Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

4.2  

Partha Pratim Guha Neogy

Inspirational

অধিকার রক্ষার নববর্ষ

অধিকার রক্ষার নববর্ষ

7 mins
619


প্রতিদিনের মত সূর্যোদয়ে দিনটা আলোকিত হয়ে এলো। আলোর রশ্মিটা প্রতিদিন যে যে জায়গায় পৌঁছে, সে সব জায়গায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। কিন্তু আজকের নতুন দিনের আলো রানীর শরীর-মনকে একটু অন্যভাবে আলোকিত করেছে। কারণ আজ তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। রানী রামধনুর সাত রঙের মাঝে বসে স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করার কল্পনায় ডুবে আছে। আজকের দিনটা তার জন্য সত্যি ভিন্ন রকমের অনুভূতি- নতুন এক অনুভবের দিন। দিনটা তার চাওয়া পাওয়ার পূর্ণতার দিন। বলা যায়, ৩৬৫ দিনের মধ্যে আজ তার বিশেষতম দিন। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দিনটাকে নিয়ে তার আজীবনের যে স্বপ্ন, ,সেটা আজ বাস্তবায়ন করতে চায় সে। এই দিনটার জন্য তাকে অনেক দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনেক বছর। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে এবার। আজ রানী কারো কথায় কান দেবে না। বাসা থেকে বের হয়েই তার স্বপ্নটার বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ নেবে।

রানীর পরনে নতুন শাড়ি, হাতে কাচের চুড়ি, পায়ে আলতা, চুলে ফিতা, চোখে কাজল, কানে দুল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিকসহ পরনের সব কাপড় নতুন। তার দিকে তাকালে বোঝাই যাচ্ছে, সে, এক বাঙালি মেয়ে, আজ বিশেষভাবে সজ্জিত। কারণ আজ বাংলা বছরের শুরুর দিন। নতুন বছরের প্রথম দিন। আজ ১লা বৈশাখ। তাই রানী পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী সব নতুন কাপড়চোপড় পরেছে। আয়নার সামনে নিজেকে বার বার দেখছে। তবুও সে আয়নার মতো স্বচ্ছ জিনিসকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ তার মনে সন্দেহ হচ্ছে তার সাজগোজ ঠিক হয়েছে কি না, আজকের সাজগোজের মাধ্যমে সে নিজেকে নিজের সাধ্যমতো উপস্থাপন করছে। তাই সে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে পটপট করে সেলফি তুলছে, সেলফিগুলো বার বার নিজের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে নিজের মুখমন্ডলের বিভিন্ন অংশ ছোট বড় করে দেখছে। গালে,কপালে, নাকে বা থুতনিতে, যেখানেই একটু খারাপ দেখাচ্ছে, ফেস পাউডারের ছোট্ট ব্রাশটি দিয়ে সেখানেই আবার নতুন করে একটু প্রসাধনী লাগিয়ে নিচ্ছে। অপূর্ণতা পূরণ করার পর নিজের মনের কাছে সে নিজেই তৃপ্তি পাচ্ছে।

তারপরও আরেকবার দেখে সাজগোজ সব ঠিক আছে। আর কোনো রকমের নিজের সাজগোজের অপূর্ণতা নেই। মনের ভেতর তার স্বস্তি ও তৃপ্তিবোধ নিয়ে এখন বাসা থেকে বের হবে রানী ।

রানীর সাজগোজ তার মা অনেক আগে টের পেয়েছেন। কিছু বলেননি। কারণ মা জানেন আজ মেয়ে ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। যাবে তার বন্ধুবান্ধবীর সাথে বৈশাখ উদযাপন করতে। রানী মায়ের রুমের দরজার সামনে এসে বলল, ‘মা, আমাকে কেমন লাগছে?’

মা মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘তুমি তো আজ বাঙালি বধূ।’

মায়ের কথা শুনে রানী একটু পুলকিত হলো। সে হেসে বলল, ‘মা, আমি কিন্তু বের হচ্ছি।’

মা কিছু বলার আগেই ঘর থেকে বাবা রাজীব বাবু বললেন, ‘রানী , এত সকালে তুমি কোথায় যাবে?’

বাবার কথা শুনে রানী একটু অবাক হলো। সে ভাবল, আজ আমি এত সকালে কোথায় যাব বাবা কি আমার পোশাক দেখেও বুঝতে পারেননি। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। নাকি বুঝতে পারেননি। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

রানীর চুপচাপ থাকা দেখে রাজীব বাবুর আরও সন্দেহ হলো। বিছানা থেকে উঠে বসলেন তিনি। তারপর রানীর দিকে তাকালেন। রানীর গায়ে নতুন শাড়ি ব্লাউজ ও তার সাজসজ্জা দেখে সাপের মতো যেন তার চোখ মুখ ফণা তুলে তেড়ে এলো।

জোরে এক ধমক দিয়ে রাজীব বাবু বললেন, ‘রানী , কথা বলছ না কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। তুমি সত্যি করে বলো, কোথায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছ।’

রানী এবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘বাবা, আমার পোশাক দেখে বুঝতে পারছেন না আমি আজ কোথায় যেতে চাইছি ।’

রানীর পোশাকের দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, ‘পোশাক দেখে কি সব কিছু বোঝা যায়। বোঝা যায় না। একটা গান আছে না সাদা পোশাক পরলে মনটা সাদা হয় না। তোমার সাদা লাল পাড়ের শাড়ি দেখে কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি বলো কোথায় যাবে?’

রানীর বাবা পোশাক দেখে ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে জানার জন্য তিনি একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন।

রানী বলল, ‘বাবা, আপনার কি মনে আছে আজ একটা বিশেষ দিন? দিনটার একটা নাম আছে। বিশেষ দিনটার নাম কি বলতে পারবেন?’

রাজীব বাবু এবার একটু বিব্রত বোধ করে উপহাসের সঙ্গে বললেন, ‘ও বুঝেছি। আজ ১লা বৈশাখ।’

‘হ্যাঁ বাবা, আজ ১লা বৈশাখ।’

রাজীব বাবু বললেন, ‘এবার বুঝতে পারছি। তুমি তাহলে ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে যাচ্ছ?’

‘ঠিক বলেছেন বাবা। আমি ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে যেতে চাচ্ছি।’

রাজীব বাবু এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘না, তুমি ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে যেতে পারবে না।’

বাবার মুখ থেকে “যেতে পারবে না” শব্দ ক’টি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রানীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। রানী মাথার চুলের ভেতর হাত দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলে, ‘কেন বাবা, আপনি আজ আমাকে যেতে দেবেন না? আমি তো কোনদিন যেতে চাইনি। শুধু গল্প শুনেছি। ছবি দেখেছি। এবার-ই প্রথম যেতে চাইছি। কেন যেতে পারবো না?’

‘আমি বলছি তুমি বের হবে না। বাসায় বসে থাক। প্রয়োজনে টিভিতে ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠান দেখ।’

‘না, বাবা আজ বাসায় বসে থাকতে পারব না। আমি ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে যাব। এখন বাসা থেকে বের হবো।’

বাবা আবারও জোরে ধমক দিয়ে বললেন, ‘রানী , আমি বলছি, তুমি যাবে না, ১লা বৈশাখ উদযাপন করার জন্যে বাইরে যেতে হবে না”।

‘বাবা আপনি কেন বার বার নিষেধ করছেন? শিল্প-সংস্কৃতির সব ব্যাপারেই আপনার মনোভাব এরকম নেগেটিভ। কিন্তু কেন? পয়লা বৈশাখ কি আমাদের নয়? আজ কি নববর্ষের দিন নয়?”

“ আজ পয়লা বৈশাখ ঠিক আছে।“ বাবা বলেন।

“তাহলে?”

রানী ভালো করে জানে বাবার আপত্তিটা কোথায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে দিয়েছেন, সেটাই যথেষ্ট বলে মেনে নেওয়া উচিত ছিল রানীর। বাবার মনোভাব এইটিই।


কিন্তু এতদিন বাবার মুখের উপর কিছু বলেনি সে। আজ স্পষ্ট করে বলে ফেলল, “বাবা, আজ আমাকে যেতেই হবে। আমি সারা শহর ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই কোথায় কী ঘটে পয়লা বৈশাখে। নিজের চোখে সব দেখবো আমি।“


রাজীব বাবু মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘রানী তোমার ভালোর জন্য আমি বলছি। তুমি আজ বাসা থেকে বের হইয়ো না। একজন সচেতন অভিভাবক হিসেবে তোমাকে নিষেধ করছি আমি। আবারও বলছি আজ তুমি ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যেও না।’

‘বাবা, কেন বের হবো না। আপনি বিষয়টা আমাকে খুলে বলবেন?’

‘আবারও বলছি, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তুমি বাসা থেকে বের হইয়ো না আজ।’

রানী এবার জোর দিয়ে বলল, ‘বাবা আমাকে বের হতেই হবে।’

রাজীব বাবু এবার বিছানা থেকে উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দুই হাত দুই দিক দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আর কিছু বললেন না। তিনি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন মেয়ের স্পর্ধা দেখে। ।

রানী আবার বলে, ‘বাবা, আপনি কেন এমন করছেন। আমাকে যেতে দিন। আমাকে যে যেতেই হবে।’

রাজীব বাবু এবার রানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রতি বছর বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কিছু না কিছু ঝামেলা হয়েই থাকে। একবার তো পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিল কয়েকজন নারী। সে ঘটনাগুলোর কথা তো তোমার মনে থাকার কথা।’

‘বাবা আমার সব জানা আছে, আছে মনেও। আমরা কি তাদের ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে বাসায় বসে থাকব? না থাকব না। আমরা ঘরে বসে থাকলে তাদের লাভ। আমি চাই সবাই অংশগ্রহণ করুক। আপনি ও মাও আসুন। আমরা সবাই মিলে বেরুলে ওরা পরাজিত হবেই। প্লিজ বাবা, আমাকে বাধা দেবেন না। আমাকে যেতে দিন। আমাকে আজ যেতেই হবে।’

বাবার কোনো কিছু বলার আগেই রানীর মোবাইল ফোনে রিংটোন বেজে উঠল, এসো হে বৈশাখ এসো, হে বৈশাখ। মোবাইলের সবুজ অংশটায় টাচ করে ডান কানে মোবাইল রেখে কথা বলতে লাগল রানী।

‘বাবা বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছেন না। তুই একটু আয় না!’

অপর প্রান্ত থেকে শোনা গেল কথা, ‘ঠিক আছে রানী। আমি আসছি।’

‘ওকে।’

রানীদের ফ্ল্যাট নিচ তলায়। উপরের ফ্ল্যাট থেকে সপরিবারে দুই সন্তান নিয়ে নামছেন হীরেন সাহা । তিনি নামতেই দেখতে পেলেন, বাবা মেয়ের মধ্যে তর্ক হচ্ছে রানীদের খোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়েই। হীরেন বাবু বললেন, ‘রাজীব বাবু , আমি সন্তানদের নিয়ে শহরে থাকছি না। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছি ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে। গ্রামেই ১লা বৈশাখ ঘটা করে করব।’

‘ঠিক কথা বলেছেন হীরেন বাবু । যত সব ন্যাক্কারজনক ঘটনা শহরেই ঘটছে। যান গ্রামে যান। গ্রামে ১লা বৈশাখের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।’

‘তাই যাচ্ছি, আমাদের গ্রামে বৈশাখের মেলা বসেছে। গ্রামের ১লা বৈশাখের ঐতিহ্য সন্তানদের একটু দেখিয়ে নিয়ে আসি। আর আপনি মেয়ের সাথে কথা বলে যেটা ভালো হয়, সেটা করেন। আমি যাই রাজীব বাবু।’

হীরেন সাহা চলে গেলেন।

রানীর বান্ধবী পিউ এলো। পিউ রানীর বাবাকে বলল, ‘আংকেল, আমরা যদি না যাই তাহলে আমাদের এত বড় কৃষ্টি, আমাদের নিজস্ব কালচার সব কিছু ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। তা কখনো করতে দেওয়া যায়? আমাদের চুপ করে ঘরে বসে থাকা মানেই সেটা ঘটতে দেয়া। পয়লা বৈশাখ যে বাঙালির সার্বজনীন একটি উৎসবের দিন, সে কথাটা আমাদের সংস্কৃতিতে প্রোথিত করবে কারা? আমরা ছাড়া?“’

‘তুমি ঠিক বলেছ। কিন্তু কোনো বাবা-মা কি চায় নিজের সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে। কেউ চাইবে না। আমিও চাই না। তাই বলছি তোমরা ১লা বৈশাখে যেও না।’

রানী বলল, ‘না বাবা, আপনার সব কথা মানি, ভবিষ্যতেও অনেক কিছু হয়ত মানবো। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আপনার এ কথাটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না। সরি বাবা। আমরা চললাম।’

রানী আর পিউ বাসা থেকে বের হতে গিয়ে একটু থামে। মায়ের দিকে ফিরে তাকায় রানী ।

পরিতৃপ্ত হাসি মুখে মা ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। রানী ও পিউ পেছন ফিরতেই দুইহাতে দুজনের কাঁধ স্পর্শ করলেন মা। কোন কথা না বললেও তার ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে নড়ে উঠলো। রানীর মা কি তবে ওদের আশীর্বাদ করছেন, ভাবে পিউ ।

রানীর মনে হল মা যেন বলছেন, “যা তোরা। আমি যদি পারতাম, নিজেও যেতাম তোদের সঙ্গে। কিন্তু তোরা যাচ্ছিস, তাতেই মহা খুশি আমি। “

অবশেষে মায়ের কন্ঠে শব্দ ফোটে। মা বলেন, ‘তোমরা সাবধানে থেকো।’

রানী পেছন দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমাদের একটা গ্রুপ আছে। গ্রুপের সবাই একসাথে মেলায় ঘুরব। আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। তোমরা কোনো চিন্তা কোরো না।’

হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলেন মা।

মায়ের উদ্বেগহীন প্রশান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বাবার-মুখমন্ডল থেকেও যেন ধীরে ধীরে উৎকণ্ঠা কমতে শুরু করে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational