Sanghamitra Roychowdhury

Drama Classics Inspirational

3.5  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Classics Inspirational

মা ও মানবিকতার মুখ

মা ও মানবিকতার মুখ

8 mins
1.2K


রাজসী এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। নতুন ক্লাসে ওঠার পরেই মেয়ের পুলকার বন্ধ করেছে নীতা, আসলে বন্ধ করতে একরকম বাধ্যই হয়েছে বলা চলে। এখন রাজসী রোজ পাবলিক বাসে করেই একা একা স্কুলে যাতায়াত করছে। রাজসীর মা নীতা একটু ভয়ে ভয়েই থাকে। দিনকাল তো খুব একটা ভালো নয়! কিন্তু কীইবা করতে পারতো নীতা? ক্রমবর্ধমান সংসার খরচ আর স্বামী অনিমেষের চিকিৎসার খরচ, এই দুইয়ে মিলে জেরবার নীতা।

তাছাড়া স্কুলের শেষ দুটো বছরে মেয়ে রাজসীর টিউশনের খরচও বেশ কিছুটা বেড়েছে। নীতা প্রথম রাজসীর সাথেই কথা বলেছে, রাজসী মা'কে আশ্বস্ত করেছে। মা'কে জড়িয়ে ধরে বলেছে, "তুমি একদম চিন্তা কোরো না মা, আমি ঠিক পারবো, বাসে অথবা অটোরিকশায় যাতায়াত করতে। এই তো পাঁচটা মোটে স্টপেজ! ঠিইইক পারবো আমি, তুমি মিলিয়ে দেখে নিও!" মেয়ের উপর ভারী ভরসা নীতার। আর হবে নাই বা কেন? এই বয়সে কতো বুঝদার মেয়ে রাজসী, মেয়ের লেখাপড়াতেও খুব মন মাথা, দুইই।

প্রায় সাত আট মাস পার হয়ে গেছে, রাজসী একা একাই স্কুলে যাচ্ছে। নীতা সকাল থেকে দম ফেলার ফুরসতটুকুও পায় না। সংসারের যাবতীয় কাজ একাহাতেই সামলায়। তার ওপর ঐ ছোট্ট এক চিলতে বুটিকের কাজ। অসুস্থ স্বামী আর বৃদ্ধা শাশুড়ি দু'জনেই কেমন একটা অপরাধী অপরাধী মুখে নীতার দিকে তাকিয়ে থাকে। নীতার নিজেরই খারাপ লাগে। এই সমস্যাসঙ্কুল জীবন ওদের তো কেউ ইচ্ছে করে ডেকে আনেনি। নাহলে ওদের নিজেদের ঐ অতোবড়ো রেডিমেড গার্মেন্টস-এর ব্যবসা ওভাবে লাটে উঠবেই বা কেন?

এক মধ্যরাতে ওদের ঘুম ভেঙেছিলো নাইট গার্ডের চিৎকারে। দোকানে আগুন, কথাটা শুনেই ওরা ছুটেছিলো বাড়ী থেকে শ'দুয়েক মিটারের দূরত্বে সুপার মার্কেটে নিজেদের দোকানের সামনে। নাইট গার্ড দোকানের সামনের দিক থেকে পেছনে গিয়েছিলো ছুটে, পেছন থেকে ততক্ষণে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ছাপিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে উর্দ্ধমুখী। পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে হাত চালিয়ে কাজ সারছে নীতা। ‌

আবার একটা পুজো এসে গেলো বলে, সেবারও তো পুজোর ঠিক মুখেই ঘটলো ঐ দুর্ঘটনা। পুজোর নতুন রাশিকৃত স্টকে ঠাসা দোকান। তার মধ্যেই এ বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ড, চোখের সামনে অত সাধের, অত বড়ো চালু দোকান পুড়ে ছাই। একতলা-দোতলায় ছড়ানো আধুনিক ফ্যাশনদুরস্ত দোকান, কলকাতার লাগোয়া শহরতলিতে। একদিনে পথের ভিখারি করে দিলো ঐ আগুন। অনিমেষ সামলাতে পারলো না। সেরিব্রাল অ্যাটাকে পঙ্গু, পুরো অসাড় শরীরটা। নিয়মিত চিকিৎসা, ওষুধ, ফিজিওথেরাপিতে বিপুল খরচ। কিচ্ছু বাঁচেনি দোকানের, কিছু থাকলে নাহয় তবু সেসব বিক্রি বাটা করা যেতো। উল্টে পাশাপাশি অনেকগুলো দোকান একসাথে পুড়েছে, কেউ রটিয়ে দিলো নিজেরাই নাকি নিজেদের দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। ব্যাস্, অমনি ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র সব আটকে গেলো, মামলা মোকদ্দমা করে কেইবা তদ্বির তদারকি করবে? সব ওভাবেই আটকে পড়ে আছে। একটা পয়সাও আজও মেলেনি ওদের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে।

গাড়িদুটো গেছে, একে একে নীতার সব গয়নাগুলো যাচ্ছে, শাশুড়ি নীতার হাতে ওনার নিজের গয়নার বাক্সও তুলে দিয়েছেন। তবে নীতা এখনো ওতে হাত দেয়নি, রাখা থাক রাজসীর জন্য, তাই ভেবেছে। এই তিন বছরে বুটিকটা একটু দাঁড়িয়ে গেছে। চেনাজানা তো প্রচুর খদ্দের ছিলো, খোঁজ পেয়ে তারাই মূলতঃ আসে। বসতবাড়ীর একতলায় রাস্তার দিকের ফালি ঘরখানাকেই নীতা ঘরোয়া করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে। একতলার পেছন দিকটা ভাড়ায় দিয়েছে, এক প্যাকেজিং কোম্পানিকে। সারাদিন কাজ করে ওরা, রাতে বন্ধ, কোনো ঝুটঝামেলা নেই। এভাবেই কোনোরকমে কুড়িয়ে-কাঁচিয়ে সংসারটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নীতা। ভরসা হারায়নি একবিন্দুও, এমনকি কারুর কাছে হাতও পাতেনি এপর্যন্ত। ঘর গেরস্থালির কাজের লোকজনও ছাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সুখী শরীরে এই ধকল সহ্য হতে একটু সময় লেগেছে বৈকি।

সকালের সব কাজকর্ম সাপটে গুছিয়ে এই সাড়ে দশটা নাগাদ নীতা নীচে এসে বুটিকের দোকানটা খুলে বসে। অল্প যা কিছু বিক্রি হয়! বিকেলের দিকটাতেই লোকজন আসে বেশী। সকালের দিকে সলমা বসে ব্লাউজপিস কেটে অর্ডারি মাপমতো ব্লাউজ তৈরী করে, ডিজাইন মাফিক। অনেকে ফলস্ পিকোও করতে দিয়ে যায়। সেসবও করে মেয়েটা, নীতা নিজেও সলমার কাছ থেকে একটু একটু কাজ শিখছে। আগে তো কখনো এসব করেনি স্কুল ছাড়ার পরে! তবে পারবে নীতা, সেটুকু আত্মবিশ্বাস ওর আছে।

সেদিন সলমা খেতে যাবে, নীতাও ওপরে উঠবে। রাজসীর স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়েছে, ওর খাবার-দাবার গোছগাছ করতে হবে। অনিমেষকে খাওয়ানোটা অবশ্য বসে বসে শাশুড়িই করেন। রাজসী ফিরলে তারপর নীতা মেয়েকে আর শাশুড়িকে নিয়ে একসাথে বসে খায়। টুকরো-টাকরা গল্প-গুজব করে তিনজনে বসে। খুব গুছিয়ে বেশ পরিপাটি করেই চালাচ্ছে নীতা, আগের সে বৈভব নাইবা থাকুক। কাউকে কিচ্ছুটি বুঝতেই দেয় না নীতা। সেদিন এরকম দুপুরের সময়েই হঠাৎ ফোনটা আসে রাজসীর স্কুল থেকে, রাজসীর ক্লাস টিচারের ফোন। কেঁপে উঠেছে নীতা, কোনো বিপদ নাকি?

ক্লাস টিচার বলছেন, "আপনি রাজসীর মা বলছেন তো?"

কাঁপা গলা লুকোতে পারলো না নীতা, ঢোঁক গিলে ক্ষীণ স্বরে বললো, "হ্যাঁ, আমিই রাজসীর মা? কী হয়েছে রাজসীর? বলুন আমাকে।"

ক্লাস টিচার বললেন, "আমি তো আপনার কাছেই জানতে চাইছি, আপনার মেয়ে আজকাল প্রত্যেক সপ্তাহেই দু-এক দিন করে অ্যাবসেন্ট করছে কেন? কোনো অসুবিধা? ওর শরীর ঠিক আছে তো? আপনারা সবাই ঠিক আছেন তো? দেখুন, আপনাদের পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা এই অঞ্চলের সবাই জানি। আবার নতুন করে কোনো সমস্যা কিনা, তাই জানতে চাইছিলাম। রাজসীর মতো সিনসিয়ার ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে, হঠাৎ কী এমন হলো? প্রিন্সিপাল ম্যাডামের সাথে আলোচনা করেই আমি আপনাকে ফোন করেছি। যদি আপনাদের কোনোরকম কোনো অসুবিধা হয় রাজসীর পড়াশোনার বিষয়ে, আপনি নিঃসঙ্কোচে আমাদের জানাবেন। আমরা সবসময় রাজসীর সঙ্গে আছি।" একদমে একটানা কথাগুলো বলে থামলেন ক্লাস টিচার, নীতার কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বেরোচ্ছে, চোখ ঝাপসা, গলা শুকিয়ে কাঠ। ধীরে অস্ফুটে কোনোরকমে বললো, "ঠিক আছে।"

নীতার হিসেব সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বদ কোনো সঙ্গে পড়েছে মেয়ে নির্ঘাত। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে চুপ করে রইলো, রাজসী একদম সঠিক সময়েই স্কুল থেকে ফিরলো, খাওয়া-দাওয়া করলো, গল্প-গুজবও করলো রোজকার মতোই। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো নীতা। কই, কোথাও তো কোনো অস্বাভাবিকতা নীতা দেখতে পাচ্ছে না! বার বার করে রাজসীর ক্লাস টিচারের বলা কথাগুলোই নীতার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অবিরত।

যথারীতি পরেরদিন সকাল সাতটা নাগাদ স্কুলের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে রাজসী। বাড়ীতে বুটিকের কাজ আছে বলে বেরিয়ে, রাজসীর মা নীতাও চুপচাপ মুখ মাথা মুড়িয়ে ঢেকে রাজসীকে অনুসরণ করে নিরাপদ দূরত্ব থেকে। রাজসী বাস স্টপ থেকে বাস ধরে স্কুলের দিকে রওনা হয়ে যায়, অটো ধরে নীতাও, যায় ঐ বাসের সঙ্গে সঙ্গেই। তারপর দেখেছে স্কুলের সামনের স্টপেজে নেমে রাজসী স্কুলে ঢুকে পড়েছে। আবার ছুটির পরেও ঠিক সময়েই বাড়ী ফিরছে। সকালে একবার স্কুলে ঢুকে গেলে তো ছুটি হওয়ার আগে বেরোতেই পারবে না।

তারপর টানা একসপ্তাহ ধরে মেয়েকে অনুসরণ করে নীতা, মেয়েকে বুঝতে না দিয়ে। রোজই তো মেয়ে স্কুলেই যাচ্ছে, তবে? ক্লাস টিচার কেন বললো ফোন করে অমন কথা, ঐতো, গত বৃহস্পতিবারে? কোনো তো সমস্যা এ ক'দিনে চোখে পড়লো না! আবার একটা বৃহস্পতিবার এসে গেলো। নীতা মেয়েকে অনুসরণ করছে। এরকম মুখ মাথা মুড়িয়ে ঢেকে রেখে হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে প্যাচপ্যাচে হয়ে ঘেমে উঠেছে নীতা, এই ভাদ্রের গুমোট ভ্যাপসা গরমে। বাসস্টপে পৌঁছে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে রাজসী সোজা বাঁ-দিকের গলিতে ঢুকে গেলো। কোথায় যাচ্ছে ও? নীতার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছে, আজ সেই বৃহস্পতিবার, আর ক্লাস টিচার তো গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবারেই ফোন করে নীতাকে জানিয়েছিলো রাজসীর ব্যাপারে।

গলিতে ঢুকে রাজসী গলির একপাশের একটা গুমটি দোকান থেকে কয়েকটা বাপুজি কেক আর ছোট ছোট কয়েকটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে নিজের স্কুলব্যাগের চেন খুলে ব্যাগে পুরে আবার সামনের দিকে হাঁটা শুরু করলো। তারপর পাশের আরেকটা আরো সরু গলিতে ঢুকে হাঁটতে থাকে। রাজসীর মাও অজানা আশঙ্কা ও উৎকন্ঠা নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রেখেই মেয়েকে অনুসরণ করতে থাকে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর রাজসী একটা ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। পায়ের আওয়াজ পেয়েই বোধহয় ভিতর থেকে দু'টো ছোট ছোট ছেলে বেরিয়ে আসে, রাজসী তাদের সাথে ভিতরে চলে যায়। জায়গাটা এত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর রাজসীর মায়ের গা ঘিনঘিন করে উঠছে। এখানে রাজসী কী করছে?

তবুও এগিয়ে যায় রাজসীর মা। ঝুপড়ি ঘরের সামনে এসে রাজসীর মা স্তব্ধ, হতবাক। একি তার ছোট্ট রাজসী? ঝুপড়ির নড়বড়ে চৌকিটার ওপর নোংরা একটা বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে শ্যামলী। শ্যামলী, রাজসীর আয়া! রুগ্ন, কৃশ, বিছানায় মিশে আছে যেন! সাতদিন বয়স থেকে রাজসীকে শ্যামলী কোলে পিঠে করে অতি যত্নে মানুষ করেছে, দোকানে আগুন লেগে যেদিন রাজসীরা সর্বস্বান্ত হয়েছে, সেইদিন পর্যন্ত। তারপর নীতা আর রাখতে পারেনি কাউকে, সবাইকেই দু'মাসের করে মাইনে দিয়ে জোড়হাতে চোখে জল নিয়ে বিদায় জানিয়েছে। তাও শ্যামলীর এতো মায়ার টান ছিলো যে, ঠিক রাখী পূর্ণিমার দিনে তিনখানা রাখী হাতে করে, একটু মিষ্টি নিয়ে আসতো। একটা রাখী শ্যামলী নিজে শয্যাশায়ী দাদাবাবুর হাতে বেঁধে দিতো, আর দু'খানা রাখী রাজসীর হাতে দিয়ে নিজের ছেলেদের হাতে বাঁধাতো। এই যমজ ছেলেদের জন্মের সময়ও শ্যামলী মাত্র দেড়মাস ছুটি নিয়েছিলো, তারপর নিজের ছেলেদের মায়ের কাছে রেখে কাজে আসতো, কারণ রাজসীর শ্যামাকে ছাড়া চলতোই না। নাওয়ানো খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো, সব শ্যামার করানো চাই। রাজসী শ্যামলীর নামটা সংক্ষিপ্ত করে শ্যামা করে নিয়েছিলো সবে বুলি ফুটতেই।

নীতা অবাক হয়ে দেখলো, শ্যামলীর পাশে বসে রাজসী ব্যাগ থেকে কেক বিস্কুট সব বার করে রাখলো, তারপর নিজের টিফিনবক্সটা খুলে শ্যামলীর হাতে ধরিয়ে দিলো কাটা ফলের টুকরো। আজ বৃহস্পতিবার, নিরামিষ খাওয়া, টিফিনেও নীতা রাজসীকে শুধু ফল মিষ্টিই দেয়। ভেতরে ওরা কলবল করে কথা বলছে, নীতার চোখ ঝাপসা, ওরা কেউ ভাগ্যিস এখনো নীতাকে খেয়াল করেনি!

নীতা সন্তর্পণে পিছন ফিরে বাড়ীর পথে হাঁটতে শুরু করলো। ভাবতেই পারছে না নীতা, রাজসী এই ছোট্ট বয়সেই এমন সংবেদনশীল কী করে হলো? কখন হলো?

ঠিক সময়ে রাজসী বাড়ী ফিরেছে, একেবারে স্কুল ছুটি হয়ে ফেরার সময়েই। ফ্রেশ হয়ে যথারীতি রাজসী মা ঠাকুমার সাথে বসে খেয়েছে। তারপর একটা গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসেছে। কয়েক লাইন পড়া হয়েছে কি হয়নি, রাজসীর মা নীতা মৌরি চিবোতে চিবোতে পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো। কোনো ভূমিকা না করেই সোজাসুজি বললো, "রাজি, তুমি কাল থেকে সকালে পনেরো-কুড়ি মিনিট আগে বেরিও, আর যাবার পথে শ্যামলীর ঘরে একটু রুটি তরকারি পৌঁছে দিয়ে যেও। আমি দিয়ে দেবো, যখন যেমন পারবো। ওসব কেক-টেক বাসী হয়ে গেলে খাওয়া শরীরের জন্য খারাপ, জানো তো?"

রাজসী হাঁ করে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। নীতা বললো মেয়েকে ক্লাস টিচারের ফোন আসা থেকে আজ পর্যন্ত, ঘটে যাওয়া সব কথা। আসলে শ্যামলী এবার রাখী নিয়ে আসতে পারেনি, খেয়ালই করতে পারেনি নীতা। রাখীর কিছুদিন আগেই রাজসী স্কুলে যাওয়ার পথে দেখে শ্যামলীর ছেলেদের ভিক্ষা করতে। রাজসী দিদিকে দেখে ওরা খুব লজ্জা পেয়েছিলো। রাজসী এগিয়ে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছিলো, আর ওদের সঙ্গে গিয়েই দেখেছিলো শ্যামলী শয্যাশায়ী, শ্যামলীর মাও আর বেঁচে নেই। ছেলেদুটো ওদের স্কুলের মিড ডে মিলের খাবারটা বাড়ীতে এনে তিনজনে ভাগ করে খায়, কিন্তু তাতে তো সারাদিন থাকা যায় না। তাছাড়া স্কুলের ছুটির দিনও থাকে। তাই ভিক্ষা করে ওরা।

রাজসী তো ওদের নিজেদের বাড়ীর অবস্থাও খুব ভালো করেই জানে, তাই এসব বলে আর মা'কে বিব্রত করতে চায়নি। বৃহস্পতিবারে মা ফল দেয়, তাই প্রত্যেক বৃহস্পতিবারেই রাজসী ফল মিষ্টিটা ওর শ্যামাকে খাওয়াতে যায়, শ্যামার এখন একটু ফল খাওয়া খুব দরকার। অন্য কোনোদিনেও মা টিফিনে ফল দিলে রাজসী ওর শ্যামার জন্য দিয়ে আসে গিয়ে। অন্যসময় তো নেই... অগত্যা তাই স্কুল কামাই করেই যায়!

তারপরের দিন নীতা মেয়ের হাতে একটা কৌটোয় রুটি তরকারি দিয়ে বললো, "তুমি লেখাপড়া করে যেদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে, সেদিন দেখবে তুমি এই গরীব মানুষগুলোর জন্য আরও অনেক বড়ো বড়ো পদক্ষেপ নিতে পারছো। সমাজের নীচুতলার পিছিয়ে পড়া মানুষদের দিকে আরো অনেক বেশী করে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারছো। আমি আর আমার আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে সর্বদা বলয়ের মতো ঘিরে থাকবে। আমি তোমার জন্য গর্বিত, রাজি। ঈশ্বর যেন সারাজীবন তোমার এই অমূল্য মানবিকতার মুখকে সুরক্ষিত রাখেন, আর তোমার হাত দিয়ে দেশের দশের মঙ্গল করান।"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama