সুযোগ
সুযোগ
"দিদি গো তোমার একটা চিঠি এসেছে।"
"চিঠি!" মালতীর কথায় একটু অবাকই হল সাইনি। আজকাল এই মোবাইল আর ইমেলের যুগে চিঠি কে পাঠায়! মালতীকে সাইনি বলল চিঠিটা নিয়ে আসতে। মালতী চিঠিটা আনতে তার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই সাইনি বুঝতে পারল ওটা চিঠি মানে আসলে একটা আমন্ত্রণ পত্র। নিশ্চয় কোনো স্কুল বা কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠান রয়েছে। আজকাল লোকে সাধারণত ফোনে বা মেইল করেই আমন্ত্রণ জানায়। আজকে হঠাৎ আবার পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ দেখে বেশ কৌতূহল হল সাইনির। তাড়াতাড়ি খামটা ছিঁড়ে পত্রটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই চমকে উঠল সে। একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাকে। আমন্ত্রণ পত্রটা টেবিলে রেখে একগ্লাস জল খেল সাইনি। মালতী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কিসের চিঠি গো দিদি? সব ঠিক আছে তো?"
"হ্যাঁ রে। একটা সেমিনারে যাওয়ার জন্য ডেকেছে।"
"অ। তা তোমার মুখটা অমন ধারার লাগছে কেন?"
"কই কিছু না তো। তুই কাজে যা।" মালতী চলে গেল। আমন্ত্রণ পত্রটা আরও একবার চোখের সামনে মেলে ধরল সাইনি। আচমকা তার চোখের সামনের কালো অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠল একটা সাদা কালো ছবি…
★★★
"শুনেছিস এই বছর আমাদের ডিপার্টমেন্টের ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারে নাকি স্টুডেন্টরাও পেপার সাবমিট করতে পারবে।"
"স্টুডেন্টরা মানে প্রত্যেক সেমিস্টার থেকে দু'জন করে মোট চারজন। তার আগে পেপার বি.এম স্যারের কাছে জমা দিতে হবে। বি.এম স্যার পড়ে সিলেক্ট করবেন।"
"হ্যাঁ শুনলাম তো। তা তুই দিচ্ছিস?"
"না… না, পাগল নাকি! কত কঠিন কঠিন জিনিস লিখতে হবে।"
সাইনি জ্বর হওয়ার জন্য কয়েকদিন ক্লাসে আসতে পারেনি, তাই সেমিনারের ব্যাপারে সে কিছুই জানত না। এইমাত্র সহপাঠীদের কথোপকথন কানে লাগতেই সে উঠে গিয়ে জানতে চাইল ব্যাপারটা। সাইনি বরাবরই একটু মুখচোরা, তাই সে গিয়ে কথা বলাতে বাকিরা একটু অবাক হলেও সবাই আগ্রহ নিয়েই পুরো বিষয়টা জানাল তাকে। আসলে সাইনি মুখচোরা হলে কী হবে, পড়াশুনাতে যথেষ্ট ভাল। ক্লাসে তার আর কুনাল বলে একটি ছেলের মধ্যে প্রথম স্থান নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। মুখচোরা স্বভাবের জন্য প্রথম সেমিস্টারে সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষকরা অবধি তাকে বিশেষ নজর করত না, কিন্তু সেমিস্টার শেষে দুর্দান্ত রেজাল্ট করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল সে। সেই থেকে এখন অনেকেই তাকে বেশ পছন্দ করে, প্রয়োজনে সাহায্যও চায়। আজকে তাই সেমিনার সম্বন্ধে বিস্তারিত বলে সাবিনা জানতে চাইল, "তুই কি অংশ নিবি?"
"ভাবছি। আর তোরা?"
"ওরে বাবা আমরা এত কঠিন জিনিস পারব না।"
"তোরা না নিলে আমি একলা কী করে নিই!"
সমস্যার সমাধান হয়ে গেল সেদিনই। তখন অবধি একটাও পেপার জমা না পড়ায় বি.এম স্যার ক্লাসে খুব বকাঝকা করে বললেন আগামী বুধবারের মধ্যে পেপার জমা দিতে। সাইনি মহা উৎসাহে পড়াশুনা শুরু করল। অনেক খেটেখুটে শেষমেষ পেপারটা জমা দিল সে। বি.এম স্যার তার পেপার দেখেই চমকে গেলেন, "এটা তুমি লিখেছো? নিজে?"
"হ্যাঁ স্যার, কেন?" ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল সাইনি। বি.এম উচ্ছাসের সঙ্গে বলে উঠলেন আমি ভাবতে পারছি না একটা পি.জির স্টুডেন্ট এত পরিণত একটা পেপার লিখতে পারে বলে। দুর্দান্ত লিখেছো। আমি নিশ্চিত গেস্টরাও চমকে যাবেন।"
অবশেষে সাইনি আর কুণালের নির্বাচন হয়ে গেল ফোর্থ সেমিস্টার থেকে। কুণালের পেপারে স্যারকে বেশ কিছু সংশোধন করতে হয়েছিল কিন্তু সাইনির কিচ্ছু করতে হয়নি। শনিবার দিন স্যার বললেন ওদের অপেক্ষা করতে, সোমবার সেমিনারের আগে ওদের একবার ট্রায়াল করাবেন। যতই হোক, এত বড় সেমিনারে এই প্রথম প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেবে ওরা। শনিবার ক্লাস করবে বলে সাড়ে ন'টাতেই কলেজে চলে গিয়েছিল সাইনি। কিন্তু ওইদিন ক্লাস হল না। সাইনি আর কুনাল অপেক্ষা করতে লাগল ট্রায়ালের জন্য। বেলা এগারোটা নাগাদ হঠাৎ করে অর্নিকা বলে একটি মেয়ে বি. এম স্যারের কেবিনে ঢুকে গেল। অর্নিকা খুব ধনী পরিবারের মেয়ে, সেই সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী। পড়াশুনায় মধ্যম মানের হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ওকে চেনে না এমন কেউ নেই। অর্নিকাকে ওই সময় স্যারের কেবিনে ঢুকতে দেখে বেশ অবাক হল সাইনিরা। কুনাল বলল, "ওর হাতের কাগজটা কী ছিল বলত? আজকে পেপার দেখাতে এসেছে নাকি? ডেট তো পেরিয়ে গিয়েছে।"
"কে জানে! আমাদের তো সিলেকশন হয়ে গিয়েছে, এবার ওকে স্যার নিলে নেবেন।" বলল সাইনি।
ওরা অপেক্ষা করতে থাকল স্যারের কেবিনের বাইরে। প্রায় দু'টার সময় কেবিনের দরজা খুলল। ততক্ষণে সেকেন্ড সেমিস্টারের নির্বাচিত দু'জনও এসে গিয়েছে। ওরা স্যারের কেবিনে ঢুকে দেখল অর্নিকা একটা চেয়ারে বসে রয়েছে। ওরা চারজন ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বি.এম স্যার একটা অপ্রস্তুতের হাসি হেসে সাইনির দিকে তাকিয়ে বললেন, "সাইনি রে তোর পেপারটা এবার রাখতে পারছি না। তোর পেপারটা আসলে অতটা স্ট্যান্ডার্ড নয়, বিভিন্ন দেশের স্কলাররা আসবেন তো, তাই…"
স্যার আরও কিছু বলে যাচ্ছিলেন, সাইনির আর কিছু যেন কানে ঢুকছিল না। পা দুটো কেঁপে উঠছিল। সেই সকাল সাড়ে ন'টার থেকে বেলা দু'টা অবধি এই কারণে অপেক্ষা করছিল সে! সেদিন তো স্যার বললেন সবার পেপারটা দেখে তাকে লেগে যাবে, তাহলে আজকে কী হল! বাইরে বেরিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল করিডোরে, চোখ দুটো জলে ঝাপসা হয়ে এসেছে। পেছন থেকে হঠাৎ অর্নিকার এক সঙ্গীর গলা শুনতে পেল, "তোকে কেউ হারাতে পারবে না জানতাম।"
সাইনি পেছন ফিরে দেখল কখন যেন অর্নিকা আর তার এক সঙ্গী এসে দাঁড়িয়েছে করিডোরে। অর্নিকার মুখে বিদ্রুপের হাসি।
সেমিনারের দিন সাইনি নির্বাক দর্শকের চেয়ার থেকে দেখেছিল অহংকারী অর্নিকার অহংকারকে সাজতে।
★★★
আজ বহু বছর পর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দাঁড়িয়েছে সাইনি। সে ভেবেছিল এই আমন্ত্রণটা প্রত্যাখ্যান করবে কিন্তু শেষমেশ মত পাল্টায়। আজ সাইনি তুলনামূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক সুপরিচিত নাম। তার লেখা বই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। দেশ বিদেশ থেকে সে আমন্ত্রণ পায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। সেদিন তাকে অন্যায়ভাবে সুযোগ না দেওয়া হলেও তার যোগ্যতা ছিল বলেই সুযোগ নিজে তাকে খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু সেই অপমান, সেই কষ্ট আজও যেন সাইনির বুকে টাটকা। আজ নিজের প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের প্রাক্তন ডিপার্টমেন্ট আয়োজিত আন্তর্জাতিক সেমিনারের প্রধান বক্তা সে। তিনদিন ব্যাপী এই সেমিনারের শেষ দিনে চারজন শিক্ষার্থী নিজেদের পেপার প্রেজেন্ট করল। প্রেজেন্টেশন শেষ হওয়ার পর তারা সাইনিকে এসে প্রণাম করল। কেঁপে উঠল সাইনি।
সেমিনার শেষে হঠাৎ বি. এম স্যার এলেন সাইনির কাছে। প্রণাম করল সাইনি। স্যার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, "আরও বড় হও।"
তারপর স্যার সাইনির দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোকে কিছু বলার ছিল।"
"হ্যাঁ স্যার, বলুন।"
"পরের মাসে আমার রিটায়ারমেন্ট। তার আগে তোর কাছে ক্ষমা না চাইলে নিজের বিবেকের কাছে ছোট হয়ে যাব।"
"ক্ষমা! কিসের জন্য স্যার?" অবাক হল সাইনি। স্যার বললেন, "একদিন এই সেমিনার থেকেই তোকে অন্যায় ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমা করে দিস আমাকে।"
চমকে উঠল সাইনি। স্যার বলে গেলেন, "আসলে সেদিন হেড ফোন করে বললেন… ওনার মতে অর্নিকার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে তাই ওকে সুযোগটা দেওয়া উচিৎ। অন্যান্য মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা তো মাস্টার্স শেষ করেই বিয়ে করে নেয়, সংসার আর…"
"আমি সবটাই জানি স্যার, এই কথাগুলো আজকে বলা নিষ্প্রয়োজন। আর যুক্তি দিতে মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েদের কাঠগড়ায় নাই বা তুললেন।" স্যারের কথার মাঝেই কথাগুলো বলে উঠল সাইনি। এবার চমকে উঠলেন স্যার, বললেন, "তুই সবটা জানিস?"
"হ্যাঁ স্যার। কুণাল ছিল একটা ছেলে, তার ওপর ইউনিয়ন করত। ওকে বাদ দিলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হতে পারত। আমি একে মেয়ে, তার ওপর মুখচোরা খুব সাধারণ একটা মেয়ে। এত 'ইজি প্রে' আর হয় নাকি! আর অর্নিকার আসল ব্যাপারটাও আমি জানি স্যার।"
আলতো করে হাসল সাইনি। অর্নিকার সঙ্গে তখনকার হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্টের একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। কুনালের থেকেই পরে জেনেছিল সাইনি। স্যার সাইনির হাত দুটো ধরে বললেন, "বিশ্বাস কর আমি এটা করতে চাইনি। কিন্তু…"
সাইনি বলল, "আপনি আমার গুরুজন, আমার শিক্ষক। আমার কাছে আপনার ক্ষমা চাওয়া মানায় না। তবে একটা আশীর্বাদ করবেন স্যার?"
"আশীর্বাদ! কী আশীর্বাদ?" অবাক গলায় জানতে চাইলেন স্যার। সাইনি আলতো হেসে বলল, "আমিও তো একজন শিক্ষক, শিক্ষক হিসেবে যেন চিরকাল মেরুদন্ডটা সোজা রেখে চলতে পারি, পক্ষপাতের কালো পর্দা যেন আমার চোখকে কোনোদিনও ঢেকে দেয়।"
প্রাক্তন ছাত্রীর কথাটা শুনে হঠাৎ চোখগুলো জলে ভরে উঠল প্রৌঢ় অধ্যাপকের।
#InspiringWoman #অনুপ্রেরণাদানকারীনারী