সিঙ্গেল মাদার
সিঙ্গেল মাদার
গল্প : সিঙ্গেল মাদার
মীরার মা এর অপারেশন চলছে۔۔ মীরা অপারেশনটা নিজেই করছে ..তার মায়ের ব্রেইন টিউমার হয়েছে ۔۔খুব ক্রিটিক্যাল একটা সিচুয়েশন۔۔সে নাও বাঁচতে পারে! বাঁচলেও হয়তো কাউকে চিনতে পারবে না ۔۔নটা বেজে পঁচিশ মিনিট۔۔মিরা গম্ভীর মুখে নিজের কাজ করে যাচ্ছে۔۔রক্ত টা একটু বেশি ঝরছে۔۔মিরা বুঝতে পারছে না এখনো যে রক্তের কি প্রয়োজন আছে, কিনা !
এইতো ১৬ বছর আগে মিরা যখন ক্লাস সিক্সে পড়তো তখন তার বাবা তার মাকে অবহেলায় ফেলে আর একটা জায়গায় বিয়ে করে۔۔۔
তারপরে তার মা যখন তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন কেমন জানি মীরাও তার নিজ ইচ্ছায় মায়ের আঙ্গুলগুলো ধরে বেরিয়ে এসেছিলো۔۔ তার বাবা যেতে বারণ করেছিল মিরাকে যদিও۔۔
মিরা তার মার সাথে নানুর বাসায় গিয়ে উঠেছিল۔۔একদিন বিকেলে টিভির ঘরে উঁকি দিতেই মিরা দেখলো বাড়ির সবাই কিছু আলোচনা করছে তার মাকে সহ ۔۔
মিরা খেয়াল করেছিল তার মায়ের দিকে কারণ তার মা কাঁদছিলো۔۔۔তবে কেন কাঁদছিল সেটা তার বোঝার সাধ্যের মধ্যে ছিল না, তাকে কি আবার কেউ বকেছে! ঘরের ভেতর থেকে মীরার কোনোএক খালামণি মীরাকে ডেকে বলে উঠলো ,"তার মাকে তারা বিয়ে দিতে চাইছে!" তোমাকে চকলেট কিনে দিবো, তোমাকে গল্প শোনাবো۔۔ তুমি আমাদের সাথে থাকবে! তোমার নতুন বাবা আর তোমার মা মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসবে۔۔কত কি বলে মিরাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো۔۔۔ মিরা অসহায় চোখে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল ,সে কি বলবে বুঝতে পারছিল না۔۔۔۔
পরদিন
সকালবেলা উঠে মীরার মা মিরাকে নিয়ে নানুর বাসা থেকে বের হয়ে চলে আসছিলো ۔۔বাড়ির সবাই তার মাকে ধমকের সুরে বলেছিল ,"আমরা তোর ভালো চেয়েছিলাম۔۔۔একটা মেয়ে বাচ্চার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়ার মানেই হয়না !"۔۔ মা সেদিন বলেছিল এর উত্তর একদিন তোমরা পাবে ۔۔۔۔
আজকের মীরার খুব ভয় করছে۔۔তার মা কি বাঁচবে ?আর বাঁচলেও তার মা কি তাকে চিনতে পারবে??
কত কিছু করে তার মা তাকে সামলিয়েছে তার মা খুব নরমাল একটা স্কুলে চাকরি নিয়েছিল, বাসায় ছোট্ট বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়া তো আবার মিরা কেও পড়াতে থাকলো ۔۔۔
মীরার সাথে অনেকে মিসতো আবার অনেকে মিসতো না۔۔অনেকে বলতো বাবা নেই কে জানে কেমন পরিবার ! মিরা দেখেছিলো, আশেপাশের মহিলাদের তার মাকে নিয়ে আলোচনা করতে তারা বলেছিল," কি জানি বাপু একা একা মেয়ে মানুষ বাচ্চা নিয়ে থাকে, শুনেছি স্বামীর ছেড়ে দিয়েছে, ভালো হলে কি ছাড় তো? নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছে!"অথচ -মিরা দেখেছে ,
তার মা ,বাবাকে কতটা ভালোবাসতো !মীরার মা সব সময় মীরার বাবাকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দিতো۔۔۔অফিস থেকে ফিরলে ক্লান্ত হয়ে জুতো পায়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লে জুতোগুলো কত ভালোবাসায় যত্নে খুলে দিত ! একদিন মিরাদের বাসায় তাদের সামনে ফ্ল্যাটের একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা এসে বলেছিল তার মাকে ! "মেয়েছেলে মানুষ একা থাকবে কেন?তারা চাইলেই কি ছেলে হতে পারে নাকি কি ??কি এমন হয়েছিল যে স্বামী তোমাকে ছেড়ে দিলো?"মিরা সেদিন দেখেছিলো তার মা কিভাবে চোখে বেশখানিক পানি নিয়েও ঠোঁটের কোণায় নকল হাসি ফুটিয়ে সম্মানের সাথে ভদ্রমহিলাকে বিদায় দিয়েছে! ۔۔۔۔۔তার মাকে কত ছেলেপেলে কত লোক কুপ্রস্তাব দেওয়ার চেষ্টা করত কত যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছিল তার মাকে শুধু তাকে মানুষ করতে চেয়েছিলো বলে۔۔۔মিরা তখন ভাবতো তার বাবা একটুও কেন ভাবেনি যে তার কুকর্মের জন্যে একটা মেয়েকে জীবনে কতটা জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়!এগুলোকে কি সম্পর্ক বলে ???
মীরা সুন্দরভাবে মায়ের অপারেশন টা শেষ করলো! তার মা বেচে আছে তার জ্ঞান ফিরলে সে কি সবাইকে চিনতে পারবে কি চিনতে পারবে না সেটা বুঝতে পারছে না মিরা۔۔۔۔মীরা বুকের ভেতর একগাদা প্রশ্ন আর কান্না নিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসলো۔۔ বেরুতেই তার নানুর বাড়ির সবাইকে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলো ۔۔۔
মীরা ঘড়িতে দেখল রাত 12:30 নিজের হাঁটুর ওপর হাতের কুনোই ভর করে গাল দুই হাতের তালুর ভেতর দিয়ে বসে থাকলো একটা সিটে এ ۔۔۔
নানির বাড়ির একজন এসে বলল তোর মার যদি কিছু হয় ,তাই তোর বাবা কে শেষ একবার ডাকা দরকার ۔۔মিনার মনে হল তার বাবাকে যদি ডাকা হয় তাহলে তার মার অসম্মান করা হবে !
তার নানিরবাড়ির মানুষগুলো বলল মেয়ে মানুষের এত রাগ ঠিক নয় !
মীরার তখন মনে হচ্ছিল," তার মা তাকে একাই সামলিয়ে ছে ,জগতের সাথে লড়াই করেছে ,কত মানুষের কটু কথা শুনেও থেমে থাকেনি۔۔যার পরিণামে তার মেয়ে একজন বড় ডাক্তার হতে পেরেছে ..সমাজে ভালো রুপি কিছু পশুর সাথে কত যুদ্ধ করেছেন তার মা !!একজন সিঙ্গেল মাদার হিসেবে লড়াই করাটা কতটা সাহসিকতার বিষয়
সেটা আর কেউ বুঝতে পারুক আর নাই পারুক সে আর তার মা ঠিকই বুঝে আর সেই সাহসিকতা,সেই সম্মান কে অপমান করার কোন মানে হয়না সেই নিষ্ঠুর মানুষটাকে ডেকে۔۔۔
একজন সিস্টার্ মিরাকে খবর দিল পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে! মীরার বুক ধুক করে উঠলো, জগতের সব নিয়ম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে,, মীরা ক্লান্ত শরীরেই ছোট ধাপে হাটা দিতে লাগল !তার মা তাকে চিনবে কি ? মা ছাড়া তার জীবনে কেউ নেই !সে তাকে ভুলে গেলে কি করবে কি নিয়ে বাঁচবে! মীরা কাঁপা কাঁপা পায়ে তার মার কেবিনে ঢুকলো! মীরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে! সে বুঝতে পারছে না কিছু ! তার মা তাকে চিনতে পারছে না কি পারছে না ?মীরার মা মীরার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,"কাদিসনা মীরা মা !আমি ভালো আছি !!!!!"
-তাবাসসুম স্বরনী