Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Classics Crime

3.6  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Classics Crime

অশ্লীলতার দায়ে

অশ্লীলতার দায়ে

12 mins
2.0K



সুদীপ্তার একমাত্র মেয়ে শ্রেয়াকে নিয়ে সুদীপ্তার ছোট্ট সংসার। সুদীপ্তার স্বামী শ্রীধর খুব ভালো ন্যাশনাল লেভেলের অ্যাথলিট ছিল, স্পোর্টস কোটায় রেলে চাকরি পেয়েছিল। আর সুদীপ্তাও একই সময়েই চাকরি পেয়েছিল রেলেই, তবে কম্পেনসেটরি গ্রাউন্ডে, কর্মরত অবস্থায় বাবা মারা গিয়েছিল হঠাৎ, অফিসেই স্ট্রোক হয়ে। তখন সুদীপ্তা সবে কলেজের সেকেণ্ড ইয়ারে, মাত্র কুড়ি বছর বয়স। তবুও মা জোর করেই মেয়েকেই বাবার অফিসের চাকরিতে ঢুকতে বাধ্য করেছিল। বিএসসি পড়াটা না শেষ করেই। পরীক্ষাটা আর পরে দেওয়া হয় নি। চাকরিতে জয়েন করতে হয়েছিল। তাই পড়াশোনা শেষ করতে না পারার আফশোষটা ওর মনে ছোট্ট একটা কাঁটার মতো হয়ে বিঁধেছিল। তাই সুদীপ্তা নিজের একমাত্র মেয়ের লেখাপড়ার ব্যাপারে বড্ডই বেশী অবসেসড্ ছিল। মেয়েকে কখনো পড়াশোনার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই প্রভাবিত করে নি মাতৃত্বসুলভ জোর খাটিয়ে।


সুদীপ্তার জীবনের দ্বিতীয় বিপর্যয় নেমে এসেছিল, যখন তার রেলওয়ের টিকিট কালেক্টর স্বামী শ্রীধর একদিন একদল কলেজপড়ুয়া ছেলের কাছে টিকিট চাওয়ার ফলে বেধড়ক মার খেয়ে শেষপর্যন্ত মারাই যায়। তখন থেকেই শ্রেয়াকে বুকে আঁকড়েই সুদীপ্তার সংসার। যতদিন সুদীপ্তার মা বেঁচেছিল ততদিন ওর মা'ও ওদের সঙ্গেই থাকত। তবে ওর মা শ্রীধরকে নিজের ছেলের মতোই দেখত, তাই শ্রীধরের এই মর্মান্তিক পরিণতিতে একেবারে চুপ হয়ে গিয়েছিল। তারপর একদিন মা'ও চোখ বুজল, শোক সামলাতে না পেরে। কিন্তু সুদীপ্তার তো ভেঙে পড়লে চলবে না, শ্রেয়াকে বড় করা, মানুষ করা, তারপর সময়মতো বিয়ে দেওয়া, এইসব গুরুদায়িত্ব তো তাকেই সম্পূর্ণ করতে হবে।

**********

পিএইচডি শেষ করার পরেই সুদীপ্তার মেয়ে শ্রেয়া কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে কলেজে পড়ানোর চাকরি পেয়ে যায়। তার বছর চারেক পরই শ্রেয়া আরও ভালো চাকরি পায়, একেবারে পছন্দের কেন্দ্রীয় সরকারি ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর চাকরি। এবার সুদীপ্তা উঠেপড়ে লাগল এতদিনে মেয়ের পেছনে, বিয়ে করবার জন্য। মেয়ে তিরিশ পেরিয়েছে, তাও অন্য শহরে মেয়ে একা একা থাকবে এতেই সুদীপ্তার মনে বেশ একটু খিঁচ, এদিকে নিজেরও কয়েকবছর চাকরি আছে এখনো। তাই মেয়ের বিয়ে দেবার চিন্তা সুদীপ্তার মাথায় প্রবলভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে।


তবে ছোট থেকেই সুদীপ্তা কোনো বিষয়েই মেয়ের উপরে কোনো জোর খাটায় নি, মেয়েকে নিজের ইচ্ছে মতই চলতে দিয়েছে। বিয়ে কেমনভাবে হবে

লাভ ম্যারেজ নাকি সম্বন্ধ করে বিয়ে, এব্যাপারেও মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে সুদীপ্তা। তার নিজের আর শ্রীধরেরও তো লাভ ম্যারেজই ছিল। আর বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে লাভ ম্যারেজ অনেক বেশি কাম্য। এদিকে ইন্টারনেটের যুগে ভোল পাল্টে স্মার্ট চেহারায় হাজির অ্যারেঞ্জড ম্যারেজও, বিভিন্ন ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের দৌলতে। আসলে সুদীপ্তা শ্রেয়ার মুখে কখনোই বয়ফ্রেন্ড সংক্রান্ত কোনো কথাই শোনে নি, তাই দ্বিতীয় অপশনটা নিয়েও ভেবে রেখেছে শ্রেয়ার বিয়ের ব্যাপারে।


শ্রেয়া পরিষ্কারভাবে জানিয়েছে ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই, এমনকি বিয়ের ব্যাপারেও তেমন ভাবছেও না। ওর অনেক ব্যস্ততা আছে। তাই ওর মা সুদীপ্তার জন্য ঐ দ্বিতীয় অপশনটাই ঠিক আছে। আজকাল সবকিছুই তো ইন্টারনেটের দৌলতে হাতের মুঠোয়। মানে আক্ষরিক অর্থেই হাতে ধরা মুঠোফোনে। ব্যাঙ্ক থেকে বাজার-হাট, সিনেমার টিকিট থেকে মেয়ের বিয়ের জন্য জামাই খোঁজা.... সবই প্রযুক্তি আর ইন্টারনেটের দাক্ষিণ্যে সহজলভ্য যে! আজ গোটা বিশ্বটাই বাস্তবিকই আমাদের হাতের মুঠোয়, মানে স্মার্টফোনে। আর শ্রেয়া বরং ওর মা'কে এই স্মার্টফোন ব্যবহারটাই ঠিক করে শিখিয়ে দেবে, মনে মনে ভাবল।

এমনকি রসিকতা করে মা'কে এও বলেছে শ্রেয়া, যে

উলটপুরাণ হলেই বা ক্ষতি কি? "উপার্জন করবে পুরুষ, ঘরের যাবতীয় কাজ সামলাবে নারী, এতদিন এটাই ছিল সংসারের পরিচিত রূপ। কিন্তু এখন সময়ের সঙ্গেও এই চিরাচরিত ভূমিকাটিও তো বদলে যাচ্ছে, মানে অনেকদিন ধরেই বদলাচ্ছে। স্ত্রীর বদলে এখন সংসার সামলানোর দায়-দায়িত্ব আর সংসারের চাবিকাঠি থাকতেই পারে একজন হাউজ হাজব্যান্ডের হাতে। মা, তুমি বরং একজন সেরকম ছেলেরই খোঁজ করো, বুঝলে? তুমি আর বাবা অফিস করেছ যখন, দিদু তখন সংসার সামলেছে। আর এখন তো তুমি কলকাতায় আর আমি বেনারসে চাকরি করব, এবার তুমিই বল, চাকরি করা ছেলে কি আর চাকরি ছেড়ে আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য তোমার কথা শুনে আমার সঙ্গে বেনারসে গিয়ে থাকতে রাজি হবে? তার থেকে ঐ বেকার হাউজ হাজব্যান্ডই ভালো।" বলে হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে মা'কে জড়িয়ে ধরেছে শ্রেয়া ।

সুদীপ্তা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছে শুধু। বোঝে নি তার সমাজবিদ্যার অধ্যাপিকা মেয়ে ঠিক কতটা পরিমাণ রসিকতা করছে? নাকি হাসির মোড়কে সত্যি কথাই বলছে? এত গভীরভাবে কখনো ভেবেই দেখে নি সুদীপ্তা। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছে, সেই কষ্ট একটু সামলাতে না সামলাতেই স্বামীকে আর মা'কে হারিয়েছে। তারপর থেকে শুধু শ্রেয়াকে বড় করতে হবে, আর মানুষ করতে হবে, এই চিন্তাতেই বিভোর থেকেছে। বাইরের দুনিয়ায় যে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে সেটা তেমন খেয়াল করে উঠতে পারে নি সুদীপ্তা। ঐ হঠাৎ হঠাৎ চাঞ্চল্যকর কোনো খবর কলিগদের মুখে কখনো শুনেছে হয়তো, ব্যাস্, ঐ পর্যন্তই। তারপর মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।

আজ নিজের মেয়ে শ্রেয়ার মুখে দিন বদলের কথা ঠিক এরকম ভাবে শুনে একটু হকচকিয়ে গেল সুদীপ্তা। যাই হোক, মেয়ে শ্রেয়া খুব যত্ন করে ধরে ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করা শিখিয়েছে সুদীপ্তাকে।

আর মা'কে আশ্বস্ত করেছে, "চিন্তার কিচ্ছু নেই। রোজ দু'বেলা ভিডিও কলিং হবে। আর আমি চেষ্টা করব মাসে একবার একদিনের জন্য হলেও এসে তোমার কাছ থেকে ঘুরে যাবার। আর তুমি বরং ভলান্টারী রিটায়ারমেন্টের অ্যাপ্লাই কর, কারণ তোমার একলা থাকতে কষ্ট হবে। তোমার রিটায়ার করার পর আমরা তখন দু'জনে মিলেই বেনারসে থাকব। ততদিন পর্যন্ত আমি হস্টেলেই থাকব।"

**********

সুদীপ্তা মেয়ের সাথে দু'বেলাই ভিডিও কলিঙে কথা বলে, দেখে তো সুদীপ্তার মনে হয় শ্রেয়া বেশ ভালোই আছে। সুদীপ্তাও অ্যাপ্লিকেশন করেছে ভলান্টারী রিটায়ারমেন্টের। বেশ মসৃণ গতিতেই চলছে সব। সুদীপ্তার আত্মীয় স্বজন তেমন নেই কাছেপিঠে। ঐ অফিস কলিগদের আর ফ্ল্যাটের দু-এক জনের বাইরে তেমন বন্ধু বান্ধবও নেই। শ্রেয়া বেনারসে চলে যাওয়ার পরে সুদীপ্তা একদম একা হয়ে গেছে। অফিস থেকে সাড়ে ছটা সাতটার মধ্যেই বাড়ী ফিরে যায়, তাও অফিস থেকে বেরিয়ে বাজার দোকান প্রয়োজনীয় কেনাকাটি সেরে। যদিও শ্রেয়া সব কিছুই অনলাইনে শপিং করতে শিখিয়ে দিয়েছে মা'কে, তবুও সুদীপ্তা বাজারে দোকানে ঘুরে ঘুরে লোকজনের অগোছালো কথাবার্তা আর উপস্থিতির উষ্ণতাটুকু বুক ভরে নিতে চায়। ঘরে ফিরে একলা বসে চা খাওয়া, নিজের জন্য একমুঠো চাল-ডাল সবরকম সবজি দিয়ে ফুটিয়ে নিয়ে মুখ বুজে একলা বসে খাওয়া, তারপর অপেক্ষা করা রাত সাড়ে দশটা বাজার। ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে দশটাতেই শ্রেয়া রোজ রাতের ফোনটা করে, ভিডিও কলিঙে। আর সকালে নটা নাগাদ একবার করে ভিডিও কলিং, তবে তখন তো দু'জনেরই তাড়া থাকে বেরোবার। বেশীক্ষণ কথা হতে পারে না।

প্রত্যেকদিনের এই গতানুগতিক একঘেয়ে রুটিনে কয়েক সপ্তাহেই সুদীপ্তা হাঁপিয়ে উঠেছে। প্রতিদিন তদ্বির করছে কত তাড়াতাড়ি ভলান্টারী রিটায়ার করতে পারে সুদীপ্তা, হলেই চলে যাবে মেয়ের কাছে, বেনারসে। এই মারাত্মক একাকীত্বের হাত থেকে বাঁচতে সুদীপ্তা টিভি চালিয়ে বসে থাকত প্রথম প্রথম, শ্রেয়া বেনারসে যাবার পরে। একটা সময় ঐ নানান চ্যানেলের নানান সিরিয়াল, আর তাতে যত সিরিয়াল হয় সব গল্পই সুদীপ্তার কাছে একই রকম একঘেয়ে মনে হয়। এসব সংসারের কূটকচালি একদম পছন্দ করে না সুদীপ্তা। সিনেমা যে দেখবে, তাতেও শান্তি নেই অ্যাডের জ্বালায়। শ্রেয়া যখন কলকাতায় ছিল তখন মা-মেয়ে দু'জনে মিলে দু'জনের সারাদিনের জমে থাকা গল্প টুকটুক করে শেয়ার করত, শ্রেয়া ভালো ভালো সিনেমা ডাউনলোড করে পেন ড্রাইভে করে টিভিতে চালিয়ে দেখাত। আর প্রায় প্রতিটি শনিবার-রবিবারই সারাদিন মা মেয়েতে শপিং করে, বাইরেই খেয়ে, কোনো না কোনো একটা মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে সিনেমা দেখে কাটাত। একাএকা তো আর এসব করে নি কখনো সুদীপ্তা, শ্রেয়াই মা'কে নিয়ে সারাক্ষণ একটু ঘুরতে বেড়াতে ভালোবাসত।

আর এই দমবন্ধ হওয়া বোরিং দিন কাটান থেকে বাঁচাতে শ্রেয়া মা'কে সোশ্যাল মিডিয়ায় অ্যাড করে দিল। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম সব শিখিয়ে দিল শ্রেয়া, মা'কে সুন্দর করে বুঝিয়ে এবং খুব ভালো একটা ফোন কিনে দিয়ে তাতে। সুদীপ্তার প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হয়েছিল ঠিকই, তবে শিখে নিয়েছিল শেষ পর্যন্ত সবকিছুই বেশ ভালোভাবেই। তারপর থেকে অফিস থেকে ফিরে সুদীপ্তা এক কাপ চা খেয়েই ঐ নতুন ফোনটা নিয়ে ইন্টারনেট অন করে বসে পড়ে। এই নতুন ফোনটা শুধুমাত্র বাড়ীতে রেখেই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্সেসের জন্যই ব্যবহার করে। মেয়ের কিনে দেওয়া এতো দামী ফোন সুদীপ্তা বাড়ীর বাইরে বার করে না মোটেই। পুরনো কমদামী ফোনটাই ব্যবহার করে সবসময়, ওতে নেট অন করলে মেয়ের সাথে ভিডিও কলিংটাও করা যায়, তাই সবসময় ওটাই সঙ্গে রাখে।


ফোন নিয়ে বসলে তারপর কোথা দিয়ে যে সময় পার হয়ে যায় তা আর সুদীপ্তা টেরও পায় না। একাকীত্বে ভোগা এখন আর একেবারেই নেই সুদীপ্তার, বরং ভার্চুয়াল দুনিয়ায় বেশ মশগুল থাকা যায়, কিন্তু কোনো দায়বদ্ধতা নেই, সবই কেমন দূর থেকে, ওপর ওপর। প্রথম দিকে একটু অদ্ভুত লাগলেও পরে সুদীপ্তা পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেছে ইন্টারনেটে ঢুকে ভার্চুয়াল জগতে ঘোরাফেরা করার কায়দা কানুন। নিজেই পারে সব নিজের মতো করে।

************

শ্রেয়া তখনও হস্টেলে ঘুমিয়ে, ফোনটা বহুক্ষণ ধরে ভাইব্রেট করে যাচ্ছে। অনেক রাতে কাজকর্ম সেরে শুয়েছে শ্রেয়া, মায়ের সাথেও বেশীক্ষণ কথা বলতে পারে নি, সেমেস্টারের খাতা দেখার চাপে। ঘুমচোখে ফোনটা হাতে নিয়ে চশমাটা পরতে পরতে ভাবছে শ্রেয়া, এতো ভোরে কে ফোন করছে? এতোবার করে? আরো অবাক হল আননোন নাম্বার দেখে। আবার ভাইব্রেট করতে শুরু করেছে ফোনটা। শ্রেয়া ফোনটা রিসিভ করে কেঁপে উঠল, ওর দু'চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আর সময় নেওয়া যাবে না, এক্ষুণি তৈরী হয়ে কলকাতায় যেতে হবে ওকে। কোনো রকমে ফ্লাইটের একটা টিকিট জোগাড় করল শ্রেয়া। ওর এক কলিগ, ওর পাশের ঘরেই থাকে হস্টেলে, দিল্লির মেয়ে, ওই মেয়েটাই সব ব্যবস্থা করে শ্রেয়ার সাথে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এসেছে। সাহস জুগিয়েছে শ্রেয়াকে যথাসাধ্য।


কলকাতা পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দুপুর গড়িয়ে গেল, এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজাসুজি হসপিটালে চলে এল শ্রেয়া। তারপর ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে বুঝল কোনো আশা সেরকম অবশিষ্ট নেই। শ্রেয়া কিছুতেই বুঝতে পারছে না আগের রাতেই যে মানুষটার সাথে ভিডিও কলিঙে কথা হল, সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক হাসিখুশি, সেই মানুষটাই ভোররাতে কেন আটতলার ব্যালকনি থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে? কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না শ্রেয়ার কাছে। কী কারণে? কী কষ্টে মা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, মাত্রই কয়েকঘন্টার ব্যবধানে? শ্রেয়ার চোখে তো কখনো অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়ে নি! যতই সামনাসামনি না দেখা হোক ও ওর মায়ের ব্যবহারে পরিবর্তন হলে বুঝতে পারবে না? ডাক্তার সঙ্গে করে শ্রেয়াকে সুদীপ্তার বেডের সামনে নিয়ে এল, সারা গা মাথা সব ব্যান্ডেজে মোড়া, নানান রকম নল লাগান হাতে পায়ে, লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেমে। সব ব্যবস্থা পুলিশই করেছে। ফ্ল্যাটের কম্পাউন্ড থেকে রক্তাক্ত দেহটি তুলে হসপিটালে পাঠান এবং ঐ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা যারা, তাদের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করেই সুদীপ্তার মেয়ের খোঁজ, আর সুদীপ্তার অফিসের খোঁজ পেয়েছে। আর ফ্ল্যাটের কমিটির রেজিস্টার থেকে সুদীপ্তার মেয়ে শ্রেয়ার ফোন নাম্বারও উদ্ধার করেছে পুলিশ, তারপর শ্রেয়াকে ফোন করে জানিয়েছে।


সুদীপ্তা সংসারের মায়া কাটাল। যে মেয়ের কাছে থাকার জন্য ভলান্টারী রিটায়ারামেন্টের জন্য পর্যন্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই মেয়েকেই একেবারে বাস্তবিকই একলা করে দিয়ে সুদীপ্তা চলে গেল কোনো এক অজানা দেশে। শ্রেয়া কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না, কেন মা এরকম কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল? পুলিশের সহায়তায় এই রহস্য ভেদ করতেই হবে, এই ঘটনার পেছনে তো গভীর রহস্যময় কারণ অবশ্যই আছে! সুদীপ্তার অফিস কলিগদের, আর ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদের সাহায্যে দাহকার্য্যও সম্পন্ন করে অনেক রাতে বাড়ীতে ঢুকল শ্রেয়া। এই ফ্ল্যাট আছে অথচ মা নেই, এটা শ্রেয়ার বিশ্বাস হতে চাইল না যেন।


খালি ফ্ল্যাটটা একদম যেন গিলে খেতে আসছে শ্রেয়াকে। সেই কোন ছোট্টবেলায় বাবা মারা গেছে। তারপর থেকে মা সুদীপ্তাকে জড়িয়েই তো সুদীপ্তার একমাত্র মেয়ে শ্রেয়া ছিল, লতানে গাছের মতোই। শ্রেয়ার জীবনের সবটা জুড়েই শুধু মা, মা যে নেই এটাই যেন শ্রেয়া মানতে পারছে না কিছুতেই। পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমার কাছেই বরাবরই ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবির সেটটা রাখা থাকে। সেই কাকিমাই থাকতে চেয়েছিল রাতে শ্রেয়ার সাথে, রাজী হয় নি শ্রেয়া। একার সাথে একা হতে চেয়েছিল শ্রেয়া। এক অদ্ভুত অপরাধবোধ কাজ করছে শ্রেয়ার মনে। ভাবছে মা'কে এভাবে একলা রেখে বেনারসের নতুন চাকরিতে জয়েন করা ওর উচিৎ হয় নি। মা যতই বাধা না দিক, যতই নিজের কষ্টের কথা না বলুক মুখে, আসলে মা এই একা থাকাটাই মানিয়ে নিতে পারল না।


সুদীপ্তার শোবার ঘরে ঢুকে দেখল শ্রেয়া, সব টিপটপ গোছান, যেমন রাখে মা, দেখে মনে হচ্ছে যেন রান্নাঘরে বা টয়লেটে গেছে, এক্ষুণি এসে পড়বে। বিছানাটা পর্যন্ত টান টান করে পাতা, এতেই বিরাট খটকা লাগলো শ্রেয়ার। বিছানা এতো টান টান? তার মানে মা রাতে শোয়ই নি নাকি? পুলিশ, ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার, নাইটগার্ড সবার বক্তব্য অনুযায়ী আট'তলার নিজেদের ব্যালকনি থেকে সুদীপ্তা ভোর রাতে ঝাঁপ দিয়েছে। তার মানে ভোর রাত পর্যন্ত মা জেগেই ছিল? কী করছিল সারা রাত জেগে? শ্রেয়ার সাথে মা সুদীপ্তার রাতে যখন কথা হয়েছে, তখন মায়ের রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। তখনও খাতা দেখছিল বলে না খেয়ে, সেজন্য মা শ্রেয়াকে তখন বকাবকি করেছে। তারপর কল কেটেছিল শ্রেয়া, মা'কে গুডনাইট জানিয়ে, বলেছিল সকালে যেমন নটায় কল করে তেমনই করবে। কিন্তু তা আর হল কোথায়?


মায়ের বিছানার এক পাশেই শুয়ে পড়ল। শ্রেয়া। ভীষণ টায়ার্ড, তাও ঘুম আসছে না, আলোটা জ্বেলে রেখেই শুয়েছে শ্রেয়া, মাথাটা অসহ্য ধরে রয়েছে। মাত্র চব্বিশ পঁচিশ ঘন্টার মধ্যে কতকিছু ঘটে গেল শ্রেয়ার জীবনে। জানালার কাঁচে নিজের ছায়া দেখে নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে। শ্রেয়া পাশ ফিরে শুল। চোখ বুজতেই পারছে না। তখনই চোখে পড়ল মায়ের নতুন ফোনটা বেডসাইড টেবিলে রাখা। শ্রেয়া শুয়ে শুয়েই হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিল। সুইচ অফ হয়ে রয়েছে, অন করা গেল না, তার মানে চার্জ ফুরিয়েছে পুরোপুরি।


শ্রেয়া উঠে গিয়ে মায়ের ফোনটা চার্জারে লাগিয়ে চার্জে বসিয়ে দিল। শ্রেয়া ঘুমোয় নি, তবে শুয়েই ছিল। হঠাৎ মায়ের ফোনে টিঙটিঙ টিঙটিঙ করে মেসেজ ঢুকছে। চার্জ হয়েছে খানিকটা, থাক। উঠে গিয়ে শ্রেয়ার আর ফোনটা সাইলেন্ট করার ইচ্ছে হল না। নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতায় ঐ আওয়াজটুকু থাক। কাল সকালে বরং দেখবে এত কী মেসেজ ঢুকছে? হতে পারে মায়ের চেনাজানা কেউ! "বহুতল থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা... একাকীত্বের শিকার মধ্যবয়সী মহিলা...." এইরকম একটা ক্যাপশনে সিটি টুডে নিউজ থেকে ব্রেকিং নিউজ হয়ে গেছে। শ্রেয়া তো আপাতত নিজের ফোন বন্ধই রেখেছে। কাজেই চেনা পরিচিতরা হয়তো জানতে চাইছে ডিটেলস খবরাখবর। যাক গে, যা হচ্ছে হোক। শ্রেয়া শুয়েই রইল, আড়াতাড়ি করে হাত রেখে চোখের ওপর।


অত ধকলের পরে একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, সকালে চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল শ্রেয়ার। ডোরবেলের আওয়াজে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল সব রিলেট করতে। দরজা খুলে শ্রেয়া দেখে পুলিশ, ইনভেস্টিগেশনের জন্য এসেছে। সব ঘুরিয়ে দেখাল শ্রেয়া, সন্দেহজনক কিছু সূত্র এখনো পাওয়া যায় নি। ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দাদের, দুই শিফটের কেয়ারটেকার-কাম-লিফটম্যান, গার্ড, অফিস কলিগ, শ্রেয়া.... সবাইকে ইন্টারোগেশন করা হয়েছে। সুদীপ্তার ফোননাম্বারটা নিয়ে নেটওয়ার্কের সহায়তায় সুদীপ্তার ফোননাম্বারের কললিস্ট চেক হয়েছে, শ্রেয়ার সাথেই শেষবার কথা হয়েছে, রাত সাড়ে দশটায়।কোথাও কোনো সূত্র মেলে নি। সবাই জানিয়েছে শেষবার কার সঙ্গে কোথায় কীভাবে সুদীপ্তার দেখা হয়েছে, কীকী কথা হয়েছে, সব বিস্তারিতভাবে, পুলিশ কিচ্ছু পায় নি অসামঞ্জস্যপূর্ণ সন্দেহজনক। এমনকি কোনো সুইসাইড নোটও নেই। ডায়েরি লেখার অভ্যাসও ছিল না সুদীপ্তার। তবে? বিরাট এক প্রশ্নচিহ্ন ঝুলছে সুদীপ্তার আত্মহত্যা ঘিরে।


ইনভেস্টিগেটিং পুলিশ অফিসার বসার ঘরে বসে শ্রেয়ার সাথে তদন্ত সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে যখন বিদায় নিতে যাবে, তখনই শ্রেয়ার মনে পড়ল মা'কে কিনে দেওয়া নতুন খুব দামী স্মার্টফোনটার কথা, চার্জে বসানো ছিল। অফিসারকে একমিনিট অপেক্ষা করতে বলে, ক্ষমা চেয়ে নিয়ে শ্রেয়া ছুটে মায়ের ঘরে ঢুকল। ফোনটা চার্জার থেকে খুলেই চেক করতে করতেই বসার ঘরে চলে এল শ্রেয়া।


এসব কী দেখছে শ্রেয়া? 'রাত জাগা পাখি' নামের প্রোফাইল থেকে মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ঢুকেছে অজস্র অশ্লীল ন্যুড ছবি, সব মায়ের! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না শ্রেয়া। সঙ্গে মোটা টাকার দাবী। না দিলে, ঐসব ছবি, এমনকি কয়েকটি ভিডিওও আছে, সেইসব ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি! ফোনটা পুলিশ অফিসারের হাতে দিয়ে, দু'হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়েছে শ্রেয়া। কখন হল এসব? কী করে? মুহূর্তের মধ্যেই তদন্তের অভিমুখ ঘুরে গেল।


পুলিশি তদন্তে ফেসবুকের সহযোগিতায় ধরা পড়েছে অপরাধী 'রাত জাগা পাখি'.... একটা প্যাঁচার ছবি দেওয়া প্রোফাইলের মালিক। ফেক প্রোফাইল। প্রথমে ফেসবুকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু হওয়া, বেশীরভাগ এইরকম মধ্যবয়সী নিঃসঙ্গ মহিলাই এর টার্গেট। তারপর প্রতিদিন চ্যাটে নানানরকম গল্প করে বিশ্বাস অর্জন করা, তারপর দু-একদিন অন্তরঙ্গ কথাবার্তা বলে ফোন নম্বর নেওয়া, হালকা রসিকতার ছলে ছোটখাটো সেক্স চ্যাট করা। আর তারপর ঝোপ বুঝে কোপ মারা, অর্থাৎ সেই মহিলার আর্থিক ও সামাজিক অবস্থান বুঝে তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করা। বিপদ বুঝে কোনো মহিলা তাকে ব্লক করে দিলে, তাদেরকে আবার অন্য অপরিচিত নাম্বার বা ফেসবুক আর মেসেঞ্জার একাউন্ট থেকে কানেক্ট করে আবার, ঠিক একইভাবে বিরক্ত করা টাকার দাবীতে। ছবিগুলো টার্গেটের ফেসবুক একাউন্ট থেকে নিয়ে সুপার ইম্পোজ করে এডিটিং করা সেসব ছবি। নগ্ন অশ্লীল কোনো ছবিতে টার্গেটের মুখটাকে শুধুমাত্র বসিয়ে দিয়ে, সুপার ইম্পোজ এডিটিং করা। একই ভাবে ভিডিও তৈরী করে টার্গেট করা মহিলাকে ব্ল্যাকমেইল করে দিনের পর দিন টাকা আদায় করা। এধরনের কিছুকিছু ঘটনা পুলিশের লালবাজার সাইবার ক্রাইম সেলে রিপোর্ট হলেও, ধরা পড়ে নি অপরাধীরা এতদিন। সুদীপ্তার আত্মহত্যার পরে, এই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে ঘটা কিছু অপরাধের অপরাধীকে পুলিশ ধরতে পারল ঠিকই, তাতে কিন্তু নির্মূল হয় নি এই জঘণ্যতম অশ্লীল অপরাধীরা, যারা অশ্লীলতার জালে ফাঁসিয়ে ফেলে সুদীপ্তার মতো সাদাসিধে মহিলাদের। আর তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তোবা লজ্জায় ভয়ে আতঙ্কে সুদীপ্তার মতোই মিথ্যা "অশ্লীলতার দায়" মাথায় নিয়ে আত্মহত্যার মতো চরমপথ বেছে নেয়।

*********

ফেসবুক ব্যবহারকারী সববয়সী মহিলাদের খুব সতর্ক থাকাটা আবশ্যিক। অচেনা অজানা এবং প্রোফাইলে কোনো মানুষের মুখের ছবি নেই, এমন একাউন্ট থেকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এলে অবশ্যই ভালো করে প্রোফাইল চেক না করে, মিউচুয়াল কমন ফ্রেণ্ড না থাকলে, সেই রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলে বিপদ না জানিয়েই আসতে পারে। সুতরাং সতর্কতার অভাবে হয়তো গল্পের সুদীপ্তার বা সুদীপ্তার মেয়ে শ্রেয়ার মতোই অনেক বড়ো দাম দিতে হতেই পারে।

আসলে এই অন্ধ প্রযুক্তিনির্ভরতা আজকাল এতটাই বেড়েছে যে, এই যান্ত্রিক দুনিয়ার বাইরেও যে একটা বাস্তব দুনিয়া রয়েছে, তা আমরা সবাই প্রায় ভুলতেই বসেছি। প্রযুক্তির এই ঘেরাটোপ থেকে নিজেদের মুক্ত করারও বিশেষ প্রয়োজন নিজের এবং নিজের সন্তান ও পরিবারের খুশী ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে। এবারের বিএইচইউ সোসিওলজির কনফারেন্সে এই বিষয়টিই উপস্থাপিত করবে, সোসিওলজির (সমাজবিদ্যার) অধ্যাপিকা, গল্পের শ্রেয়া।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy