Piyali Mukherjee

Abstract Inspirational

4.5  

Piyali Mukherjee

Abstract Inspirational

জানকীরা ...🍁

জানকীরা ...🍁

11 mins
603


#ডায়েরির পাতায়


চোখ মেলে যখন তাকালাম তখন গভীর রাত হয়ে গেছে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বিছানায় বসে অনেক চিৎকার করলাম, কান্নাও পেয়ে গেল। বারবার সন্দীপের ফোনে ফোন করলাম। কিন্তু নাম্বার বন্ধ। রুমের মধ্যেই আত্মহত্যাও করতে চাইলাম কিন্তু সাহস করতে পারলাম না। ……

জানকীর গলার আর্তি যেন এষার সাথে মিলে গেল। মনটা যেন কেমন করে উঠলো! এষা উত্তেজিত হয়ে ঘটনাটা বললো, প্রিন্সিপাল স্যারের ছেলে যখন ফাঁকা ক্লাসরুমে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো, "আমি তোমাকে ভালবাসি। " তখন পিছনে ফিরে দেখি প্রিন্সিপাল স্যার দরজার সামনে।

আমি কিছু বলতে গিয়েও থমকে গেলাম, "স্যারের ছেলের ওই প্রপোজালের জবাব কিভাবে ‌দেবো !?

নাকি স্যার কি কি প্রশ্ন করবে তার জবাব দেবো !?"

কিছু বুঝতে পারলাম না! কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়েছি মাত্র। এতক্ষণ মোবাইলের অপরপ্রান্ত হতে এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বলে গেল এষা।

আমি বললাম, "তারপর কি হলো? প্রিন্সিপাল স্যার কিছু বললেন না তোকে?!"

-"না। কিন্তু মুখটা গম্ভীর ছিল। আমার ভয় আর ভাবনা যেন সত্যিই খানিকটা কমে গেল । কারণ প্রিন্সিপাল স্যার দ্রুত সরে গেলেন, আর আমিও তড়িঘড়ি করে বের হয়ে দিলাম দৌড়। কিন্তু পরবর্তী মুহূর্তে আমার ভাগ্যে কি হতে পারে, সেকথা যেন ভগবানই তখন বলতে পারতেন!"

আমি ওকে সেই মুহূর্তে থামিয়ে দিয়ে বললাম, "ঠিক আছে আমি তো আজ রওনা দিয়েছি কলকাতার উদ্দেশ্যে , কালকে সকালে পৌঁছে যাবো । তারপর না হয় গিয়ে দেখবো কি করা যায় ? " আশ্বস্ত করলাম এষাকে । -"শমীক, তুই তাড়াতাড়ি আয়। তুই না আসা পর্যন্ত আমি কলেজে যাবো না। " কেমন বিভ্রান্তের মতো বলে উঠলো এষা ।

-"আচ্ছা ঠিক আছে এখন ফোন রাখ, আমি এইমাত্র বাসের মধ্যে উঠে বসলাম।"

-"ঠিক আছে তবে , সাবধানে আয়"।

কুচবিহারে বাড়ীতে এসেছিলাম, আজকে চলে যাচ্ছি। এতক্ষণ ধরে আমার অসমবয়সী বন্ধু এষা সেনের সঙ্গেই কথা বলছিলাম। কিন্তু সত্যিই এই মুহূর্তে বাস না ছাড়ার জন্য আমি বিরক্ত হয়ে উঠলাম , কি কারণে দেরি হচ্ছে বুঝতেও পারছি না!

একটু পরে বাসের টিকিট চেকারকে কথাটা জিজ্ঞেস করার পরে জানলাম একজন যাত্রী নাকি এখনো আসেনি। বারবার কল করা হচ্ছে কিন্তু তিনি অনেকক্ষণ ধরেই পাঁচ মিনিট , পাঁচ মিনিট করছেন।

নির্দিষ্ট সময়ের চল্লিশ মিনিট পরে সেই যাত্রী এসে উপস্থিত হলো, বাসের মধ্যে তখন একটা টানটান উত্তেজনা। গেট দিয়ে ঢুকে যে মেয়ে সামনের দিক থেকে আসছে ,তাকে দেখে অবাক হলাম। চেহারার মধ্যে আহামরি কিছু নেই, কিন্তু তাকিয়ে থাকলে যেন অনেক কিছুই দেখার আছে।

আমি বসে আছি জানালার পাশে, আমার পাশে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তাকে যদিও আমি সহ্য করতে পারছি না, কারণ অনেকক্ষণ ধরে তিনি ঘাসের মতো পান চিবোচ্ছেন। হঠাৎই আমাদের কাছে এসে মেয়েটা আমার পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বললো, " দাদা, এটা তো মনে হয় আমার সিট, আপনি কি এই সিটের যাত্রী ?"

লোকটা তার পান চিবানো দাঁতগুলো বের করে দিয়ে বললো, " সেটাই তো মনে হচ্ছে।" মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবেই টিকিট-চেকারকে ডাক দিয়ে বিষয়টা বললেন, তখন তিনি দুজনের টিকিট চেক করে আমার পাশের লোকটাকে পিছনের সিটে যেতে বললেন। লোকটা নাকি ভুল করে একটা সিট সামনে বসে পড়েছে, আর ওই মেয়েটির সিট নাকি আমার পাশে !!

"বাঃ, আমি তো তখন মনে মনে খুব খুশি। এমন সুন্দর একটা মেয়ের সঙ্গে পুরো রাস্তা একসাথে যেতে পারবো।" মুখে গম্ভীর ভাব নিয়ে চুপ করে বসে আছি, যেন পাশের সিটের বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই আমার।

মেয়েটাও ব্যাগ রেখে আমার পাশে ধপাস করে বসে পড়লো। তারপর বললো, "আপনার যদি খুব বেশি অসুবিধা না হয় তাহলে একটু জানালা বন্ধ করে দিন না। শীতের হাওয়ায় আমার শ্বাসকষ্ট হয়। " 

জানলা বন্ধ করে দিলাম, মেয়েটাও বললো, "ধন্যবাদ "।

আমি বললাম, "আমার নাম শমীক"। সেও একটা হাসি দিয়ে বললো, "জানকী"।

তারপর দুজনেই চুপচাপ, উত্তরবঙ্গ বাস-পরিবহণ আমাদের নিয়ে কলকাতার দিকে রওনা দিল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসেও এখানে বেশ ঠান্ডা থাকে আর সেটাই স্বাভাবিক, তাই আমি আগেই শীতের পোশাক পরে নিয়েছি।

বাসের ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা লেগেছিল, হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালাম। পাশের সিটের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি সে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আমি কিছুটা অবাক হয়ে বললাম , "আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে "?

মেয়েটা যেন লজ্জা পেল, হাত দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে বললো, "কই কিছু না তো।"

আমি চুপ করে গেলাম, কিন্তু চোখে ঘুম আসছে না, মেয়েটার কান্নার রহস্য জানতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কীভাবে কথা বের করা যায় সেটাই ভাবছি, বোধহয় একটু গল্প করা দরকার।বললাম, "আপনি কোথায় যাবেন?"

মেয়েটি বললো, "বনগাঁ।"

- ওহ্হ আচ্ছা, সেখানে আপনার বাড়ি? নাকি কোনো কাজে?

-আমার বাড়ি।

- কুচবিহারে কেন , বেড়াতে?

- এতো প্রশ্ন করছেন কেন? মেয়েটি যেন এবার বিরক্ত হলো !

-না মানে এমনি, সরি। কিছু মনে করবেন না, প্লীজ।

-"ঠিক আছে। কিছু মনে করিনি।" মেয়েটি হেসে ফেললো।

দূরপাল্লার বাসের একটা নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রাবিরতি হয়, কুচবিহার-কলকাতাগামী বাসটিও দাঁড়ালো তার সময়ে। সবাই আস্তে আস্তে নামলো, কিন্তু মেয়েটার নামার কোনো লক্ষ্মণ ছিল না।

আমি বললাম, "আপনি কি নীচে নামবেন? আমার কিন্তু যাওয়ার প্রয়োজন আছে।"

মেয়েটা খানিকটা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, "আপনার কাছে যদি বেশি টাকা থাকে তাহলে আমাকে কিছু খাওয়াতে পারবেন? একদমই নেই আমার কাছে টাকা। অনেক কষ্ট করে বাসের টিকিটের টাকা জোগাড় করেছি ।"বলেই কেঁদে ফেললো।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,"হ্যাঁ টাকা আছে। চলুন।"

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দুজনেই একটা টেবিলে খেতে বসলাম, আমার মনের মধ্যে একটার পর একটা কৌতুহল জমা হচ্ছে। মেয়েটা এতক্ষণ ধরে ক্রমাগত চাপা কান্নায় ছিল, এখন বলছে তার সঙ্গে নাকি টাকা নেই। অদ্ভুত! তবে খেয়াল করলাম যে, ওর হাতে কোনো মোবাইল নেই ! একটু অবাক হলাম।

খেতে খেতে আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো বলে ভাবলাম, কিন্তু করলাম না। কারণ আবার যদি অন্য কিছু বলে! কিন্তু এবার সে নিজে থেকেই বললো,

-"আমি যে বাড়িতে ছিলাম সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্ট্যান্ডে এসেছি তাই দেরি হয়েছে ।"

আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটি বলল, " টিকিট কাটার টাকা আমি ছোটো মোবাইল বিক্রি করে যোগাড় করেছি।" ভাবলাম, ও আরও কিছু বলবে। কিন্তু না, সে বললো না আর কিছু! আমিও আর বেশি জোর দিলাম না।

খাবার খেয়ে চা হাতে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি দুজনেই, আমাদের বাসের অন্য যাত্রীরা আমার আর মেয়েটার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাচ্ছে। হয়তো ভাবছেন যে এরা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে ঘনিষ্ঠ হলো !! আর আমি মনকে বললাম, " যদি জানতে চাও কিছু , তাহলে অপেক্ষা করো, হয়তো জানতে পারবে।" মনের কৌতূহল চেপে রাখলাম।

সিটে বসে মেয়েটা বললো, " আপনার কাছে এই রাতটার জন্য চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। এভাবে সবাই সবার উপকার হয়তো করে না।"

-"ঠিক আছে ,সমস্যা নেই।"

-" আপনি প্রথম যখন অনবরত প্রশ্ন করছিলেন তখন বিরক্ত লাগছিল। তবে এখন আর বিরক্ত লাগছে না তাই নিজের কাছে কথা বলতে ভালোই লাগছে।"

আমি শুধু হাসলাম।

- "জানেন, আমি দুপুরেও কিছু খাইনি, বেরিয়ে এলাম, যেখানে ছিলাম।" আবার দুজনে চুপচাপ।

বাস আবারও চলতে আরম্ভ করলো, মেয়েটা একটু পরেই ঘুমিয়ে গেল। মনে হলো, দীর্ঘ ক্ষুধার পরে খাবার খেয়ে শরীর এলিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর তার মাথাটা যখন আমার কাঁধের উপর পড়লো তখন আমি যেন কেঁপে উঠলাম। কেন এমন হলো, জানিনা। কিন্তু হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে আবার হাত গুটিয়ে নিলাম, থাক, সে ঘুমাক। রাত তখন সাড়ে দশটা।

রাতের কুয়াশা ভেদ করে বাস এগিয়ে যাচ্ছে, এই একটু আগে শিলিগুড়ি চৌরাস্তা পেরিয়ে এখন হাইওয়ের দিকে যাচ্ছি। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন অনলাইন করতেই হৈ হৈ করে হোয়াটসঅ্যাপে অনেক ছবি আর ভিডিও যেন ঢুকে পড়লো , তবে নেটওয়ার্ক সমস্যা রয়েছে। তাই একটু সময় লাগছে ডাউনলোড হতে, অপেক্ষা করতে লাগলাম, তবে ছবির নিচে টেক্সট আছে একটা। ছবি আসেনি এখনো, কিন্তু টেক্সট পড়া যাচ্ছে। তাতে লেখা , "ছবিগুলো ভাইরাল হয়ে গেছে, দেখতে থাকো, ভালো লাগবে।" কোনো এক বন্ধু পাঠিয়েছে গ্রুপে। পরে নাম দেখবো। একটু অবহেলা করেই দেখতে থাকলাম।

টেক্সট পড়তে পড়তে পিকচার ওপেন হয়েছে, একটা মেয়ের স্বাভাবিক ৬/৭ টা পিকচার এবং তিনটা পোশাক- বিহীন পিকচার। পোশাকবিহীন পিকচারগুলো যে একটা কোনো ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট করা হয়েছে, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু ছবিটি ভালো করে দেখতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে কেঁপে উঠলাম। সেই মুহূর্তে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না যে, মোবাইলের স্ক্রিনে যে মেয়েটার ছবি উলঙ্গ অবস্থায় আছে সেই মেয়েটাই আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। এটা কীভাবে সম্ভব?! সত্যিই কি এটা আমার পাশের সিটের মেয়েটার ছবি !

আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুললাম, ঘুম চোখে তাকিয়ে মেয়েটি আবার চোখ বন্ধ করলো। আমি এবার

ওকে ঠেলা দিয়ে বললাম, "ভালো করে দেখুন তো এই ছবিগুলো আপনার নাকি?"

মেয়েটা সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে গেল, আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। যেহেতু তার শরীর আমার শরীরের সঙ্গে মিশে আছে তাই অনুভব করছি যে সে কাঁপছে। আমার দিকে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিয়ে হাতে ওড়না নিয়ে মুখ চেপে কাঁদতে শুরু করলো । আশেপাশের লোকজন তখন গভীর ঘুমে, আর আমি ততক্ষণে যা বোঝার সেটা বুঝতে পেরেছি।

-"ছবিগুলো কে ছেড়েছে? আমার বন্ধু বলছিল যে একটা ভিডিও নাকি ভাইরাল করা হয়েছে। এই ভিডিওটি অনলাইনে কে ছেড়েছে?"

মেয়েটা কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বললো, "এটা আমার বয়ফ্রেন্ডের কাজ। ওই করেছে এগুলো!"

-"মানে..?"

-" হ্যাঁ , ঠিকই বলছি। আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে, ভেবেছিলাম ভিডিওটা অন্ততঃ ছাড়বে না, কিন্তু সেটাও ছেড়ে দিলো ! " তার দুই চোখ বেয়ে নিঃশব্দে জল পড়তে লাগলো।

আমি তখন বললাম, "আমি কি সবটা শুনতে পারি?"

মেয়েটা মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বললো।

-"তাহলে বলুন।"

-' " ওর ডাক নাম রনো, ভালো নাম সন্দীপ। বাবা, মা নেই। ওর প্রতি এই কারণেই আমার একটা দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। যখন ও মা-বাবার জন্য মন খারাপ করতো তখন আমি ওকে অনেক সান্ত্বনা দিতাম। দুই বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের। ও সেইবার শহর থেকে কুচবিহারে চাকরি নিয়ে এসেছিল আর আমি তখন আমার বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে কুচবিহারে গেছিলাম। সেখানেই দেখা হয় আমাদের। তারপর সে আমার বান্ধবীর মাধ্যমে প্রপোজ করে। আমি সেই সময় কিছু বলিনি কিন্তু পরে আস্তে আস্তে তার একাকিত্বের কথা শুনে মায়া হলো। তারপর কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আমি তার প্রেমের অভিনয়ে সাড়া দিয়ে ফেললাম।

জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল নিয়ে এগিয়ে চলছিল আমার জীবন। কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমার বিয়ে ঠিক করে আমার পরিবার। আমি সে কথা রনোকে বললাম, ও আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চাইলো। আমি সপ্তাহখানেক ধরে ভাবলাম, তারপর রনোর কাছে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম , এটা আরেকটা ভুল।

বাড়ি থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে কুচবিহারে চলে এলাম একা একা। বান্ধবীকে জানালাম এতো বড়ো সিদ্ধান্ত। ও শুনে ভয় পেল‌ বারণ ও করলো। কিন্তু আমি শুনলাম না।

নিয়তি হয়তো একেই বলে!

কিন্তু অদ্ভুত! সন্দীপ আমাকে কুচবিহারে ওর বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে সরাসরি আলিপুরদুয়ারে নিয়ে এলো।

অথচ, কুচবিহার শহরে আমাদের দুজনের চেনাশোনা অনেক। যখন জিজ্ঞেস করলাম তখন বললো , "বিয়ে আর হানিমুন একসাথে করবো । যদিও আমার কাছে ভালো লাগেনি এই সিদ্ধান্ত, কিন্তু ওর পরবর্তী কথা শুনে আর কিছু বলিনি। যেহেতু মাসের মাঝামাঝি, তাই এই মুহূর্তে নাকি নতুন কোনো বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। আর ও যেখানে থাকে, সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই চলতি মাসের এগারো দিন পর আমরা যদি আসি তাহলে নাকি এক তারিখ থেকে নতুন বাড়িতে উঠতে পারবো। রনোর কথায় কোনো সন্দেহ হলো না, তাই ভালবাসার মানুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে ঘুমাতে আলিপুরদুয়ারে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে একটা রুম নিলাম, আমি ওকে বিয়ের কথা বলাতে ও বললো , ওর কাগজপত্র সব নাকি কুচবিহারে রয়ে গেছে, তাই ফিরে আমরা বিয়ে করবো। বিশ্বাস করে বিয়ে ছাড়াই আমরা একই সঙ্গে থাকতে লাগলাম। এটাই সবচেয়ে বড়ো ভুল।

স্বামী -স্ত্রীর সব কাজ সম্পন্ন করে ফেললাম। এতদিনের আগলে রাখা সম্মান, শরীরের সম্ভ্রম সব শেষ করলাম , কারণ আমি বিশ্বাস করতাম রনো আমাকে ঠকাবে না। আটদিন আমরা হোটেলে ছিলাম, এরমধ্যে রনো আমার সঙ্গে কখনো দিনে, কখনো রাতে এই অবৈধ কাজটা করে যেত। বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা কিন্তু সত্যি বলছি, প্রথম দিনের পরে প্রতিবারই খুব খারাপ লাগতো।

কিন্তু কাকে বলবো? ওর জন্য তো আমিও সবকিছু ফেলে এসেছি। তাই মনের মধ্যে প্রতিবাদ উঠলেও সেটা কখনো মুখে প্রকাশ করিনি। আমি ওকে যখন বলেছিলাম ,যে চাকরির ক্ষতি হচ্ছে না তোমার?!

রনো বললো , "সে নাকি ছুটি নিয়েছে পনেরো দিনের জন্য, বিয়ের কথা বলে নাকি সে ছুটি নিয়ে এসেছে।"

আটদিন পরে একদিন আমি দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রনো তখন বাইরে গেছিল, কারণ কি নাকি কাগজপত্র মেইল করতে হবে, নাকি এমন কিছু একটা!

ঘুম থেকে উঠে দেখি চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, রনো তখনও ফেরেনি। ফোন করলাম, দু-তিনবার ফোন করার পরে রনো ফোন ধরে যেটা বললো সেটা শুনে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

রনো বললো, "জানকী,তোমার সঙ্গে আর কখনো আমার দেখা হবে না। তুমি তোমার সবকিছু নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে যাও, আর তোমার মা~বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে সংসার করো। আমার সঙ্গে কাটানো এই মুহূর্তগুলোকে স্বপ্ন ভেবে ভুলে যেও, তুমি যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে ততই লাভ। আর এসব নিয়ে কারো সঙ্গে অভিযোগ করতে যেও না। কোনো লাভ হবে না। এমনকি যদি বেশি বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করো , তাহলে কিন্তু তোমার ওই ফুটফুটে দেহটির সঙ্গে আমার খেলাধূলা সব ভাইরাল হবে। কারণ আমি তিনটি ভিডিও বানিয়ে নিয়েছি তোমারই অজান্তে।" মাথাটা হঠাৎই ঘুরে গেল।

চোখ মেলে যখন তাকালাম তখন গভীর রাত হয়ে গেছে, ধড়ফড়িয়ে উঠে বিছানায় বসে অনেক চিৎকার করলাম। কাঁদলাম। বারবার রনোর নাম্বারে ফোন দিলাম। কিন্তু নাম্বার বন্ধ করে দিয়েছে। রুমের মধ্যেই আত্মহত্যা করতে চাইলাম কিন্তু সাহস করতে পারলাম না।

সকাল বেলা হোটেলের ম্যানেজারের কাছে বকেয়া বিলের কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ। নিজের ব্যাগে সামান্য টাকা ছিল কারণ এ কয়দিনে যা খরচ হয়েছে, সেটা বাদ দিয়ে বাকি সবটাই রনোর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলাম। কিন্তু এখন আমি হোটেলের টাকা শোধ করবো কিভাবে?!! বাধ্য হয়ে হাতের বড়ো মোবাইল বিক্রি করলাম। কারণ ইতিমধ্যে হোটেলের লোক কিছু কিছু বুঝতে পেরেছে। ছোটো মোবাইল আর খুচরো কিছু টাকা নিয়ে কুচবিহারে এলাম। এসে আমার ওই বান্ধবীকে ফোন করলাম , তারপর ওর বাড়িতে গেলাম। আর সেখান থেকেই এখন অজানার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আর কতদিন ওর বাড়িতে থাকবো? ওর বাড়ির লোকজন বিষয়টা পছন্দ করলো না। নিজের বাড়িতে যে ফোন করবো তারও আর উপায় নেই বোধহয়, কেউ মানবে না। কি করবো জানি না। "'চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়লো জানকীর।

স্তব্ধ হলাম মেয়েটার ঘটনা শুনে। বাস ততক্ষণে অনেক দূরে চলে এসেছে, বর্ধমান থেকে কেউ কেউ যে যার স্টপেজে নেমে যাচ্ছে। কোলাঘাটের ধাবাতে এসে ব্রেকফাস্টের জন্যে বাস থামলো। বাস থেকে বাইরে নেমে দাঁড়ালাম। ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় মনটা ভরে গেল। পাশে রূপনারায়ণ, এখানে আসলেই মনটা ভীষন ভালো হয়ে যায়। জানকীকে ডাকলাম। নামতে হবে। আবার অনেকটা যাত্রা।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই রেডি হয়ে বাসে উঠলাম। ‌‌এবারে একবারে কলকাতা। পৌঁছে যাবো এগারোটার আগেই হয়তো। একবার কলেজে যাবো এষাকে নিয়ে। স্টুডেণ্ট ইউনিয়নে বিষয়টা দিয়ে ইউনিভার্সিটি যাবো। কিন্তু জানকীকে নিয়ে কি করবো! জিজ্ঞাসা করলাম," কে আছে কলকাতায়?"

-"কেউ নেই।"

- "আর বনগাঁ যাবেন যে বললেন তখন! কিভাবে যাবেন ?"

-" না, আর যাওয়া যাবে না। ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে না? তাহলে কি করে!" ; সত্যিই আমিও ওর কথা শুনে চিন্তায় পড়লাম। কলকাতার বাড়িতে আমিও ওকে নিয়ে যেতে পারিনা। তাহলে!

ভেবে ঠিক করলাম ওকে কিছুদিন এষার সাথে রাখি। দুজনে দুজনের সমস্যাটা বুঝবে। পরে দেখছি কি করা যায়। পুলিশ কমপ্লেন করতে হবে কি না আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। বললাম," আমার সঙ্গে যাবেন?"

জানকী মাথা হেলালো। বুঝলো, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর।

বাস চললো গন্তব্যের দিকে। ভাবলাম, জীবন সত্যিই এক রহস্যময় বস্তু, আবার এক বিরক্তিকর অধ্যায়। এই পৃথিবীতে সবাই নাকি বিপরীত মানুষেরই প্রেমে পড়ে, ধোঁকাও খায়। তবুও পরবর্তী পৃষ্ঠার মধ্যে ভালো কিছু থাকবে বলে আমরা তো প্রতিনিয়ত পাতা উল্টাই।

জীবনের পর জীবন এ ঘটনা চলতেই থাকে। জানকীরা এমন বিপদেই পড়ে, বিশ্বাস করে, কেউ জীবন শেষ করে, আবার কেউ বা লড়ে যায়। মেয়েদের এমন বিপদের শেষ নেই হয়তো কোনোদিন, শুধু পরিস্থিতি পাল্টায়, সময় পাল্টায় ।।…… .....

(কলমে -পিয়ালী মুখোপাধ্যায় )



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract