালীকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হৃং হৃং হ্রীং হ্রীং হ্রীং স্বহা।
ওঁ কালী কালী মহাকালী কালীকে পাপহারিণী
ধর্মার্থমোক্ষদে দেবী নারায়ণী নমোস্তুতে।"
দেখা যাক ওনার বাড়িতে আর পটুয়াপাড়ায় ভালো করে জেরা করে।
২৪শে অক্টোবর, ২০১৯
সকাল ১১টা
তারকবাবুর বাড়ির বৈঠকখানা
শঙ্করবাবু বসে আছেন কালীঘাট থানার সাব ইন্সপেক্টর রাজা সেনের সামনে, অসৌচের পোশাক পরা, চোখে মুখে শোকের চিহ্ন।
রাজা: শঙ্করবাবু, আপনি আর আপনার দাদা তো একসাথেই এই work shop সামলান। আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক কেমন?
শঙ্কর: বেশ ভালো, আমরা ভাগ করে কাজটা দেখি।
আমি ক্রিয়েটিভ দিকটা দেখি দাদা sales এর দিকটা।
রাজা: কিন্তু আমার কাছে যে অন্যরকম খবর আছে শংকর বাবু, আজকাল আপনাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রায়ই অশান্তি হয়। আপনার দাদা নাকি সবার সামনেই দুবার আপনার বাবাকে শাসিয়েছে, ব্যবসা আলাদা করার জন্য। কি কারণে ব্যবসা আলাদা করার কথা হচ্ছে?
শঙ্কর: আপনি দাদাকে জিজ্ঞাসা করুন না, আমার এ ব্যাপারে কিছু বক্তব্য নেই।
রাজা: আপনার বাবার সঙ্গে ঘটনার দিন শেষ কখন দেখা হয়।
শঙ্কর: খাবার টেবিলে রাত ১০টা নাগাদ, ওই একটা সময় আমরা সবাই একসাথে হই।
রাজা: ওনার মধ্যে কোনো উত্তেজনা লক্ষ্য করেছেন?
শঙ্কর: না তো, আমার মেয়ের সঙ্গে খুনসুটি করছিলেন।
রাজা: আচ্ছা আপনি সঞ্জয় বাবুকে পাঠিয়ে দিন।
সঞ্জয় ঘরে ঢুকলো, শংকর বাবুর তুলনায় মুখটা অনেক কঠিন।
রাজা: আপনার সাথে আপনার বাবার শেষ কখন দেখা হয়েছে?
সঞ্জয়: ঘটনার দিন সকালবেলায়।
রাজা : কেন রাতে তো একসাথে খান আপনারা?
সঞ্জয়: সেদিন আমার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল তাই শুয়ে পড়েছি। খাবার ঘরেই খেয়েছি।
রাজা: কেন ? কিছু ঝামেলা হয়েছিল আপনার ভাই আর বাবার সাথে?
সঞ্জয়: কে বলেছে আপনাকে এসব ফালতু কথা? আর আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।এটা একান্তই আমার পারিবারিক ব্যাপার।
রাজা ওর উদ্ধত আচরণ দেখে অবাক হলো।
একটু জোরেই বললো এবার, আলবাৎ বাধ্য। যখন আপনার বাবা খুন হয়েছেন আর আপনারা কেউই সন্দেহের তালিকার বাইরে ছিলেন না। আমাদের সাথে অসহযোগিতা করলে আমরা আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।
সঞ্জয়ের গলা এবার মোলায়েম শোনালো, আসলে যে পরিমাণ জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, কাঁচা মালের যোগান ও কম। আগে কুমোরটুলির ঘাটে ভেসে আসা বাঁশের চালি এসব কম পয়সায় কেনা যেত। এখন পৌরসভার সৌজন্যে গঙ্গা বক্ষ পরিস্কার রাখার জন্য বিসর্জনের পরই তুলে নেওয়া হয় আর পৌরসভার লোকেরাই নিয়ে চলে যায়। আমি যেহেতু এগুলো দেখি, তাই প্রতিমার দাম বাড়ানোর ব্যাপারেও আমার ই মত থাকা উচিৎ তাই না? কিন্তু বাবা, ভাই আমাদের পুরোনো কাস্টোমারদের ক্ষেত্রে এত দুর্বল প্রতি বছর যৎসামান্য বাড়াবেন। এভাবে চলছে না, তাই আমি বাবাকে বলেছি ব্যবসা আলাদা করে দাও।।
রাজা: আচ্ছা আমি আপনার বাবার ঘরটা একবার দেখবো।
সঞ্জয় : চলুন।
তারকবাবুর ঘরটা মোটামুটি বড়, ঘরে আসবাব বলতে একটা স্টিলের আলমারি, পাশে একটা সিন্দুক, ঘরের মাঝে একটা বড় খাট, তার পাশে ছোট্ট একটা টেবিল, তার উপরে একটা টেবিল ল্যাম্প। হঠাৎ রাজার চোখ গেলো একটা খামের দিকে, পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া। খামটা খুলে দেখতে পেল একটা মাকালীর ছবি, ছবিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গিয়েই দেখলো কিছু লেখা আছে পিছনে, লেখাটা পড়েই বুঝলো এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি এই খুনের রহস্যে। খামটা পকেটস্থ করে, ঘরে অন্যান্য জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো, খাটের উল্টো দিকের দেয়ালে বড় একটা মাকালীর ছবি, তার পাশে দুইজন বয়স্ক মানুষের ছবি, বাঁ দিকের দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার, তার পাশে একটা গ্রুপ ছবি। খুব পুরোনো সাদা কালো, একটু ঝাপসা, অনেক জন ছেলে মেয়েদের গ্রুপ। নীচে লেখা "গভঃ আর্ট কলেজ, ১৯৭৮",নিচে সবার নাম লেখা। ছবিটাও খুলে নিল রাজা।
এরপরেও বেশ কিছুদিন কেটে গেলো এই দুটো খুনের কোনো কিনারা হয় নি।
তারকবাবুর বাড়ির থেকে জেরা করে সেভাবে কিছুই পাওয়া গেলো না। শুধুমাত্র কালীঘাট রোডের সি.সি টিভি তে তারকবাবুকে হেঁটে যেতে দেখা গেছে , স্থানীয় একজন পানের দোকানের মালিক ও তাই সাক্ষ্য দিয়েছে।
এদিকে মন্ত্রী মহলের চাপ আসছে লালবাজারে আর তার চাপ পড়ছে লোকাল থানায়, দুই জনই খুব বিখ্যাত শিল্পী, বিশেষতঃ দিবাকর পাল সদ্য বেশ কিছু বিদেশি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন, তাই চাপটা আরো বেশি।
শোনা যাচ্ছে সি.বি.আই এর একজন হোমরা চোমরা অফিসারের হাতে এই রহস্য সন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
আস্তে আস্তে ঠান্ডার আমেজ বাড়ছে।
দৃশ্য ৯
৩রা নভেম্বর ২০১৯
লাল বাজার কন্ট্রোল রুম
জরুরি মিটিং ডাকা হয়েছে, উপস্থিত শ্যামপুকুর থানার বড়বাবু সুনীল পাড়ুই, কালীঘাট থানার বড়বাবু পুলকেশ সান্যাল এবং সাব ইন্সপেক্টর রাজা সেন, যাদবপুর থানার বড়বাবু নীলাভ সেন, সাব ইন্সপেক্টর সমীক দত্ত, পুলিশ কমিশনার এবং মিঃ রজত বোস,
cbi এর সিনিয়র অফিসার।
পুলিশ কমিশনার সবার সাথে রজত বাবুর আলাপের পর রজত বাবুই বক্তব্য শুরু করলেন।
দেখুন আমি এখানে আসার আগেই কেসগুলো স্টাডি করেছি, তার থেকে আমার নিজস্ব কতগুলো পর্যবেক্ষণ আছে। সেইগুলো বলার আগে আমি তদন্তকারী অফিসারদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের কোনো বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে কি এই কেসদুটোর বিষয়ে?
সুনীল বাবু আপনি বলুন প্ৰথমে।
সুনীল বাবু: দেখুন স্যার দিবাকর বাবুর বাড়িতে তদন্ত করে উল্লেখ যোগ্য কিছুই পাই নি। তবে একটা ছবি পেয়েছি তার পিছনে কিছু লেখা,
সেটার থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি, তবে কেস ফাইলে রেখে দিয়েছি, এই যে সেই ছবি।
রজত হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিলেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন তারপর ফাইলে রেখে দিলেন।
আচ্ছা এবার আসা নীলাভ বাবুর কাছে, আপনার এই কেসটা তদন্ত করে কি মনে হয়?
নীলাভ : দেখুন এই কেসটা যখন আসে আমি তখন বাইরে ছিলাম, সমীকই তদন্ত করেছে। তাই ওই ভালো বলতে পারবে।
রজত: তাহলে সমীক বাবু আপনি বলুন, এই কেসটা নিয়ে আপনার কি বক্তব্য?
সমীক: আমার কয়েকটা জিনিস অদ্ভূত মিল লেগেছে এই দুটি কেসের মধ্যে।
যেমন ১) যিনি খুন করেছেন তিনি হয় শিল্পী নয় শিল্প রসিক একজন মানুষ।
২) অত্যন্ত গুণী একজন মানুষ
৩) এই দুই শিল্পী তাঁর পূর্ব পরিচিত এবং কোনো একটি কারনে দুজনের উপরই রাগ ছিলো, কিন্তু যোগ সূত্রটা ধরতে পারিনি।
রজত: প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকালেন, বললেন অত্যন্ত ভালো পর্যবেক্ষণ । আর বাকিরা কিছু বলবেন? পুলকেশ বাবু?
পুলকেশ বাবু: না স্যার, তারকবাবুর ঘর থেকে সন্দেহ জনক কিছুই পাইনি আমরা। আর ওনাদের পরিবারের লোকেদের জেরা করেও নতুন কোনো তথ্য উঠে আসেনি।
রাজা মনে মনে বললো তাকে কিছু বলতেই হবে, পুলকেশদা তো ফাইলটাই দেখেনি ভালো করে।
রাজা: স্যার আমি কিছু বলতে পারি?
রজত: হ্যাঁ নিশ্চই, বলুন।
রাজা: স্যার আমরাও কিন্তু তারকবাবুর ঘর থেকে একটা ছবি পেয়েছি, তার পিছনেও একটা কবিতা লেখা। তা ছাড়া ওনার ঘরে একটা গ্রুপ ছবিও আমি ফাইলিং করেছি। মনে হয় এর থেকে কিছু তথ্য সূত্র আমরা পেতে পারি।
রজত: গুড, দেখি আপনার ফাইলটা।আপনি বলুন আর কি বক্তব্য?
রাজা: ১) আমার মনে হয় খুনি ছৌ নাচের সঙ্গে যুক্ত।
২) ভিকটিমদের বয়স দেখে মনে হয় শত্রুতাটা অনেক পুরোনো।
৩) খুনি ছৌ এর মুখোশ অথবা ঠাকুরের মুখের মুখোশ রেখে কিছু ইঙ্গিত করতে চাইছে।
রজত: টেবিল চাপড়ে উঠে, সাবাস।
রাজা লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলো।
রজত : এই ছবিগুলো সবাই দেখুন একবার।
সুনীলবাবু গ্রুপ ফোটো টা দেখে লাফিয়ে উঠলেন, আরে এই ফটোটা তো দিবাকরবাবুর দেওয়ালে টাঙানো ছিলো।
রজত : ভর্ৎসনার সুরে, ছিলো? এই জুনিয়র অফিসারের মনে হলো ফটোটা অত্যন্ত দরকারী এভিডেন্স হতে পারে আপনার মনে হলো না?
যাক গিয়ে আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই, যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, পরবর্তী খুনটা আটকাতেই হবে...
রাজা বাদে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো মানে???
কমিশনার সাহেব বললেন আপনি জানেন আবার একটা খুন হতে চলেছে !! কবে? কোথায়?
রাজা মৃদু স্বরে বললো, ৩রা নভেম্বর থেকে ৫ই নভেম্বরের মধ্যে।
সবাই সমস্বরে কি!!!
রজত : সঠিক বলেছ। জগদ্ধাত্রী পূজা। সাবাস মাই বয়, well done, তুমি আমার কাজটা অনেক সোজা করে দিয়েছ। রজত বলে চললো খুনের পদ্ধতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুনি পূজার দিন বা তার নিকটবর্তী দিনগুলোকে টার্গেট করছে, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে, এখন সামনেই জগদ্ধাত্রী পূজা, তাই ওই সময়টাকে টার্গেট করবে মনে হয়।
কমিশনার: কিন্তু এত পুজোর মাঝখানে কি করে বের করবেন খুনিকে?
রজত: ব্যাপারটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। দেখুন প্রতিটি খুনের একটা স্থান মাহাত্ম্য আছে। যেমন দিবাকর বাবু কুমোরটুলি অঞ্চলে খুন হয়েছেন, যা কিনা দুর্গা মূর্তির জন্য বিখ্যাত, তারকবাবুর বডি অন্য জায়গায় পাওয়া গেলেও খুনটা আমার বিশ্বাস কালীঘাট পটুয়া পাড়ার আসে পাশেই হয়েছে, কারণ কালীঘাট মা কালীর জন্য বিখ্যাত, শুধুমাত্র গুলিয়ে দেওয়ার জন্য বডিটাকে যাদবপুর রেল লাইনের ধারে ফেলে দেয়। সুতরাং জগদ্ধাত্রী পুজোয় খুন হলে চন্দন নগরে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কমিশনার: কিন্তু কিভাবে রজত বাবু? চন্দন নগরে হাজার হাজার জগদ্ধাত্রী পূজা? তাঁর মধ্যে কোন শিল্পী খুনির পরবর্তী শিকার , এতো খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার সমান।
রজত: স্যার আমার মনে হয় একটা উপায় আছে, এই গ্রুপ ফটোটাই আমাদের পথ দেখাতে পারবে।
রাজা: স্যার এই ফটোটায় দেখুন দশ জনের ফটো আছে, এদের মধ্যে দুই জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বাকিদের মধ্যে তিনজন থাকেন বিদেশে। তাহলে বাকি পাঁচজনকে আমাদের follow করতে হবে। এই পাঁচজনের মধ্যে দুইজন মাত্র মূর্তি গড়ার সাথে যুক্ত। অলোকেশ বাবু আর সত্য সুন্দর বাবু। বাকিরা সবাই অন্য প্রফেশনে আছেন। তাই খোঁজাটা অত কঠিন হবে বলে মনে হয় না।
রজত: excellent my boy, outstanding!! তবে আমার মনে হয় পুরোনো শত্রুতা হলে যে কেউ টার্গেট হতে পারে এই পাঁচ জনের মধ্যে। তাই পাঁচজনকেই সুরক্ষা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তবে বর্তমান টার্গেট ৯৯ শতাংশ অলোকেশবাবু বলেই মনে হয়।
তাহলে আমরা দুটি দলে ভাগ হয়ে যাই, এক দলে আমি , রাজা আর পুলকেশ বাবু আর অন্য দলে সমীকবাবু, সুনীল বাবু আর নীলাভ বাবু।
রাজা বুঝতে পারলো রজত বাবু ইচ্ছে করেই ওকে ওনার টিমে নিয়ে নিলো।
রজত : তাহলে আমাদের টিম চন্দন নগর যাচ্ছে আজই মিঃ অলোকেশ বড়ুয়ার বাড়ি। আর পুলকেশ বাবু আপনারা এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ুন আর মিঃ সত্যসুন্দর ঘোষের বাড়ি চলে যান। আমার ধারণা বাকিদের বিপদের সম্ভাবনা কম। তবে মোটিভটা স্পষ্ট নয় তাই সাবধানের মার নেই, সবাইকেই উপযুক্ত প্রটেকশন দেওয়া দরকার।
ও একটা কথা সবাই সিভিল ড্রেসে, আর কেউ যেন বুঝতে না পারে ওনাদের উপর নজরদারি চলছে।
দৃশ্য ১০
১৮ কার্তিক ১৪২৬, ৫ই নভেম্বর, ২০১৯
স্থান : চন্দননগর,
অলোকেশ বড়ুয়ার বাড়ি
আজ জগদ্ধাত্রী পূজার নবমী, চন্দন নগরে মানুষের ঢল নেমেছে।
গত বেশ কয়েকদিন ধরে অলোকেশ বাবুর খুব পরিশ্রম গেছে। একে প্রচুর মূর্তির বায়না তারপর নিজের বাড়ির পূজা। বয়স তো হচ্ছে, চারিদিকে তদারকি করতে আর পারেন না। একমাত্র মেয়ে কমলিকা অবশ্য অনেকটাই দায়িত্ব নেয় এই সময়ে। সে তো বিয়ের পর বিদেশেই থেকে গেছে, ওর বর ময়ূখ একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক, তাঁর মেয়েও একই বিদ্যালয়ে গবেষণা করছে ভারতীয় চিত্রকলার উপর।
দুর্গাপূজার সময় প্রায় একমাসের ছুটিতে আসে। একেবারে বাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা কাটিয়ে ফেরে।
অলোকেশ বাবুর স্ত্রীর ও এই সময়টা খুব ভালোই কাটে।
প্রতিবারের মত এবছরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসছেন। তাই প্রচুর পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ঘুরে বেড়ায়। বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন ও আসেন এই সময় , সারা বাড়ি গমগম করে। খুব সুন্দর ভাবে কেটে গেলো অষ্টমী অবধি। দেবীর পুষ্পাঞ্জলির পর আড্ডা জমে উঠেছে, মামাতো দাদা, পিসতুতো বোন, সব ভাই বোনেরা মিলে জড়ো হয় এই কটা দিন, খুব হাসি ঠাট্টা চলছে, সেই সময় একটা বাচ্চা এসে হাতে একটা খাম দিয়ে গেলো। খামটা একটা পুজো গ্রিটিংস এর সাইজে, একবার ফাঁক করে দেখলেন একটা পোস্টকার্ড সাইজের ছবি, কেউ পুজোর শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছে, ঠিক আছে পরে দেখা যাবে, বলে পকেটে রেখে দিলেন।
আজ মায়ের পুজোর শেষ দিন। আবার সারা বছরের প্রতীক্ষা। মনটা সকাল থেকেই ভারাক্রান্ত।
নবমীর পুজোয় বসার সময় মনে পড়লো, দেবীর মুখ দেখার সোনার দর্পণ ওনার আলমারিতে আছে। ওটা শুধু নবমীর দিনই বের করা হয় ওঁদের বাড়ির রীতি অনুযায়ী।
ওনার স্ত্রীকে ধারে কাছে দেখলেন না, মনে হয় পূজার ভোগ ও অন্যান্য আয়োজনে ব্যস্ত, মেয়েও কথা বলছে কারোর সাথে দূরে দাঁড়িয়ে। উনি তাই নিজেই গেলেন আনতে।
উপরে বিশেষ কেউ নেই, ওনার ঘরে ঢুকেই দেখলেন পাঞ্জাবিটা খাটে পরে রয়েছে, মনে পড়েছে চাবির গোছাটা তো পকেটে। তাড়াহুড়ো করে বের করতে গিয়ে কি একটা পড়লো মেঝেতে... হাতে তুলে দেখলেন সেই কালকের খামটা, নীচু হয়ে খামটা তুলে নিয়ে খুললেন, জগদ্ধাত্রী মায়ের ছবি, আরে এটাতো বাড়িরই ঠাকুর, গত বছরের, কি ব্যাপার? খামটার উপরে কিছুই লেখা নেই, ফটোটা উল্টালেন তিনি, দেখলেন কিছু একটা লেখা আছে...
তাড়াতাড়ি রিডিং গ্লাসটা টেবিল থেকে নিয়ে পড়লেন....
" মায়ের পুজোয় মাতলি সবে,
মোর ব্যথাটো ভুলে,
বুকটা করে হাঁপর পারা,
ভাইসছি চোখের জলে,
ঝলমলাইছে স্বপন পুরী,
মোর ঘরেতে আন্ধার,
রাত পুহালেই ছাইটো রবে,
সাধ্যি নাই তোর বাঁচার।"
অলোকেশের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম...এসব কি ?? কোন জায়গা ছাই হবে? তাঁর workshop নাকি?
না,না এখনই যেতে হবে, তাঁর স্বপ্নের work shop...কি হতে চলেছে ওখানে??
সবাই যে যাঁর মত ব্যস্ত অলোকেশ বাবু যখন বেরোলেন কেউ খেয়াল করলেন না । আর অলোকেশ বাবুও খেয়াল করলেন না দুজন লোক ছায়ার মত তাঁকে অনুসরণ করলো।
ওনার বাড়ি তো তেলেনিপাড়া তে আর ওনার ওয়ার্কশপ হলো মনসা তলা গঙ্গার ঘাটের কাছে।
রাত প্রায় ১১টার কাছাকাছি, চারিদিকে আলো ঝলমল করছে, ওনার workshop অবশ্য বন্ধ, সবাই পুজোর ওখানে। তালা খুলে ঢুকলেন, আলো জ্বালিয়ে দেখলেন, নাহ কেউ তো নেই, ধুস কেউ রসিকতা করেছে, আবার আলোটা নিভিয়ে বেরোতে যাবেন, এই সময় কাঁধে কেউ একটা হাত দিলো .. কি রে বাবু তুই কি খুঁইজছিস মোরে??
কে,কে করে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, অন্ধকারে মুখটা বোঝা যাচ্ছে না, মিশকালো দৈত্যের মত কিছু একটা পথ আগলে দাঁড়ালো, রাস্তার আলো তার মুখের উপর না পড়লেও তাঁর হাতটা বোঝা যাচ্ছে, অলোকেশ বাবু বুঝতে পারলেন তাতে একটা ছোরা ধরা, চিৎকার করে উঠলেন তিনি, আর তখনই অনেক গুলো টর্চ একসাথে জ্বলে উঠলো। রজত এগিয়ে এসে বন্দুকের নলটা ঠেকালো আততায়ীর ঘাড়ে....
দৃশ্য ১১
অন্তিম পর্ব
দিবাকর বাবুর বৈঠকখানা
৭ই নভেম্বর ২০১৯
আজ এই কেসের সাথে যুক্ত সবাই জড়ো হয়েছে। দিবাকর বাবুর পরিবারের লোক, তারক বাবুর পরিবারের লোক এবং অলোকেশ বাবুর পরিবারের লোক। এছাড়া রাজেশ বাবু ও পুলিশের তরফ থেকে, সুনীলবাবু,নীলাভ,রাজা,সমীক, এবং রজত বাবু।
রজত: উপস্থিত সকলকে ধন্যবাদ জানাই, এখানে আসার জন্য। অর্ক বাবু বিশেষ ধন্যবাদ আজ এখানে এই সভাটা আয়োজনের অনুমতি দেওয়ার জন্য।
কমিশনার সাহেব অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। তবে আমি বলবো শুধু আমার একার কৃতিত্ব নয়। আমাদের পুরো টিম খুবই দক্ষতার সাথে কাজ করেছে।
রজত : আপনারা সকলেই জানেন আততায়ী ভোলা ওরফে ছিদাম সূত্রধর ধরা পড়েছে। সে তাঁর অপরাধ ও স্বীকার করে নিয়েছে।আমি জানি আপনাদের সকলেরই প্রশ্ন আততায়ীর মোটিভটা কি?
এই খুনের উদ্দেশ্যে কি? সেটা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৪০ বছর আগে যেখানে এই ঘটনার সূত্রপাত, সেইখান থেকেই শুরু করছি।
আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এক দল বন্ধু যাঁরা সবাই সরকারী আর্ট কলেজের সহপাঠী ছিলো এক সময়, তাঁদের একটি মিট হলো। মূলত কলেজের ১২৫ বর্ষ উদযাপনে এসেছিল সবাই। অনেকদিন বাদে দেখা হয় সবার। দিবাকর, তারক, অলোকেশ, শুভেন্দু,সত্য, ইকবাল, মইদুল, নিখিলেশ, ডিসুজা, নিত্য।
সবাই হুজুগ উঠলো যে বেরিয়ে আসা যাক দুদিনের জন্য। হুজুগটা তুললো দিবাকর। ও বরাবরই খুব হুল্লোড়ে ছিল। সবারই পুরুলিয়ার ছৌ নাচের ব্যাপারে আগ্রহ ছিলো, কি ভাবে তৈরি হয়, তাছাড়া ওই সময় পুরুলিয়ায় ফেস্টিভ্যাল ছিল, বেরিয়ে পড়লো তাঁরা দল বেঁধে।সবাই পারলো না যেতে, নিখিলেশ, সত্য দুজনই পরদিন ফেরার পালা। ডিসুজা, ইকবাল আর মইদুল ও যেতে পারলো না, বিশেষ কাজের কারণে, বাকিরা বেরিয়ে পড়লো।
ওঁদের মধ্যে নিত্য বলে ছেলেটির বাড়ি ছিল চরিদা গ্রামে। ওরা যেহেতু সার্কিট হাউসেই উঠেছিল, ওখান থেকে নিত্যর বাড়ি কাছে ছিল, ওর বাড়িতেও বেড়াতে গেলো সবাই। তারপর সেখান থেকে সুবল সূত্রধরের বাড়ি গেলো, ওই গ্রামে ওনার তৈরি মুখোশই সবচেয়ে বিখ্যাত।
ওখানেই আলাপ হলো সুবল সূত্রধরের ছেলে ছিদামের আর মেয়ে টগরের সাথে। টগরের তখন বছর কুড়ি বয়স, তাঁর মিসকালো চেহারায় ডাগর চোখটা অনেকেরই বুকে ঝড় তুললো। যাই হোক সবাই সারাদিন হইচই করে বেশ কিছু মুখোশের অর্ডার দিয়ে চলে গেলো। সন্ধ্যে নাগাদ ছিদাম আর তাঁর দিদি টগর গেল মুখোশগুলি দিতে।
সার্কিট হাউসে তখন মোচ্ছব চলছে, মহুয়ার নেশায় মাতাল সবাই। হরেক রকম খাবারের সারি। ছোট্ট ছিদাম তখন খেতেই ব্যস্ত। দেখলো দিদিটা মেলা গল্প জুড়েছে শহরি বাবুদের সাথে, একজন বাবু বললো তুই চলে যা, আমরা দিদিকে পৌঁছে দিয়ে আসবো, ও একটু গল্প করছে, আমাদের সাথে।
ওইটুকু ছেলে, গ্রামের সরল, সাধাসিধে জীবন তাঁদের, তারও ভীষণ ঘুম পাচ্ছিলো, সে বাড়ি চলে আসে। রাত বাড়ে কিন্তু তাঁর দিদি আর ফেরেনা। সুবল গ্রামের কয়জন লোক নিয়ে যায় সার্কিট হাউসে, কিন্তু গিয়ে দেখে বাবুরা সব চলে গেছে। দুদিন পরে কুসুমের দেহ রেল লাইনের ধারে পাওয়া যায়। নিত্যকেও আর গ্রামে দেখা যায়নি। গ্রামবাসী নিত্যদের ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তাতে কি বাপ মায়ের বুকের জ্বালা জুড়ায়?
ছিদাম বুকে আগুন নিয়ে বড় হতে থাকে, সেই সময় মিললো সুযোগ গ্রামে কয়জন ছেলে এলো শহর থেকে। তাকে বারবার বলে গেলো শহরের পুজোয় মুখোশ বিক্রির জন্য। ছিদাম এই সুযোগটাকেই কাজে লাগালো।
পাখি পাহাড়ের কাজের সুবাদেই বেশ কিছু লোকের সাথে পরিচয় ছিল ছিদামের। তাঁর মধ্যে পাঁচু একজন।
গ্রাম ছাড়ার আগেই পাঁচুকে ফোন করে, আর শহরে যাবার ব্যাপারে ইচ্ছা প্রকাশ করে। পাঁচুও তখন কদিন গ্রামের বাড়িতে আসবে বলে ছুটি নিতে চাইছিল, ও কিছুদিনের জন্য দিবাকর বাবুর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিল।
ছিদাম যখন আসে তখন জানতো না যে ও যেখানে কাজ করতে ঢুকেছে তিনিই প্রথম শিকার।
ছিদাম এমনি গ্রামের স্কুলে ১২ক্লাস অবধি পড়াশোনা করেছে, সংস্কৃত ছিলো তাঁর, ৮ ক্লাস অবধি। তাছাড়া পাড়ার কানু পুরোহিত ও খুব ভালোবাসতো তাকে, ওনার কাছেই সংস্কৃত শিক্ষা।
কিছুদিনের মধ্যেই দিবাকর বাবুর অত্যন্ত কাছের মানুষ হয়ে উঠলো সে। এদিকে ছিদাম ও সুযোগ খুঁজছিল আর পেয়েও গেল। মহালয়ার দিন ভোরেই দিবাকর বাবুকে শেষ করে দিলো। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলো পরবর্তী খুনের।
এখানে থাকার সুবাদে বাকিদের খুঁজে পেতেও
খুব কষ্ট পেতে হয়নি, প্রত্যেকেই বিখ্যাত ততদিনে।
শুভেন্দু ঘোষ আর নিত্য পাল অনেকদিন আগেই মারা গেছেন, বাকিদের খুঁজে বের করতেও বিশেষ অসুবিধা হলো না। তারকবাবু কে খুন করার আগের দিন অর্কবাবুকে ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার নাম করে ছুটি নেয়, তবে তারকবাবুর খুনের পর ওনার বডিটা ইচ্ছে করেই দূরে গিয়ে ফেলে আসে, বিষয়টি কে গুলিয়ে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে পাঁচু ফিরে আসায় ও অর্ক বাবুদের কাজ ছেড়ে দেয়।
টানা বলার পর, রজত বাবু থামলেন, ঘরে সবাই চুপ।
এদিকে সমান্তরাল ভাবে আরো একটা ঘটনাও ঘটতে যাচ্ছিল। কিন্তু ছিদামের আকস্মিক আবির্ভাব তাঁর পরিকল্পনাকে বানচাল করে দেয়। কি রাজেশ বাবু?
রাজেশ মাথা নিচু করে শুনছিলেন, হঠাৎ নিজের নামটা শুনে চমকে তাকালেন। মানে কি বলছেন এসব?
রজত : রাজেশ বাবু একটা কথা বলবেন? আপনার বাবার নাম কি? উনি কিভাবে মারা যান?
রাজেশ: আমার বাবার নাম নিত্য সূত্রধর। কেন? তাঁর সঙ্গে এই কেসেরই বা সম্পর্ক কি?
রজত: সে কথা বলতে গেলে আবার গত চল্লিশ বছর আগের ঘটনার দিনের কথা আবার বলতে হয়। হ্যাঁ সেই দিন পুরুলিয়ায় যে বন্ধু গ্রুপটা গিয়েছিল যাঁদের বাড়ি গিয়েছিল সেটাই আপনার পৈত্রিক বাড়ি, এটা নিশ্চই অস্বীকার করবেন না। আর আপনার বাবার ও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, উনি আত্মহত্যা করেছিলেন দীর্ঘ অবসাদে ভুগে। আর ঘটনার দিন রাতে আপনি যে বাড়ি গিয়ে আবার মধ্যরাতে বেরিয়েছিলেন, তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। গঙ্গার ধারের সি সি টিভি আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী। অত সকালে হঠাৎ গঙ্গার ধারে কি করছিলেন আপনি? কিছু কি সদুত্তর আছে আপনার কাছে?
রাজেশ : চিৎকার করে উঠলো। হ্যাঁ আমি চেয়েছিলাম ওনাকে খুন করতে। ওনাদের কয়েকজনের জন্য আমাদের পরিবারটা ধ্বংস হয়ে গেলো। আমাদের গ্রামের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসীরা। আমরা ভিটে মাটি ছাড়া হলাম। তারপরও বাবা সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতো, সব সময় বলতো টগরদিদি আসছে, এই করে করে পাগল হয়ে গেলো, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা। জানেন কি এই দিবাকর কাকাই নেতৃত্ব দিয়েছিল। টগরপিসীকে মহুয়ার সাথে মদ খাইয়ে কি অচৈতন্য করা হয়েছিল, বাবা বাধা দিয়েছিল বলে বাবাকেও আটকে রেখেছিল। এরা মানুষ !!!
দুঃখের বিষয় আমি নিজের হাতে পারলাম না ওকে শেষ করতে, আমি পৌঁছনোর আগেই ছিদামকাকা কাজ সেরে ফেলেছেন। এতদিনে টগরপিসীর আত্মার শান্তি পেলো।
ঘরে একটা পিন পড়লেও শব্দ পাওয়া যাবে।
রজত মাথা নীচু করে বললো আমার আর কিছু বলার নেই।
শুধু রাজা মৃদু স্বরে বললো, আমরা আইনের রক্ষক তাই তথ্য প্রমাণ যাকে অপরাধী বলবে তাকেই বিশ্বাস করবো, কিন্তু সত্যি কি ছিদাম অপরাধী স্যার?
সবাই মাথা নিচু করে বসে রইলেন, রাজা রজত সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি আসতে পারি স্যার?
রজত মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
রাজা বেরিয়ে আসলো ধীরে ধীরে, বাইরে মা জগদ্ধাত্রীর ভাসানের মিছিল চলছে....
চারিদিকে আলোর রোশনাই, রাজা ভাবলো চরিদা গ্রামেও কি আলো জ্বলছে না কি নেমেছে বৃষ্টিধারা ...যাতে মিশে আছে কোনো এক টগরের চোখের জল......জানিনা আর কত নির্দোষ টগরকে এভাবে হতে হবে লালসার স্বীকার, দিতে হবে জীবন বলি....
--------সমাপ্ত------
(এই ঘটনা এবং ঘটনার চরিত্ররা সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বাস্তবের কোনো চরিত্রের সাথে কোনো অনিচ্ছাকৃত মিল থেকে থাকলে আমি দুঃখিত, শুধুমাত্র স্থানগুলোর নাম নেওয়া হয়েছে গল্পের প্রয়োজনে।)
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহিষাসুর মর্দিনী,পুরুলিয়া অঞ্চলের কিছু মানুষের ভাষা ও লেখা, ওই অঞ্চলের টুসু গান, গুগলের উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য নেট থেকে সংগৃহীত তথ্য)