নীল রংয়ের সাঁকো/৭
নীল রংয়ের সাঁকো/৭
নীল রংয়ের সাঁকো/৭
সন্দীপ চক্রবর্তী
মুড়ি আর নারকেল দিয়ে শুরু হল আমার পলাতক জীবন। সাধারণ বাঙালি খাবারে যে এমন অসামান্য স্বাদ থাকতে পারে আমি আগে তেমন করে বুঝিনি। বসু পরিবারে জলখাবার হিসেবে মুড়ি নারকেলের কথা কেউ কখনও ভাবে না। ছোটবেলা থেকে টোস্ট, স্যান্ডউইচ, নানারকম ফল আর ডিম খেয়ে আসছি। বাঙালি খাবার বলতে লুচি আলুর তরকারি। অর্থাৎ ইংরেজিয়ানা হোক বা বাঙালিয়ানা--অভিজাত না হয়ে তার উপায় নেই। টাকাপয়সা আর স্টেটাসে মোড়া আভিজাত্যের মোহে আকণ্ঠ ডুবে থেকে আমরা ভুলে যাই আজ যাকে জীবনের সারাৎসার ভাবছি কাল তাকেই অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হবে। ফিরতে ইচ্ছা করবে শেকড়ে। মাটির কাছে। কিন্তু শেকড় কোথায় সেটাই যদি জানা না থাকে তা হলে আমি কোথায় ফিরব? বেলজিয়াম কাঁচের দামি আয়নায় নিজের কপর্দকহীন নিঃস্ব মুখ দেখার সাহস আমার নেই। টাকা না থাকে থাক আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে যেন আমার আমৃত্যু ভালো লাগে। জীবনের কাছে এর থেকে বেশি আর আমার কিছু চাওয়ার নেই।
গল্প আর খাওয়া একই সঙ্গে চলছিল। গল্প বলতে
বসুবাড়ির গল্প। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি জানার পর কে কী বলল...এইসব। গল্পের মধ্যেই ফুলমণি চা দিয়ে গেল। আমাকে নিয়ে মেয়েটার খুব কৌতূহল। দেখে আর মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে হাসে। ফাগুন চোখ পাকিয়ে বলল, হাসছিস কেন রে!
এই বাবুটো খুব সুইন্দর! কথাটা বলেই ফুলমণি লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
বাবু টো খুব সুইন্দর! দাঁড়া তোর বাবাকে বলছি।
ফুলমণি ঠাট্টা বোঝে। জানে ফাগুন রাগ করে কথাটা বলেনি। তাই অবাক হয়ে বলল, অ মা! খারাপটা কী বইললাম গ যে তুমি বাপকে বল্যে দেব্যে?
আমার বেশ মজা লাগছিল। বললাম, তুমি খারাপ কিচ্ছু বলোনি ফুলমণি। তবে একটা কথা, আমি বাবু নই। দাদা। আজ থেকে আমায় দাদা বলবে, কেমন?
ফুলমণি মুখ থেকে আঁচল সরিয়ে সহজ ভঙ্গিতে হাসল, দাদা বুলব? সইত্যি দাদা বুলব?
সত্যি দাদা বলবে।
বোধহয় মনে মনে বারকয়েক দাদা শব্দটা বলে রিহার্সাল দিল ফুলমণি। তারপর বলল, তুমি হিথ্যায় অখন থাইকবে ত দাদা?
থাকব।
আমি যে সমাজ থেকে এসেছি সেখানে সম্পর্ক জিনিসটা খুবই ঠুনকো। স্বার্থে আঘাত লাগলে ভেঙে যায়। কিন্তু মৃগীচামির এই টালির চালের ঘরে যারা থাকেন তাদের কাছে সম্পর্ক তত ফেলনা নয়। আমি থাকব শুনে ফুলমণির চোখে যে খুশির ছায়াটি পড়ল ঠিক সেরকমটি আমি কলকাতার মতো বড়ো শহরে পেতাম না। বরং বসুবাড়ির টাকাপয়সা আর স্টেটাসের কথা চিন্তা করে ফুলমণির বয়েসি কলকাতার মেয়েরা আমার কথায় দুঃখই পেত। কারণ ভাইবোনের সম্পর্ক ভাঙিয়ে ব্যাঙ্কব্যালান্সের দখল নেওয়া যায় না।
ফাগুন বলল, মেয়েটা খুব ভালো। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। আমি চেয়েছিলাম কলেজে পড়ুক। কিন্তু ওর বাবা-মা রাজি নয়।
রাজি নয় কেন?
মেয়ে কলেজে পড়লে পাত্র পাওয়া যাবে না, তাই। শবরদের ছেলেরা তো পড়াশোনা বেশি করতে পারে না।
ইচ্ছে হল বলি, ঠিক আছে, আমি ওর বাবার সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু মনের সায় পেলাম না। মনে হল আমি নিজেকে একটু বেশিই বীরপুরুষ ভাবছি। বাড়ির বেড়ি ভেঙে পালিয়ে এসেছি বলে নিজেকে লার্জার দ্যান লাইফ ভাবার কোনও কারণ নেই। তা ছাড়া, ফাগুনই-বা কী ভাববে?
ফাগুন বলল, ফুলমণির কথা তো হল। এবার তোমার কথা বলো। কী প্ল্যান তোমার?
প্ল্যান মানে?
আরে বাবা বেড়াবার প্ল্যান। মৃগীচামিতে দেখার বিশেষ কিছু নেই। তবে অযোধ্যা পাহাড়ে যেতে পারো।
আমি এখানে বেড়াতে আসিনি ফাগুন। আমি নিজেকে জানতে চাই। এতদিন আমার কোনও ভূমিকা ছিল না। আমি যে একটা মানুষ, জীবনকে যে আমিও কিছু দিতে
পারি--এই বোধটাই এতদিন আমার তৈরি হয়নি। বাবা-মা ওইভাবে মারা যাওয়ার পর আমি একটা অন্ধকার কুয়োয় পড়ে গিয়েছিলাম। শচীজেঠুর চিকিৎসায় আমি কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু অসুখ সেরে যাওয়া আর অসুখ ভালো হওয়ার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম তফাৎ আছে। শচীজেঠু আমাকে সারিয়ে তুলেছেন কিন্তু ভালো করতে পারেননি। সেটা করতে পারো তুমি।
ফাগুন অবাক হল, আমি! কীভাবে?
আমাকে তোমার কাজের সঙ্গী করে নিয়ে। মানুষের কাছে না গেলে আমি কীভাবে নিজেকে চিনব? আর কীভাবে আমি মানুষের কাছে যাব সেটা একমাত্র তুমিই বলতে পারো।
আমরা এখানে কী কাজ করি, তুমি তো জানোই না অনি। আগে আমাদের কাজ দেখো। যদি তোমার ভালো লাগে তখন আমরা তার পরেরটা ডিসকাস করব।
বুঝলাম ফাগুন এখনও আমায় পুরোপুরি ভরসা করতে পারছে না। হয়তো ভাবছে বড়োলোকের ছেলে হঠাৎ খেয়ালের বশে চলে এসেছে। শখ মিটে গেলেই দু'দিন পর পালাই-পালাই করবে। মনে মনে বললাম, আমাকে ভুল
বোঝার জন্য তোমাকে আমি দোষ দেব না ফাগুন। বড়োলোকের ছেলেরা তো চিরকাল এমনটাই করেছে। নিজের শখ মেটাতে সহৃদয়তার মুখোশ পরে স্বপ্ন দেদার দেখিয়েছে। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের জন্য অপেক্ষা না করে একটা কোনও অজুহাত খুঁজে নিয়ে পালিয়ে যায় নিরুপদ্রব শহুরে জীবনে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো ফাগুন, আমার জাত আলাদা। কলকাতায় আমার অনেকগুলো বাড়ি আছে ঠিকই কিন্তু কোনও শেকড় নেই। বিরাট বড়োলোকের ছেলে হয়েও আমি নিঃস্ব। কোথায় ফিরব বলো? স্থূল কিছু ভোগ ছাড়া যেখানে কিছুই নেই সেখানে ফিরে গিয়ে আমি আর একবার কুয়োর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে চাই না।
এই কথাগুলোই ঘুরেফিরে এসে আমাকে মধ্যরাত পর্যন্ত জাগিয়ে রাখল। মৃগীচামিতে আজ আমার প্রথম রাত। পাশের ঘরে ফাগুন নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ আমার চোখের সামনে ফুলমণির মুখ। মাথায় অজস্র পরিকল্পনা। ফুলমণির দাদা হলেই শুধু চলবে না। আমাকে ওর বাবা-মা'রও বিশ্বাসভাজন হতে হবে। তবেই ওরা আমার কথা ওরা বিশ্বাস করবেন। ফুলমণি কলেজে ভর্তি হবে। তারপর ইউনিভার্সিটিতে। ফুলমণি লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ালেই গ্রামের অন্য মেয়েরা এগিয়ে আসবে। কিন্তু ফাগুন কি এসব আমায় করতে
দেবে? মাথায় কেমন একটা জিদ চেপে গেল। মনে হল ফাগুন যদি রাজি না হয় তা হলে আমি এখান থেকেও পালাব। অন্য কোথাও অন্য কোনও ফুলমণিকে খুঁজে নেব। কিন্তু উত্তেজনা থিতিয়ে যাওয়ার পর বুঝলাম, তা হয় না। যদি ফুলমণিকে বদলাতে হয়, এই গ্রামকে বদলাতে হয় তা হলে আমায় ফাগুনকেও বদলাতে হবে। ফাগুন যদি দরজা না খোলে তা হলে আমাকে দরজার সামনে দিনের পর দিন বসে থাকতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সেই দিনটার জন্য যেদিন ফাগুন নিজেই দরজা খুলে আমাকে ভেতরে ডাকবে।
ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের শব্দে। এখানকার সকাল দেখব বলে কাল রাতে ছ'টার সময় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখি ঘরের সামনে একফালি ফাঁকা জায়গাটায় পাখিদের হাট বসে গেছে। কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। বেশিরভাগ পাখিকেই আমি চিনি না। হঠাৎ নতুন মানুষ দেখে অবাক হয়ে আমাকে দেখছে। কথা বলতে পারলে নির্ঘাৎ বলত, এট্টা কে বটে! এরেক তো আগে দেখি লাই। নিজের রসিকতায় বেশ মজা পেলাম। মৃগীচামির ভাষা মাত্র কয়েক ঘন্টাতেই কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছি।
ঠাণ্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। পাখিদের পাশ কাটিয়ে
স্কুলের কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেল ফুলমণির সঙ্গে। ওর হাতে কালকের মতো ঝাঁটা। কিন্তু আজ ও একজনের সঙ্গে কথা বলছে। কে হতে পারে লোকটা? পাথরে কোঁদা চেহারা। এমন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডাতেও পরনে একটা খাটো ধুতি আর ছিটের জামা ছাড়া আর কিছু নেই। বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে বলেই মনে হয়। ফুলমণি আমাকে দেখে হাসল, জাড়কালে ইত্ত সোকালে ঘুম থিক্যা উইঠলেক ক্যান? তুমার জাড় লাগেক লাই?
জাড় মানে আন্দাজে বুঝলাম শীত। ফুলমণির সঙ্গের লোকটিকে দেখিয়ে বললাম, ঘর থেকে যখন বেরোলাম তখন লাগছিল। কিন্তু ওকে দেখার পর আর লাগছে না।
ফুলমণি হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ল, ই তো আমার বাপ বটে। ইখানকার মানুষ।
এই লোকটা ফুলমণির বাবা! চেহারায় এত মিল দেখে আমার বোঝা উচিত ছিল। হঠাৎ মাথায় একটা আইডিয়া এল। এদের বিশ্বাস অর্জন করতে হলে আগে নিজেকে গজদন্তমিনার থেকে নামিয়ে আনতে হবে। বাবু সেজে বসে থাকলে ওদের কাছাকাছি আমি কোনওদিনই যেতে পারব না। ফুলমণিকে আমি বোন বলেছি। সেই হিসেবে মানুষটা আমারও বাবারই মতো। বাবার মতো একজন
মানুষের সঙ্গে আমি যেরকম ব্যবহার করি, এর সঙ্গেও আমার তাই করা উচিত। কিন্তু কী করা উচিত? ভাবতে ভাবতে ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন আমি ক্লাস ফোরে। বাবা শিখিয়েছিল বিজয়া দশমীর পর বড়োদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়। সেবার বিজয়া দশমীর পরের দিন বাবা একটা মিউজিক কনফারেন্সে যোগ দেবার জন্য বেনারস যাবে। বাবার ড্রাইভার রফিক চাচা জিনিসপত্র ঘর থেকে বের করে গাড়িতে তুলছে। এমন সময় আমি রফিক চাচাকে ঢিপ করে প্রণাম করে ফেললাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষটা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার পর বলল, এইডা কী করলেন খোকাবাবু? হিন্দু হইয়া মোছলমানের পায়ে হাত দিলেন? বাবা কাছেই ছিল। বলল, ওকে আশীর্বাদ করো রফিক। ও ভুল কিছু করেনি। হিন্দুদের কাছে বয়েসে বড়ো মানেই গুরুজন। তোমাকে ও চাচা বলে। সেই হিসেবে তুমি ওর গুরুজন।
কিন্তু প্রণাম করার জন্য আমি নীচু হতেই ফুলমণির বাবা ছিটকে সরে গেলেন, এট্টা ঠিক না বটে। আমরা শবর। নীচু জাত। আপনার মুতন বড়ো ঘরের বিট্টা পেন্নাম করলেক আমার পাপ হবেক।
আপনি ফুলমণির বাবা। আমার গুরুজন। আপনাকে
প্রণাম না করলে আমার পাপ হবে কাকাবাবু।
আমাকে কাক্কাবাবু বলছেক রে ফুলি!
দেখলাম ফুলমণি শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখও অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়ার আনন্দে ছলছল করছে। কিন্তু আমার মনে চাপা অস্বস্তি। প্রণাম করলেও মানুষটার কাছে নত হতে পারলাম কি? উদ্দেশ্য পূরণের জন্য ওদের সঙ্গে ছলনা করলাম না তো? ফুলমণির বাবা এখন হাসি-হাসি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুলমণিও হাসছে। দূরে খুট করে একটা শব্দ হল। বোধহয় ফাগুন দরজা খুলল। এখনই ফাগুনের চোখে পড়তে চাই না। বললাম, তোমরা গল্প করো। আমি চট করে গ্রামটা একবার দেখে আসি।
(ক্রমশ)