GOUTAM KUMAR BHADURI

Romance Tragedy Classics

4.3  

GOUTAM KUMAR BHADURI

Romance Tragedy Classics

ভালোবাসার ঘর কান্নার ঘর

ভালোবাসার ঘর কান্নার ঘর

4 mins
1.3K



‘ তুমি একটু ছোঁবে আমাকে ? একবার ?’

অবাক হয়ে বললাম- ‘ কিন্তু তোমাদের হোটেলে তো সেটা অ্যালাওড নয়  ’।

‘ তা ঠিকই, তবু আমি তোমাকে অনুরোধ করছি – ছোঁবে একবার ? প্লিজ ’।

আমি জাপানে এসেছি একটা প্রজেক্টের কাজ নিয়ে। তিন বছর আছি এখানে।কোম্পানি বলেছে,যদি রাজি থাকি পরের প্রজেক্টটাও আমাকেই দেবে এখান থেকে শেষ করতে। আমাদের কাজটায় বাড়ি থেকে এত দূরে এক-দু বছরের বেশি কেউ থাকতেই চায়না। কিন্তু আমার সে তাড়া নেই। আমি কনসেন্ট দিয়ে রেখেছি, কোম্পানি চাইলে আরও তিন বছর থেকে যাব।আজই মেল করে দিয়েছি আমার ইয়েস অপশন।তার একটা কারণও অবশ্য আছে। সে আমার একান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু যে কারণটা সবার সামনেই বলে ফেলা যায় সে হল, এই জাপান জায়গাটা আমার ভারি পছন্দ। আমি সুযোগ পেলেই এখানকার যাবতীয় ঘুরে ঘুরে দেখি।সামান্য জাপানি আগেই শিখে নিয়েছিলাম। এখানে এই প্রায়  তিন বছরে অনেকটাই সরগর হয়েছি এদের ভাষাটায় । এদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাই দিব্যি ইংরেজির সঙ্গে জাপানি মিশিয়ে অনর্গল কথা বলি। বাংলা বলবার সুযোগ বলতে বাড়ির সঙ্গে  ফোনে, আর বন্ধুদের সঙ্গে ।সুযোগ পেলেই গল্প জুড়ে দিই সামান্য পরিচিতের সঙ্গেও। হোটেল কফিশপ এমনকি ফলের ফেরিওলাদের সঙ্গে  পর্যন্ত আমার ভাব হয়ে গেছে। এখানকার মানুষজনের কথা জানতে আমার ভালো লাগে। অনেকটা সেকারণেই আমার আজ এই হোটেলে ঢোকা।

জাপানি মেয়েটির নাম সাকোরাকো। ভালো বাংলা জানে।অবাকই হলাম ওর কথা শুনে , বিশেষ করে এমন পরিষ্কার উচ্চারণে একটি জাপানি মেয়ের মুখ থেকে নিজের মাতৃভাষা শুনতে পাব আমি একটু আগে পর্যন্তও ভাবিনি সেটা। বলল-‘ অ্যালাওড নয় সে আমি জানি। এই যে ভালবাসার ঘর ভাড়া নিয়েছ তুমি, এখানে আমি অনেকদিন ধরেই পুরুষদের সঙ্গ দিচ্ছি ।এদের হোটেলের রেজিস্টারে আমার নাম লিস্টেড আছে। আমার মতো অনেকেরই আছে সেটা, আমাদের কাজ আলাদা আলাদা। তবে না, এরা আমাকে খুব বেশি ডাকে না, এখানে সে রেওয়াজও নেই।আমিই দরকার বুঝে আসি।সে স্বাধীনতা আমার মত ক্যাজুয়াল কর্মীদের আছে ।

অবশ্য কাজ আছে কিনা খোঁজ নিয়ে তবেই আসতে হয়’।

মেয়েটির মুখে কেমন একটা মায়া মাখানো যেন ।মনে হল এ মুখটাকে বহুদিন চিনি আমি।

ব্যবধান রেখেই আমি ওর দিকে পাশ ফিরে শুলাম। আমার কৌতূহল ওকে ভরসা দিয়েছে টের পেলাম ওর চোখের তারায়।

-‘ ভাবছো আমার আবার দরকার কিসে, তাইনা? আছে ’।মেয়েটি নিজে থেকেই বলল কথাটা –‘ এখানে তোমায় সঙ্গ দিলে আমি যে অর্থ পাব সেটা আমার বাড়তি আয়, আমার সংসার এর খোঁজ নেবে না। জানতেও চাইবে না। সে টাকা আমি আমার নিজস্ব দরকারে ব্যবহার করব ।কী দরকার? হ্যাঁ সে টাকায় আমিও তোমার মতো ঘর ভাড়া নেব, হ্য়ত কালই ’।

‘ কিসের ঘর ’?

‘ কান্নার ঘর । সেও ভাড়া পাওয়া যায় এদেশে ,জানো তুমি? সেখানে তুমি প্রাণ ভরে কাঁদতে পারবে ’।

মেয়েটি ইচ্ছে করেই আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দিল , এটা ওদের প্রফেশনের শর্ত। কাস্টমার যারা তারা নিজের কথা বলবে এখানে এসে ,তাকে সঙ্গ দিতে হবে ।তারই সূত্রে কথা বলে তাকে খুশি রাখতে হবে, এটুকুই কাজ। স্পর্শরহিত দু ঘণ্টা চার ঘণ্টা -যে যত সময়ের জন্য ভাড়া নেয় ঘর আর কথা বলার সঙ্গী।

বললাম- ‘পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হোটেলের বাইরে বড়ো বড়ো করে লেখা পড়ে ভাবলাম ,যাই না ভেতরে, দেখে আসি কি আছে এমন। তাই এ ঘর বুক করেছি। রিসেপশন থেকে আমাকে ঘরভাড়ার শর্তগুলো বলে দেওয়া হয়েছে। আমি তাতে রীতিমতো সই করে এখানে ঢুকেছি। তাতে কি বলা আছে জানো? আছে, এখন থেকে দু’ঘণ্টার জন্য আমি এই ঘরের অধিকারী ।এখানে একজন নারী একই শয্যায় শুয়ে আমাকে সঙ্গ দেবে। তাকে আমি আমার সমস্ত কিছু বলতে পারব , কিন্তু তার নাম ছাড়া আমি আর কিছুই জানতে চাইব না। আর, মোটা মোটা অক্ষরে লেখা – কিছুতেই স্পর্শ করব না তাকে ’। 

মেয়েটি সামান্য হাসল।

-‘ জানি। এ’কাজে যোগ দেবার পর এতদিনে প্রায় একশ পুরুষ আমার পাশে শুয়েছে। অনর্গল কথা বলে গেছে তারা । সবই দুখের কথা তাদের জীবনের ।কিন্তু নিয়ম মেনে তারা কেউই আমাকে স্পর্শ করতে চায়নি । তারা বেশির ভাগই আমাদের জাপানের মানুষ,তবে পাঁচ সাতজন হয়ত অন্য দেশের পুরুষও পেয়েছি। অনেককে দেখেছি ,দুঘণ্টা চুপচাপ আমার পাশে শুয়ে থাকল ,আমাকে হয়ত একটি কথাও বলল না ,নিজের মনেই বিড়বিড় করে কীসব বলল। তারপর উঠে চলে গেল।এরকম একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম , তুমি তো একটিও কথা বললে না আমার সঙ্গে , আমার নামটি পর্যন্ত জানতে চাইলে না। সত্যি করে বলোত কেন এসেছিলে তুমি? কি জবাব দিয়েছিল জানো?

- কী

বলেছিল, ‘ খুঁজতে এসেছিলাম। ভালোবাসা ’।

-পেলে ?

উত্তরে বলেছিল ‘আমি জানি কোনদিনই তা পাবনা ।তাইতো বারবার খুঁজতে আসি,হেরে গিয়েও সুখ পাই যেন’।

আর যারা আমার পাশে শুয়ে সারাক্ষণ কথা বলে, তারাও আমার কাছে তাদের দুঃখের ডায়েরিটাই শুধু রেখে যায় ।তোমরা পুরুষরা কী সত্যিই দুঃখী বড়ো? এবং বিশ্বাস করো , এ পর্যন্ত কেউই প্রায় আমার বিষয়ে একটি কথাও জানতে চায়নি ।টাকা দিয়ে বুকিং করা হোটেলের কোথায় দেয়ালে চির ধরেছে, কোথায়

রং চটে গেছে –খদ্দেররা কখনও জানতে চায় তা? আমাকে নিয়ে তারা বলবেই বা কি’?

বললাম, ‘তুমি এমন সুন্দর বাংলা জানো ’?

সাকোরাকোর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

- ‘বহুদিন শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছি। আর্ট শিখতে গিয়েছিলাম। এক বাঙালি ছেলের প্রেমে পড়ে নিজের ভাষাটাও যেন ভুলতে বসেছিলাম।খুব মিষ্টি ভাষা তোমাদের ।ছেলেটি যখন ঘাসের বিছানায় বসে আমাকে তোমাদের বাউলগান আর কীর্তনের কথা বলত , যখন একটার পর একটা রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাত, আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম ওর মুখের দিকে।কী মধুর একেকটি শব্দ। মনে হত আমি যেন স্বর্গের কোনও ঝরনার তলায় বসে পৃথিবীর মধুরতম কথাগুলো প্রাণ ভরে শুনছি। ও বলত

-‘ তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছ নাকি আমাদের ভাষার প্রেমে’?

এমনি করে চার বছর চলল আমার পড়াশোনা। ভাবছো ,চলে এলাম কেন? সে অনেক কথা। প্লিজ জানতে চেয়োনা। জানো ,এই যে ভালবাসার ঘরে শুয়ে আমি তোমাকে সঙ্গ দিচ্ছি এই উপার্জনে আমি কী করি?

বিপ্রদাসের কথা ভেবে আমি পাশের হোটেলেই কান্নার ঘর ভাড়া করি, সেখানে গিয়ে সপ্তাহের একটা দিন খুব কাঁদি ’।

আমি কোনও কথা বললাম না ।

অস্পষ্ট আলোয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সাকোরাকো বলল-‘ তোমাকে একটা কথা বলব , রাখবে?

-বলো ।

আমি কাছেই একটা অফিসে চাকরি করি।সে টাকায় আমাদের সংসার চলে। আমি পরিবারকে বঞ্চিত না করতে চেয়ে বাড়তি আয়ের এই পথটা বেছে নিয়েছি।আজ আমি কান্নার ঘরই ভাড়া করতে এসেছিলাম নিজের জন্য।রিসেপশনে এসে দেখলাম বুকিং খাতায় অ্যাডভান্স বুকিং তোমার-বিপ্রদাস ব্যানার্জি, ফ্রম ইন্ডিয়া। বিপ্রদাস ? ভারত থেকে ! কান্নার ঘর আর নেয়া হলনা, নিজেই খদ্দের বেছে নিলাম।তোমার বুকিংএর টাকাটা আমি ফেরত দিতে চাই’ । হেসে বললাম , ‘ থাকনা সেকথা ’।

‘ তোমার হাতটা একবার রাখবে আমার হাতের ওপর, বিপ্রদাস ?’ 

 



Rate this content
Log in

More bengali story from GOUTAM KUMAR BHADURI

Similar bengali story from Romance