Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Inspirational

প্রাগৈতিহাসিক

প্রাগৈতিহাসিক

12 mins
866



ঊর্ধ্বমুখে ক্ষণেক দৃষ্টিপাত করে বৃহৎ এক শিকারী দল দ্রুত ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়লো বনানীর বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষতলে। গুরুগুরু আওয়াজ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবার দ্রিমদ্রিম আওয়াজে বর্ষণ আরম্ভ। আর তারই সাথে কক্কড়-কড়-কড়াৎ কক্কড়-কড়-কড়াৎ বিকট শব্দে অত্যুজ্জ্বল আলোকের বক্রাকার রেখা উর্দ্ধে বিস্তৃত গগনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত জ্বলে উঠছে ঘনঘন। দলের রমণীগুলি আতঙ্কিত শিশুগুলিকে কঠিন বাহুবন্ধনে বক্ষে চেপে ধরে নিজ নিজ পৃষ্ঠদেশ বৃক্ষ কান্ডের সাথে চেপে ধরেও ধারাবর্ষণে সম্পূর্ণ সিক্ত। প্রবল বাতাসের সাথে শীতল জলকুচি প্রস্তর ফলাকারে সর্বাঙ্গে বিদ্ধ হচ্ছে। শিশুগুলি কম্পমান আকস্মিক শীতলতায়। রম‍ণীগুলি শিশুদের নিয়ে চিন্তিত। দলপতিসমেত দলের অন্যান্য পুরুষেরা চিন্তামগ্ন আহার্য সংগ্রহ করতে না পারার কারণে। আকস্মিক দিবা দ্বিপ্রহরেই বনানী গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হওয়া, অবিরল ধারাবর্ষণ আর নভোনীল চিরে তীব্র আলোক কক্কড়-কড়-কড়াৎ শব্দ সহযোগে, সেদিনের শিকার সম্পূর্ণরূপে বিঘ্নিত বিপর্যস্ত। এই প্রবল ধারাবর্ষণের সময়ে ছোট বড় সব পশুই নিরাপদ আশ্রয় সন্ধান করে অপেক্ষা করে দুর্যোগ স্তিমিত হওয়ার।


বিস্তীর্ণ সময় অতিবাহিত, বনানী জোড়া ঘন অন্ধকার ধীরে অন্তর্হিত হচ্ছে। উজ্জ্বল আলোক বৃক্ষময় পত্ররাজিত জমা বিন্দু বিন্দু জলে প্রতিসারিত বিচ্ছূরণ ঘটাচ্ছে। চতুর্দিক পুনরায় আলোকিত। আনন্দিত হুহু চিৎকারে বনানী বিদীর্ণ করে অপেক্ষমান শিকারী দলগুলি সম্মিলিত হয়ে প্রবৃত্ত হোলো শিকারের সন্ধানে। আহার্য চাই, প্রতি দলের প্রতি সদস্য ক্ষুধার্ত। কিছু পুরুষ, কয়েক রমণীও বৃক্ষে আরোহণ করে পাকা ফল সংগ্রহ করতে লাগলো। অনেকে সিক্ত মৃত্তিকা খনন করে সংগ্রহ করতে লাগলো সুস্বাদু মিষ্ট কন্দমূল। তবে বহু সময় বৃথা অতিবাহিত ধারাবর্ষণে, এতে দলের সকলেই ক্ষুব্ধ শিকারের ব্যাঘাত ঘটায়, কারণ নির্বিশেষে প্রতি শিকারী দলেরই আহার্য রূপে সর্বাধিক প্রিয় অগ্নিপক্ক পশুমাংস। সুতরাং কালবিলম্ব না করে তারা অত্যন্ত সতর্কতা ও তৎপরতার সঙ্গে পশুর সন্ধানে নিয়োজিত হোলো।



***********



অকস্মাৎ বিকট চিৎকারে আহত পশুটি দিকভ্রান্ত, দিশাহারা, পলায়নের নিষ্ফল চেষ্টাও সে করলো শেষবারের মতো । চতুর্দিকের পথই বন্ধ শিকারীদের বেষ্টনীতে, অসহায় পশুটি ভূলুণ্ঠিত। পরবর্তী পর্যায়ে আহত, রক্তাক্ত, অন্তিম শ্বাস নেওয়া পশুটির দখলদারি নিয়ে যুযুধান বিবদমান দুই দল। অত্যন্ত কঠিন শুষ্ক বিশেষ ধরণের গাছের ডালের মাথাটি সামান্য চেরা এবং ঐ চেরার ফাঁকেই আটকানো তিনকোণাকৃতি চ্যাপ্টাকৃতি ত্রিকোণাকার ছুঁচলো-ধারালো পাথরের টুকরো। তৈরী হয়েছে নতুন ধরণের এক অস্ত্র। অপেক্ষাকৃত ছোট দলটির অস্ত্র ভান্ডারে শিকারে ও আত্মরক্ষায় ব্যবহৃত বিশেষ ধরণের এই অস্ত্রটি এক নবতম সংযোজন। ছোট দলের এই অস্ত্রেই শিকার করা পশুটি আহত হয়ে বড় দলটির শিকারের সীমানায় এসে ভূপতিত হয়। উৎপন্ন হয় যুদ্ধের অবকাশ। অর্থাৎ যুদ্ধের উৎস ধরাশায়ী এই মৃতপ্রায় পশুটিই। আহত পশুটি একটি পূর্ণবয়স্ক মৃগ। উভয় দলের অত্যুগ্র আগ্রহের কারণ মৃগটিই।



দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত, যুদ্ধ বিরতির কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে যুদ্ধের তীব্রতা ও ভয়াবহতা। ক্রমাগত বিভিন্ন আকৃতির বড়ো, মাঝারি, ছোট, তীক্ষ্ম পাথর, মৃত পশুর হাড়ের নানা খণ্ড ও মোটা মোটা গাছের ডাল ছুঁড়ছে বড় দলটির পুরুষরা। মেয়েগুলি শিশুদের নিয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে গাছের গুঁড়ির আড়ালে। প্রত্যেকের লজ্জাস্থানগুলি কেবল আবৃত পশুচর্ম, বৃক্ষবল্কল ও অর্ধশুষ্ক লতাপাতায়। মেয়েগুলির কাঁধে লতারজ্জু দিয়ে বাঁধা মৃত পশুদের চামড়ার মধ্যে সারা দিনের আহরিত ফলমূল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় তারা ঘটনাপ্রবাহে, ছোট শিশুগুলিও ভয়ার্ত, ক্রন্দন ভুলেছে তারা। ছোট দলটির হাতে অভিনব অস্ত্র, তথাপি তারা পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ তুলনায় সংখ্যায় ওরা নিজেরা অনেক কম। উপরন্তু পাথরের আঘাতে দলের সঙ্গীদের মধ্যে প্রায় সব পুরুষই গুরুতর আহত।



যদিও বড় দলের কিছুসংখ্যক পুরুষও তাদের আঘাতে আহত তবুও সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে দলপতি মৃতপ্রায় পশুটির মালিকানা ছেড়ে দিয়ে এবার পলায়নের পথ আশ্রয় করলো। দলপতির নিজের আঘাতও অত্যন্ত অধিক, গুরুতর। হাত থেকে পড়ে যাওয়া অস্ত্রটি কুড়োতে গিয়ে ছোট দলটির এক বলিষ্ঠ কৃষ্ণকায় তরুণ দেখতে পেলো বড় দলের অগ্রণী সারি থেকে নিক্ষিপ্ত একটি ধূসর রঙের বিশালাকৃতির পাথরের খণ্ড প্রবল বেগে ধেয়ে আসছে তাদের দলপতির মস্তক লক্ষ্য করে। দলপতি দেখতে পায় নি, তাই দ্রুত সরবার চেষ্টাও নেই। সেই আসন্ন বিপদের মূহুর্তে চূড়ান্ত ক্ষিপ্রতায় বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে সেই তরুণ হাতের অস্ত্রটি বিপরীত দলের দলপতিকে লক্ষ্য করে সজোরে ছুঁড়ে মারলো। কিন্তু হায় হায়, লক্ষ্যের গায়ে সে অস্ত্র স্পর্শও করে নি, অর্থাৎ সে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে সম্পূর্ণ রূপে।



অপরদিক থেকে বড়দলের ছোঁড়া বৃহদায়তন সে পাথরের নির্মম আঘাতে তাদের ছোট দলের দলপতির মস্তক তৎক্ষণাৎ থেঁতলে গেলো। সশব্দে দলপতির দেহটি ভূলুণ্ঠিত হোলো। বড়দলের পুরুষগুলি উজ্জ্বল মুখে দুই হাত তুলে অঙ্গভঙ্গি সহকারে বীভৎস জান্তব চিৎকারে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে আপাত বিরাজমান নৈঃশব্দ্য ভেঙে দিলো। উল্লাসে হাত-পা ছুঁড়ে তান্ডব নৃত্য আর চিৎকার করতেই থাকলো। ছোট দলটির সেই তরুণ পিছনে দৃষ্টি ফেলে দেখলো শিশুদের আঁকড়ে ধরে তার দলের রমণীরা ভীত-সন্ত্রস্ত-কম্পমান। দলপতি মৃত, অন্যান্য পুরুষেরা গুরুতর আহত অথবা মৃত। তাদের দলটিকে বিপরীতের দলটি অধিকার করেছে। প্রবল চিৎকার সহযোগে মৃত পশুটির দখলদারিও সম্পন্ন। কৃষ্ণকায় তরুণটি দুই হাত মাথার উপরে তুলে বিপক্ষ দলপতির বশ্যতা স্বীকার করে নেবে, এমনসময় বড় দলটির রমণীরা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি সহকারে উচ্চৈস্বরে রীতিমতো কোলাহল শুরু করলো।

কৃষ্ণকায় তরুণটি দেখলো তারই ছোঁড়া অস্ত্রটি বিপক্ষের এক কৃশাঙ্গী তরুণীর একটি বাহু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। সেই কৃশাঙ্গী তরুণী জ্ঞান হারিয়েছে। এই ঘটনায় দলপতি ক্ষোভে ফেটে পড়লো চতুর্গুণ চিৎকারে। অবিলম্বে দলপতি কৃষ্ণকায়কে আঘাত করতে উদ্যত হলে হাতের ইশারায় কৃষ্ণকায় নিজের দলের এক রমণীকে দেখালো। কুঞ্চিতকেশী সে রমণী। তার কটিদেশে বাঁধা তৃণগুল্মের গেঁজে থেকে একটি পাতা বার করে দু'হাতের তালুতে ঘষে পাতাটি কৃশাঙ্গীর নাকের সামনে ধরে থাকলো। কয়েক মূহুর্ত পরেই কৃশাঙ্গী ধীরে ধীরে ক্লান্ত চোখদুটি মেললো। আবার কোলাহল, এবার উল্লাসে। রক্তপাতে অবসন্ন কৃশাঙ্গী। কুঞ্চিতকেশী এবার অস্ত্রটি একটানে কৃশাঙ্গীর বাহু থেকে বার করলো, সাথে সাথেই ফিনকি দিয়ে রক্তপাত। কুঞ্চিতকেশী অতি দ্রুত তার গেঁজে থেকে অন্য এক পাতা নিয়ে দু'টি শ্বেতবর্ণের খণ্ডাংশ পাথরের চাপে পিষ্ট করে রস বার করে সেই রস কৃশাঙ্গীর ক্ষতস্থানে যত্ন করে প্রলেপ দিয়ে দিলো। ধীরে ধীরে রক্তধারার গতি কমতে থাকলো।



কৃশাঙ্গীর মুখে মৃদু হাসি। তবে শরীর ক্লান্ত-অবসন্ন, অতিরিক্ত রক্তপাতে দুর্বল, এবং উত্থানশক্তিরহিত। দিনমান শেষ প্রায়, বনানী গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন হবার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে হবে। দুই দলের যুদ্ধ ও কৃশাঙ্গীর শুশ্রূষায় দীর্ঘ সময় অতিবাহিত। বিজয়ী দলের দলপতি রক্তচক্ষু এক পাথরের টুকরোর ধারালো কোণ দিয়ে বিজিত দলের রমণীগুলির কপালে একটি রক্তচিহ্ন মুদ্রিত করে দিলো চিহ্নিতকরণের সুবিধার্থে। দুই দল এবার সংযুক্ত। দুই দলেরই মৃতদের দেহগুলি এক স্থানে জড়ো করে শুষ্ক ডালপালা পাতা, ছোট ছোট প্রস্তরখণ্ড দিয়ে আচ্ছাদিত করা হোলো। তারপর ধারাবর্ষণে সিক্ত ভূমিপ্রান্তে খনন করা মাটির চাঙড়ে পূর্ণ আচ্ছাদন করা হোলো। সকলে মস্তক ঝুঁকিয়ে কয়েক দণ্ডের নীরবতা পালন করলো।



**************



কৃষ্ণকায়ের কাঁধে কৃশাঙ্গীকে স্থাপন করা হয়েছে, কারণ সুঠামদেহী তরুণ কৃষ্ণকায় ভারবহনে সক্ষম। দলপতি রক্তচক্ষুকে অনুসরণ করলো সমগ্র দলটি। সর্বাগ্রে রক্তচক্ষু, তার পিছনেই কৃশাঙ্গীকে কাঁধে নিয়ে কৃষ্ণকায়। তাদের পিছনে শিশুসমেত রমণীগুলি। তাদেরও পিছনে একেবারে পশ্চাতে দলের অন্যান্য পুরুষেরা গাছের মোটা মোটা ডাল, বিভিন্ন আকৃতির পাথর আর শিকার করা মৃগটি, কিছু ফল ও কন্দ এবং গুরুতর আহত সঙ্গীদের বহন করে নিয়ে চললো। অদূরেই একটি পর্বত, বৃহৎ এক গুহাদেশও দৃশ্যমান। আবার সেই সমবেত উল্লাস ধ্বনি। এটিই তাদের সে আঁধার রাতের নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল হতে পারে।



দলপতি রক্তচক্ষু, কুঞ্চিতকেশী, শ্বেতকেশ এবং স্থূলবাহুকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম গুহামধ্যে প্রবেশ করে দুই ওষ্ঠ দ্বারা নিরাপত্তা সূচক এক উচ্চ আওয়াজ উৎপন্ন করলো। প্রথমে কৃষ্ণকায় ও তাকে অনুসরণ করে সম্পূর্ণ দলটিই গুহায় প্রবেশ করলো। পর্বতের সানুদেশের বনানী ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন, ততোধিক নিকষ কালো পুঞ্জীভূত অন্ধকারে নিমজ্জিত গুহাভ্যন্তর। শ্বেতকেশ, বৃহৎদন্ত, স্থূলবাহু, ক্ষুদ্রাক্ষি, উন্নতনাসা, স্ফীতোদরা সকলে মিলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুই প্রস্তরখণ্ডের ঘর্ষণে গুহামুখে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করলো। কৃষ্ণকায়ের কাঁধে আহত কৃশাঙ্গী আচ্ছন্ন তখনও। এরপর কুঞ্চিতকেশী আর স্থূলবাহুর সহযোগীতায় কৃষ্ণকায় কৃশাঙ্গীকে গুহার দূরতম প্রান্তদেশে একটি লোমশ কোমল পশুচর্মের উপর অত্যন্ত সন্তর্পণে শুইয়ে দিলো। কৃশাঙ্গীর ক্ষততে বিন্দুমাত্র স্পর্শ না হয় গুহাতলের কঠিন প্রস্তর।

দলপতি রক্তচক্ষুকে সাহায্য করছে শ্বেতকেশ, পিঙ্গলদন্ত, স্ফীতোদরা, লোলচর্ম.... মৃত মৃগটির গাত্রচর্ম ছাড়িয়ে সেটি উদ্যত অগ্নিশিখায় ঝলসাতে। ক্ষুদ্রাক্ষি ও কুঞ্চিতকেশী একসাথে গিয়ে সব ফল এবং কন্দমূলগুলিকে বৃহদায়তন দুটি পাতায় রেখে সমপরিমাণে ভাগ করে ফেললো। ইত্যবসরে মৃগটিও সম্পূর্ণরূপে ঝলসানো হয়েছে। ছোট বড় নানা আকারের কিছু পাতা সংগৃহীত ছিল স্থূলবাহুর হাতে। ঝলসানো পশুমাংস, ফল-মূল দিয়ে পুরো দলের ভোজন পর্ব সমাপ্ত হোলো। ফাঁপা বৃক্ষডালে সঞ্চিত ওষধি গাছের রস এবং বংশখণ্ডে সঞ্চিত স্বচ্ছ মিষ্ট জলপান করে সকলে পরিতৃপ্ত। নির্বিশেষ উদ্গারেই তার যথেষ্ট প্রমাণ।



হিমশীতল বাতাসের প্রবল প্রকোপে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের উদ্গত অগ্নিশিখা লেলিহান। সামান্য ধূমও উদগীরণ হচ্ছে অগ্নিকুণ্ড থেকে। ধূমের কটু গন্ধে কীটাদি দূর হয়েছে। শিশু ও রমণীরা গুহার অভ্যন্তরে শায়িত। গুরুতর আহতরাও গুহার অপরপার্শ্বে শায়িত। বাতাসের প্রকোপ সেখানে পৌছতে পারে না, সকলে গভীর নিদ্রামগ্ন। অগ্নিকুণ্ড ঘিরে সবল বলিষ্ঠ পুরুষেরা পর্যায়ক্রমে প্রহরারত। অগ্নিশিখা ম্রিয়মাণ হলেই তাতে কাষ্ঠসংযোগ করে অগ্নিকে তেজস্মান করা হতে থাকলো, আলোক ও উত্তাপের জন্য। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ বন্য পশুদের আক্রমণ থেকে নিজেদের আশ্রয়স্থলকে নিরাপদে রাখার উদ্দেশ্যেও বটে।



একটি একটি করে প্রহর পার হয়ে রাত গভীর থেকে গভীরতর। রাতের কয়েক প্রহর হয়তো পার। কৃষ্ণকায় সারাদিনের পরিশ্রমে ও পথশ্রমে ক্লান্ত। গুহামুখে প্রহরারত কৃষ্ণকায়। কায়ক্লেশে নিদ্রাচ্ছন্ন চক্ষু দু'টি মেলে থাকতে থাকতে কম্পিত অগ্নিশিখার আলোকে কৃষ্ণকায় দেখলো কৃশাঙ্গী পা দু'টি কুঞ্চিত জড়সড় করে গভীর নিদ্রায়। কৃশাঙ্গীর পাংশু ওষ্ঠাধর থিরথির কম্পমান। কৃশাঙ্গীর অবয়বে স্পষ্ট শীতানুভবের অনুভূতি। কৃষ্ণকায় উঠে দাঁড়ালো, অগ্নিতাপে শুষ্ক পশুচর্মটি নিয়ে ধীরস্থির পদক্ষেপে গিয়ে সন্তর্পণে কৃশাঙ্গীর দেহটিকে আবৃত করলো। উষ্ণতার স্পর্শে সে বেদনাক্লান্ত মুখটি ঈষৎ কাত করে গভীর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। তার মুখের একপাশে নিভন্তপ্রায় অগ্নিকুণ্ডের কম্পমান ম্লান আলোকশিখা এক অনির্বচনীয় আলোছায়ার কারিকুরি এঁকে চলেছে। কৃষ্ণকায়ের মুগ্ধ দৃষ্টি কৃশাঙ্গীর নিদ্রামগ্ন মুখাবয়বের আলোছায়ায় নিবদ্ধ। কৃষ্ণকায়ের অন্তরে এক গভীর প্রশান্তি সে মুখাবয়ব দর্শণে। অপর কেউ লক্ষ্য করলে তার গোচরে আসতো কৃষ্ণকায়ের সম্পূর্ণ অবয়বেই

উচ্ছাসের তরঙ্গ। উন্মুক্ত ঊর্দ্ধপানে গাঢ় ধূসর রঙের উপর বিন্দু বিন্দু আকারে আলোক উৎস বহুদূরে। কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকবিন্দু, আবার কোথাও কিঞ্চিৎ বৃহৎ ও অধিকতর উজ্জ্বল একক আলোকবিন্দু। কৃষ্ণকায় নির্নিমেষ সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, সর্বাঙ্গে অনুভূত অজানা এক শিহরণের কম্পন।



***********



এক সজোর ধাক্কায় কৃষ্ণকায় নিদ্রাচ্ছন্ন চোখ মেলে তাকালো। কৃশাঙ্গী তো নয়, তবে এ কে? কৃষ্ণকায় ধাতস্থ হতে কয়েক মূহুর্ত সময় নিলো। ধীরে ধীরে সব এলো তার স্মৃতিপথে। কৃষ্ণকায়ের পূর্ব রাতের স্মৃতিতে খুব প্রবল ভাবে কৃশাঙ্গীই কেবল। চিন্তার রেশটা কেটে গেলো, দলের ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের সমবেত উল্লসিত চিৎকারে। কৃষ্ণকায় মাথা ঘুরিয়ে উল্লাসের কারণ অনুধাবন করতে চেষ্টা করলো। দেখলো দূর পাহাড়ের ফাঁকে উঁকি দিয়েছে আলোর রেখা। বিদায় হয়েছে অন্ধকার, শেষ হয়েছে ভয়-আতঙ্ক-দুশ্চিন্তা-অনিশ্চয়তা। আবার একটি নতুন দিনের প্রস্তুতি।



কৃষ্ণকায়ও উঠে এসে দলের উল্লসিত চিৎকারে যোগদান করলো হাত-পা নেড়ে বিচিত্র অঙ্গ ভঙ্গি সহকারে। কৃশাঙ্গী তখনও অতিশয় দুর্বল, গুহামুখের ধারের উচ্চ পাথরে হেলান দিয়ে বসে। কুঞ্চিতকেশী তার ক্ষতে চূর্ণপাতার প্রলেপ লাগাচ্ছে অতি যত্নে, পরম মমতায়। কৃশাঙ্গীর দৃষ্টি নিবদ্ধ অনতিদূরে কৃষ্ণকায়ের দরাজ বক্ষে, পেশীবহুল বাহুতে, ঝাঁকড়া কালো কেশরাশিতে, ঘন শ্মশ্রু-গুম্ফের আড়ালে হাসির আভাসদীপ্ত উজ্জ্বল দু'টি চোখে, ব্যাঘ্রের মতো দৃপ্ত ভঙ্গিমায়। কুঞ্চিতকেশী কৃশাঙ্গীর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখতে পেল কৃষ্ণকায়ের দৃষ্টিতেও উজ্জ্বল মুগ্ধতা। অনুভব করতে পারলো একাধিক কিছু সামান্য একটি লহমায় মাত্র। কৃষ্ণকায়কে স্বহস্তে নাড়ীছিন্ন করে জন্ম দেওয়ার মূহুর্তটা মনে পড়লো কুঞ্চিতকেশীর। আর মনে পড়লো পূর্বদিনের দৃশ্য, প্রাক্তন দলপতির রক্তাক্ত নিস্পন্দ মৃত মুখটা।

আগের দিনের অবশিষ্ট কিছু ফল মূল খেয়ে পুরুষেরা শিকারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। কৃশাঙ্গী এখনও অশক্ত থাকায় রমণীরা গুহার আশপাশ থেকেই ফল-মূল-ছোটখাটো শিকার-জল-ওষধি বৃক্ষরস-শুষ্ক ডালপালা ও পাতা ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহ করবে। আহত-অসুস্থদের ও শিশুদের পরিচর্যা করবে। সেই মূহুর্তে পরাজিত দলের থেকে সংগৃহীত অস্ত্রটির ব্যবহার বিধি শিখতে দলের প্রত্যেকেই উদগ্রীব, অদম্য কৌতূহলবশত চক্রাকারে ঘিরে রয়েছে সকলে একত্রে কৃষ্ণকায়কে।



কুঞ্চিতকেশী ও ক্ষুদ্রাক্ষি দু'জনে মিলে কৃশাঙ্গীর সর্বাঙ্গের ধূসর ধূলা ও শুষ্ক রক্ত পরিষ্কার করে দিচ্ছে পশুচর্মের লোমশ দিকটা জলসিক্ত করে। শ্মশ্রু-গুম্ফের ফাঁকে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে কৃষ্ণকায় পিছনে তাকালো একঝলক। তারপর দলের সদস্যদের সাথে শিকারে চললো, তার নতুন দলের দলপতিকে অনুসরণ করে। ঝকঝকে উজ্জ্বল আলোয় গাঢ় সবুজ বনানী আলোয় উদ্ভাসিত। দূর নীলিমায় পক্ষীকূল উড্ডীয়মান খাদ্যের সন্ধানে। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো প্রাণীর চলাফেরার সড়সড়ানি। দূরে ও নিকটে বৃক্ষে পক্ষীর কলকাকলি। বৃক্ষের শাখাপ্রশাখায় শাখামৃগদের দাপাদাপি। তৃণভক্ষণে নিয়োজিত বাইসনের দল, বা গণ্ডার পরিবারের নির্লিপ্ততা। হঠাৎই কোনো বৃহৎ প্রাণীর পাশবিক হুংকারে বনানী প্রাত্যহিকীর ব্যস্ততায়। সম্মুখেই এক বরাহ, দু'প্রান্ত থেকে দু'জন, কৃষ্ণকায় ও স্থূলবাহু অস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, বরাহটি রক্তাক্ত, ভূলুন্ঠিত। কিন্তু আশ্চর্য! কৃষ্ণকায় লক্ষ্যভ্রষ্ট! স্থূলবাহুর অস্ত্র লক্ষ্যভেদ করেছে। কৃষ্ণকায় কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক বোধহয়।



কৃষ্ণকায়ের দৃষ্টিপথে চকিতে উদিত হোলো মৃগের অক্ষির মতো দীপ্ত একজোড়া ক্লান্ত কৃষ্ণচক্ষু, বনানী প্রান্তদেশে বহমান স্রোতস্বিনী কাকচক্ষু স্বচ্ছ জলে নিমজ্জিত গোলাকার উজ্জ্বল উপলখণ্ডের মতো শুভ্র দন্তরাজি, অপ্রশস্ত ললাটে অবিন্যস্ত ঈষৎ পিঙ্গল কেশগুচ্ছ, স্ফীত রক্তবর্ণ ওষ্ঠাধর, লঘু গুরুর মধ্যবর্তী নিতম্ব আর...... ঈষৎ স্মিতহাস্যে কৃষ্ণকায় চক্ষু নিমীলিত করলো।



**************



প্রথমবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার পর কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত কৃষ্ণকায়। পরবর্তী শিকারগুলি লক্ষ্যবিদ্ধ সবই প্রায় কৃষ্ণকায়ের একক পারদর্শিতায়। একটি বরাহ, দু'টি মৃগ, গোটা কয়েক শশক ও একটি বৃহদায়তন সর্প শিকার করে উল্লাসে চিৎকারে বনানী কম্পমান করে গুহা অভিমুখে যাত্রা করলো সমগ্র দলটি। আলোক প্রস্থানের আর অধিক বিলম্ব নেই। দলপতি রক্তচক্ষু কৃষ্ণকায়কে আলিঙ্গন করে অস্ত্রের ব্যবহারের প্রশংসা ব্যক্ত করলো, ওষ্ঠ ও জিহ্বার ব্যবহারে অদ্ভুত তীক্ষ্ম শব্দ সহযোগে। এদৃশ্যে স্থূলবাহুর কুঞ্চিত চক্ষে ঈর্ষার স্ফুরণ হোলো মূহুর্তমাত্রের জন্য। সমগ্র দল গুহার সম্মুখে পৌঁছতে না পৌঁছতেই আলোক সম্পূর্ণ অন্তর্হিত, সমগ্র বনানী অন্ধকারে আচ্ছন্ন।

দলে শিশুর সংখ্যা অনেকগুলি, শিকার দেখে শিশুরা আনন্দে উল্লাসমুখর। তারা মৃত পশুগুলির পদ, কর্ণ ও পুচ্ছ আকর্ষণ করে ভারী আমোদিত, আহ্লাদিত তারা। কৃষ্ণকায়ের দৃষ্টি গুহামুখে উপবিষ্ট কৃশাঙ্গীর দিকে পড়তেই চকিতে কৃশাঙ্গী দৃষ্টিপথ অন্যত্র সরিয়ে নিলো। কৃষ্ণকায়ও রক্তচক্ষু, স্থূলবাহু, শ্বেতকেশ, বৃহৎদন্তদের সাথে পশুচর্ম ছাড়ানোয় অধিক মনোনিবেশ করলো।

চর্ম নিষ্কাশনের পর অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান অগ্নিশিখায় পশুগুলি ঝলসানো সমাধা হোলো।



তারপর ঝলসানো মাংস দলের সকলের জন্য বন্টন করা হোলো। সেদিন অধিক মাংস থাকায় বেশীরভাগ ফলমূল সঞ্চিত রাখা হোলো পরবর্তী দিনের জন্য। কারণ সবদিন বনানীতে খাদ্যের প্রতুলতা সমান হয় না, তাই এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ। ভোজন পর্ব সমাধা হলে ওষধিরস ও জলপানও সমাপ্ত। হঠাৎ করেই কৃষ্ণকায়ের দৃষ্টি পতিত হোলো গুহামুখে, স্থূলবাহু একটি বৃহৎ পাতায় নিজের অংশের কিছু খাদ্যবস্তু কৃশাঙ্গীর সম্মুখে ধরে অপর হাত নেড়ে নেড়ে ইশারায় কিছু ব্যক্ত করছে অত্যন্ত গম্ভীর মুখভঙ্গিমায়।



একাকীই ঈষৎ হেসে কৃষ্ণকায় প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে দৃষ্টি স্থাপন করলো। কৃশাঙ্গীর বিপরীতে গুহার বাঁক খাওয়া অংশের গুহাগাত্রে হেলান দিয়ে বসলো কৃষ্ণকায়। অগ্নিকুণ্ডের উপরের উত্তপ্ত কিঞ্চিৎ ধূমায়িত পাক খাওয়া বাতাসে কী অপরূপ অনিন্দ্যসুন্দর কৃশাঙ্গীর অবয়বখানি! ক্ষণিকের জন্য স্থায়ী হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে, আবার কৃশাঙ্গীর অবয়ব অন্য বিভঙ্গে, আবার অন্য রূপে, বারবার বারংবার..... ক্রম পর্যায়ে। কৃষ্ণকায়ের বিহ্বল দৃষ্টি ও অনুভূতি স্খলিত প্রায়। কৃষ্ণকায় নিজেকে প্রাণপণ সম্বরণ করে শুষ্ক এক কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে অগ্নিকুণ্ডে সংযোগ করলো, তারপর আর একটি। নির্বাপিত যাতে কোনোরূপেই না হতে পারে প্রজ্জ্বলিত কিঞ্চিৎ ধূমায়িত অগ্নিকুণ্ড। কৃষ্ণকায় অগ্নিকুণ্ডের একপাশ থেকে শীতল একখণ্ড চারকোল অর্থাৎ পোড়া কাঠ কয়লা তুলে নিলো। কটিদেশের পশুচর্মে গেঁথে রাখা শজারুর কাঁটা এবং কৃষ্ণবর্ণের ব্যাঘ্রনখাকৃতি এক ক্ষুদ্রাকার প্রস্তরখণ্ড দিয়ে কৃষ্ণকায় গুহাগাত্রে রেখাঙ্কিত করে চলেছে দ্রুত হস্তে, বিভিন্ন অবয়ব। একের পর এক। উন্মেষিত চিত্রে কৃষ্ণকায়ের

পারিপার্শ্বিকতার দৈনন্দিন পরিমণ্ডল।



***************

***************



কাহিনীটা সর্বক্ষণ চিত্রায়িত হয়ে চলেছে সুতনুকার মাথায়। একটা শিরীষ জাতীয় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে সুতনুকা পুরো স্টোরি লাইনে এবং স্ক্রিপ্টটায় আর একবার আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে নিলো। এধার ওধার তাকাতে তাকাতে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে সুতনুকা। শর্ট ফিল্মে রীতিমতো হাত পাকালেও এটা সুতনুকার প্রথম ফিচার ফিল্ম এবং কোনো সংলাপ ছাড়া। ওর ঈশ্বর সত্যজিৎ রায়ের কথাটা সুতনুকা মাথায় গেঁথে নিয়েছে একেবারে, "সংলাপ দিয়ে নয়। সংলাপ হোলো কমিউনিকেশন্স-এর সবচেয়ে দুর্বলতম হাতিয়ার।" সুতরাং ডিটেলিং-এর ওপর ভীষণ রকম কনসেন্ট্রেট করতে হবে। ভীষণ ভালো প্রোডাকশন হাউস পেয়েছে, আবহের জন্য বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টর নিজেই অত্যন্ত আগ্রহী, গ্রাফিক্স টিমের তো কোনো তুলনাই হয় না। আর ন্যারেশনের ভয়েস ওভারের জন্য খ্যাতনামা কন্ঠশিল্পী উপযাচক প্রায়। সাধু ভাষার আধিক্য ঐ ব্যারিটোন ভয়েসে যাথার্থ্য পাবে। সত্যি বলতে কি ফিচার ফিল্ম মেকিং-এর জন্য এইরকম একটি বিষয় বাছার অন্যতম কারণ হোলো সিনেমার ভাষায় ক্যামেরা দিয়ে কতটা গল্প বলা যায়.... এটাই সুতনুকা দেখতে চায় অথবা দেখাতে চায়।



সুতনুকা মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করে দু'হাতে মুখ চাপা দিলো। সুতনুকার ঐ উদ্ভট চিৎকার শুনে রুদ্রাণী আর বিক্রম দৌড়ে এলো। তারপর হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সুতনুকার দৃষ্টি অনুসরণ করে।

কী অসাধারণ গুহাচিত্র! ঠিক যেমনটি সুতনুকা চাইছিলো। আদিম মানব সভ্যতার জন্মলগ্নের শিল্প সৃষ্টি! সূচনা হচ্ছে সমাজের, যূথবদ্ধ গোষ্ঠীর ও হয়তো সম্পর্কেরও। ভারতবর্ষের বুকে আবিষ্কৃত হয়েছে মানবসভ্যতার প্রথম নিদর্শনের স্থান, ভীমবেটকায়। ভীমবেটকার গুহায় সার সার প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র। শিকারের দৃশ্য, উৎসবের দৃশ্য, নাচের দৃশ্য, কিছু দুর্বোধ্য চিহ্ন, প্রাণীদের সাথে সহাবস্থানের দৃশ্য। এমনকি মৃতদেহ সমাহিত করার দৃশ্য পর্যন্ত। আর তাতে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার, হাজার হাজার বছর.... প্রায় তিরিশ হাজার বছরেরও বেশী সময় পরেও আজও এমন অমলিন। সমাজবদ্ধ জীব হয়ে ওঠার চিত্রায়িত নিদর্শন, সামাজিক গঠন কাঠামোর প্রাচীনতম রেখাচিত্র, এক প্রাগৈতিহাসিক দলিল।



সমাজ তৈরী হবার প্রাথমিক প্রাগৈতিহাসিক দলিলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে শুধু ওদের হতবাক হবার পালা।



সুতনুকা বয়স তিরিশ বছর পূর্ণ করার আগেই ফিল্ম ডিরেক্টর হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিলাভ করেছে। সঙ্গে আছে আর্ট ডিরেক্টর রুদ্রাণী, আর আছে ক্যামেরাম্যান বিক্রম। আর পাঁচটা কাজের ফাঁকে সময় বার করে ওদের নিয়ে কয়েকমাস ধরে দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত রেইকি করে বেড়াচ্ছে সুতনুকা। স্ক্রিপ্ট মাফিক লোকেশনের খোঁজে। এবং অবশেষে লোকেশন ফাইনাল। মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকা।



এবার শুধু সরকারি পারমিশন আর ফর্মালিটিজের অপেক্ষা। এখানে বসে রুদ্রাণী ইন্ডোর সেট তৈরীর জন্য যাবতীয় স্কেচ করে নেবে এবং দরকারে ছবিও তুলে নেবে। নিশ্চিন্ত সুতনুকা, মোটামুটি সব কাজই গুছিয়ে এনেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও ইউনিটের ক্রু মেম্বারদের কাছ থেকে জেনেছে কাস্টিং এবং লুক টেস্টও এগোচ্ছে মসৃণ গতিতে। একটু খুঁতখুঁতুনি রয়েছে মনে, আহা, সুতনুকা কেন হলিউডে কাজ করার সুযোগ পেলো না। সব মিলিয়ে প্রোডাকশন আরও ভালো হোতো। কস্টিউমে আরেকটু সাহসী হওয়া যেতো। ওর ইউনিটের কস্টিউম ডিজাইনার মনস্বী দিবারাত্রি খাটছে, সেন্সর বোর্ডের কাঁচির কথা মাথায় রেখে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে বেচারা। শুধু ফিল্মের টাইটেলটা কিছুতেই মনোমত হচ্ছে না সুতনুকার।



প্রাগৈতিহাসিক এই গুহাচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অজান্তেই সুতনুকার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, "ইউরেকা! 'সামাজিক সভ্যতার শিকড়'..... টাইটেল হলে কেমন হয় রে?"


(তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট গুগল সার্চ)

-------------------------------------

(বিষয়: কল্পনা এবং বাস্তব)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational