নিশী রাতের টাঙ্গাওয়ালা
নিশী রাতের টাঙ্গাওয়ালা
১
২০০২ সালের তখন ঠিক ডিসেম্বর মাস। কন কনে ঠান্ডা।অফিসে কাজের তেমন প্রেসার ও নেই, তাই ভাবলাম কদিন বর্ধমানে মামার বাড়ি ঘুরে আসি। বাড়িতে মাকে বলায় ,মা মামা কে ফোন করে দিলো ।আমি যথারীতি অফিসে থেকে ৫ দিনের ছুটি নিয়ে পরের দিন বেরিয়ে পড়লাম।সন্ধ্যে ৭:৩০ ট্রেন থাকার কারণে ও ট্রেন ২ ঘন্টা লেট থাকার কারণে বর্ধমান পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো।কিন্তু সেদিন ভারি অদ্ভুত লাগলো পুরো স্টেশন এ কোথাও কেউ নেই,তার ওপর হাতের ঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেছে। একটু এগিয়েই স্টেশন এর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখন রাত ১:৩০।শীতের এই কন কনে ঠান্ডায় র কুয়াশায় চারপাশ ঢেকে গেছে।উফফফফ, কি ঠান্ডা!
স্টেশন থেকে নেমে রাস্তায় কোনো গাড়ি তো দূরের কথা একটা লোক কেও দেখতে পেলাম না। এর আগেও অনেকবার এসেছি ,শীতকালেও এসেছি কিন্তু জনমানব হীন এরকম আগে কখনো দেখিনি।স্টেশন থেকে মামার বাড়ি প্রায় আরো ১০কিমি। কি আর করা যাবে ,তাই কিছু না ভেবে হাটতে শুরু করলাম।
২
কিছুদূর যেতেই দেখলাম রাস্তার ধরে একটা টাঙাগড়ি।
এখানে টাঙাগড়ি! যাক গে কিছু না পাওয়ার যে এটাই যথেষ্ট।
গিয়ে দেখলাম কেউ নেই ,একটু এদিক ওদিক দেখলাম কোনো সারা পেলাম না।তাই আর অপেক্ষা না করে যেই চলতে শুরু করলাম অমনি কুয়াশার মধ্যে দিয়ে.......
ব্যক্তি - রোকেন, রোকেন সাহাব রোকেন।কাহা জানা হেয় আপকো?খুব ভারি গলায় জিগ্যেস করলো।
আমি বললাম, ' ও জো কবারস্থান কে পিছে এক স্কুল হেয় না, উধার হি জানা হেয়। যাওগে? ওখান থেকে মামার বাড়ি হেটে ২ মিনিট। আমার কথা শুনে লোকটা বললো,
বেক্তি- জায়গা সাহাব! হাম সব কো উস্কি মানজিল তাক পৌছা দেতে হেয়। আপকোভী দেঙ্গে, হাহাহাহাহা.......
ভারি অদ্ভুত এই লোকটা হাসছে কেনো! যাইহোক আমি উঠে পড়লাম। টাঙা চলতে শুরু করলো,আমি লোকটা জিগ্যেস করলাম,'আরে ভাই আপ ইতনি রাত কো ঠান্ডে মেয় ক্যা কার রাহে থে?' কোনো সারা নেই।আবার আমি,'আরে ও ভাই আপকা নাম ক্যা হেয়?'লোকটা আপন মনে টাঙ্গা চালাতে থাকলো।
৩
কিছু দূর গিয়ে ঘোরা টা রাস্তার মাঝে হটাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘোরাটা কোনোমতেই আর যাচ্ছে না দেখে টাঙ্গাওয়ালা আমাকে বললো,'সাহাব আপ থোৱা রুকিয়ে মেয় দেখ কারকে অভি আয়া'।
আমি,আরে ভাই.. কাহা যা রাহে হো, আরে .....ও
টাঙেয়ালে.........কথা শেষ হতে না হতেই দেখি লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।
আমি একা অপেক্ষা করতে লাগলাম।দূরে কথা শেয়াল ডাকছে, এই শীতের অন্ধকার রাস্তায় একা... একটু ভয়ও লাগছে। অনেক্ষন পর দেখলাম লোকটা ফিরে এলো।
আমিজিভেস করলাম,'ও ভাই আপ কাহা গায়ে থে? আরে বহত হি আজিব ইনসান হো আপ। তামিজ নেহি হেয় ক্যা? পুছা আপসে মেয়!না কোনো লাব নেই'।
লোক টা কোনো উত্তর না দিয়ে আবার টাঙ্গা চালা তে লাগলো।কোমন যেন , কোনো কথা বলে না চুপচাপ।মুখে চাদর চাপা থাকার জন্য মুখ টাও দেখতে পাচ্ছি না। রাত তখন কটা জানি না।আকাশে মেঘ সরে গেছে চাদের আলোয় আশেপাশে অনেকটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু, একি..... লোকটার হাত, হাতের জাগায় মনেহচ্ছে কঙ্কালের হাত। তাই তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এতো কংকালের হাত।আমার ভয় সারা শরীর গরমে ঘামতে শুরু করলো।
৫
আমি চুপচাপ বসে ভয়ে। হটাৎ লোকটা জিগ্যেস করলো,'ক্যা সাহাব ডার কিউ রাহে হো? হাহাহা.....'
দেখলাম লোকটার মাথাটা পুরো আমার দিকে ঘুরে গেলো।
একি কি দেখছি আমি! মুখের জায়গায় কঙ্কাল, লাল আগুনের মতো চোখ জ্বলছে। আমি ভয়ে কোনো দিক না ভেবে দিলাম চলন্ত গাড়ি থেকে ঝাঁপ।
পা হাত কেটে, মাথা ফেটে গেলো।ঐ ভাবেই শরীরে যত জোর ছিলো সব একসাথে এনে দৌড়াতে লাগলাম। আর পেছনে সেই টাঙ্গাওয়ালা,
'সাহাব ডার কিউ রাহে হো? রুকো, মেয় আপকো চর দুঙ্গা। মেরে সাথ চালো... হাহাহাহাহাআ.....
আমি পেছন দিকে আর না তাকিয়ে সামনে দৌড়াতে লাগলাম। ক্ষত শরীর নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে কপালের জোরে কোনোমতে মামার বাড়ির গেটের সামনে এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
৬
জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে।আমার মাথায় হাতে ব্যাণ্ডেজ করা। মামা ডক্টর এর সাথে কথা বলছে।
সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে মামি বলে, "ঐ গ্রামে এক টাঙ্গাওয়ালা থাকতো ,নাম নূর আলী। কয়েকমাস আগে একদিন রাতে টাঙ্গা নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক আগুনতক এর হাতে খুন হয়,তাকে যখন উদ্ধার করা হয় অর্ধেক শরীর পোড়া ছিলো। তার পর থেকেই রাতের বেলা কেউ স্টেশন থেকে একা ফিরলে ওকে দেখতে পায়। গ্রামে অনেকে জানায়, দুজন মানুষ এর আগে মারা গেছিলো।তাদের দেহ উদ্ধার করা হয় জঙ্গল এর পাশের,আর সেই দেহের কাছে দাঁড়িছিলো নূর আলী এর টাঙ্গা।আমাকে বলে তর কপাল খুব ভালো যে বেঁচে ফিরেছিস"।
তারপর থেকে মামার বাড়ি গেলেও রাতে নয় সকালের ট্রেনে যেতাম।কিন্তু আজও মাঝে মাঝে রাতে সেই গলা...'সাহাব ডার কিউ রহে হো, আও ,মেয় আপকো ছোর দুঙ্গা '। আজও আমার কানে বাজে।
সমাপ্ত