Sandip Chakraborty

Romance Tragedy Classics

4.3  

Sandip Chakraborty

Romance Tragedy Classics

বাসে

বাসে

5 mins
1.5K


মেয়েটি রোজ বাসে জানলার ধারে সিট পেয়ে যায়। ওর পাশের সিটেও কেউ না কেউ বসে পড়ে। আমি রোজই বাড়ি থেকে সময়মতো বেরোই কিন্তু সময়ে পৌঁছতে পারি না । আমার দেরি হয়ে যায়। বাসে উঠে দেখি অন্য কেউ মেয়েটির পাশে বসে আছে।

মিথ্যে বলব না, আমার প্রচণ্ড ঈর্ষা হয়। খুন চেপে যায় মাথায়। মনে হয় ওই গুঁফো লোকটাকে যদি খুন করতে পারতাম--- মেয়েটির পাশে বসার কী অধিকার আছে ওর! আমি ওকে ভালোবাসি। ওর জন্য জীবন দিতে পারি। পৃথিবীর সব সুখ ওকে উপহার দিতে পারি। ও চাইলে ওর জন্য বিনা প্রতিবাদে মরেও যেতে পারি।

 শুধু এই কথাগুলো ওর কাছে গিয়ে বলতে পারি না। অনেকরকম প্ল্যান করি। মনে সাহস আনার জন্য বাসস্ট্যান্ডে আসার পথে শনিমন্দিরে প্রণাম করি। বাসে উঠে বসার জায়গা পেলেও মুহূর্তকাল দাঁড়াই। অপেক্ষা করি যদি ও আমার দিকে তাকায়। তাকায় না। জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকে। হতোদ্যম হয়ে বসে পড়ি। হতাশ লাগে। আজও হল না। তবে হবে। একদিন আমি নিশ্চয়ই পারব। পজিটিভ থাকার জন্য আমি ক্রমাগত বলে যাই, পারব পারব পারব। মন খুশিতে ভরে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর মুখ। পানপাতা গড়নের ছোট্ট মুখ। চোখনাক ঠোঁট যেন তুলিতে আঁকা। এক পিঠ খোলা চুল। হলুদ বোধহয় ওর প্রিয় রং। বেশিরভাগ সময় হলুদ রংয়ের ড্রেস পরে। খুব পবিত্র লাগে। যেন স্বর্গের কোনও দেবী আমার জন্য নেমে এসেছেন। বিয়ের পর ওকে কেমন দেখতে হবে সেই কল্পনায় আমি বুঁদ হয়ে যাই। কিন্তু আমার কল্পনা বড়ো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। হীনমন্যতা গ্রাস করে আমাকে। আমি তো ওর মতো সুন্দর নই। চাকরিটাও সাদামাটা। আমাকে কি ওর পছন্দ হবে? তা ছাড়া---

 একদিন গোপনে ওর ছবি তুললাম। সেদিন আকাশ মেঘলা। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। ও বাসের জানলা বন্ধ করেনি। ওর চুলে জলের কণা। আমার তোলা ছবিতেও রয়ে গেল বৃষ্টির দাগ।

 বাড়িতে দিদি আমার বন্ধু। ওকে সব কথা বলি। দিদি একটু সেকেলে টাইপ। ছবি দেখে বলল, মেয়েটা দারুণ সুন্দর তো। সিঁদুর পরলে চোখ ফেরাতে পারবি না।

 কথাটা আমার মনের কথা। আমিও তো সিঁদুরের আভায় ঈষৎ লাল হয়ে থাকা মুখটা সবসময় দেখতে পাই। মনে মনে আদর করি। আমার ঠোঁট নেমে আসে ওর ঠোঁটে। কিন্তু দিদি কথাটা এমন আকস্মিক ভাবে বলল যে আমি কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলাম না। অপ্রস্তুত ভাবটা কেটে যাওয়ার পর দিদির দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখের ভাষা বদলে গেছে। যেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে মারাত্মক কোনও অপরাধবোধে ভুগছে ও। কিংবা, নিষ্ঠুর কোনও বাস্তবতার আঘাতে চুরমার হয়ে গেছে ওর ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস। আমি তো অবাক। কী হল! কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই ও বলল, এসব এখন থাক না পুলু। এখন বরং চাকরিটা মন দিয়ে কর। দু'চার বছর পর না হয় এসব কথা ভাববি।

 তুই খেপেছিস! ওর মতো মেয়ে এতদিন অপেক্ষা করবে? আমাকে যা করার দু'চার দিনের মধ্যে করতে হবে।

 কথাটা বলা সহজ কিন্তু করা কঠিন। দু'চার দিন ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। চিঠি লেখার কথা ভাবলাম। প্রেমপত্র যাকে বলে আর কী! বাংলাটা আমি ভালোই লিখি। কিন্তু চিঠি লিখে পাঠাব কোথায়? মেয়েটির ঠিকানাই তো জানি না। এসএমএস বা ফোন করার ভাবনাও বাতিল হল একই কারণে। ফোন নাম্বার জানি না। মানুষের কাছে যাওয়া এত কঠিন কেই বা জানত! কিন্তু কেউ কেউ তো যেতে পারে। আমার অনেক বন্ধুই তো প্রেম করে। ওরা কীভাবে ভালোবাসার কথা গার্ল ফ্রেন্ডকে বলেছে সেটা ওদের কাছ থেকে জেনে নিলে হয় না?

 প্রথমে দিদিকে বললাম। নীলু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বেপরোয়া টাইপের ছেলে। বছরখানেক হয়ে গেল প্রেম করছে। ও নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু আমার পরিকল্পনা শুনে দিদি রেগে গেল, একদম না। তুই কী আরম্ভ করেছিস বল তো! এই নিয়ে তুই কোনও কথা কাউকে বলবি না।

 কিন্তু কেন?

 কেন! তোর লজ্জা করে না পুলু? এই পর্যন্ত বলে দিদি চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর আবার বলল, ওই মেয়ে তোকে ভালোবাসে না। আগ বাড়িয়ে কিছু বলে মিছিমিছি দুঃখ পাবার কী দরকার!

 ও আমাকে ভালোবাসে কিনা আমি জানি না। হয়তো বাসে না। কিন্তু আমি তো ভালোবাসি। সেটা বললে ও দুঃখ দেবে কেন? বেশ অধৈর্য হয়ে বললাম।

 কারণ তুই আর পাঁচজনের মতো নয়। আলাদা।

আমি কীসে আলাদা দিদি?

 দিদি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কীসে আলাদা তাও তুই ভুলে গেছিস, তাই না? আয় আমার সঙ্গে। বলে দিদি আমার হাত ধরে টানতে টানতে পাশের ঘরে নিয়ে গেল। তারপর স্টিলের আলমারির গা-আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, এবার নিজের চোখে দ্যাখ কীসে তুই আলাদা।

 এই আয়নার কাছে আমি বড়ো একটা আসি না। আমার দাড়ি কামানো চুল আঁচড়ানো সব ছোট আয়নায়। যাতে শুধু মুখ দেখা যায়। অনেকদিন পর নিজেকে আপাদমস্তক দেখলাম। দেখে চমকে উঠলাম বলা ভালো। এমনিতে সব ঠিকই আছে। শুধু ডান পা'টা হাঁটুর পর থেকে নেই। আর ডানদিকের ব্যালান্স ঠিক রাখার জন্য একটা ক্রাচ শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে।

 প্রতিবিম্বের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে ক্রাচটা পড়ে গেল। আমিও পড়ে যাচ্ছিলাম। দিদি আমাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিল। জীবনে এত অবাক আগে কখনও হইনি। ভালোবাসা কি সব অসম্পূর্ণতা ভুলিয়ে দেয়? দেয় নিশ্চয়ই। নয়তো আমি কী করে সব ভুলে গেলাম! প্রেমে পড়ার পর থেকে আমি কিছুই মনে রাখিনি। সাত বছর বয়েসে সেই অ্যাক্সিডেন্ট--ডান পা হাঁটুর পর থেকে বাদ যাওয়া--আমি সব ভুলে গেছিলাম। ভুলিয়ে দিয়েছিল ও। বাসের জানলার ধারে বসা ওই মেয়েটা।

ভাগ্যিস দিদি আমাকে সব কথা আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ বুকের গভীর থেকে একটা কান্না উঠে এসে আমার ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিল। বলতে ইচ্ছে করল, কেন মনে করিয়ে দিলি দিদি? কিন্তু বললাম না। দিদিরা যখন তাদের আকাশ ছুঁতে চাওয়া ভাইকে ক্রাচের কথা মনে করিয়ে দেয় তখন তাদের যন্ত্রণার কোনও সীমা থাকে না। আমি জানি দিদি এখন পাশের ঘরে। হয়তো কাঁদছে। কিংবা ঘর অন্ধকার করে একা বসে আছে।

 আমি চুপি চুপি বারান্দায় গেলাম। চমৎকার চাঁদ উঠেছে আজ। আকাশে অজস্র তারা। অদ্ভুত সুন্দর রাত। আমার খুব ভালো লাগছিল। আমি ক্রমশ ভেসে যাচ্ছিলাম। হয়তো অনেকদূর ভেসে যেতাম। ফিরে আসার কোনও ইচ্ছেই আমার ছিল না। কিন্তু সম্বিত ফিরল পরিচিত স্পর্শে। দিদি আবার আমায় ফিরিয়ে এনে বলল, আমাদের যখন টাকা হবে তখন তোকে নিয়ে আমি জয়পুরে যাব। শুনেছি ওখানে রবারের পা পাওয়া যায়। দেখবি, তখন আর তোকে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে হবে না।

 মনে মনে বললাম, ক্রাচ শরীরের অসম্পূর্ণতা দেখিয়ে দেয়। আর নকল পা সেটা শুধু ঢেকে রাখে। বদলাতে পারে না। কিন্তু এ কথা দিদিকে বলা যায় না। ও যা ভাবছে ভাবুক। যে স্বপ্ন দেখছে দেখুক। আমি বরং অন্য কিছু দেখি। চাঁদের ওপর দিয়ে এক টুকরো মেঘ ভেসে যাচ্ছিল। মনে হল পানপাতা গড়নের একটা মুখ পিছনে ফেলে ক্রাচের শব্দটা দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

 শব্দটা বড়ো আপন। ওইটুকু শুনলেই বোঝা যায় আমি আছি। একটা অসম্পূর্ণতা আমাকে মুছে ফেলতে পারেনি।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance