যখন অন্ধকার
যখন অন্ধকার
অন্ধকার বারান্দায় একটা কালো পাথরের মূর্তির মতো একলা দাঁড়িয়ে আছে অনুরাধা। সমস্ত সন্ধ্যা পার করে, এতোখানি রাত পর্যন্ত একাই দাঁড়িয়ে আছে অনুরাধা। মনটা ওর ঠিক যেন সিনেমার রিলের মতো ঘুরতে ঘুরতে অনেক পেছনে দূরের অতীতে হারিয়ে গেছে। অনুরাধা দাঁড়িয়েই আছে। গালে শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ, মজে যাওয়া নদীর মতো। চোখ দুটো এখন শুকনো খটখটে মরুভূমির মতো হয়ে গেছে। জলের লেশমাত্র নেই। আছে শুধু লঙ্কাবাটা লাগার মতো হুহু করা জ্বলুনি। সেই কবে দশমাসের ছোট্ট মেয়েটাকে বুকে করে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে এসেছিলো যখন, তখন থেকেই অনুরাধার জীবনের বসন্তগুলো বেরঙীন হয়ে গিয়েছিলো। বসন্তের পর বসন্ত কেটে গেছে একলা ঘরে, মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে। তবুও বসন্তে আর রঙের আগমন ঘটতে দেয়নি। একাকীত্বে কেটেছে দিবারাত্রি, জীবনে বসন্ত আর ফুল ফোটায়নি।
অনুরাধার ছোট্ট বারান্দা বাগানে বাহারি টবের সারি। নানা রঙের অনেক ফুল ফুটেছে... ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, গোলাপ। টকটকে লাল অনেক রক্তগোলাপ। অনুরাধার ভারী প্রিয় গোলাপ। বিয়ের পরে স্বামীর কাছে আবদার করেছিলো গোলাপচারা আর টবের। এক রবিবার সকালে স্বামী অনির্বাণ নার্সারি নানা রঙের অনেক গোলাপচারা কিনে এনে দিয়েছিলো। আর তার সাথে পোড়ামাটির ডিজাইন করা বাহারি টব অনেকগুলো।
বেশ চলেছিলো বিয়ের পরের প্রথম তিনটে বছর। বেশ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। তারপরেই ধীরেধীরে তাল কাটতে লাগলো। প্রথমে ছোটখাটো মন কষাকষি, তারপর তা বিরাট বিরাট ডালপালা ছড়িয়ে বট-অশ্বত্থের আকার নিয়ে নিলো। সেসব অশান্তি আর কমার নয়, বলেই ক্রমশঃ বেড়েছিলো। অনুরাধা আর অনির্বাণ নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছিলো কয়েক আলোকবর্ষ বোধহয়। বেশ অনেকদিন কথাবার্তা বন্ধ থাকার পরে, এক বিকেলে অফিস থেকে হঠাৎ ফিরেই অনির্বাণ ঘোষণা করেছিলো, "এই দমবন্ধ করা, মরে যাওয়া সম্পর্ক থেকে আমি মুক্তি চাই। কোনো ঝুটঝামেলা করার দরকার পড়বে না। তোমার আর তোমার মেয়ের ভরণপোষণের যাবতীয় খরচ খরচা যা লাগবে, তার থেকে বেশীই দেবো তোমাকে... কিন্তু মুক্তি দাও আমাকে।" অনুরাধা কিচ্ছু বলতে পারেনি এই আকস্মিক অভিঘাতে। কেবল কেমন একটা বোকাবোকা শূন্যদৃষ্টি মেলে তাকিয়েছিলো অনির্বাণের মুখের দিকে। আর নিজের স্মৃতিপথে আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো নিজের দোষত্রুটি কিছু আছে কিনা। কিন্তু নাহ্, কিচ্ছুটি খুঁজে পায়নি।
তবে একটা কাণ্ড ঘটেছিলো... অনুরাধার ঐরকম আড়পাড় করে দেওয়া মর্মভেদী দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে পারেনি অনির্বাণ। ছিটকে সরে গিয়ে অনির্বাণ বলেছিলো, "টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মানসিকতা আর কাকে বলে? বিয়ে হয়েছে মানেই সারাজীবন একসাথে এক ছাদের তলায়, এক বিছানায় একই বৌ নিয়ে থাকতেই হবে?" আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো অনির্বাণ। কিন্তু অনুরাধার আর কিছু শোনার শক্তি ছিলো না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্তম্ভিত অনুরাধা অবাক হয়ে চেয়ে থাকলো তার সদ্য অপরিচিত হয়ে ওঠা স্বামীর দিকে। আর অপরিচিত কেন ভাবছে অনুরাধা? আদৌ কী কখনো অনির্বাণ ওর পরিচিত হয়ে উঠেছিলো নাকি? হয়তো এই রূপটা আজকেই ও প্রথম দেখালো, কিন্তু আসলে হয়তো প্রথম থেকেই ও এরকমই। শুধু অনুরাধার সামনে একটা মুখোশ এঁটে রেখেছিলো। একটা আদ্যোপান্ত ভালোমানুষির মুখোশ। কে জানে? অনুরাধার সব চিন্তাভাবনা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। মেয়ের কান্নায় সম্বিত ফিরলো অনুরাধার। মেয়ের দুধের বোতলটা খালি হয়েছে, কাঁদছে তাই।
অনির্বাণ নিজের বক্তব্য জানিয়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অনুরাধা মেয়েকে জল খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে, একটা ভালো জামা পরিয়ে, নিজের শাড়িটা পাল্টে নিলো। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দেখা করে, মেয়েকে কোলে নিয়ে একলাই গিয়ে চেপে বসেছিলো রিক্সায়। তারপর সোনারপুর স্টেশনে গিয়ে শিয়ালদাগামী ট্রেনে চেপে বসেছিলো। শিয়ালদা থেকে আবার ট্রেনে করে একদম ব্যারাকপুরে বাপেরবাড়ীতে।
সংক্ষেপে অনুরাধা বাবা-মাকে কী বলেছিলো, আর তার উত্তরে বাবা-মাই বা অনুরাধাকে ঠিক কী কী বলেছিলো, তার আর কিছুই এই সাতাশ বছর পরে অনুরাধার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, মা অনুরাধার এক বছরের মেয়ে অনুলেখাকে বুকে করে নিয়ে কত কিছু বলেছিলো, যেন কত আনন্দ... নাতনি এসেছে বলে। বাবা অনুরাধার পছন্দের কড়াভাজা জিলিপি আর মোচার চপ কিনে এনেছিলো। তারপর থেকে ব্যারাকপুরের বাড়ীতে অনুরাধা, ওর বাবা-মা আর মেয়ে অনুলেখা... চারজনে মিলে জড়াজড়ি করেই ছিলো, বড়ো মমতায় একে অপরকে বেঁধে রেখে।
ব্যারাকপুরের বাড়ীর একতলায় অনুরাধার সফট টয় বানানো শেখানো শুরু হলো। ধীরেধীরে অনেক মেয়ে এলো শিখতে। কেউ নিতান্তই শখে, আবার কেউবা প্রয়োজনে, আর কেউ কেউ আসে বানানো সফট টয়গুলি কিনে নিয়ে গিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে। তারপর এভাবেই কয়েক বছরের মধ্যেই অনুরাধার সফট টয়ের ব্যবসা বেশ বড়সড় হয়ে ভালোমতোই দাঁড়িয়ে গেলো। অনির্বাণ ডিভোর্স দেওয়ার জন্য কাগজপত্র পাঠিয়েছিলো, অনুরাধা কোর্ট কাছারিতে দৌড়ঝাঁপ করে নিজের অধিকার রক্ষার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করেনি। কাজেই মিউচ্যুয়াল সেপারেশন হয়েছিলো নির্বিঘ্নে। মেয়ে অনুলেখার জন্য কয়েকবারই টাকা পাঠিয়েছিলো অনির্বাণ, তবে প্রত্যেকবারই সে টাকা ফিরিয়ে দিয়েছে অনুরাধা।
তারপর সময়ের নিয়মে বাবা-মা দু'জনেই চোখ বুজেছে। আর অনুরাধার তুখোড় মেধাবী মেয়ে অনুলেখা ডাক্তার হয়েছে। আঠাশ বছর বয়সেই যথেষ্ট পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে অনুলেখা। ডঃ অনুলেখা... কারণ অনুলেখা বাবার পদবীর ভার বহন করতে চায়নি। মা'কে বলেছিলো অনুলেখা, "কেন তোমাকে ডিভোর্স দেওয়া হলো? কেন আমার দায়িত্ব এড়িয়ে মাঝেমধ্যে শুধুমাত্র কিছু টাকা পাঠিয়ে দায় সারার চেষ্টা করা হলো? এসব নিয়ে তোমার মনে হয়তো কোনো ক্ষোভ না থাকতে পারে মা, কিন্তু আমার আছে। যে মানুষটি বিনা কারণে তোমাকে ত্যাগ করেছে, তারই মঙ্গল কামনা করে তুমি চুলের ফাঁকে সিঁদুর ছোঁয়াতে পারো, কিন্তু আমার মনে মানুষটি সম্পর্কে ঘৃণা ছাড়া আর যে কিছু নেই মা।" মেয়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারেনি অনুরাধা, কেবল চোখের সামনে দিয়ে ভেসে ভেসে এলোমেলো উড়ে গেছে চার বছরের দাম্পত্যের টুকরো ছবিগুলির কোলাজ। আর গলায় পিন ফোটানো ব্যথা আর দু'চোখের কোণে চিরচিরে জ্বালা অনুভব করেছে। সত্যিই তো অনুরাধা অনির্বাণকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিলো, এই এতোগুলো বছরের বিচ্ছেদের পরেও তাই হয়তো স্নানের পরে নিজের অজান্তেই হাতটা সিঁদুর কৌটোয় চলে যায়।
সেদিন অনুলেখা হাসপাতালে বেরিয়ে যাবার পরে অনুরাধা রোজকার মতোই স্নান টান সেরে পাটের কাপড় পরে ঠাকুরঘ
রে ঢুকেছিলো। রোজই তাই করে। মেয়ে না বেরোনো পর্যন্ত অনুরাধার ভারী হুড়োতাড়া থাকে। মেয়েকে চা-জলখাবার খাইয়ে রওনা করিয়ে দিয়ে, রান্না কি হবে না হবে রান্নার লোককে গুছিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে, তবে অনুরাধা একটু ফুরসৎ পায়। তারপর স্নান পুজো সব সেরে তবে অনুরাধা এককাপ চা আর হালকা একটু জলখাবার নিয়ে বসে। কিন্তু সেদিন রুটিনের ছন্দটা হঠাৎ কেটে গেলো। পুজো শেষ করে প্রণাম করতে করতেই শুনতে পেলো ফোনের ঘন্টি বাজার কর্কশ আওয়াজ, মোবাইল নয়। প্রথমে একবার, তারপরে আবার, ল্যাণ্ড ফোন। রান্নার লোক এসে ধরেছে ল্যাণ্ড ফোন। হাঁটুর ব্যথার জন্য আজকাল বেশি তাড়াতাড়ি হাঁটাচলায় একটু অসুবিধা হয় অনুরাধার। ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে ফোনের রিসিভারটা রান্নার লোকের হাত থেকে নিলো অনুরাধা। কথা শুরু করার আগেই অনুরাধার মনে হলো, "আজ দেরীই হয়ে গেলো। আজ নীচে নামতে লেট হয়ে যাবে। সফট টয়ের কারখানায় তো এই সকালের দিকেই রিটেলাররা আর নতুন শিখতে আসা মেয়েগুলো আসে। এইসময় আবার কে ফোন করলো? কেইবা আছে অনুরাধার এমন অসময়ে ফোন করবার মতো? "হ্যালো", অপরিচিত গলার স্বর। কলকাতা শহরের এক হাসপাতাল থেকে। শুনলো অনির্বাণ শেষশয্যায়। একবার দেখা করতে চায়, অনুরাধার সাথে, মেয়ের সাথে। অনুরাধার পায়ের তলার মাটিটা কেমন দুলে উঠলো। অনুলেখা তো হাসপাতালে চলে গেছে, এতোক্ষণে হয়তো পৌঁছে রুগী দেখাও শুরু করে দিয়েছে। তবুও অনুরাধা অনুলেখাকে মোবাইলে ফোন করলো, যতই হোক, অনির্বাণ তো অনুলেখার জন্মদাতা বাবা বটে। এসময় অভিমান সাজে না। সংক্ষেপে মেয়েকে বুঝিয়ে বললো অনুরাধা, তারপর রান্নার লোক, কাজের লোকেদের বুঝিয়ে অনুরাধা ড্রাইভারকে ফোন করে ডেকে বেরিয়ে পড়লো, যে হাসপাতালে অনির্বাণ ভর্তি আছে, সেই হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
গাড়ির পেছনের সিটে হেলান দিয়ে অনুরাধা হারিয়ে গিয়েছিলো সাতাশ-আঠাশ বছর পেছনে। চলে আসার অনেক পরে অনুরাধা লোকমুখে শুনেছিলো যে অনির্বাণ এক ডিভোর্সি মহিলাকে বিয়ে করেছিলো। আসলে এই সম্পর্কটার কারণেই অনুরাধা আর অনির্বাণের সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিলো। তবে অনির্বাণ মেয়ের দায়িত্বটুকু টাকাপয়সা পাঠিয়েই সারতে চেয়েছিলো। আর অনুরাধা মেয়ের জন্য ঐ দয়ার দানকে কিছুতেই নিতে চায়নি। নিজেই নিজের দায়িত্বে মেয়েকে বড়ো করেছে, ডাক্তারি পড়িয়েছে। ওপরে ওপরে মুখে যাই বলুক, অনুরাধার ভেতরে অনির্বাণের জন্য এখনো বয়ে চলা চোরাস্রোতটা একমাত্র অনুলেখাই টের পায়। তাই হয়তো মায়ের ফোনের ওপ্রান্ত থেকে মায়ের কাঁপা কাঁপা গলায় আর কিছু কঠিন কথা মা'কে বলতে পারেনি আজ। অনুলেখা এসে পায়ে পায়ে হাসপাতালের গেটের মুখে দাঁড়িয়েছিলো, ভাগ্যিস আজ আউটডোর ছিলো না। গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে এসে অনুরাধা মেয়ের হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করে উঠলো ধরা গলায়, "কোথায়? কোন ব্লকে? কোন ফ্লোরে?" মায়ের হাতে চাপ দিয়ে অনুলেখা মৃদুস্বরে বললো, "চলো, আমি দেখে এসেছি, সাততলায় আইসিইউতে, জ্ঞান আসছে যাচ্ছে।" তারপর লিফটে করে মেয়ের হাত ধরে সাততলায় পৌঁছতে যেন কয়েকযুগ পেরিয়ে গেলো মনে হলো অনুরাধার। কাঁচের দরজা ঠেলে অনুলেখা মা'কে নিয়ে ঢুকলো। অনুলেখা ঐ হাসপাতালেরই ডাক্তার, অসুবিধা হলো না। তখন আর খুব কিছু করার ছিলো না। অন্তিম মুহূর্তে জড়ানো গলায় অনির্বাণ কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পারেনি। কোটরাগত চোখের কোল বেয়ে শুধু কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিলো। তারপর ঘাড়টা এলিয়ে চোখের পাতাদুটো একটু কেঁপেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অনির্বাণ চলে গেলো চিরঘুমের দেশে।
অনুলেখা আর অনুরাধার খবর অনির্বাণেরই এক পুরোনো বন্ধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলো।
অনির্বাণের মৃত্যুর পরে ঐ বন্ধু ভদ্রলোক অনুরাধার হাতে মোটা একখানা খাম ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়েছিলো। বয়স্ক মানুষ। বন্ধুর মৃত্যুশোকে হতাশ, অবসন্ন। যাবার আগে অনুরাধাকে বলেছিলো, "শেষের কয়েকটা বছর শুধু তোমাদের কথা। মেয়ের ডাক্তার হবার কথা। সব খবরই রাখতো তোমাদের। তথাপি সাহস জোটাতে পারেনি তোমাদের মুখোমুখি হবার। আমাকে দিয়েছিলো এই খামটা। পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলো। দায়িত্ব পূরণ হলো। এবার আসি। পরে একদিন সময় নিয়ে কথা হবে।" অনুরাধার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো, তারপর ভেঙে পড়লো বাইরের খোলসের আবরণের মেকি প্রতিরোধ। সাতাশ বছরের অদর্শনেও অনুরাধার অন্তরে বয়ে চলেছে অন্তঃসলিলা প্রেমের ফল্গুধারা। অবাধ্য চোখকে আর সেদিন শাসন করেনি অনুরাধা।
তারপর কাজকর্ম মিটতে মিটতে হাজার একটা কাজের চাপে ভুলেই গিয়েছিলো অনুরাধা, ঐ যে অনির্বাণের রেখে যাওয়া খামটা খুলে দেখতে। বেশ ভারী খামটা। বড়সড় ভারী সিল করা মুখবন্ধ খাম। অনুলেখা হাসপাতাল থেকে ফেরেনি তখনো। বাড়ীতে একলাই ছিলো অনুরাধা। রাতে সাতটা নাগাদ কাজের লোকজনকে সেদিনের মতো ছেড়ে দিলো। অনুলেখার ফিরতে ফিরতে একটু দেরী হবে, এমার্জেন্সি আছে। শোবার ঘরের খাটের ওপরে বসে অনুরাধা খামটার মুখ খুললো। ভেতরে বেশ কিছু রঙীন কাগজের শক্ত খাম, দুটো ব্রাউন পেপারের লম্বা লম্বা খাম, আর একটা সাদা ছোট্ট মুখবন্ধ খাম। সাবধানে কাঁপা হাতে সাদা খামটা ছিঁড়লো অনুরাধা। ভেতরে ভাঁজকরা সাদা একটা কাগজ। তাতে ছোট্ট একটা চিঠি লেখা, অনুরাধার উদ্দেশ্যে।
"কল্যানীয়া অনু, এই সামান্য কিছু আমাদের ছোট্ট অনুর জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। অনুকে বোলো যে এটা তার জন্য তার হতভাগ্য বাবার সামান্য উপহার। তোমাকে কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। সর্বস্ব আরেকজন নিয়ে নিয়েছে, ডিভোর্স দিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। পারলে আমায় ক্ষমা কোরো। আমার ছোট্ট অনুর কাছে ক্ষমা চাইবার মুখও আমার নেই। শুধু প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করি, অনেক অনেক বড়ো ডাক্তার হোক। তোমার তপস্যা সার্থক হোক। চললাম। বিদায়।
ইতি,
তোমার অনি"
চলে গেছে অনির্বাণ তার শেষ কথাটা বলে দিয়ে। সাতাশটা রঙীন খামে মেয়ের জন্মদিনের একটা করে কার্ডে লেখা... "ছোট অনুকে মা ও বাবা", আর ব্রাউন পেপারের খাম দুটোর একটায় ওর বাড়ীর দলিলটা। আরেকটায় অনুরাধার ফেরত পাঠানো সব চেকগুলো আর ওদের বিয়ের পরে পরেই করানো সেই পুরনো জয়েন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্টের পাসবুকটা ডিপোজিটসমেত ও চেকবুকটা। অনুরাধা অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কান্না শুকিয়ে গেছে ওর। আজ অনুরাধা বহুকাল ধরে অবিরল অঝোরধারায় বুকের ভেতরে ঘটতে থাকা রক্তক্ষরণ বুকেই বেঁধে রেখে অস্ফুটে উচ্চারণ করে, "এককালে তো দূরেই সরে গিয়েছিলে স্বেচ্ছায়, তবে এতোদিন পরে কেন এসে আবার আমায় ঠেলে দিলে এই অন্ধকার গহ্বরে? ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো, হয়তো আবার দেখা হবে... অন্ধকার কাটবে আমার জীবনে।"