পরশপাথর
পরশপাথর
(পর্ব -১)
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে, আর মন্দিরা বারান্দায় বসে আকাশ-পাতাল, পুরানো স্মৃতি সব ভেবেই চলেছে। আসলে, এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো কোনোদিন, কোনোভাবেই ভোলা যায় না। বরং সারা জীবনের স্মৃতি হয়ে মনের মণিকোঠায় অমর হয়ে যায়। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন সে প্রথম চাঁপাডাঙা হাই স্কুলে চাকরি পেল ; তখন সবাইকে ছেড়ে ,কলকাতা ছেড়ে গ্রামের স্কুলে চাকরি করতে যাওয়ার কথায় মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু সরকারী চাকরী , যেতে তো হবেই।
পঞ্চম শ্রেণীর , "খ" বিভাগে ভূগোল পড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করে দীপককে , লাস্ট বেঞ্চের কোণায় বসে থাকা শান্ত মুখের একটি ছেলেকে। সারাদিন আনমনে বসে থাকা, ঠিক মতন পড়া না শোনা, ছেলেটার সম্পর্কে নানা রকম কথা শোনে মন্দিরা। এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে পড়ে সে । পড়া জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দেয় না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। জানিয়ে দেয়, "পড়া সে করে নি, আর পড়তে তার ভালো লাগে না, " গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একদিন পিছন ফিরে বোর্ড ওয়ার্ক করাতে গিয়ে শুনতে পায় ক্লাসের মধ্যে চাপা হাসির শব্দ।
হাসির কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝতে পারে যে, খ্যাপা ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর বেশ আরাম করেই ঘুমাচ্ছে, কোনো শব্দই যেন ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না । পল্লব মজা করে বলে, "ম্যাডাম, খ্যাপা পরশপাথর খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাই স্কুলে এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। "
ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজে, হৈ হৈ করে ছেলেরা রওনা দেয় বাড়ীর পথে। মন্দিরা খ্যাপা-কে ডাকে, চোখ মেলে তাকিয়ে চারিদিক দেখে বোঝার চেষ্টা করে, বুঝতে পারে সবাই রওনা দিয়েছে বাড়ির দিকে, সেও পা বাড়ায়। একবারও শিক্ষিকার দিকে তাকিয়ে দেখে না, বিদায় সম্ভাষণ করে না। আনমনে বেরিয়ে যায়, মন্দিরাও টির্চাস রুমের দিকে পা বাড়ায়। ছুটির শেষে রিনাদির সঙ্গে বাড়ীর দিকে যেতে যেতে খ্যাপা অর্থাৎ দীপকের গল্প শোনে মন্দিরা। ছোটোবেলায় মা-বাবা একসাথে দুজন-কেই হারায় খ্যাপা, সেই থেকেই মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু-মামা, মামীর কাছেই বড়ো হয়েছে ।কিন্তু ভালোবাসার অভাবে তার জীবনটাই বদলে গেছে। আজ আর দিম্মাও নেই, তাই এক অদ্ভুত দ্বন্দ্বের পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা খ্যাপার কাছে জীবনের মানেটাই আলাদা হয়ে গেছে।
আর একদিন ছুটির শেষে মন্দিরা দেখলো যে , একটা লাঠি দিয়ে ছোটো ছোটো গাছপালাগুলোকে মারতে মারতে , ঝোপঝাড়ের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে, আপনমনে কথা বলতে বলতে খ্যাপা নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কখন যে বাড়ি যাবে কে জানে ! কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কথার উত্তর দেয় না। এখন আর কেউ কিছু তাই জানতে চায় না, কোথায় ঘোরে তাও কেউ খোঁজ নেয় না।
পরদিন ক্লাসে মন্দিরা ঠিক করে ভূগোল পড়ানোর পরে ছাত্রদের সঙ্গে পরিবেশ আর সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলবে। আলোচনা করতে গিয়ে ছাত্রদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা উঠে আসে। সবাই তাদের বাড়ী, বাবা-মায়ের কথা বলে। শুধু খ্যাপা কিছুই বলতে পারে না। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হয়তো ওই এ্যাক্সিডেণ্ট আর সব হারানোর যন্ত্রণা ওর স্মৃতিকেও অনেকটাই আঘাত করেছে। যা হয়তো ছোটোবেলায় বোঝা যায় নি কিন্তু এখন ধরা পড়ছে। হয়তো খ্যাপাকে নিয়ে ভাববার দরকার মন্দিরার ছিল না, কিন্তু এক অদ্ভুত চিন্তা এখন তাকেও মানসিক ভাবে অস্থির করে তুলেছে। কি মনে হলো হঠাৎই মন্দিরা তার প্রিয় কবিতাটা নিজের মনে বলতে শুরু করলো, ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে গেল, -
"খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
মাথায় বৃহৎ জটা ধূলায় কাদায় কটা,
মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
ওষ্ঠে অধরেতে চাপি অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
দুটো নেত্র সদা যেন নিশার খদ্যোত-হেন
উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।
নাহি যার চালচুলা গায়ে মাখে ছাইধুলা
কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন,
ডেকে কথা কয় তারে কেহ নাই এ সংসারে
পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন,
তার এত অভিমান, সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান,
রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর,
দশা দেখে হাসি পায় আর কিছু নাহি চায়
একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!
সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার।
তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি হেসে হল কুটিকুটি
সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার।
আকাশ রয়েছে চাহি, নয়নে নিমেষ নাহি,
হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে পূর্ব গগনের ভালে,
সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ।
জলরাশি অবিরল করিতেছে কলকল,
অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।
কাম্য ধন আছে কোথা জানে যেন সব কথা,
সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি, মহা গাথা গান গাহি
সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।
কেহ যায়, কেহ আসে, কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,
খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।।"
রবি ঠাকুরের লেখা, "সোনার তরী" কাব্যগ্রন্থের এক অদ্ভুত সৃষ্টি।
কবিতাটা বলা শেষ হয়ে গেলেও সবাই একরকম ঘোরের মধ্যেই যেন বসে রইলো। আজ শুধু খ্যাপার চোখটা যেন কিছু খুঁজে পাওয়ার আনন্দে চকচক করে উঠলো। ক্লাস শেষের ঘণ্টা বাজলো, সবাই আজ ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল। শুধু আজ খ্যাপা যাবার আগে টেবিলের সামনে দাঁড়ালো, তারপর নীরবে বেরিয়ে গেল। মন্দিরাও টির্চাস রুমের দিকে পা বাড়ালো।
...........................................
(পর্ব -২)
পরের দিন ক্লাসে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। খ্যাপা হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো, "পরশপাথর কি সত্যি খুঁজে পাওয়া যায়?"। মন্দিরা অবাক হয়। স্মিত হেসে উত্তর দেয়, "কেন যাবে না? তবে ভালো করে খুঁজতে শিখতে হবে,খুঁজে পেলে চিনতে শিখতে হবে সে জন্য অনেক কিছু জানতে হবে। আর জানতে গেলে তো পড়তে হয়। কিন্তু তোমার তো পড়তে ভালো লাগেনা। তাইনা?"। এক মুহুর্ত যেন ভেবে নিয়ে অবাক করে দিয়ে খ্যাপা বললো, " পরশপাথরের জন্য ও নাকি সব করতে পারে "।
এরপর খ্যাপাকে প্রায়দিন পড়া ধরে মন্দিরা, বোর্ডে লিখতেও দেয়। পারুক না পারুক, চেষ্টা করে সে।কোনোদিন পারে কোনোদিন পারে না, .... আর না পারলে পরিষ্কার করে বলে, "পারবে না ।" কিন্তু অসহযোগিতা করে না আর। এমনকি খ্যাপার বাড়ী থেকেও জানিয়েছে এখন বাড়ির কাজও করে সব নিয়মিত। আস্তে আস্তে ছেলেটা বদলাচ্ছে, অন্যান্য শিক্ষক -শিক্ষিকারাও সেটা লক্ষ্য করছিলেন। সবাই লক্ষ্য করেছিল । মন্দিরাও এখন ওকে কিছু কিছু বাইরের বই পড়তে দেয় , বিস্ময়কর ভাবে খ্যাপা সেগুলো পড়ে , ফেরতও দেয়। সেবার ইউনিট টেস্টে সে আর ফেল করেনি।
বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সবাইকে অবাক করে প্রথম দশজনের মধ্যে জায়গা করে নিল খ্যাপা ওরফে দীপক। তারপর থেকে প্রথম স্হানটা কিভাবে যেন ওর দখলেই চলে গেল। মাধ্যমিকে জেলা থেকে দ্বিতীয় স্থান পাওয়ার পর মন্দিরা ট্রান্সফার নেয় কলকাতায়। ওর রিসার্চের কিছু কাজ বাকি থাকার জন্য এবারে ওকে কলকাতায় আসতেই হবে। তবে এবারে সঙ্গে নিয়েএলো খ্যাপাকে। কলকাতায় ওর বাকী পড়াশোনা শেষ করানোর দায়িত্ব এখন মন্দিরার । পুরানো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে যায় মন্দিরা । হঠাৎই কলিং বেলের শব্দে চমকে উঠে দরজা খুলতেই একরাশ ফুলমিষ্টি হাতে ঘরে ঢুকে প্রণাম করল বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দীপক ব্যানার্জি। পরশপাথর খুঁজে পাগল হতে বসা সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ নিজেই পরশপাথরে পরিণত। কত বিধ্বস্ত, ভেঙে যাওয়া মন তার শুশ্রূষার ছোঁয়া পেয়ে সোনা হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। প্রতি বছর শত কাজের মধ্যে কষ্ট করে , সময় বার করে দীপক এই দিনটাতে ঠিক আসে। মন্দিরার কোনো কথা শোনে না। জিজ্ঞেস করে ও, "কেন দীপু ? কত ব্যস্ত তুই এখন ! একবছর না আসতে পারলে তো কোনো অসুবিধা নেই ! "। সঙ্গে সঙ্গে খ্যাপা ওরফে দীপক থামিয়ে বলে, " আজ যে শিক্ষকদিবস। তোমার কাছে আসব না ? তুমিই যে আমার পরশপাথর ম্যাডাম। তুমিই তো বদলে দিলে সেই জিরো কনফিডেন্সের ছেলেটাকে। তোমাকে দেখেই আমি বুঝেছি, পরশপাথর শুধু রূপকথাতেই থাকে না, শিক্ষকরাই আমাদের সমাজে সত্যিকারের পরশপাথর।"
একগাল মিষ্টি হেসে গলা জড়িয়ে ধরে দীপক। কখন যে সময় পার হয়ে যায় টের পায় না দুজনে। অনেক গল্প জমা হয়ে আছে যে । এরই মধ্যে কথায় কথায় জানিয়ে দিয়েছে দীপু, সামনের মাসে সে তার মা অর্থাৎ ম্যাডামকে নিয়ে দিল্লী যাবে। একটা বড়ো পুরস্কার পাবে দীপক। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ মনোরোগী বিশেষজ্ঞ দীপক ব্যানার্জিকে এখন এককথায় জানে বিশ্ব। কথাটা শুনে মনে হয় , এবারে জীবনের এক অদ্ভুত অনুভূতি আর আনন্দের সাক্ষী হয়ে ওঠার সময় হয়েছে মন্দিরার । মন ভরে যায়, চোখ চলে যায় দূরের বাড়ীটার দিকে। বাইরে তখনো অঝোরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।।
(কলমে -পিয়ালী মুখোপাধ্যায়)
