STORYMIRROR

Piyali Mukherjee

Abstract Inspirational

3  

Piyali Mukherjee

Abstract Inspirational

রাজেশ্বরী 🌼

রাজেশ্বরী 🌼

5 mins
13


#এক সুরের জন্ম


ঘুঘু- পাখি এক অদ্ভুত সুরে ডাকে রোজ

একই সময়ে, বারান্দার রেলিঙে, ভোর সকালে

কিন্তু কাকে ডাকে কী বলে জানিনা,

তবে ভালো লাগে,

এই কি সেই শিশু পাখি !

জন্মেছিল ঝোলানো টবে, নাইন ও'ক্লক গাছ 

বিছানায়

গলায় ছিটছিট পালক ঢাকা শরীর, 

চঞ্চল চোখদুটি 

শুধু কাউকে খোঁজে আর ডেকে চলে

লোকে বলে ঘুঘু ডাকা, অকল্যাণ 

এই ডাকে কি অকল্যাণের সুর থাকে ! 

অথচ একা বারান্দায় বসে এক বৃদ্ধা 

নীরবে করুণ সুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে 

কাকে যেন ডাকে, ডেকেই চলে

আয়..আয়.... ফিরে আয়, 

বড়ো যে নিঝুম লাগে......


অর্জুনদাস বাসুদেব ছিলেন লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি। তাঁর মেধাবী কন্যার লেখা পড়া লাহোরেই। পঞ্জাবের মেয়ে। সংস্কৃতের মেধাবী ছাত্রী।

শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার তাগিদেই তিন মাসের মধ্যে শিখে ফেলেছিলেন বাংলা ভাষা। সে কালে মেয়েদের গান শেখার পরিবেশ সহজ ছিল না। স্নাতক হওয়ার পর মেধাবী রাজেশ্বরী এক রকম জোর করেই শান্তিনিকেতনে চলে আসেন সঙ্গীতশিক্ষার জন্য। 

সেটা ছিল ১৯৩৮ সাল। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত চার বছরের শিক্ষাক্রমে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখেন শান্তিদেব ঘোষ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, ইন্দুলেখা ঘোষ, অমিতা সেন (খুকু) প্রমুখের কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে তালিমের সঙ্গে পেয়েছেন তাঁর স্নেহ,ভালবাসা, আশীর্বাদ । অবাঙালি কন্যাটির প্রতিভা ও সুকণ্ঠ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অগাধ আস্থা ছিল, অন্দরমহলে তিনি আক্ষেপ করতেন শারীরিক অসমর্থতার জন্য একে আমার শিখিয়ে যাওয়া হল না। তিনি রাজেশ্বরী বাসুদেব (দত্ত) এক ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়েও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, অথচ প্রায় অনালোচিত !

রাজেশ্বরী চার বছর বয়সে গান গাওয়া শুরু করেছেন, প্রথম পাবলিক পারফরমেন্স করেন বেশ অল্প বয়সে। গেয়েছিলেন ক্যাসিক্যাল, ঠুংরী ও রাগঘেষা গান কোনও গুরুর কাছে না শিখেই।গ্ৰ্যাজুয়েট হওয়ার পরে শান্তিনিকেতনে গেলেন একটা স্কলারশিপ পেয়ে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের অপরূপ ভঙ্গীতে অবাঙালি রাজেশ্বরী বাসুদেব তখন সন্মোহিত। গানের রসগ্ৰহণের দুর্বার আকর্ষণে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার প্রথম তিন মাসে শিখে ফেলেছিলেন বাংলা ভাষা। 

রবিলিপিকর সুধীরচন্দ্র কর লিখেছেন , "(গুরুদেব) উদয়নের একতলায় সামনের চাতালে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে গান শেখাচ্ছেন সঙ্গীতভবনের ছাত্রী রাজেশ্বরী দেবীকে। গেয়েই চলেছেন। কণ্ঠে আকুলতা কুল মানছে না। পুরনো গান— ‘আমার পরান লয়ে...’। কখনও গাইতেন— ‘বড়ো বেদনার মতো...’।” (কবিকথা)

সে সময় শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন নৃত্যনাট্যে গানে অংশ নিয়েছিলেন রাজেশ্বরী। প্রথম রেকর্ডও শান্তিনিকেতনে বাসকালেই ১৯৪১-এ। বর্ষামঙ্গলের জন্যে ১৯৩৯-এ কবির লেখা ‘আজি তোমায় আবার’ ও ‘বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল’ গেয়েছিলেন।

শান্তিনিকেতনের পর রাজেশ্বরী কলকাতায় গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের তালিম নিলেও রেকর্ডে গেয়েছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতই। বেশির ভাগ রেকর্ডই ছিল ‘হিন্দুস্থান’-এ। প্রধানত খেয়াল-ঠুংরি-টপ্পা ধরনের দুরূহ রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতিই ছিল তাঁর বরাবরের পক্ষপাত। চর্চিত উজ্জ্বল কণ্ঠ, উচ্চারণ অবাঙালিসুলভ নয়, অলঙ্করণ-প্রয়োগও ছিল নিপুণ। উপস্থাপনায় আবেগের আতিশয্য নেই, বরং যেন একটু নিস্পৃহতা। রবীন্দ্রগানের অন্তর্লীন বেদনা ঠিকই ধরতে পেরেছেন ‘আজি যে রজনী যায়’, ‘কখন বসন্ত গেল’, ‘চিরসখা হে’, ‘শেষ গানেরই রেশ’— এমন সব গানে। 

এমনকি রমেশচন্দ্রর সঙ্গে দ্বৈত গান ‘আমার মাথা নত করে দাও’ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। রাজেশ্বরীর জীবনে শান্তিনিকেতন পর্বেই ঘটেছে জীবনের এক বিশেষ ঘটনা। রাজেশ্বরীর ‘ফুল বলে ধন্য আমি’ শুনে কবি সুধীন্দ্রনাথ মোহিত। তবে তিনি বিবাহিত, কিন্তু কিছু দিন ধরেই বনিবনা হচ্ছে না প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে। একটা দূরত্বও তৈরি হয়েছে। ঘনিয়ে উঠল রাজেশ্বরীর সঙ্গে প্রেম। দু’জনের মধ্যে বহু পত্রবিনিময় হয়। ওদিক সুধীন দত্তের স্ত্রী বর্তমান, উপরন্তু দু’জনের মধ্যে বয়সের ফারাক অনেকটা— এ সব নিয়ে অনেক টানাপড়েনের পর ১৯৪৩-এর ২৯ মে লাহোরে বিবাহ।

সেই ৪৩ থেকে ৬০ রাজেশ্বরীর জীবনে স্বপ্নরাঙা অধ্যায়। একদিকে সুধীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে "কাব্য ও সমালোচনা"-কে ধ্রুপদীভাবের মর্যাদাভূষিত করছেন, অন্যদিকে রাগভিত্তিক রবীন্দ্রসঙ্গীতের দীপ্তিতে রাজেশ্বরী সঙ্গীত জীবন আলোকময়।স্বামী -স্ত্রী দুজন দুজনের প্রেরণা। রাজেশ্বরীর একের পর এক রেকর্ড বের হতে লাগল। 'শেষ গানেরই রেশ ', 'ওগো আমার চির -অচেনা', 'যে রাতে মোর দুয়ারখাগুলি', 'আজি যে রজনী যায় ', সহ আরও অনেক। রাজেশ্বরী সম্ভবত একমাত্র শিল্পী যিনি একই দিনে বেতারে ভজন, ঠুংরী এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত সমান দক্ষতায় পরিবেশন করেছেন। 

নিজের মুখেই অবশ্য বলেছেন "ক্ল্যাসিক্যাল গানের প্রতি আমার ভালবাসা গভীর একথা সত্যি হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার মনের আকাশকে এমন এক বিচিত্র আবেগে রাঙিয়ে তুলেছিল যে এই গানের জন্য আমি আলাদা এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করতাম"।

অবশ্য মেধাবী রাজেশ্বরী ফরাসি, ইটালীয়, জার্মান ভাষা শিখে এই সব ভাষার কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন পরবর্তী কালে স্বামী সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে।ক্রিস্টিন বসনেকের সঙ্গে ফরাসিতে অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’। ১৯৬০ সালে সুধীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রাজেশ্বরী নিজেকে সক্রিয় রেখেছিলেন। ১৯৬৩ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা, ১৯৬৫-তে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, সব শেষে ১৯৬৯-এ লন্ডনে এসওএএস (দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ়)-এ ভারতীয় সঙ্গীত ও সঙ্গীততত্ত্বের শিক্ষকতা। ১৯৬০সালে কবি পতির প্রয়াণের পর তিনি লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে ' স্কুল অফ আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে' এর সঙ্গীত বিভাগের ডাইরেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে বিদেশে চলে আসেন।

কবি বিষ্ণু দে ছিলেন রাজেশ্বরী দত্তের গানের ভক্ত, তাঁকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন কবিতা ' পরকে আপন করে'। রাজেশ্বরী দত্ত সম্পর্কে সঙ্গীতের সমালোচকরা বলেন তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, চাইলে বড় ধ্রুপদী হতে পারতেন,খেয়ালিয়া হতে পারতেন, ভারতের শীর্ষ মানের গজল কিংবা ভজন গাইয়ে হতে পারতেন। কিন্তু উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বিরাট পটভূমি থাকা সত্ত্বেও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত কে ভালবেসেছিলেন।

গান তাঁর পেশা নয়, ছিল ধর্ম। প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, বৈদগ্ধ্য, প্রতিভার অধিকারী হয়েও রাজেশ্বরী ছিলেন স্নিগ্ধ, বিনয়ী, কোমল প্রসন্নভরা এক অসাধারণ চরিত্র। তাঁর অভিজাত ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে যিনি এসেছেন তিনি রাজেশ্বরী দত্তের ভক্ত হয়েছেন। 

কিন্তু সুখ তো অল্পস্থায়ী। সুধীন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু হল ১৯৬০’র ২৫ জুন। রাজেশ্বরী তখন মাত্র বিয়াল্লিশ। জীবনের ধারাটি আবার বদলে গেল তাঁর। ভারতের পশ্চিম প্রান্তের যে কন্যাটি সুরের টানে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে, নীড় বেঁধেছিলেন কলকাতায়, যাঁর সুরে মুগ্ধ বিষ্ণু দে লিখেছিলেন ‘পরকে আপন করে’, সেই রাজেশ্বরী তখন সংকটে জর্জরিত। সমস্যা শুধু আত্মিক নয় আর্থিকও। থেমে গেল গানের চর্চা।

১৯৬১তে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে National Tagore Centenary Committee-র আহ্বানে লন্ডনে আমন্ত্রিত হলেন তিনি। গাইলেন গান। লন্ডন, সরবোন, তারপর রোম আর বন শহরে। এই বছরেই যোগ দিলেন Congress for Cultural Freedom Paris-এ। ‘ভারতীয় সঙ্গীত’ বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন সরবোনের প্রাচ্য সঙ্গীতবিদ্যাচর্চা কেন্দ্রে। ক্রিস্টিন বসনেকের সঙ্গে অনুবাদ করতে শুরু করলেন রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’। যা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হল গালিমার থেকে। ১৯৬২ সালেই যোগ দিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগে। প্রথম বছরে তাঁর পড়ানোর বিষয় ছিল 'Ragas and Raginis of the Music of India'. পেলেন লাইব্রেরি সায়েন্স পড়ার জন্য স্কলারশিপ। এত কিছুর পরেও হাহাকার ছিল তাঁর কলকাতার জন্য। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ রাজেশ্বরী শিক্ষকতা করলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

১৯৭৫-এ স্টাডি লিভ নিয়ে এলেন ভারতে। ১৯৭৬ সালে ক্ষেত্র-সমীক্ষার জন্য বারাণসীতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়। ৬ এপ্রিল ভর্তি করা হল নার্সিংহোমে। ১০ এপ্রিল ভোরে চলে গেলেন রাজেশ্বরী। কলকাতা খবরও পেল না সব মোহ আবরণ' সরিয়ে চির অন্তরালে চলে গেল এক মহাপ্রাণ।

“এই মৃত্যু ঘোর মৃত্যু, পত্রপুষ্পে বিরাট বকুল/ আজকে উন্মূল হল”।।

(কলমে -পিয়ালী মুখোপাধ্যায়)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract