Sandip Chakraborty

Abstract Romance Others

3  

Sandip Chakraborty

Abstract Romance Others

নীল রংয়ের সাঁকো /১

নীল রংয়ের সাঁকো /১

5 mins
265



আজ আমি ভালো আছি। ঘুম থেকে উঠেছি সাতটা নাগাদ। ব্রেকফাস্টে মঞ্জুদি টোস্ট বানিয়ে দিয়েছিল। আমাদের বাড়িতে কাজ করলে কী হয়, মঞ্জুদি আমাকে মায়ের মতো যত্ন করে। জানে টোস্ট খেতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু মার্জারিন আমার ভালো লাগে না। আমার পছন্দ বাটার। আমুল বাটার। সেই যে ছোট্ট মেয়েটা দু'দিকে দুটো বেণী ঝুলিয়ে নেচে নেচে বলত, আটারলি বাটারলি ডেলিসিয়াস--চোখ বুজলে আমি এখনও দেখতে পাই মেয়েটাকে। নিরেট অন্ধকারে মেয়েটা কী যেন খুঁজছে। কিন্তু কী খুঁজছে আমি জানি না। কারণ মেয়েটা কিছু খুঁজে পাবার আগেই রোজ আমার ঘুম ভেঙে যায়। কোনওদিন যদি ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয় তা হলে আমি ঠিক বুঝতে পারব, মেয়েটা কী চায়!


 স্বপ্নের কথায় মনে পড়ে গেল। ইদানীং আমার আর হতাশার অন্ধকার-অন্ধকার স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে না। দেখিও না। তিন বছর আগে মনটা যখন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল তখন একগুচ্ছ বিশ্রী কালো রংয়ের স্বপ্ন দেখতাম। সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকতাম বলেই বোধহয় রাতে ঘুমের মধ্যে নেমে আসত একটা জনমানবহীন রাস্তা। দেখতাম আমি একটা চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে থমথম করছে অন্ধকার। স্ট্রিট লাইটের আলো মাটিতে নেমে আসার পরিবর্তে শূন্যেই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আমি ভয়ে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে ভাবছি, কোনদিকে যাব। কে আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে? এখন অবশ্য এসব স্বপ্ন আর দেখি না। কারণ এখন বিশ্বাস করতে পারি একদিন রাস্তা আমি নিজেই খুঁজে নিতে পারব। কাউকে আমার দরকার হবে না।


 ও মা তুমি এখানে! তোমাকে ঘরে দেখতে না পেয়ে আমি সারা বাড়ি খুঁজে মরছি। এই নাও তোমার কফি। দেখো, আজ যেন আবার কালকের মতো ঠাণ্ডা করে ফেলো না।


 কফিতে চুমুক দিয়ে মন ভরল না। স্বাদটা কেমন যেন তিতো। আমি জানি মঞ্জুদি খুব ভালো কফি বানায়। আজও হয়তো ভালোই বানিয়েছে। কিন্তু একটা বিরক্তি আমায় ভালো স্বাদটা পেতে দিচ্ছে না। কথাটা এখনই না বললে সারাদিন আমাকে জ্বালিয়ে মারবে।


 আচ্ছা মঞ্জুদি, তোমরা এখনও আমায় ছেলেমানুষ

ভাবো কেন বলো তো? ভুলে যেয়ো না আমার আটাশ বছর বয়েস। তিন বছর আগে আমার একটা অসুখ করেছিল বলে কি আমি সারাজীবন অসুস্থই থাকব?


 রাগ করলে নাকি! আমার কী দোষ বলো? ডাক্তারবাবু যেমন বলেন আমি তো তাই করি।


 ডাক্তারবাবু মানে বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট শচীদুলাল রায়। বাবার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমার শচীজেঠু। ওরই চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়েছি। কিন্তু শচীজেঠু কি সত্যিই আমার সঙ্গে ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করতে বলেন? কই, জেঠু নিজে তো তা করেন না! এই তো পরশু আমি ওর ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, ভবিষ্যত নিয়ে কী ভাবছিস অনি? এত বড়ো প্রপার্টি তোকেই তো সব দেখাশোনা করতে হবে। ব্যবসাপত্র বিক্রি হয়ে গেছে তাই ব্যবসা হয়তো দেখতে হবে না। কিন্তু জমি বাড়ি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের জমানো টাকা মিলিয়ে তোদের বিশাল প্রপার্টি। এসব নিয়ে এবার সিরিয়াসলি ভাব।


 শচীজেঠু যদি আমাকে ছেলেমানুষ বা পাগল ভাবতেন তা হলে কি প্রপার্টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে বলতেন?

ছেলেমানুষেরা কি ভাবতে পারে? একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেল। কিন্তু এসব কথা মঞ্জুদিকে বলে কোনও লাভ নেই। প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞাসা করলাম, মালি এসে গেছে কি না জানো?


 এসেছে তো। যাবে? রতনদাকে আসতে বলি? তোমাকে নিয়ে যাবে।


 কাউকে আসতে হবে না। আমি একাই যেতে পারব।


 সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে সোজা বাগানে চলে গেলাম। আমাদের পুরনো মালি তারকনাথ মারা গেছে। তার জায়গায় শঙ্কর বলে একজনকে রাখা হয়েছে। সাধারণত এ বাড়ির কর্মচারীরা সবাই বাড়িতেই থাকে। আমার প্রপিতামহ অমরনাথ বসুর আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। কিন্তু শঙ্কর এ বাড়িতে থাকে না। সকালে এসে বিকেলে চলে যায়। ওর বাবা-মা দু'জনেই অসুস্থ। বাবা-মা'কে একলা রেখে ওর পক্ষে এখানে এসে থাকা সম্ভব নয়। কথাটা জানার পর আমি আর জোর করিনি। কিন্তু এই ব্যতিক্রম আমার ভালোও লাগেনি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় বলি, বাবা-মা'কে নিয়েই তুমি এখানে চলে এসো। মালির ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। শূন্যতা আমার ভালো লাগে না শঙ্কর। আমার বাবা-মা নেই।

আত্মীয়স্বজন নেই। বন্ধু নেই। তোমরাই তো আমার আপনজন। আমি সারাদিন তোমাদের সঙ্গে কথা বলব। তোমাদের কথা শুনব। আমার জীবনে জেলখানার এই স্টিরিওটাইপটা আমি এবার ভাঙতে চাই। তারপর একদিন এ বাড়ির বেড়ি খুলে যেখানে কোনও বেড়ি নেই সেখানে চলে যেতে চাই।


 রতনকাকা আমায় দেখতে পেয়েছিল। হাঁ হাঁ করে দৌড়ে এসে বলল, তুমি একা ওপর থেকে নামলে কেন? মঞ্জুকে দিয়ে খবর দিলে তো আমি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসতে পারতাম।


 শঙ্কর কোথায় রতনকাকা?


 ওই তো---


 শঙ্কর গোলাপগাছে জল দিচ্ছিল। আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি ক্রিসেনথিমাম চেনো শঙ্কর?


  আজ্ঞে না বাবু।


  তোমার চেনা লোক আছে যে এ ব্যাপারে খোঁজখবর রাখে? 


  লোক আছে। আমার ভগ্নীপোত। শিয়ালদায় একটা নার্সারিতে কাজ করে। ও এসব জানে।


 তুমি আজ এখান থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে শিয়ালদায় চলে যাও। সব জেনে কাল আমাকে এসে বলবে।


 ক্রিসেনথিমাম। আমার খুব প্রিয় ফুল। ছোটবেলায় একটা ছবির বইতে দেখেছিলাম। তখন থেকেই আমার মনে হত, আমাদের বাগানে এত রকমের ফুল ফোটে ক্রিসেনথিমাম কেন ফোটে না! একদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম। বাবা বলল, ও তো বিলিতি ফুল। ঠিক আছে তোর যখন এত পছন্দ তারককে বলব। কিন্তু বাবা বলেনি। আমি অনেকবার মনে করিয়ে দিয়েছি। বাবা ওই একই কথা বলেছে, বলব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলেনি। কেন বলেনি কে জানে! ক্রিসেনথিমাম বিদেশী বলে? বাবার তো কোনও ছুঁতমার্গ ছিল না। আমাদের বাগানে লিলি আছে। বোয়েগনভেলিয়া আছে। ড্যাফোডিল আছে। শুধু ক্রিসেনথিমাম নেই। আজ বাগানে আসা মাত্র সেই না-থাকার কথা মনে পড়ে গেল। দেখা যাক শঙ্কর কোনও খবর আনতে পারে কি না!


  অনিবাবাকে এখনই পাঠিয়ে দাও রতনদা। ল্যান্ডলাইনে ফোন আছে।


 আমার ফোন? তাও আবার ল্যান্ডলাইনে? কে করতে পারে? যারই হোক, আমার কোনও কৌতূহল নেই। তাড়াও না। ধীরেসুস্থে ওপরে গেলাম। বটল গ্রিন রংয়ের টেবিল কভারে সাদা রিসিভারটা হাত-পা ছড়িয়ে রানির মতো অপেক্ষা করছে। হ্যালো বলতেই ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল শচীজেঠুর গলা, আজ বিকেলে একবার ক্লিনিকে চলে আয়। অনেকদিন তোর সঙ্গে কথা হয়নি।


 এই তো পরশুদিন গেলাম। এরই মধ্যে ভুলে গেলে!


 না রে ভুলিনি। একটা অন্য বিষয়ে কথা বলব।


 ঠিক আছে। যাব।


 এতক্ষণে ল্যান্ডলাইনে ফোন আসার রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার হল। আমার একলা বাগানে যাওয়ার বৃত্তান্ত রিপোর্ট করার জন্য শচীজেঠুকে ফোনটা করেছিল মঞ্জুদি। সব শুনে জেঠু আমাকে ডেকে দিতে বলে।


  আজ সকাল থেকে আমার মন গেরোবাজ পায়রার মতো আকাশে সাঁই সাঁই করে উড়ছিল। হঠাৎ লাট খেয়ে কৌটোয় ঢুকে পড়ল। মঞ্জুদির মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ মাঝে মাঝে আমার হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয় এরা বোধহয় আমাকে পুরোপুরি সুস্থ হতেই দেবে না।


(ক্রমশ)



 


  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract