ভারতের বীরাঙ্গনা বীণা দাস
ভারতের বীরাঙ্গনা বীণা দাস
#ভারতের কথা #সাক্ষী ইতিহাস
# বীণা দাস
"স্যার, ভদ্রমহিলা আবারও এসেছেন। ভেতরে আসতে বলবো ?"
ডি আই সাহেব আজ একটু বিরক্তির সুরেই বললেন... 'বল।'
ভেতরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধা। দক্ষিণ কোলকাতায় এক স্কুল থেকে তিনি দশ বছর আগে রিটায়ার করেছেন। এখনো পেনশন পাননি। তদ্বির করতে এসেছেন বৃদ্ধা।
ভেতরে ঢুকতেই ডি. আই. অব স্কুল তাঁর ফাইলে কৃত্রিম মনোযোগ নিক্ষেপ করে বললেন... 'যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন।'
মহিলা তাঁর আঁচলে মুখের ঘাম মুছলেন। চশমার কাঁচ মুছলেন। তারপর ক্ষীণকন্ঠে একটা চেয়ারের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন.....
'স্যার ! আমার ফাইলটা মুভ করেছে?'
টেবিলের অপর প্রান্তে ফাইলে মুখ গুঁজে ডি. আই এর অবহেলার উত্তর ভেসে এলো...
"কী করে করবে? এ.জি বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। যথাযথ রিপ্লাই না পেলে আপনার ফাইল পাঠিয়ে কোন লাভ হবে না।"
প্রৌঢ়া বললো, 'কী জানতে চান ?'
ডি.আই বিরক্তির সুরে বললেন..... "আপনার সার্ভিস বুক থরোলি চেক করে আপনাকে আমি আগেও যে প্রশ্ন করেছিলাম এ জি ঠিক সেই প্রশ্নই করেছে ... তবুও আপনি আমায় রিকোয়েস্ট করেছিলেন এ জি-তে ফাইলটা পাঠাতে। আই হ্যাভ ডান মাই ডিউটি । নাও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু। আপনার সার্ভিস বুকে আপনার কোয়ালিফিকেশানের কোন উল্লেখ নেই। আপনি যে বি এ পাশ করেছেন তার প্রমাণ কোথায়? আপনাকে স্কুল কমিটি সিলেক্ট করেছিল কমপ্যাশানাট গ্রাউন্ডে। সার্ভিস বুকে শুধু লেখা রয়েছে, - সী হ্যাস বীন সিলেক্টেড অন দ্য রেকমেনডেশান অব এ সিনিয়র ক্যাবিনেট মিনিস্টার এন্ড দ্যা স্কুল কমিটি হ্যাজ বীন কমপেলড টু রিক্রুট হার অন কমপ্যাশানেট গ্রাউন্ড দ্যাট সি ওয়াজ এ ফ্রীডাম ফাইটার এন্ড হ্যাড বীন ইন জেল ফর এ সেভারেল লঙ ইয়ার্স।"
বৃদ্ধার মুখে এবারে ফুটে উঠলো অপমানের ছাপ।
সত্যিই তো, তিনি যে বি এ পাশ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে প্রমাণ কোথায়? তিনি বি এ পাশ করার পর একটা চোথা কাগজ পেয়েছিলেন বটে যেটাকে মার্কশিট বলে। কিন্তু সেটাই বা কোথায়? ১৯৩১ সালে বি এ পাশ করলেন ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে। পরের বছরে হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। সেই সমাবর্তনে তাঁর সারফিকেট পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হল কৈ? সেদিনই যে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করলো। তারপর দীর্ঘ কারাবাস। কারাবাস থেকে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন পুলিশ ঘরে ঢুকে তাঁর বইপত্র সবকিছু তছনছ করে চলে গেছে। অনেক খুঁজেও পাওয়া গেলো না তাঁর সেই মার্কশিট । আর সেনেট হলের সেই ঘটনার পরেই তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর সারটিফিকেট বাতিল করে দিল। তাঁর তখন মনে হয়নি ঐ সারটিফিকেটের মূল্য কতখানি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর আবারো জেলে গেলেন ভারত-ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দিয়ে। দেশ স্বাধীন হল। তাঁর মনে হল, এই স্বাধীনতাই কি তাঁরা চেয়েছিল? পেটের দায়ে নেতাদের দয়ায় দক্ষিণ কলকাতার এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে চাকরি করলেন ক'বছর। তখন কি করে বুঝবেন যে এ দেশে কমপ্যাসানেট গ্রাউন্ডে চাকরি পাওয়া যেতে পারে কিন্তু ইউনিভার্সিটির বাজেয়াপ্ত সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না ! এই সার্টিফিকেটের জন্যে তিনি বহুবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রেজাল্ট সেকশানে তদ্বির করেছেন। শেষে একজন এ্যাসিস্ট্যান্ট কন্ট্রোলার অনেক ফাইল ঘেঁটে-ঘুটে তাঁকে শেষে বলেছিলেন, "আপনার সম্পর্কে সে সময় সিনেটে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা বর্তমান সিনেট কনডোন করে আপনাকে সার্টিফিকেট দেওয়ার সুপারিশ না করা পর্যন্ত আপনাকে কোন সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না।"
অনেক চেষ্টা করে বৃদ্ধা একবার ভাইস চ্যান্সেলারের সাথে গিয়েও দেখা করেছিলেন। ভি সি যদিও খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তিনিও তাঁকে সেই একই কথা বলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস অনুযায়ী সিনেটের পারমিশান ছাড়া কাউকে সার্টিফিকেট দেওয়ার কোন প্রভিশান নেই। একজন সিনেট সদস্য একবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁকে ইউনিভার্সিটির তরফে সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে একটা প্রস্তাব তুলেছিলেন। কিন্তু সিনেট তো আসলে দলীয় রাজনীতির আখড়া। যিনি প্রস্তাব তুলেছিলেন তিনি তো দলীয় রাজনীতির বিচারে মাইনরিটি। তা তাঁর প্রস্তাব বাকিরা মানবে কেন? ফলে প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান হল। শত হলেও, বৃদ্ধা একজন কংগ্রেসি মন্ত্রীর রেকমনডেশনে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছিলেন। কংগ্রেসিরা রাজ্য শাসন থেকে বিদায় নিয়েছে। বৃদ্ধা আজও মনে-প্রাণে কংগ্রেসি। ক্ষমতায় এখন বামপন্থীরা। তাদের সেনেটররা এটা মানবেন কেন? কংগ্রেসিদের যত কিছু ছলাকলা সেসব গঙ্গাজলে ধুয়েমুছে শিক্ষাক্ষেত্রকে স্যানিটাইজ করার জন্যেই তো বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছেন।
দোরে দোরে ঘুরেও সমস্যার কোন সুরাহা হল না। উপরন্তু যারা তাঁকে কর্মসূত্রে চেনে বা জানে তারা আড়ালে-আবডালে বলতে লাগলো, মন্ত্রীর সুপারিশে কোনো সার্টিফিকেট ছাড়া এতো বছর চাকরি করেও ক্ষিদে মেটেনি। এখন আবার পেনশনের জন্যে বুড়ি তদ্বির করতে শুরু করেছেন এখানে ওখানে। একদিন কথাটা কানে গেলো বৃদ্ধার। তাঁর স্বামীও ছিলেন একজন প্রাক্তন স্বাধীনতা সংগ্রামী । তিনিও গত হয়েছেন। নিঃসন্তান, সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধার দু-চোখে তখন শুধু অন্ধকার। মনে করে দেখলেন, যেদিন তিনি কলকাতা ইউনিভারসিটির সার্টিফিকেটের পরোয়া না করে শহিদ বিনয় বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিভারসিটির চ্যান্সেলর স্টানলি জ্যাকসনের দিকে তাক করে রিভলবার চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেদিন কিন্তু তাঁর দু-চোখে একটুও অন্ধকার ছিল না। ছিল শুধু স্বপ্ন ! সে স্বপ্ন হল একদিন না একদিন দেশ স্বাধীন হবেই হবে। সে সব কোন যুগের কথা। আর কেই বা সেসব কথা মনে রেখেছে ?
হতাশায় নিমজ্জিত, আশাহীন বৃদ্ধা চোখের জল ফেলতে ফেলতে একদিন মনের দুঃখে চলে গেলেন হরিদ্বারে। তারপর হরিদ্বার থেকে একদিন এলেন হৃষীকেশে। কবে গেলেন হরিদ্বার আর কবেই বা এলেন হৃষীকেশে ---- সেসব এখন ডাস্টবিনের জঞ্জাল !
কলকাতা শহরটাকে তাঁর নিশ্চয়ই তখন মনে হয়েছিল এক জেলখানা। যে জেলখানার চেয়ে ইংরেজের জেলেখানায় কষ্ট এবং গর্ব ---- দুইই ছিল ঢের ঢের বেশি। এই গর্বই একদিন সব দুঃখ-কষ্ট ভোলাতে সাহায্য করেছিল তাঁকে। কিন্তু এখন এখানে থাকবেন কার ভরসায় আর কীসের আকর্ষণে ? এখানে তো দুহাত ভরে কুড়িয়েছেন শুধু অপমান আর অপমান।
হৃষীকেশে কার কাছে গেলেন তিনি ? কে তাঁকে আশ্রয় দিল ? হয়তো দেখা যাবে কোন আশ্রমে সকালে ও সন্ধ্যায় অনাথ ভিখিরিদের সাথে পাত-পেড়ে তিনিও বসে গেছেন দুটো অন্নের লোভে ! মানুষের পেটের দায় যে বড় বেশি !
কতদিন হৃষীকেশে ছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই। কে রাখবে সে খোঁজ ? কত মানুষ সেখানে নিত্য আসে যায় ! তবে হ্যাঁ, একদিন হৃষীকেশের পুলিশের কাছে খবর এলো যে অমৃতবাহিনী গঙ্গার কোলে এক নির্জন স্থানে এক বেওয়ারিশ লাশ দেখা গেছে । লোক্যাল মানুষেরা কেউ তাকে চেনে না। পুলিশ গিয়ে সেই লাশ উদ্ধার করলো। পুলিশ দেখলো লাশটি এক মহিলার। বয়েস আনুমানিক সত্তর। তাঁর কাপড় পরার ধরণ দেখে পুলিশের মনে হল মহিলা সম্ভবত বাঙালি। শরীরে কোন অলংকার নেই। লোক্যাল পেপারে মহিলার মুখের ছবি ছাপা হল। পেপারের খবরটা নজরে এলো ড. ত্রিগুণা সেনের। তিনি তখন কনখলে আনন্দময়ী মায়ের আশ্রম রয়েছেন। ড. ত্রিগুণা সেন ফোন করলেন তাঁর এক ছাত্রকে হৃষীকেশে। সেই ছাত্রের কাছে সংবাদের সত্যতা যাচাই করে ছুটে এলেন নিজে, হৃষীকেশে।
এসে কী দেখলেন ত্রিগুণা সেন ? পুলিশ মর্গে গিয়ে দেখলেন কীভাবে নিশ্চিন্তে 'ঘুমের দেশে' চলে গেছেন এক বীরাঙ্গনা যিনি একদিন বাংলার ছোটলাটকে সেনেট হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গুলি চালিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। যিনি ছিলেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ বীর ও দেশপ্রেমিক সুভাষচন্দ্রের জীবনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত বেণীমাধব দাসের কন্যা।
যিনি কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নীতিগত কারণে। অথচ যিনি বহু চেষ্টা করেও আইনের বজ্রআঁটুনির জন্যে নিজের প্রাপ্য পেনশান আদায় করতে পারেননি সরকারের থেকে। বঞ্চিত হয়েছিলেন ন্যায্য অধিকার থেকে।
বলাই বাহুল্য যে, ত্রিগুণা সেন বীণাকে চিনতেন। যাদবপুরে যখন তিনি ভি. সি তখন অনেক অনুষ্ঠানেই বীণার সাথে তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। ইনিই যে বীণা দাস, তাই সেই বিষয়ে তাঁর আর কোনো সন্দেহই রইলো না। সেইসময়ে জ্যাকসনকে রক্ষা ও বীণা দাসকে ধরে ফেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী। এই হত্যা প্রচেষ্টা চালানোর কারণে ৯ বছর কারাবরণ করেছিলেন
বীণা দাস।
আইন অমান্য আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচার যখন চরমে উঠেছে, হিজলি-চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ, তখন মুখ বুজে মেনে নেননি বিপ্লবীরা। এর প্রতিবাদেই গর্জে উঠেছিল বীণা দাসের বন্দুক। আদালতে জবানবন্দীতে তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা থেকেই তিনি গভর্নরকে গুলি চালিয়েছিলেন। গভর্নরের প্রতি তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা ক্ষোভ ছিল না। কিন্তু গভর্নর তো সেই নির্যাতন-ব্যবস্থার প্রতিনিধি, যা আমার ৩০ কোটি দেশবাসীকে পরাধীনতার নিগড়ে বেঁধে রেখেছে। তিনি বলেছিলেন," I have no sort of personal feelings against Sir Stanley Jackson, the man and Lady Jackson, the woman. But the governor of Bengal represents the system of repression which has kept enslaved 300 millions of my countrymen and countrywomen."
ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট ও ছাত্রছাত্রীরা। সমাবর্তন কক্ষে অভিভাষণ পাঠ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তথা বাংলার গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসন। মঞ্চের দিকে তখন ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলেন গাউন পরিহিতা এক ছাত্রী। আচমকাই তাঁর হাতে গর্জে উঠল বন্দুক। আত্মরক্ষায় মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন জ্যাকসন। অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় গুলি। সম্বিত ফিরে পেয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসে ওই ছাত্রীকে ধরে ফেলেন উপাচার্য হাসান সুরাবর্দি। তখনও থামেনি বন্দুকের গর্জন। পাঁচ-পাঁচটি গুলি বেরিয়ে যায় তাঁর বন্দুক থেকে। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার আরও একটি অদম্য বজ্রনির্ঘোষ সমাবর্তন কক্ষের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার হন ওই ছাত্রী। তাঁর নাম বীণা দাস। অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সেদিন তাঁরও শংসাপত্র নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থের কবেই বা পরোয়া করেছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা!
বীণা দাস (২৪ আগস্ট ১৯১১- ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৮৬) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন ব্যক্তিত্ব এবং অগ্নিকন্যা। বীণা দাসের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার কারণে তার দাদা কারাবরণ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনৈতিক মনস্ক হয়ে ওঠেন। সে সময় যুগান্তর দল এর কতিপয় সদস্যের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। ১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ছোট ছোট দলের নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার হন। বীণা দাস ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবের নেত্রী ছিলেন ।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সম্পাদিকা ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন। নোয়াখালির দাঙ্গার পরে সেখানে তিনি রিলিফের কাজ করতেন। স্বাধীনতার পরেও সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে নিজেকে ব্যপ্ত রাখেন। মরিচঝাঁপি গণহত্যার সময় তিনি প্রতিবাদী হন।
বীণা দাস ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসুর শিক্ষক বেণীমাধব দাসের কন্যা। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর জীবনে শিক্ষক বেণীমাধব দাসের অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। বীণা দাসের মা সরলা দেবী। সমাজসেবায় তিনিও ছিলেন অগ্রণী মহিলা। অসহায় ও দুঃস্থ মহিলাদের জন্য তিনি পরিচালনা করতেন 'পুণ্যাশ্রমে'র।
বেনীমাধব দাস ও সরলা তাঁদের সন্তানদের মনে মুক্তচিন্তার বীজ বপন করেছিলেন শৈশবেই। বীণা দাসের দিদি কল্যানী দাস-ও (১৯০৭- ৮৩) ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা ছাত্রসংঘের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। বিপ্লবীদের গোপন সভায় যোগ দিতেন তিনি। এমনই এক সভার প্রচারের লিফলেট বিলি করে থাকার জন্য কল্যাণী দাসকে গ্রেফতার করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ। দিদির কারাবাসের দিনগুলির অবর্ণনীয় কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন বীণা দাস। একজন সাম্মানিক স্নাতক ও রাজনৈতিক কারণে বন্দি হওয়া সত্ত্বেও কল্যাণী দাসকে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি হিসেবে রেখেছিল ব্রিটিশ সরকার। বীণা দাস তাঁর জবানবন্দিতে এই প্রসঙ্গেরও উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদিদের পোশাক, কয়েদিদের খাবার, অপরাধজগতের সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে তাঁর দিদিকে থাকতে হত।" এই ঘটনাকে সম্পূর্ণ অন্যায় মনে করেন তিনি। মেয়ের প্রতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণে বাবা-মায়ের চোখের জলও দেখেছেন তিনি।আর এই সব ঘটনাই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের সিদ্ধান্তকে আরও জোরাল করে তুলেছিল। দিদির আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা সঞ্চার করেছিল তাঁর মনে।
এই সময়েই বাংলা তথা সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশের দমন-পীড়নের প্রতিবাদ জানাতে গর্ভনর জ্যাকসনকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আর তাঁর এই লক্ষ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, বিপ্লবীদের সংগঠন যুগান্তরের সদস্যা কমলা দাশগুপ্ত। কমলা দাশগুপ্ত ছিলেন বীণা দাসের দিদি কল্যাণী দাসের বান্ধবী। বীণা যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাঁর দৃঢ়তা ও অটুট সংকল্পের কথা বুঝতে পেরে কমলা দাশগুপ্ত বীণা দাসকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। অস্ত্র সংগ্রহের এক পুরুষ সহবিপ্লবীর দ্বারস্থ হন তিনি। ২৮০ টাকা দামে সংগ্রহ হয় একটি চোরাই রিভলভারের। মানিকতলার কাছে রামমোহন রায় গ্রন্থাগার লুকিয়ে বন্দুক নিয়ে এসে কমলা দাশগুপ্ত তুলে দিয়েছিলেন বীণা দাসের হাতে। বন্দুক চালানোর কৌশল শিখিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্যবস্তুতে নিশানা করার অনুশীলন শেখানো যায়নি বীণা দাসকে। তাই তাঁর অপটু হাতে চালানো রিভলভারের গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। বীণা দাসের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনেছিলেন তাঁরা বাবা-মাও। তাঁরা জানতেন, দেশের জন্য যে কোনও কিছুই করতে প্রস্তত তাঁদের মেয়ে।
জানা যায়, খোঁপায় রিভলভার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন বীণা দাস। সমাবর্তন কক্ষ থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বীণাকে। এরপর চলে টানা জেরা। রিভলবার কোথা থেকে পেয়েছিলেন, তা জানতে চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। কিন্তু দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ বীণা দাসের মুখ থেকে একটি কথাও বের হল না। মেয়ের মুখ খোলাতে তাঁর বাবা বেণীমাধবকেও বলেছিল পুলিশ। কিন্তু সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে ফিরিয়ে দেন তিনি। এরপর বিচারের নামে প্রহসন চলল। আদালতে দৃঢ়তার সঙ্গে গভর্নরের ওপর আক্রমণের দায় নিজের কাঁধেই তুলে নেন বীণা দাস। আর স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন নিজের উদ্দেশ্যের কথা। বলেছিলেন, "ব্রিটিশ শাসনের সীমাহীন অত্যাচার ও পরাধীনতার মধ্যে গুমরে কাঁদার চেয়ে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদানের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।"
ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর নয় বছরের কারাদণ্ডের ঘোষণা করে ব্রিটিশ আদালত। এরপর সাত বছর বাংলার বিভিন্ন জেলে কাটিয়ে ১৯৩৯-এ মুক্তি পান বীণা দাস। গাঁধীজীর চেষ্টায় অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে তিনিও মুক্তি পেয়েছিলেন।
জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বীণা দাসের সংগ্রাম থামেনি। সে সময় সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। বীণা দাসও কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বস্তিবাসী দরিদ্র শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন পরম মমতায়। ১৯৪২-এ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। দক্ষিণ কলকাতার হাজরা পার্কের সভা থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। আবার কারান্তরালে চলে যেতে হয়। রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। ১৯৪৫-এ মুক্তি পান।
স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সদস্য হিসেবে প্রাদেশিক সভার নিম্নকক্ষে জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু তারপর থেকে আর কখনও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি । তবে উদ্বাস্তু আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আন্দোলনে অগ্রণী সৈনিক ছিলেন বীণা দাস। স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকতাও করেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৬০ সালে সমাজসেবায় অবদানের জন্য অবশেষে পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত করা হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তাঁর শেষ জীবন কেটেছে অত্যন্ত কষ্টে ও অপমানের সঙ্গে। বৈপ্লবিক কার্যকলাপের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বীণা দাসকে স্নাতক ডিগ্রি দিতেও অস্বীকার করেছিল।
বীরাঙ্গনা বীণা দাস ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি নিজের ভবিষ্যৎ না ভেবে , কাগুজে ডিগ্রির কথা না চিন্তা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশের কাজে।
গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলার আরও একটি অদম্য বজ্রনির্ঘোষ সমাবর্তন কক্ষের বাইরে এভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল ।।
(কলমে -পিয়ালী মুখোপাধ্যায়)
