Golpo Guchho

Inspirational

5.0  

Golpo Guchho

Inspirational

বেঁচে থাকার লড়াই

বেঁচে থাকার লড়াই

6 mins
1.7K


[আজকের গল্প...

   না , ঠিক গল্প নয়, আজ একজন মহিলার জীবনের সংগ্রামের কথা বলবো ,কিভাবে সে নিজের সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েছিল, এই মহামারির দিনে।]

                                ১

সাল 2020,নতুন বছরের আগমনে সবাই নিজের জীবন নতুন করে শুরু করা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু কে জানতো এই নতুন বছরে মানবজীবনে নেমে আসবে এক অভিশাপ, যা সমস্ত মানবকুল কে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

 জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি যখন মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় জানা গেলো এক ভাইরাস যার নাম covid19, যা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। তার প্রভাবে মানবজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে।

ভারত , যার জনসংখ্যা প্রায় ১৩৬.৬৪ কোটি এবং বর্তমানে জনসংখ্যায় যার স্থান বিশ্বে দ্বিতীয়,এমন এক দেশে এই ভাইরাস এসে পড়লে যে কি ভয়ানক রূপ নিতে পারে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

           মার্চ মাস, দেশে শুরু হলো লকডাউন।জারি হলো কারফিউ।সব অফিস ,কলকারখানা, প্রোমোটিং এর কাজ বন্ধ হয়ে গেলো। জেলখানার মতো মানুষ নিজের ঘরে বন্দি হয়ে গেলো।

             কিন্তু এসবের মধ্যে এক মহিলা যার নাম সাবনাম খাতুন, সে দিনমজুরের কাজ করে কোলকাতা তে ,এখানেই সে এক ছোট্ট বাড়িতে ভাড়া থাকে।তার নিজের বাড়ি সুন্দরবনে।খুবই গরিব সে,কোনোরকমে দিনমজুরি করে যেটুকু টাকা পায় তাতে কোনোমতে সে ও তার ৩ বছরের ছোট্ট ছেলে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকে। তবে এই লকডাউন তার জীবনে এক অভিশাপ হিসেবে নেমে এলো।কাজ নেই, টাকা উপার্জন নেই, সে ও তার ছেলে যদি খেতে না পায় তাহলে এমনি অনাহারে মারা যাবে ,এই চিন্তায় তার রাতের ঘুম চলে গেলো।যেটুকু টাকা জমানো ছিলো তাতে কিছুদিন কোনোমতে চলে গেলো।

হটাৎ একদিন সকালে বাড়ির মালিক এসে বললো,"দেখো ভাবি এখন লকডাউন শুরু হয়েছে আর তাছাড়া এই ভাইরাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে তোমাদের আর এখানে থাকতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।তোমাদেরকে কাল সকালেই এই বাড়ি ছাড়তে হবে।"। এই কথা শুনে সাবনাম এর জীবনে যেন আরো অন্ধকার নেমে এলো।সে বললো,"বাবু এই দুর্দিনে আমি এই ছোট্ট ছেলে কে নিয়ে কোথায় যাবো দয়া করুন আমাকে এভাবে আমাদের বের করে দেবেন না"

কিন্তু বাড়ির মালিক কোনোকিছুই শুনলো না,তাই বাধ্য হয়ে তাকে বাড়ি ছাড়তে হলো।কিন্তু সে সুন্দরবন নিজের বাড়ি যাবে কি করে, তার কাছে না আছে টাকা আর না আছে খাবার সেদিন সকালে রাস্তায় ভিক্ষা করে যেটুকু পেলো তা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে রইলো।সেদিন তারা রাস্তার এক ফুটপাতেই থাকলো। লকডাউনের তোড়জোড় এতটাই কড়া হয়ে উঠলো যে সব দোকানপাঠ বন্ধ হয়ে গেলো।দুতিনদিন সে তার ছেলে কে নিয়ে ফুটপাতেই থাকলো। একদিন সকালে সে শুয়ে আছে,সেই ফুটপাতের পাশে এক বড়ো কমপ্লেক্স ছিলো সেখান থেকে সিকিউরিটি গার্ড এসে তাকে বললো,"এই, এখান থেকে চলে যা, এখানে একদম থাকবি না।" অসহায় সাবনাম তাদের বললো,"আমি বাড়ি যাবো একটু কিছু টাকা আর খাবার দিয়ে সাহায্য করবেন! আমার ছেলেটা কে খাওয়াবো" এই শুনে ওরা বললো," কি টাকা?তোদের মতো সব ভিখারীরা যদি এসে টাকা চাইতে শুরু করে আর আমরা যদি সবাই কে টাকা দিয়ে দি তো আমাদের কি হবে!যা এখান থেকে,কিহলো যাবিনা ?দেখবি লাঠির বাড়ি পড়লে কেমন লাগে?" বলে মারতে গেলো। ভয়ে সাবনাম ওখান থেকে ছেলে নিয়ে চলে গেলো।

                                   ২

আজ একদিন হয়ে গেলো সাবনাম ও তার ছেলে না খেয়ে। ছোট্ট ছেলেকে কোলে নিয়ে সাবনাম হেঁটেই চলেছে। হটাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো, সে এক ছাউনির তলায় গিয়ে বসলো। তার ছোট্ট ছেলেটি কাঁদছে আর বলছে,'মা খুব খিদে পেয়েছে একটু খেতে দাও'। অনেকবার বলায় সাবনাম খুব রেগে গেলো আর তার ছেলে কে ধরে মারলো।কিন্তু সাবনাম এর মনের ভেতরের কষ্ট টা বোঝার মতো কেউ তার পাশে নেই,মনে মনে সে ঠিক করলো এবার সে মরেই যাবে।কিন্তু তার সেই ছোট্ট ছেলেটার করুণ মুখ, আর তার মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার ইচ্ছে সাবনামের মমতাকে আবার জাগিয়ে তুললো।সে ঠিক করলো যেভাবেই হোক তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে,ছেলের খাবার যোগার করতেই হবে।তাই বৃষ্টি থামলে সে তার ছেলে কে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।হাঁটতে হাঁটতে সে অনেকদুর চলে আসে।হটাৎ সে দেখে রাস্তার ধারের একবাড়ি থেকে একজন বেরিয়ে কি যেনো একটা ফেলে গেলো প্লাস্টিকে করে।সাবনাম গিয়ে সেই রাস্তায় ধার থেকে প্লাস্টিক তুলে দেখে তার মধ্যে কিছু অর্ধেক খাওয়া মাংস , কিছুটা ভাত আর একটা প্লাস্টিক এর বোতলে কিছুটা জল।লোকের ফেলে দেওয়া সেই খাবার যেন সাবনামের জীবনে ভগবানের আশীর্বাদ হিসেবে নেমে এলো।তাই সে দেরি না করে সেই প্লাস্টিক তা নিয়ে ফুটপাতে বসলো। একটা খবরেকাগজ যোগার করে , তার মধ্যে সেই খাবার গুলো ঢেলে আগে তার ছেলে কে খাওয়ালো পরে যা বাঁচলো সেটা সাবনাম নিজে খেলো।

                                     ৩

সাবনাম এর মনোবল যেন ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করে , কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকালে আবার মনোবল ফিরে পায় সে।এই ভাবে সে হাঁটতে থাকে কিন্তু সাবনামের সারা শরীর যেন কাহিল হয়ে পড়ছে।শক্তি কমে আসছে ধীরে ধীরে।রাস্তার ধারে এখানে ওখানে পরে থাকা প্লাস্টিক ব্যাগে খুঁজতে থাকে কিছু খাবার পাওয়ার আসায়।এই দুর্দিনে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়না সাবনামকে। এইভাবে এখান ওখান থেকে খাবার কুড়িয়ে খেয়ে দিন কাটে।এই ভাবে একদিন রাস্তায় হাঁটছে হটাৎ এমন সময় সাবনামের খুব শরীর খারাপ হলো ,মাথা ঘুরে পরেই যাচ্ছিলো কোনোমতে নিজে কে সামলে মাটিতে বসে পরে। সে বুঝতে পারে তার খুব জ্ব‌‌‌র। এদিকে খিদের জ্বালায় ছেলে কেঁদেই চলেছে অপরদিকে মুসুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাতৃত্বের এ কি পরিহাস ,নিজের সন্তানকে খাওয়াতে পারছে না সে,অবশেষে সাবনাম নিজের মাতৃত্বের দুধ তুলে দেয় তার সন্তানের মুখে।ধীরে ধীরে যেন সাবনামের সারা শরীর অবস হয়ে আসে,খানিকপরে সাবনামের শরীর মাটিতে লুটিয়ে পরে।

 

                                      ৪

সাবনামের জ্ঞান ফিরলে সে দেখে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে।আর তার আশেপাশে কয়েকজন লোক ও মহিলা দাঁড়িয়ে।ডক্টর কে জিগ্যেস করায় সাবনাম জানতে পারে এতদিন না খেয়ে থাকার ফলে শরীরের জোর কমে আসে যে, সে সুন্দরবনের কাছের এক গ্রামে রাস্তার ধারে তাকে কিছু গ্রামেরলোক অজ্ঞান পরে থাকতে দেখে তাকে সুন্দরবন সরকারি হাসপাতালে নিয়ে আসে।আজ ৪দিন পরে তার জ্ঞান ফেরে,তবে তার শরীর এখনো দুর্বল।নিজের ছেলে কে দেখতে না পেলে যখন সে ছেলের খোঁজ করে ,তখন ঐ দাঁড়িয়ে থাকি মহিলাদের মধ্যে একজন জানায়, তার ছেলে ঐ মহিলার বাড়িতে আছে এবং সুস্থ্য আছে।মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরে ও কাটিয়ে আসা দিনগুলোর কথা ভেবে সাবনাম যেন কান্নায় ভেঙে পরে।কয়েকদিন পরে সাবনাম কে ঐ মহিলা নিজের বাড়ি নিয়ে যায় ও তার সেবা করে।

কিছুদিন পরেএকদল N.G.O এর লোক ঐ গ্রামে আসে এবং তারা সাবনামের কথা জানতে পেরে তার সাথে দেখা করতে যায়।তার মুখে সাবনামের এই সংগ্রাম এর কথা শুনে এই N.G.O এর সবাই সাবনামের এর লড়াই সোশ্যাল মিডিয়া তে শেয়ার করে, ধীরে ধীরে সাবনাম এর এই যন্ত্রনা দায়ক এবং হার না মানার কথা দেশের সব জায়গায় ছড়িয়েপড়ে। নিউজ চ্যানেল আসে সাবনামের সাথে কথা বলতে।সরকার সাবনাম এর ছেলের যাবতীয় দায়িত্ব নেয় তার সাথে সাবনাম কে একটা সেলাই এর স্কুলে কাজেরও ব্যবস্থা করে দেয়।


[আজ সাবনাম এর কথা সারা দেশ জানে অথচ সাবনাম যখন তার এই সংগ্রাম শুরু করেছিল তখন পদে পদে তাকে তাচ্ছিল্ল করা হয়েছে ,দুমুঠো খাবার এর জন্য তাকে খেতে হয়েছে নোংরায় পরে থাকা লোকের ফেলে দেওয়া খাবার।আর আজ তাকে নিয়ে সবার কত কথা, ফেসবুক এ তার ছবি শেয়ার নিউজ এ তাকে সংগ্রামী নারীর উপাধি দেওয়া,সব যেন নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি আর লোক দেখানো,সাবনাম যেন আজ সেলিব্রিটি।অথচ এই সেলিব্রিটি সাবনাম কেই সমাজ একদিন দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

সকলের উদ্দেশ্যে একটি কথা ,দয়া করে কেউ খাবার নষ্ট করে ফেলে দেবেন না বেঁচে যাওয়া খাবার টা এরকম হাজার সাবনাম এর পেট ভরাতে পারে ,এই মহামারির দিনে সকল মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়ানোটাই তো মানুষের ধর্ম।আসুন না এরকম যদি রাস্তায় সাবনাম এর মতো কাউ কে দেখি তাহলে তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে টেনে নি আর তুলে দি তাদের মুখে দুমুঠো অণ্ন]

              

পরে ভালো লাগলে নিজেদের মতামত দিতে পারেন।

            - ধন্যবাদ (S.B)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational