পরাজয়
পরাজয়
জানালার ফাঁক দিয়ে সকালের আকাশটা চোখে পড়তেই লিলির মনে হল বহু দিন সকালের আকাশ দেখা হয় না, কপাল গুনে যখন আজ সুযোগ হয়েছে তখন সেটা কাজে লাগানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একথা ভেবে লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে চুপচাপ সবার নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে এল লিলি । কিছুক্ষণ আগেই বেশ বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাদটা ভিজে এখনও, মাটির সোঁদা গন্ধটা বেশ নাকে আসছে। ছাদের এদিকটায় অনেক ফুলের টব রাখা। বৃষ্টির তোড়ে কিছু ফুল পাতা এদিক ওদিক ছড়িয়ে। ছাদের ডানদিকটা ঘন সবুজ। এদিক ওদিক শ্যাওলা তো আছেই, বাড়ির পাশেই বড় বড় গাছগুলোর জন্য সবুজটা যেন ঘনিয়ে রয়েছে আরো বেশী। এখনও ঠান্ডা হাওয়াটা দিচ্ছেই। আকাশটা পুরো পরিষ্কার হয়নি এখনও, একটু পরে হয়তো আবার নামবে। চুপচাপ নিজের মোড়া টেনে নিয়ে বসল লিলি । ছাদে নিজের প্রিয় কোণটায় গিয়ে বসল ও, যেখান থেকে কোনো ধূসর চোখে পড়ে না। যেখানে শুধু ঘন সবুজের উপস্থিতি। লাইটারটা বের করে সিগারেটটা বের করল ও, অবশেষে দিল সুখটান। ফোনটার থেকে একবার সময়টা দেখে নিল, অনেক সময় আছে। কী সুন্দর ওয়েদারটা, ওদের জানলার কাছে ভোরের মুখে যখন বৃষ্টি আছড়ে পড়ল, আর মানিপ্ল্যান্টগুলো ধাক্কা দিচ্ছিল কাঁচে, ও তখন থেকেই জেগে। বেশ লাগছিল দেখতে। নেহাত বৃষ্টিটা থামছিল না তাই ছাদে আসতে পারছিল না। কোঁকড়া চুলগুলো জড়িয়ে মাথার উপর টপ-নট বেঁধে নিয়েছে একটা। মুখে ঠান্ডা হওয়ার ঝলক, সঙ্গে সিগারেট।।।
“কীরে, আবার এখানে সুখটান?”
লিলি না তাকিয়ে চোখ বুজেই হাসল। কাকাই, লিলির সাথে কাকাই-এর সম্পর্ক যতটা না কাকা ভাইঝির, তার থেকে অনেক বেশী বন্ধুত্বের। ছোটবেলায় কাকাকে পরিষ্কার ভাবে কাকা বলতে পারত না, বলত কাকাই। সেই থেকে কাকা হয়ে গেল কাকাই।একমাত্র কাকাই-ই জানে লিলির সিগারেট খাওয়ার ব্যাপারটা। বাড়িতে বাবা, জ্যাঠারা জানলে তো রক্ষে থাকত না। কাকাই ধূমপান করে না, ধূমপানে উৎসাহও দেয় না। লিলিকে প্রথমবারই দেখে বলেছিল, “সিগারেটটা শুধু এখন পুড়ছে, বাকী কিছু আর পোড়ার আগে ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টাটা করিস।” তখন লিলি অতটা বোঝেনি কথাটার মানে, এখন বোঝে।
সিগারেটটা ছাড়ারই চেষ্টা করছিল। কিন্তু ইদানিং, স্পেশালি আজ, কিছুতেই পারল না।
চোখটা খুলে কাকাই-এর দিকে তাকিয়ে হাসল শুধু। কাকাই-এর হাসিমুখটা দেখে আবার সিগারেটে টান দিল। এ হাসি প্রশ্রয়ের হাসি।
-“আজ এত সকাল সকাল? কোনদিন তো সকাল, সূর্যোদয় দেখিস না এত তাড়াতাড়ি উঠে।”
-“উঠলাম কোথায়, ঘুমালামই কই?”
কাকাই-এর চোখে চোখ রেখে বলল লিলি ।
-“কেন? ঘুম হয়নি কাল? তোর আবার এই অনিদ্রা রোগটা কবে থেকে ধরল? ওয়েদারটাও তো কাল ভালই ছিল।”
কাকাই-এর দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল লিলি । এ দৃষ্টি অভিমানীর দৃষ্টি , “তুমি জানো কাকাই, সব তো জানো।” এটুকু বলে জোর করে ঠোঁটে একটা হাসি টানার চেষ্টা করল যেন লিলি । সিগারেটটা ততক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে।
-“হুম, বুঝলাম। এই আর খাস না।”
-“হুম, খাইনি। আচ্ছা কাকাই, তোমার মনে আছে, আমায় প্রথম যেদিন তুমি সিগারেট খেতে দেখে ফেলেছিলে, তুমি আমায় একটুও বকোনি। একটুও না। আমি জাস্ট হা! আনএক্সপেক্টেড তো পুরো ব্যাপারটা।”
-“তোকে কবে কোন কিছু নিয়ে বকেছি আমি? আর তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী, আমি জানতাম তুই বুঝতে পারবি। তাই টানা সাত মাস খাসওনি, সেটাও জানি। যখন ভালোটা বাগিয়ে আনতে পেরেছিস, তখন আর সেটা নষ্ট করিস না। আমি জানি তুই বুঝবি, খামোখা বকবো কেন?”
লিলি অন্যমনস্ক হয়ে তাকাল সামনের দিকে। পাখিরা ডাকতে শুরু করেছে কিচিরমিচির। ভোর হলেও মেঘলা থাকার জন্য তেমন আলো ফোটেনি। আলো-আঁধারি আকাশটার দিকে তাকিয়েই বলল লিলি , “হুম, এখন বুঝি। সত্যিই, কোন মানুষের মৃত্যু শুধু একজনের মৃত্যু তো নয়, তার আশপাশের মানুষ, প্রিয়জন সবাই-ই শেষ হয়ে যায়, মরে বেঁচে থাকে শুধু, ঠিক যেমন… আচ্ছা কাকাই, তোমার মনে আছে, আমার স্কুলের ওয়ার্ক এডুকেশনের সমস্ত কাজ তোমায় দিয়ে কেমন করিয়ে নিয়ে যেতাম – উলের হাতপাখা, ব্যাগ, পেঙ্গুইন । ঐ কনেবৌটা। কী মারাত্মক সুন্দর। কী সুন্দর হাতের কাজ তোমার। সবাই ঠিকই বলে তোমার আঙুলে জাদুই আছে। এখন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ঐ খিলানটায় ওগুলো সব সাজানো দেখে মনে পড়লো।”
-“মনে নেই আবার, আমার দৌলতে তো প্রতিবার ওয়ার্ক এডুকেশনে A । অলি , আঁখি ওদের সে কী চিৎকার সেবার তোর জন্মদিনে এসে, উফফ।”
অতীতের স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হেসে উঠল দুজনেই। ছোট থেকেই লিলির কাকাই-এর সাথে ভীষণ ভাল জমত। ওর সাথে কাকাই-এর বয়সের পার্থক্য বছর সাতেকের। বাবা, জ্যাঠার থেকে তাই কাকাই-এর সঙ্গই বরাবর প্রিয় রিনির। এমনকী বাবুদা, বুলিদির সাথেও অত জমতো না। ওরা নাকি কাকাই-এর অর্ধেক কথা বুঝতেই পারত না। লিলিও যে খুব বুঝত তা নয়। বেশীর ভাগ কথাই মাথার উপর দিয়েই যেত । কিন্তু এখন বোঝে লিলি কথাগুলো। এই বোঝা না বোঝায় মিলেমিশেই মানুষটা লিলির বড্ড কাছের। কী ভীষণ ট্যালেন্টেড, এত প্রতিভাও কারও হয়?
-“তোমার মনে আছে কাকাই, তোমার কত লেখা নিজের বলে চালিয়ে স্কুল ম্যাগাজিনে জমা দিয়েছিলাম। তারপর যখন লেখা বেরলো আমার সে কী ফুর্তি!”
-“হ্যাঁ , আমি তো এর বিন্দু বিসর্গও জানতাম না। সবটা বোঝার পর ভাবলাম, ও বাবা, তলে তলে এই ব্যাপার? এই জন্য রোজ দুপুরে আমার ঘরে উঁকিঝুঁকি। আমি অফিস থেকে ফিরে ভাবতাম, রোজ আমার ঘরে কী করেন মহারানী?”
-“কী আশ্চর্য না কাকাই, তুমি সেদিনও আমায় বকোনি। শুধু বলেছিলে, “আমার কিছুই হারাচ্ছে না লিলি , যা হারাচ্ছে তোমার, সারাজীবন আয়নায় চোখে চোখ রাখতে পারো যেন |”
আমি সেদিনও কিছু বুঝিনি, তবে এখন… কী অদ্ভুত না?”
যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল লিলি। চোখের সামনে ভিড় করছে অসংখ্য স্মৃতি। কাকাই-এর কাজ, কথাবার্তা, লেখালেখি, ব্যক্তিত্ব, রুচি, সবকিছুই ভীষণ ভীষণ প্রিয় লিলির। মানুষটাকে যত দেখে, জানে, চেনে তত যেন মুগ্ধ হয়ে যায়।
ওর বেশ মনে আছে, ওর যখনই ভালো কিছু খেতে ইচ্ছে হতো, মা-র কাছে বায়না করতো, মা কিছুতেই রাস্তার খাবার আনতে রাজী হতো না। এতো ভুগতো ও ছোট থেকে। কিন্তু কী আশ্চর্যজনকভাবে তার দিনকয়েকের মধ্যেই খাবারটা ওর সামনে চলে আসতো। নাহ, বাইরের কোন রেস্টুরেন্টের নয়, কাকাই-এর নিজের হাতে বানানো। এত্ত ভালো ফিশফ্রাই, রোল, চাউমিন বানাতো কাকাই – উফফ, এক সে বড়কর এক। ও একবার কাকাইকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি যখন এত সুন্দর করে আমায় বানিয়ে খাওয়ালেই, সেদিনই খাওয়াতে পারতে, এত পরে কেন?”
কাকাই বলেছিল, “হুম, একশোবার পারি, কিন্তু করবো না। ক’দিন পর সবার জন্য যখন বানানো হবে, তখনই পাবে।”
খুব রাগ হয়েছিল কাকাই-এর উপর সেই মুহূর্তে, কাকাই যে বকে কথাগুলো বলেছিল তা নয়, ভারী মিষ্টি করেই বলেছিল, কিন্তু তাও খুব রাগ হয়েছিল ওর। কিন্তু তারপর থেকে ও এটা বুঝে গেছিল ওর যা ইচ্ছে হবে, তা ও পাবেই খেতে, তবে সঙ্গে সঙ্গে নয় - ক’দিন পর। কী যে হল,অদ্ভুতভাবে ও আর বেশী বায়না করতো না। ও জানে কাকাই ঠিক বানাবে ওর জন্য, আর ও সেটা পাবেও, সবাই পাবে, ও একা নয়। ধৈর্য্য ধরতে, জিনিসের মূল্য বুঝতে, ‘না’ শুনতে শিখেছিল সেই থেকে লিলি , কোনো জেদাজেদি, অশান্তি না করেই।
মেঘটা কাটতে আরম্ভ করছে একটু একটু করে। সূর্যের আলো একটু একটু করে ছড়াতে শুরু করেছে পূবদিকটা জুড়ে। পাখিদের কিচিরমিচির বেশ জোরালো হচ্ছে ধীরে ধীরে। সাইকেলে করে একজন দুজন বেরতে শুরু করেছে। ভোরের আলো ফুটছে।
-“তারপর আস্তে আস্তে সবকিছু কেমন বদলাতে শুরু করল তাই না কাকাই? যে তুমি এত ট্যালেন্টেড, এত প্রতিভাবান, এত সফল একজন মানুষ, যাকে নিয়ে এত গর্ব, সে গর্ব হঠাৎ এত ঠুনকো কবে থেকে হলো আমি অন্তত বুঝিনি। রবীনদা, মানে ‘অরুনোদয়’ দলের রবীনদা, সেই মানুষটাকে একমাত্র দেখতাম তার ব্যবহার বদলায়নি তোমার প্রতি, আগের মতনই সবসময় স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা, সিন কেমন হবে সেই আলোচনায় মশগুল, সব আগের মতই। ভাল লাগতো বেশ। আমি আজও বুঝিনি সেদিনকার মানুষগুলোর ব্যবহারের এই পরিবর্তনের কারণ, এই ঔদ্ধত্য, মুখোশ পরা মানুষগুলোর নগ্ন রূপটা! কেন? কেন? কেন? কী এমন করেছিলে তুমি? ওদের মনের মধ্যে, সমাজের মনের মধ্যে আষ্টেপৃষ্টে গেঁথে থাকা ভাবনাটাকে তো তুমি যেচে বদলাতে যাওনি। ওরা থাকত ওদের মতন। তুমি তো ওদের জীবনে নাক গলাওনি। ওরা তবে তোমার জীবন নিয়ে এত কথা বলার সাহস পায় কোথায় থেকে?”
-“ভুল বললি লিলি । আসলে কী বলতো, একটা মানুষ তার যা কিছু, যতটুকু দেখছি সবটা ভালো, মানুষ আসতে আসতে সেটাকে শ্রদ্ধার পর্যায়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। এর সুবিধা হচ্ছে, তুমি সবদিন তাদের মনে একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিলে। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে, কোনো ভাবনা, কোন ঘটনা, কোন কিছু যদি তাদের প্রচলিত ধ্যানধারণাকে একবারও আঘাত করে, কিছুতেই সেটা মানতে পারে না মানুষ। জরুরী নয় সে কোনো অন্যায় করেছে, তাও। এরা শুধু তাদের যেটুকু ভাল লাগে, সেটাকেই ভালবাসতে জানে। ঐ মানুষটার সবকিছুকে নয়। সত্যের সাথে, কঠিন বাস্তবের সাথে চোখ মেলাতে পারে না, আসলে মেলাতে চায় না। স্বীকারই করতে পারে না রূঢ় বাস্তবটাকে। তাই যেই দেখল আমার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেগুলো ওদের ধ্যানধারণার সাথে মিলছে না, আঘাত করলো, ভীষনরকম আঘাত। ওটাই যেন ওদের কাছে একটা সুখ, প্রাপ্তি, একটা অব্যক্ত অধিকার যেন আমার উপর, আমার জীবনের উপর, আমার সিদ্ধান্তের উপর। সবাই ভুলে গেল, জীবনটা আমার তাই সিদ্ধান্তটাও একান্ত আমার। এরা সকলেই আমায় ভালবাসে লিলি , সকলে। ভালবাসে বলেই তো এরকম প্রতিক্রিয়া । কিন্তু এ ভালবাসা ভীষণ কষ্টের। অসম্পূর্ন। সম্পূর্ণ নয় এ ভালোবাসা” — একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল…
অনেক কথা বলল কাকাই। আজ কথাগুলো বোঝে লিলি ।
-“আসলে কী বলতো, দুধসাদা ক্যানভাস, সেটাকে সাদাই রাখবো, নানান রঙে সেটাকে তো রাঙিয়েও তোলা যায়, কিন্তু সবাই সেটাই মানতে পারে না। পরিবর্তনকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারে না। এটা প্রতিটি মানুষের আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনকে দেখার চোখ সবার আলাদা আলাদা। কই তোর তো কোন কিছুই অদ্ভুত, আলাদা, অন্যরকম লাগেনি, কারণ তোর চোখ আলাদা, সবার তো নয় সেটা, মেজরিটিরই সেটা নয়।
-“তোমার খুব কষ্ট হয়েছে তাই না কাকাই?”
এবার হাসলো বেশ জোরে সুনীল , সুনীল দাস , লিলির কাকাই। যার লেখার জাদুতে মশগুল এখন আপামর বাঙালী।যার প্রাণখোলা হাসি দেখলে মনখারাপ এক নিমেষে হাওয়া |
-“আমি যখন প্রথম এই ফ্যান ফলোয়িং, শুভেচ্ছাবার্তা, রয়্যালটি, অটোগ্রাফ এগুলোর সাথে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছিলাম, ভীষণ খুশী তো ছিলামই, কিন্তু তার সাথে এটা সবসময় আমার মাথায় ছিল আমার কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়, আমার জীবনের চরম অন্ধকারতম মুহূর্তে কিছু তারা থাকবে না। থাকবে আমার ফ্যামিলিই। তাই যখন তারা আমার সিদ্ধান্তগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করছিল অতটা কষ্ট পাইনি, যতটা বড়দা, মেজদা, মা, বাবা সবাই পাশ থেকে সরে গেছল আমার সেক্স চেঞ্জ অপারেশনের ডিসিশনটা শুনে। আমি যতবারই বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কাউকে পাইনি পাশে। সব ভাল, ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকরি, তারপর লেখার জগৎ, সেখানে সাকসেস, এই সব ভালগুলো যেন একলহমায় মন্দে রূপান্তরিত হলো শুধু একটা সিদ্ধান্তের জন্য। অথচ সে সিদ্ধান্তে কারো কোনো ক্ষতি হবে না, সে সিদ্ধান্তটা একান্তই আমার জীবন নিয়ে, সবটাই আমার – কিন্তু আমারই সেই ডিসিশনে সবাই মিলে একটাই শব্দ প্রয়োগ করল – “ছিঃ”। বাবাও। কেন? অন্যায় তো কিছু করিনি, সারা সমাজের কাছে, পরিবারের কাছে আমি যা, আমার বাহ্যিক যা রূপ, ভিতরে ভিতরে আমি তা নই, একেবারেই তা নই। আর আমি যেটা সেই রূপেই নিজেকে পরিবর্তিত করতে চেয়েছিলাম মাত্র। আমি ভাল থাকতে পারতাম, ওটাই কী একমাত্র প্রধান বিষয় হওয়া উচিত নয়? কোনটা বেশী জরুরী? আমার ভাল থাকা না বাকী সবার? একটা সময় পর না পরিবারের পাশে থাকাটাই একমাত্র চাওয়া হয়, আর আমি সেটাই পেলাম না জানিস। বাবাও বুঝলো না। আর মা বুঝতে চাইলেও বাবা বুঝতেই দিল না। আমার জন্মদিনের দিন বাবার সারপ্রাইজ শুনবি? ‘তোমার জন্য মেয়ে দেখেছি, ভাল মেয়ে, কবে তোমার সময় হবে বলো, ওদের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা হবে সেই মতো’- সেই দিন, সেই দিনই আমি ক্লিয়ারলি এটা বুঝে গেছিলাম এরা এটাকে জাস্ট একটা রোগ ভাবে। ঐ জন্য ‘বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে’ কথাটা আসে। কোন রোগ, অসুখ হলে তবে তো সেটা ঠিক হওয়ার প্রসঙ্গ আসে। যতদিন এরা এটাকে রোগের চোখে দেখবে, ততদিন এতে একটা ‘সমস্যা’র ট্যাগই লেগে থাকবে। এটা সাধারণ, স্বাভাবিক কিছু হয়ে উঠবে না। এত কটূক্তি, খিল্লি, হাসির খোরাক এসব কিছুই আমার গায়ে লাগত না যদি মা বাবাকে, কোন বন্ধুকে পেতাম পাশে। তুইও দূরে চলে গেলি। একটা সময় পর নিজেকে ভীষণ একা লাগত। ডাক্তারের কাছে চেক আপের সময়, অপারেশন টেবিলে কেউ ছিল না পাশে। মনের দ্বন্দ্বটা, আমার ভিতরকার এই টানাপোড়েনটা থেকে মুক্তি চাইতে গিয়ে যদি সমাজ, পরিবার এভাবে কাটা ছেঁড়া করে, তাহলে একটা মানুষ সুস্থভাবে বাঁচবে কী করে বলতো? একটা সময় পরে শরীরটাও আর সায় দিচ্ছিল না। মেন্টাল স্ট্রেস, দিনরাত এত অশান্তি সব হেলায় এড়িয়েই যাচ্ছিলাম। কিন্তু শরীরটাও আর কথা শুনলো না। ভাঙতে শুরু করল আস্তে আস্তে। বুঝতে পারছিলাম ক্ষয়ে যাচ্ছি। আর হয়ত টানা সম্ভব না…
-“আমার খুব হেল্পলেস লাগত জানো তো কাকাই, এই পুরো জার্নিতে আমি তোমার পাশে মানসিকভাবে সবদিন ছিলাম, কিন্তু শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। ডাক্তারী পড়তে গেছি অথচ যেখানে আমাকে সবথেকে বেশী প্রয়োজন সেখানেই কিছু করতে পারলাম না। এই অনুতাপ টা কোনদিনও… জানো তো ছোট থেকেই ভাবতাম, বাবা - জেঠুও বলতো, কাকাই-এর মতো হতে হবে, আমিও চাইতাম বড় হয়ে তোমার মতোই হবো, তোমার প্রতিটি কাজ, নাটক, লেখালেখি, সবেতেই সাকসেসফুল, সবকিছুতেই ব্রিলিয়ান্ট, যাতেই হাত দিয়েছো সেখানেই সাফল্য, এগুলোই হঠাৎ করে একদিন মিথ্যে হয়ে গেল ওদের কাছে। কেন? মানুষটা তো একই আছে। ছোট থেকেই যে দহনে শেষ হচ্ছিল সে শুধু সেটা থেকে মুক্তির নিজের মতো একটা পথ বেছেছিল, তার জন্য কিভাবে সবটা বদলাতে পারে? না, আমার কাছে তুমি আইডল, একই ছিলে, আছো, আর থাকবে। মানুষ হিসেবে, তোমার জায়গা কেউ কখনো নিতে পারবে না… নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে কখন চোখে জল জমেছে, খেয়ালই করেনি। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা আজও জানান দিচ্ছে নিজের পরম প্রিয় কাকাই কে কতটা মিস করে লিলি । ফোনটা বাজল হঠাৎ। ছাদে একা দাঁড়িয়ে লিলি । ভোরের আলো ফুটে গেছে ততক্ষণে। মা ফোন করছে। ধরল ফোনটা লিলি। সকালে উঠে দেখতে না পেয়ে মেয়েকে একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আর কী। আজ লিলির অনেক কাজ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফাঁকা ছাদটা একবার দেখে এগোল লিলি দরজার দিকে। নীচে সবাই ততক্ষণে উঠে পড়েছে। শ্রাদ্ধ শান্তির আয়োজন চলছে, লিলিই করবে ওর কাকাই-এর কাজটা।
কাকাই-এর চন্দন পরানো ফটোটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল রিনি। আজ সবাই কোন না কোনভাবে এই পরিণতিটার জন্য দায়ী কী? হয়তো, বা নয়, জানা নেই। যদি কাকাইকে বুঝত, যদি মানুষটার পাশে থাকত সবাই, হয়তো মানুষটা মনে এতটা যন্ত্রনা নিয়ে যেত না। হয়তো এতটা অনুতাপের আগুনে ওর মনটা দগ্ধ হতো না। “সরি কাকাই, তোমার পাশে থাকতে পারলাম না, লড়তে পারলাম না তোমার জন্য, মিস ইউ।” চোখ মুছল লিলি , সবার অলক্ষ্যে যেন লিলির দিকে তাকিয়ে আবার সেই প্রাণখোলা হাসিটা হাসল, ওর কাকাই।
গল্পটা এখানেই শেষ, কিন্তু বাস্তব জীবনে এরকম ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। এটা কোন অসুখ নয় সৃষ্টিকর্তার আপন খেয়ালে তার সৃষ্টির যদি অন্তর আর বাহিরের ভিন্ন রূপ হয় তার জন্য দায়িত্ব তো সৃষ্টির নয়। মানুষ জন্ম গ্রহণ করে স্বাধীন ভাবে, বাঁচবে স্বাধীন ভাবে এবং চিরদিনই স্বাধীন থাকবে। তাহলে এই সব প্রাণ কেন নিজের স্বাধীন অস্তিত্বকে নিজের করে পাবে না কিছু তথাকথিত সমাজপতিদের জন্য। এটা তো মনুষ্যত্ব ও মানবতার চরম পরাজয়। আজ তাই বারবার মনে হচ্ছে -'পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান’।