Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics

5  

Apurba Kr Chakrabarty

Tragedy Classics

অব্যক্ত প্রেম

অব্যক্ত প্রেম

18 mins
1.4K


মেয়েটা বাল্য কালে অতি সাধারণ ছিল,গরীবের মেয়ে বাবা অর্থাভাবে হেন কাজ নেই যে সে করত না। পবন মুখুজ্জে, ভাট বামুন থেকে অগ্রদানী , আবার মুচি দুলে বাগ্দীর ঘরে পূজো করত।আর বছরে দুবার গ্রামের বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের বাসে করে বিভিন্ন তীর্থে বেড়াতে নিয়ে যেত। তার জ্ঞাতি গুষ্টির মানুষ তাকে ছোট চোখে দেখত, এড়িয়ে চলত।

সে সময়টা ষাটের দশকের প্রথম দিক।পবন মুখুর্জ্জের নবম কন্যার জন্ম হল অর্পিতা। যদিও জীবিত কন্যা তাকে ধরে পাঁচজন। পুত্রের সখ মিটল না,পবনের স্ত্রীর বয়স তখন সাতচল্লিশ,আট বছর আগে তার অষ্টম কন্যা বনলতার জন্ম, তার পর হঠাৎই আট বছর পর অর্পিতার জন্ম।

বাবা পবনের তখন বয়স ষাটে ধাক্কা।বড় মেয়ের বিয়ে সেই কবে হয়েছিল,তার এক ছেলে ,তিন মেয়ের জন্মের পর অর্পিতার জন্ম। মেঝদির বিয়ে হয়েছিল চার পাঁচ বছর, তার এতদিন কোন বাচ্ছা কাচ্ছা হয়নি । স্বামী রেলের ড্রাইভারের হেল্পার, কয়লা ইঞ্জিনে চলন্ত ট্রেনে কয়লা ভরার কাজ। মেঝদি কল্পনার পড়াশোনার ক্লাস ফোর অবধি। বাকী দুই দিদিরাও প্রাইমারী ইস্কুলের গন্ডি পাড় হয়নি।

ছোট গ্রাম জগতপুরে পুব পাড়ায় তাদের বসতি।বাড়ির উত্তরে অলোকদের বাড়ি,ওরা বেশ সচ্ছল বনেদী ব্রাহ্মণ শিক্ষিত পরিবার। আলোকের বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক।গ্রামে চাষ জমিও আছে।সেযুগে দোতলা পাকা বাড়ি।আর ঠিক দক্ষিণে অর্পিতাদের প্রাচীন আমলের জীর্ণ মাটকোঠা ঘর। নিচে উপরে দুটো করে ছোট কক্ষ।উপরে ঘরে কোন বারান্দা নেই।নিচের দুই ঘরের মাঝ বরাবর মাটির সিঁড়ি, উঠে দুপাশে দুটি ঘর, খড়ের ছাউনি। একতলার ঘরের মাটির সিলিং মেঝে থেকে উচ্চতা আট ফুটের কম, মেঝের দৈর্ঘ্য প্রস্থে ,নয় ফুট বাই সাত ফুট। পাশাপাশি আর কোন বসত বাড়ি ছিল না। একটু দুরে অন্য প্রতিবেশীদের বাস।

আলোক আর অর্পিতার জন্ম হয়েছিল,একদিন মাত্র অন্তর। অর্পিতার মায়ের প্রসব যন্ত্রনা ওঠার চারদিন পর জন্ম, আর অলোকের মায়ের প্রসব যন্ত্রণার ছ ঘন্টার মধ্যেই জন্ম। তাই আলোকের মা বলত অর্পিতাই তিনদিনের বড়। যদিও ভুমিষ্ঠ হওয়া বিচারে আলোক একদিন আগে জন্মায়। একসাথে তারা ছোটবেলা থেকে বন্ধুর মত ছিল। আলোকও ছোট সন্তান, তারাও পাঁচ ভাইবোন,তবে তারা সবাই জীবিত।

অর্পিতার ভাগ্য ভালো! না তার মেঝদির ভাগ্য মন্দ সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন। অর্পিতার বয়স যখন আট ন বছর, তার মেঝদির স্বামী, এক রেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। পঁচিশ বছরের দিদি ছিল নিঃসন্তান। দিদি গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসে। তার পড়াশোনা প্রাইমারীর গন্ডিও পার হয়নি। তাই স্বামীর পেনশন পেলেও চাকরীর সমস্যা ছিল, অন্তত অষ্টম শ্রেণি পাস হলেই একটা ডি গ্রুপের কাজ হবে।তাই সেই চেষ্টা করছিল, নিজের শিক্ষাগত মান যাতে অন্তত এইট অবধি করা সম্ভবপর হয়।

যাইহোক বাড়ির আর্থিক দারিদ্র্যতা একটু হলেও কেটেছিল।   মেঝদি অর্পিতার মায়ের বয়সে।ছোট বোন,অর্পিতাকে কন্যাস্নেহে মেঝদি ঠিক করেছিল  শিক্ষিত করবে।নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতায় মূর্খ মানুষের যে কী জ্বালা! সে তো ভুক্তভোগী।

রোগা পাতলা শ্যামলা সম বয়সের অর্পিতা আলোকের  সহপাঠী। আলোক দেখতে সুন্দর বলিষ্ঠ শরীর, ফর্সা,বুদ্ধিদীপ্ত মুখচোখে অহংকারী ভাব মনে হলেও সরল সহজ। অর্পিতাদের প্রতি বোনেরই মুখশ্রী ভারি মিষ্টি।আর যৌবনের হাওয়া লাগলেও তাদের শারীরিক গঠন ভীষণ সুন্দর হয়ে উঠত। তাই তাদের একটু রং চাপা হলেও, ভালো বিয়ে হয়।অন্তত প্রথম দুই দিদির সেটাই হয়েছিল।

কাজল কালো মিষ্টি চাহনি,চোখে ঘন কালো দীর্ঘ পাতা, মনে হত যেন সব সময়ই কাজল পড়েই আছে। আর নিখঁত ওষ্ঠ, পরিপাটি দাঁতের রং যেন সাদা মুক্ত। মুখচোখ ও চেহারার মধ্যে এক আদিম সৌন্দর্য, দেখলেই ভালো লাগে।আর প্রতিটি বোন নিরীহ শান্ত স্বভাবের, মুখে হাসি লেগে থাকত। দারিদ্র্যতার ছাপ থাকলেও তারা ছিল সতেজ হাসি খুশী।

আলোক তাকে সহপাঠী বন্ধুর মতই ভাবলেও, অর্পিতা আলোকের প্রতি বাল্য থেকেই দুর্বল,ভীষণ ভালোবাসত, তবে আর্থিক পারিবারিক বৈষম্যতায় কারনে  তা প্রকাশ করার সাহস ছিল না। একটা মানসিক হীনমন্যতায় সে ভুগত।অলোকরা বনেদী ধনী, বাবা শিক্ষক,সে সুন্দর ফর্সা।

 আলোক ভালোবাসত অর্পিতাকে একজন বন্ধু আর সহপাঠীর মত।সচ্ছল শিক্ষকের সন্তান আলোক ক্লাসে ফাস্ট হত। অর্পিতার সচ্ছলতা নেই, বাড়িতে শিক্ষিত গার্জেন নেই, তবু বেশ ভালো রেজাল্ট করত। তাদের হাইস্কুলের চল্লিশ জন ছাত্র ছাত্রীর ক্লাসের মধ্যে পরীক্ষার ফলের নিরিখে দশের মধ্যেই থাকত।তার হাতে লেখা যেন মুক্ত ঝড়ত।

আলোক আর অর্পিতা পাড়ার প্রাইমারী বিদ্যালয় থেকে ফোরে পাশ করে,হাইস্কুলে ফাইভ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল।গ্রামের অন্য প্রান্তের হাইস্কুলটি অন্তত তাদের বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দুর। সে যুগে হাঁটা ছাড়া গতি নেই।দুই কিমি কেন! অনেকে পাশের গ্রামের ছাত্র ছাত্রী, পাঁচ ছয় কিলোমিটার পথ দৈনিক হেঁটে আসত।নদী পেরিয়ে আসত। আর বর্ষার সময় ভরা নদী সাঁতরে আসত।স্কুল ব্যাগ আর স্কুল পোষাক মাথায় বেঁধে গামছা পড়ে সাঁতার দিতে হত, আসা যাওয়ার পথে।পরিনত যৌবন,বড় মেয়েদের বেশী সমস্যা হত।সেই যুগে হাইস্কুলের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।আট দশ কি মি অন্তর এক একটা হাইস্কুল আর তেমন ছিল রাস্তার দুর্গম অবস্থা।

প্রাইভেট টিউশন আর্পিতার একটা ছিল, সে টিউটর তেমন মেধা ধরত না।এ গ্রামে তখন মেধাবী প্রাইভেট টিউটর ছিল না। আর স্কুল শিক্ষকদের সংখ্যা,গুনগত মান ছিল কম । বিশেষত ইংরেজী অঙ্কের  শিক্ষক গ্রামের কেউ ছিল না। আলোকের বাবা পাশের একটু দুর গ্রামের স্কুল শিক্ষক।বাই সাইকেলে যাতায়াত করতেন। তিনি সংস্কৃতের শিক্ষক। তবে নিজের ছেলে মেয়েদের তিনি অঙ্ক বিজ্ঞান ইংরেজী তার সাধ্যমত দেখাতেন ,কিন্ত টিউশন তার পেশা নয়।অর্পিতা পড়াশোনা বিষয়ে আলোকের ভীষণ সাহায্য পেতো।নোট বই, খাতা দিতো, আবার অর্পিতার কিছু বুঝতে কোন সমস্যা হলে মেধাবী অলোক তাকে অঙ্ক ইংরেজী সব কিছু বুঝিয়ে দিত।

আলোক শান্ত শিষ্ঠ লাজুক স্বভাবের ছেলে তবে একটু আত্মসম্মানি। বয়স দোষ বা বয়োসন্ধিকালে একটু তারল্য বুদ্ধি ও বিপরীত সেক্স প্রতি কৌতুহল তো স্বাভাবিক! কিন্ত তার একটু যেন বেশিই ছিল। এখনকার দিনের মত তখন নেটের কৌলিন্যে বাল্যকাল থেকেই নীল ছবির দৌলতে তখনকার ছেলে মেয়েরা অকালপক্ক হতো না।

কো এডুকেশন স্কুল, ছাত্র ছাত্রী কম একটাই  সেকশন। আর্পিতার, আলোক প্রীতি ও যেচে কথা বলা,অন্য মেয়েদের হাসির খোরাক হত। যারা একটু পরিনত বয়স হাসাহাসি করত।এমন ছেলে মেয়েরা তাদের ক্লাসে পড়ত, তাদের চেয়েও পাঁচ বছর বা আরও বেশী বয়সে বড়। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়তে পড়তেই অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যেতো।পাস ফেল কঠোর ছিল। তাই একই ক্লাসে দুই তিন বছর ধরে পড়ে থাকাটা,তাই অনেক অমনোযোগী মেধাহীন ছাত্র ছাত্রীদের কাছে কোন ব্যাপার ছিল না।

গ্রাম্য অর্পিতা একটু সাদাসিদে, তখন তেরো বছরের রোগা পাতলা মেয়েলী গঠন তেমন ছিল না।শীতকাল বাদে বাকী সময় সে হাত কাটা টেপ ফ্রক আর ইজের, পরে গ্রামে ঘুরত ,এমন অনেকেই থাকত। বাড়িতে পুরুষ বলতে বাবা,মাঝে মধ্যেই  গ্রামে থাকত না।মুদি মনোহারীর মাল কিনে ব্যাগে বয়ে অর্পিতা আনতো। এর মধ্যেই তার আরও দুই দিদির বিয়ে হয়েছিল, শ্বশুর বাড়ি বা স্বামীর কাছে থাকে। এই স্বল্প ঢিলেঢালা পোশাকে আর্পিতা, আলোকের কাছে পড়াশোনার দরকারে এলে, অলোক তার সাথে সিরিয়াস ভাবেই পড়াশোনার সংক্রান্তই জ্ঞান চর্চা করত ।পড়াশোনার নিয়ে গঠনমূলক কথাবার্তা বলত।

আলোকের দাদা তখন কলকাতায় বিএস সি অনার্সের ছাত্র। এক দিদির বিয়ে হয়েছিল বড়  ইঞ্জিনিয়ারের সাথে, ওরা আমেরিকায় থাকত। বাকি দুই দিদি বর্ধমান কলেজের পড়াশোনা করত, একজন উচ্চ মাধ্যমিক আর একজন  বি এ পড়ছিল।

দোতলার যে ঘরে অলোক পড়াশোনা করত, দক্ষিণ জানালা খুললেই অর্পিতাদের বাড়ি দেখা যায়।অর্পিতা মায়ের ছোট মেয়ে বড় আদুরে। শীতের দিনে উঠানে রোদে মায়ের চোখে তেরো বছরের বাচ্চা মেয়েকে নগ্ন করে সরষের তেল ,সারা শরীরে মালিশের মত ঘষে ঘষে মাখাত। অলোকের একদিন নজরে এল, এরপর সে প্রতিদিন ঐ সময়ে জানালা অল্প ফাঁক করে অর্পিতার নগ্ন শরীরে মায়ের যত্নের তেল মাখানো দেখত। তখন অর্পিতার শরীরে সদ্য মেয়েলী গড়ন বিকশিত কিন্ত তেমন আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে নি। তবু কেমন অপরাধী মনে,দুরু দুরু বুকে অলোক তার নগ্ন শরীর উপভোগ করত। সে ভাবত কেউ বুঝতে পারবে না।

অর্পিতার সন্দেহ হয়। অলোকদের দোতলার জানালা, তাকে মা যখন তেল মাখায় প্রায় বন্ধ একটু ফাঁক থাকে,খানিক পর পুরো খোলা থাকে। অর্পিতার একটু লজ্জা লাগলেও চুপ থাকত। অলোককে সে ভীষণ ভালোবাসে,পড়াশোনাতেও অনেক সহযোগিতা পায়।আর অলোক যদি তার খোলা শরীর দেখে আনন্দ পায়,তার কোন দুঃখ নেই, বরং মনে মনে সে একটা তৃপ্তি পাচ্ছিল।অলোক দেখছে জানে না, এমন ভান করে অর্পিতার নগ্ন শরীরে রোদে মায়ের হাতে শীতের রোদে তেল মাখার আরাম নেওয়া আরও কদিন গেল।

দিদিদের সাথে থেকে থেকে সে ছিল বয়সের তুলনায় একটু পরিনত। হঠাৎই একদিন অর্পিতার কী যেন মনে হল।যদি তার মায়ের নজরে এটা আসে,মা কি ভাববে!

মা এসব বিষয়ে ভীষণ কঠোর অর্পিতা জানে। পাড়ার যুবক তপন,পুকুর পাড়ে গাছের আড়াল থেকে সে মেয়েদের স্নান দেখে,তাই সবাই ঘৃনা তাচ্ছিল্য করে।মা তো পারলে তপনকে ঝাাঁটা মারতে চায়।সেই মা যদি অলোকের কথা ওর মা আর পাড়ার অন্যদের বলে দেয়,লুকিয়ে তার নগ্ন শরীর, অলোক দেখে! পাড়ায় তো ছ্যা ছ্যা হবে। আমার সঙ্গেও অলোকের সম্পর্ক তাতে খারাপ হবে,ওর রাগ হবে। নাইনে সে এবার উঠবে, অলোকের অনেক সাহায্য তার দরকার। ভালো ছেলে, মনটাও ভালো। অলোককে সে খুব ভালোবাসে,ওর বদনাম চায় না ,এই সব ভেবে এ দিন বিকালে অলোকের দোতলার ঘরে গেল। এ বাড়ী তার অবাদ যাতায়াত, অলোকের মাকে কাকীমা বলে। অলোক তার সহপাঠী।

আলোক ঘরে বসে তখন নাইনের দাদা দিদির পুরোন বই নিয়ে দেখছিল।

"আলোক কী করছিস!

"পরশু রেজাল্ট বের হবে,তাই একটু নাইনের বইগুলো দেখছিলাম, তবে অনেক সিলেবাস বদলেছে। "

"তোর কত সুবিধা,দাদা দিদির বই গুলো আছে।"

"তুই কটা বই নিয়ে যা না!"

"তাই নিয়ে যাব।"এবার একটু চুপচাপ অর্পিতা, কেমন অস্থির।

অলোক বলে "কি হল তোর ! চুপচাপ!"

"অলোক জানিস তপন দা, পুকুরে গাছের আড়াল থেকে মেয়েদের স্নান দেখে, তাই সবাই ঘৃনা তাচ্ছিল্য করে। লুকিয়ে মেয়েদের দেখাটা তো অনেকেই ভালো মনে করে না।"

অলোক বুঝতে পারে,বলে "তুই কী বলছিস খুলে বল না! আমাকে বলছিস!"

"না তা কেন! আমি তা বলি নি।"

অলোক কেমন গম্ভীর।ফর্সা মুখ লাল,রাগে না লজ্জায় কে জানে!

অর্পিতা ভীষণ নার্ভাস হয়ে বলে,"আমি তোকে খুব ভালোবাসী বিশ্বাস কর ,তোর বদনাম করতে আসি নেই! "

"তুই যা আমার কিছুই ভালো লাগছে না। তোর মা আমাকে খারাপ ভাবছে, মাকে বলবে, পাড়ায় বলবে তাই তো!" কেমন সে নার্ভাস ।

"তুই বিশ্বাস কর,মা জানে না,তার আগেই তোকে তাই মনে হল বলি।আমি শুধু বুঝতে পেরেছি। "

"তোর বাবার যেমন ছোট পেশা,তোদের সবার মন গুলো ছোট। "

অর্পিতার চোখে জল। "বাবা গরীব তাই হয়ত ভাট, অগ্রদানীর কাজ করে।"

"গরীবের জন্যই সবাই করে, তারাশংকরে অগ্রদানীও আগে ভালো বামুন ছিল ,অগ্রদানী লোভে হয়, শেষে নিজের ছেলের পিন্ডি খায়। তোর বাবাও তাই খাবে।

"আমারা তো কুলীন ছিলাম, কাকুকে জিজ্ঞেস করবি!"

"শরৎচন্দ্রের বামুনের মেয়ে পড়ছিস! কুলীন আরও খারাপ। জন্মের ঠিক নেই।"

"তুই এত জানলি কি করে!"

"বই পড়তে হয়,আমার বাবার ঘরে ঢুকে দেখবি একটা বড় আলমারি শুধু বই ভর্তি,শরৎ,বঙ্কিম, তারাশংকর, বিভুতি, রবীন্দ্রনাথ সব সেরা সেরা বই ঠাসা। পরনিন্দা পরচর্চা তোরা, তোর মা দিদিরা করবে।ছোট মানুষদের ছোট স্বভাব, শকুনের দৃষ্টি ভাগাড়ে,তিলকে তাল করে, মা ঠিকই বলে।"

অর্পিতা দুচোখ জলে ভরে ওঠে,বলে "তুই শুধু শুধুই আমাদের অপমান করছিস, আমরা গরীব তাই। বিশ্বাস কর, তোর ভালোর জন্য তোকে বলতে এলাম,তা না হলে আমার কী দরকার তোর সাথে ঝগড়া করা। আর বিশ্বাস কর, মায়ের দিব্যি কেউ জানে না।"

"বেশ তুই যা এখন, আমি একা থাকব।"

একরাশ মনের দুঃখ আর দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল অর্পিতা। তখন বিকাল চারটে।

আবার পাঁচ টায় অলোকের ঘরে গেল, কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,"তুই আমাকে লুকিয়ে কেন দেখবি! বলল না,আমি তোকে শরীর খুলে দেখাচ্ছি, দেখবি! তুচ্ছ কারনে কেন বদনাম করবি!মা একটু অন্যরকম। "

"আমাকে কী ভাবছিস! তোর মায়ের আদরের কচি মেয়েকে দুদিন তেল মাখানো দেখেছি, খুব অন্যায়! আমার মা এতটা আমাদের আদর করে না,এই বয়সে ন্যাংটো করে তেল মাখায় না!আর তোর কি এত রূপ রে! যে দেখব!"

"সে তো আমি জানি। আমি কালো, রোগা পাতলা, ছোট ঘরে জন্ম, গরীবের মেয়ে, তুই আমাকে পাত্তা দিবি কেন !" অর্পিতা মুখ নামিয়ে কাঁদছিল।

অলোক, অর্পিতার এভাবে কান্নায় খুব বিচলিত একটু নরম স্বরে বলে,"আমি কী তাই বলেছি! তুই খুব ভালো মেয়ে, তাই আমি একটু যদি ভুল করেও থাকি,সতর্ক করতে এসেছিস,আমার ভীষণ লজ্জা করছে, তুই কী ভাবছিস!"

কান্না থামিয়ে অর্পিতা বলে"আমি এসব নিয়ে কিছুই ভাবি নেই। আমার খুব নার্ভাস লাগছে ,নাইন আর টেন, এই দু বছরও তুই আমাকে আগের মত সাহায্য করবি তো ! না রেগে --"

কথা থামিয়ে অলোক বলে,"তুই সত্যিই পাগল! এর সঙ্গে পড়াশোনার কী সম্পর্ক! তুই তো আমার বন্ধু সহপাঠী,সমবয়সী,একসাথে ছোটবেলা থেকে পড়ছি, খেলছি। তুই আমাকে চিনতেই পারিস নি !"

"যাক বাবা বাঁচালি! সত্যিই বিশ্বাস কর, তোকে  আমি ভীষণ ভালোবাসী।"

প্রসন্ন মনে অলোক একটু ভার মুক্ত হয়ে বলে "যখন দরকার চলে আসবি, দুজনে পড়লে দুজনেরই লাভ।বাবা তো বলে,অর্পিতাকে অঙ্ক বোঝাবি, নিজে করার চেয়ে দশগুন লাভ। "

এ ঘটনার পর মাধ্যমিক পাশ অবধি দুজনের সম্পর্ক মধুর ছিল, তবে সহপাঠীর বাইরে নয়। অর্পিতার বার বার দুর্বলতা অলোক এড়িয়ে যায়। অর্পিতার প্রতি অলোকেরও অন্তরে ভীষণ আকর্ষণ ছিল। তার নরম মন, সুন্দর মুখমন্ভল, আর তার প্রতি চরম দুর্বলতা অলোক জানত। দীর্ঘদিন বাল্যকাল থেকে একসাথে পড়াশোনা বড় হওয়া।কিন্ত অকালপক্ক মেধাবী অলোক এটাও জানত, তাদের মধ্যে সম্পর্ক বাস্তবে সম্ভব নয়। পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সামাজিক ইজ্জত সম্মান অনেক বিষয় অন্তরায়। বাবা মায়ের দিদিদের বিবাহ সংক্রান্ত আলোচনায় বেশ বুঝত। বাবা মা এ বিষয়ে আপোষ হীন। সামাজিক সম্মান,শিক্ষা, নিজ বংশের আভিজাত্য কৌলিন্যের অহংকার তাদের মধ্যে চরম। অর্পিতার বাবা মায়ের  সাথে তার বাবা মা মেলামেশা করলেও ওদের ছোট চোখে দেখত।

গ্রামের মাধ্যমিক স্কুল থেকে পাশের পর,  অলোক আর অর্পিতার মধ্যে সম্পর্ক কেমন যেন দুরত্ব হয়ে গেছিল। অলোক সায়েন্স নিয়ে বর্ধমানের এক নামী বয়েজ স্কুলে এগার ক্লাসে ভর্তি হল। অর্পিতা ভর্তি হল আর্টস নিয়ে বর্ধমানের এক নামী বালিকা বিদ্যালয়ে। অর্পিতার মাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর ছিল আলোকের খুব কাছাকাছি। দুজনেই প্রথম বিভাগে পাস করে। কিন্ত সায়েন্স বিষয়ে অর্পিতার ভীতি। আর হাতে লেখার জন্য বাংলা ইতিহাস ভূগোলে জীবন বিজ্ঞানে আলোকের চেয়েও একটু ভালো নম্বর ছিল। কিন্ত অঙ্ক ভৌত বিজ্ঞান আর ইংরাজি অনেকটাই কম।

 সায়েন্স পড়লে,গনিত ও সায়েন্স বিষয়ে প্রাইভেট টিউশনের খরচ তার মত অসচ্ছল ঘরে সম্ভব নয়।আর বারো কিমি বাসযোগে বর্ধমানে এত সায়েন্স বিষয়ের উপর টিউশন পড়তে যাওয়ার বড় ঝক্কি, বরং আর্টস পড়লে ইংরাজী বাদে তার আর কোন টিউশনই লাগবে না। মেধাবী অর্পিতার নাইন থেকেই ভীষণ পড়াশোনায় মনটা বসেছিল। আর দিদির উৎসাহ তার সীমিত আর্থিক মদত তাকে স্বপ্ন দেখাত,সে একদিন শিক্ষিকা হবে।

অন্য দিদিদের মত ষোল সতের বছর থেকেই রূপ যৌবনে তার শরীর, নতুন করে ঈশ্বর যেন আবার ভেঙ্গেচুরে গড়ছিলেন। মেদহীন কটি,আকর্ষণীয় বুকের মেয়েলী গঠন,স্ফীত পাছা, আর একঢাল কালো চুলে স্টাইল করে খোপা বেঁধে যখন সে স্কুলের নির্ধারিত রং ,সাদা শাড়ি মেরুন পাড়, মেরুন ব্লাউজ গায়ে, বাস স্ট্যান্ডে বাস ধরতে যেত, বহু মানুষের নজর কাড়ত।লাজুক স্বভাবের অলোকের সাথে মাঝে মাঝেই পথে দেখা হত। বর্ধমান যেতে তারা একই বাসে উঠত, কিন্তু কথা হত না। অর্পিতা তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলে,অলোক বড়জোর মুখটিপে হাসিহাসি মুখের ভাব করত। এই স্কুল ড্রেসে অর্পিতাকে অলোকের ভীষণ ভালো লাগত। লাজুক মুখে বার বার লুকিয়ে দেখত।অর্পিতা তা বুঝতে পারলেও, না দেখার ভান করে অন্য দিকে চেয়ে থাকত।চোখচোখি হলেই আলোক যে আর লজ্জায় তার দিকে তাকাবেই না সে জানত। আর আলোক তাকে দেখুক অর্পিতা মনেপ্রানে চাইত।

অর্পিতার মন ভীষণভাবে অলোককে চাইত, কিন্তু আলোক যেন ধরাই দেয় না।মনোক্ষুন্ন হতাশ হয়ে অর্পিতা তাই নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছিল ।অলোকের লাজুক মনের অন্তরে অর্পিতার বড় উপস্থিতি।গোপনে তাকে নিয়ে কল্পনা করে কবিতা লিখত।তাকে নিয়ে যে কত অবাস্তব স্বপ্ন দেখত। অর্পিতার যা ছিল অজানা।বরং তার ধারনা সুন্দর ফর্সা বনেদী ধনী ঘরের অলোক তাকে গুরুত্ব দেয় না।লুকিয়ে দেখে শুধু, কিন্তু উদাসীন, ভালোবাসা দুরে থাক পাত্তাই দেয়না।তাতে তার মনের মধ্যে দুঃখ,জেদে পরিনত হয়েছিল। পড়াশোনায় জোর দিয়েছিল।

অলোকের বরং অর্পিতার জন্য মনে অস্থিরতা ছিল।তার দোতলা ঘরের দক্ষিনের জানালার পাল্লার সংকীর্ণ ফাঁকের আড়ালে অর্পিতাকে দেখত খুব গোপনে।সে ভাবত অর্পিতার নজরে আসবে না। মাটকোঠা দোতলা ঘরের উত্তরের খোলা জানালার সামনে, অর্পিতা যখন স্নান সেড়ে তার ভিজে পোষাক বদল করত, সেসময় প্রায়ই তার নগ্ন বুক ,পাছা দেহের সব কিছুই পঁচিশ ফুটেরও কম দুরত্ব থেকে অলোক দেখত অপার বিষ্ময়ে!সেই অর্পিতা !এত সুন্দর !শরীরের গোপনঅঙ্গের কোমল মসৃণ ত্বকের রূপের ছটায় অলোকের মনকে ব্যাকুল করত। দারিদ্র্যেভরা গরীব ঘরের রোগা শ্যামলা ভীরু স্বভাবের সেই স্কুল জীবনের  অর্পিতা! কত করুন মলিন ছিল,পড়াশোনায় তার কাছে কত নির্ভরশীল ছিল।আজ অলোক তার মোহে পাগল।

অর্পিতার বারো ক্লাসের রেজাল্ট খুব ভালো হল।সে ভূগোলে অনার্স নিয়ে বর্ধমান মহিলা কলেজে ভর্তি হল। আর অলোকের রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি। অনার্স পেলো না।বি এস সি পাস কোর্সে বর্ধমানের একটা কলেজে ভর্তি হয়। পাস কোর্সে পড়ে কোন ভবিষ্যত নেই, তার মনে হত।বন্ধুর পাল্লায় হুজুগে এয়ার ফোর্সের চাকরীর জন্য আবেদন করে। সে সময় আটের দশকের সূচনা। তার মেধা ছিল, মেডিক্যাল ফিটনেস ছিল,সফল হল।

তার পর সে কলেজ যাওয়া বন্ধ করল, সিলেক্ট হবার পর বন্ড করা ,সার্টিফিকেট জমা, পুলিশ ভেরিফিকেশন অনেক সময় গেল।এত কম বয়সে চাকরী আবার এয়ার ফোর্স! গ্রামের মানুষ ভাবত, বিমান চালাবে। সে মেকানিক্যাল ট্রেড ননকমিশন পদে যোগ দেবে । গ্রামে তার কদর বাড়ল। কলেজ ছুট অলোক, মনের আনন্দে সময় কাটিয়ে ছ সাত মাস পর কাজে যোগ দিল। প্রথমেই ট্রেনিং।

 বড়লোকের আদুরে ছেলে, বড় স্বাধীন চেতা। এত ডিসিপ্লিন আর টেনিং এর চাপে সে দিশেহারা হয়ে মাকে চিঠি লিখে, তার মনের কথাই লিখল।

আদরের ছোট ছেলের জন্য মায়ের তো ঘুম হয় না, কান্নাকাটি শুরু করেদিল। শিক্ষক বাবাকে, মা দোষারোপ করে। পিতা দায়িত্ব ঝেড়ে বলে "তোমার ছেলে উনিশ বছর বয়সে,নিজের ইচ্ছায় সে বায়ু সেনায় যোগ দিতে গেছে।দাদা নাকি এম এসসি পাস করে দু বছরের বেশী বেকার, আর পাশ কোর্সে বি এস সি পড়ে নাকি ওর কোন ভবিষ্যত নেই। আমাকে এখন কেন দোষ দিচ্ছ! আমি তখন আপত্তি করলে, পরে বেকার হলে,তোমরাই তো আমায় দোষ দিতে!"

মা বলে,"দায় এড়াবে না,তুমি বাবা, যে ভাবে হোক ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। "

"ও তো বন্ড করে গেছে, আমার কী করার আছে!"

পরে অনেক কষ্টে অভিজ্ঞদের পরামর্শে, ট্রনিং কালে নাকি সেনাবাহিনীর থেকে ডিসচার্জ পেতে, মায়ের অসুস্থতা, মনের চাহিদা এই ভাবে আবেদন করলে কাজ হবে জেনেছিল। 

অলোক উনিশ বছর পর সার্ভিসে গেছিল পার্সোনাল বন্ড দিয়ে।মা উদ্ধতন কতৃপক্ষকে আবেদন জানালো। আমাকে না জানিয়ে বন্ড করে অলোক চলে গেছে, আমি অসুস্থ।ওকে ছাড়া বাঁচব না,এতে কাজ হয়েছিল।

তিন মাস পর  ট্রেনিং অসমাপ্ত রেখে অলোক শেষ মেশ বেকার যুগে এয়ার ফোর্সের মত সেনাবাহিনীর কেন্দ্র সরকারের খোদ চাকরী ছেড়ে অনিশ্চিত পথে ফিরে এল।মা সুখী , কিন্তু অনেকেই তার সমালোচনা করল। জীবনযুদ্ধের পরাজিত এক সৈনিকের মত ফিরে এলি! বন্ধু থেকে আত্মীয় স্বজন অনেকেই তার সিদ্ধান্ত ভুল ভাবল।

ভুল যে হয়েছিল অলোক বেশ ভালো বুঝল,যখন ডিসকন্টিনিউ কারনে তার দুটো অ্যাকাডেমিক ইয়ার ক্ষতি করে দুবছর জুনিয়র ছেলেদের সাথে আবার বি এস সি প্রথম বর্ষে ভর্তি হল। লাজুক অলোক কেমন নিজেকে গুটিয়ে রাখত। অর্পিতার সাথে চোখাচোখি হলে বা অর্পিতা কথা বলতে এলেও এড়িয়ে যেত।এক চরম হীনমনত্যার ভাব। অর্পিতা তখন ভুগোলে অনার্স ফাস্ট ক্লাস পেয়ে এম এ ভর্তি হল,আর অলোক বি এস সি দ্বিতীয় বর্ষে সবে উঠেছিল। অর্পিতাকে দেখলেই তার কেমন যেন পরাজিত পরাজিত লাগে।লজ্জা লাগে দুঃখ হয়। সে বিষন্ন মনে ভাবত, অর্পিতা হয়ত তাকে আজ সহানুভূতি চোখে দেখে,তাই মুখোমুখি হলেই চোখ নামিয়ে এড়িয়ে যেত। কথা বলা দুরে থাক পথে বাসে দুরে সড়ে পালাত।

অর্পিতার কিন্তু তা মনে হয় না । ভাবত বিরাট যোগ্যতা না থাকলে কেউ এয়ার ফোর্সের চাকরীর পায় না। অলোক মেধাবী,সে ভালো মতোই জানে। বরং তার মনে একটা আফসোস, কত ছেলে তাকে গুরুত্ব দেয়। তার সহপাঠী এম এ, এম এস সি পাঠরত কত স্মার্ট ছেলে তার সাথে যেচে কথা বলে।অলোক তাকে, তার আবেগ ভালোবাসার কোন মুল্য দিল না।

আজও কিন্তু অর্পিতা ,অলোকে ভীষণ পছন্দ করে ভালোবাসে। ভাবত স্কুল জীবনে অলোকের এতটা সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এই সাফল্য তার আসত না।এয়ারফোর্স থেকে ফিরে আসা অলোকের ব্যর্থ দুখী মুখ দেখে অর্পিতার মনে খুব কষ্ট হতো।স্বপ্ন দেখত সে শিক্ষিকার চাকরী পেলে, অলোক বেকার থাকলেও, নিজেই তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে।তবে তার ভয় হত অলোকের যা আত্মসম্মান!

অর্পিতার ভাগ্যটা বেশ ভাল, মেঝদি বিধবা না হলে তাকে কবে ওর বাবা বিয়ে দিত। এম এ নয়, ফাইভ অবধি পড়ত কিনা সন্দেহ। বাবা দুবছর মরেছে।দিদি অনেক চেষ্টায় এইট ক্লাস পাস স্কুল থেকে সার্টিফিকেট বের করে একটা গ্রুপ ডি পদে রেলে চাকরী করত। দুবোন সকাল আটটার পর বাড়ি থেকে বের হয়। বোন অর্পিতা যেতো গোলাপবাগে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ছাত্রী, আর দিদি যেত বর্ধমান রেলের অফিস।

বিজয়া দশমীর দিন অলোকের শরীর খারাপটা যেন বেশ বাড়াবাড়ি, চাপা স্বভাবের অলোক  বাড়িতে কিছু বলেনি।ছোট দি আর তার বর বিজয়ার প্রনাম করতে বাড়িতে এসেছিল। রাতে খাসীর মাংস হয়েছে,যা ছিল অলোকের ভীষণ প্রিয়,সে কিন্ত মাংসতে আজ মুখই দিল না। রাতে ভাত খেলো না।গায়ে জ্বর, যন্ত্রণা, চোখ ছলছল করছে। বাড়ির লোকজন জামাই নিয়ে ব্যাস্ত, দাদা স্কুলে শিক্ষকতা পেয়েছিল।কলকাতায় থাকে সেও এসেছে।

হৈ হুল্লোর মাঝে অলোকের শরীর খারাপটা চাপা পড়েছিল।মা কেবল যত্ন করে তাকে দুধ সাবু করে খাওয়ালো।গায়ে হাত দিয়ে বলে,"হ্যাঁ বাবা গায়ে এত জ্বর! বলবি তো! ডাক্তার বাবু তো সকাল নটার আগে চেম্বারে আসে না! "

অলোক বলে "ও কিছু নয় ,কদিনই শরীরটা খারাপ লাগছে ঠিক হয়ে যাবে,এত ডাক্তার ডাক্তার করো না তো!"

সকালে এত বড় হঠাৎ বিপদ অঘটন ঘটবে এ পাড়ার কেউ ভাবে নেই।অর্পিতার মৃতদেহ গাড়ি করে নিয়ে এসেছিল তার বড় জামাইবাবু আর দিদি । শুনে পাড়া কেন গ্রামের মানুষ তাদের বাড়িতে ভীড় জমিয়েছিল। বড় দিদির বাড়িতে যৌথ পারিবারিক দুর্গাপূজো হয়। অর্পিতা এবার গিয়েছিল,এমন সে আগেও অনেকবার গেছে।

এবার জাপানী এনকেফেলাটিস ব্যপক হারে হচ্ছিল।

অনেক মানুষ মরেছে ,তবে বেশীরভাগ শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল।একুশ বছরের অর্পিতার এমন এইভাবে হঠাৎ এ রোগে মৃত্যু কারও চিন্তায় আসে না। বড় দিদির বাড়ির একটু দুরে আদিবাসীদের বাস, যারা শুয়োর পোষে। অনেক সন্দেহ হয়ত ঐ খান থেকেই এই রোগে তার সংক্রমণ। চিকিৎসার সুযোগ পায়নি।

আগের দিনে কত সখ করে দেবীর মঞ্চে অর্পিতা ,কত আলপনা এঁকে সবার মন জয় করেছিল।বিকাল থেকে তার ভীষণ জ্বর, ভুল বকছিল, মানুষ চিনতে পারছিল না।সঙ্গে ভীষণ মাথার যন্ত্রণা।পুজোর বাড়িতে সকলে ব্যাস্ত ছিল। তবু রাতেই গাড়ি ভাড়া করে দিদির বাড়ি থেকে চল্লিশ কি মি দুর বর্ধমান সদরের হাসপাতাল অর্পিতাকে নিয়ে যায়,তখন রাত তিনটে।আর পাঁচটায় ডাক্তার জানিয়ে দিলেন, অর্পিতা আর নেই।

বর্ধমান থেকে সোজা জগতপুর, ছটার আগেই এমন বিপদের জন্য তার মা মেঝদি প্রস্তুত ছিল না।তাদের গভীর শোকের আর্তনাদ আর কাতর করুন কান্না অন্য পাড়ার মানুষদেরও আজ ঘুম থেকে তুলেছিল। শরীর খারাপ নিয়েও লাজুক অলোক ছুটেছিল অর্পিতাদের বাড়ি। অর্পিতার মরদেহ বাড়ির উঠানের মাঝে নামানো, সারা শরীর সাদা কাপড়ে ঢাকা,গলার পর থেকে মুখমন্ডল মাথা অবধি খোলা ছিল, চোখ বন্ধ করে যেন ঘুমুচ্ছে,  সুশ্রী মুখমন্ডলে কোন বিকৃতি  নেই। কপালে চন্দনের টিপ দিয়ে সাজিয়েছে।কটা রজনীগন্ধা মালা আর বিচ্ছিন্ন ফুল শবদেহের উপর রাখা, সুগন্ধি ধুপের গন্ধ।মা আত্মীয়স্বজন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে।প্রতিবেশীদের সবার চোখে জল, বিষন্ন, কেউ কাঁদছে।  অলোক চোখে জল, মুখ লুকিয়ে আজ সে ফুঁপিয়ে  ফুঁপিয়ে ভীষণ কাঁদছিল। আজ বাল্য কৈশোর যত স্মৃতি তার মনে ভিড় করছিল। অসুস্থ শরীরে আরও অসুস্থবোধ করছে,তবু সে গ্রামের শ্মশানে যায়।

এত কম বয়স,হঠাৎই একদিনের মধ্যেই রোগে মৃত্যু, শ্মশানে ভিড় জমেছিল। যুবতী মেয়ের যৌবনের ঢেউ যেন শরীর জুড়ে।হোক না মৃত! জামাই বাবু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, এত মানুষের সামনে অর্পিতাকে  উলঙ্গ করে দাহ করা হবে না। পোষাক সহ ওর দাহ হবে।

ব্রাহ্মণ বললেন,শাস্ত্রীয় নিয়মে ওর তাতে পরলোকে অমঙ্গল হবে।সেটা এত আধুনিক যুগ ছিল না। ঠিক হল মেয়েরা শ্মশানের চিতার চারদিক শাড়ি ধরে আড়ালে 

 তাকে উলঙ্গ করে, ওর শরীর শ্মশানে চিতায় তুলে কাঁচা কয়লা আর কাঠ দিয়ে তার শব ঢাকা হবে।তার পর কাপড়ের আড়াল সড়ানো হবে। অলোক দেখল,  তার জন্ম সময়ের নিকট সাথী ,পাশের বাড়ির বাল্য কৈশোরের বন্ধু, ইস্কুলের সহপাঠীর সারা শরীর কাঠ, কাঁচা কয়লায় ঢাকা, শুধু বাঁ পায়ের গোড়ালীর কাছটা একটু দেখা যাচ্ছিল। আর থাকতে পারেনি। দাউ দাউ করে শ্মশানের চিতার আগুন জ্বলে উঠার আগেই সে শ্মশান থেকে বিদায় নেয়।

শরীর তার আরও খারাপ ডাক্তার দেখে বললেন প্যারা টাইফায়েডের লক্ষ্যন। দোতলার ঘরে একা নির্জন সে সারাদিন কাটাল।দক্ষিণের পাশের বাড়িতে অর্পিতা আর নেই, আর জীবনে তাকে দেখতে পাবে না।মনটা কষ্টে হু হু করছে । ওর মা দিদির কান্নার আওয়াজ অলোককে আরও আবেগগ্রস্থ করে তুলেছিল। সে কাঁদছিল নীরবে।চোখ মুছছিল বার বার, কেবল মা বা বাড়ীর কেউ তার খবর নিতে এলে ,ওষুধ ট্যাবলেট বা খাবার নিয়ে এলে,সে ভারাক্রান্ত মনে কিছু কথাবার্তা বলছিল। সারাটা দিন যেন আর তার কিছুই মনে আসেনা।কেবল অর্পিতাকে নিয়ে তার স্মৃতিমন্থন। আর নীরব ক্রন্দন দীর্ঘশ্বাস। এতটা যে অর্পিতাকে সে ভালোবাসত নিজেই জানত না।অর্পিতা তার এতটাই কাছে ছিল হৃদয় জুড়ে ।

রাত তখন এগারোটা অসুস্থ অবসন্ন অলোক নিজের বিছানায় । পাশে মৃত অর্পিতাদের বাড়ি শোক স্তব্ধ গৃহ মানুষ জন আলো নিভিয়ে বোধহয় শুয়েছিল। তাদের বাড়িতে সবাই যে যার ঘরে রাতে শুয়েছিল। মা একটু আগে তার খবর নিয়ে গেল। বলে গেল "বাবা কোন অসুবিধা হলে আমাকে ডাকবি, পাশের ঘরেই আছি। বারান্দার আলোটা আজ জ্বালানো থাক।"

অলোক ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।

হঠাৎ অলোকের নজরে এল, তার ঘরের পশ্চিমের খোলা জানালার বরাবর ঠিক সামনে,বারেন্দার রেলিং ধরে কেউ দাঁড়িয়ে ।এত রাতে আচমকা এ দৃশ্য দেখে আলোক ভয়ে বিচলিত হয়। পিছনের দিক থেকে দেখে মনে হচ্ছিল অর্পিতার সেই স্কুল ড্রেস, বর্ধমানের যখন সে এগার ক্লাস পড়ত, পরনে তার সাদা শাড়ি মেরুন পাড়,মেরুন ব্লাউজ। এই বয়সটায় এই পোষাকেই অর্পিতাকে তার ভীষণ ভালো লাগত।যেন পরী মনে হতো।তার রূপের বর্ণনা নিয়ে কত কবিতা লিখেছে। আজ ভীষণ ভয় করছিল অলোকের।

মৃদুস্বর যেন অর্পিতার গলা, সে শুনতে পেলো, "আমাকে তুই ভয় পাচ্ছিস কেন! অথচ এত শরীর খারাপ তোর ,আর আমাকে নিয়ে তুই সারাটা দিন ভাবছিস, কত চোখের জল ফেলছিস!"

থতমত খেয়ে অলোক আমতা আমতা করে বলে, "আমি সত্যিই তোকে ভীষণ মিস করছি , বিশ্বাস কর!"

"এখন আমি সব জেনেছি, তুই আমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসিস এখনও, আমার শুধুমাত্র শরীরটাই নয়, আমার মন আমার অন্তর সব।আমিও তোকে ভীষণ চাইতাম, খুব ভালোবাসতাম। তুই এড়িয়ে যেতিস, তাই ভাবতাম, আমাকে তুই পছন্দ করিস না, উদাসীন ! আমার ভালবাসার মুল্য দিলি না। কেবল লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে দেখতিস।

সকালে সাড়ে সাতটায় তোর ঘরে এলার্ম তোকে সজাগ করত।আমি ঐ সময়ে স্কুল বা কলেজ যাবার আগে মাটকোঠা দোতলা ঘরে গিয়ে স্নান সেরে ভিজে কাপড় বদল করতাম, উত্তরের জানালা খোলা থাকত। মেধা শুধু তোর নয় আমারও ছিল! তোর ঘরে জানালার একটু ফাঁকের রহস্য জানতাম। তোর উপস্থিতি বেশ বুঝতাম। তাই আমিও ধীরে সুস্থে কিছুক্ষণ , কখনও গায়ে মুখে ক্রিম ঘষে বা চুল আচড়ানোর ছলে, নগ্ন গায়ে উত্তরের খোলা জানালার কাছে এসে দাঁড়াতাম।

তুই ছাড়া কারও নজরে আসবে না। ভাবতাম,যখন তোকে জীবনে আপন করে পাবো না।তুই দেখ, আমার শরীরই দেখ!একটু দুর থেকে আমায় নগ্ন দেখেই তুই আনন্দ পা। আমার অন্তরটা যে তোর জন্যে এত পাগল ছিল, তুই বুঝলি না! কথা বলতে গেলেই কেমন সড়ে যেতিস।

 কিন্ত তুইও তো আমাকে খুব ভালোবাসতিস ! আমাকে নিয়ে ভেবে ভেবে কবিতা লিখতিস! তোর এ জন্যে কত পড়াশোনার ক্ষতি হল!এত মেধাবী ছিলি,কিন্তু আজ তোর কি অবস্থা! ভেবে খুব দুঃখ হচ্ছে।সবই তো তোর ব্যর্থতা আমার জন্যে, আমার মোহে! আমি এখন সব বুঝেছি। তাই মনে হল, তোর সাথে কথা বলি, গোপন সত্যটা পরস্পরের জানা দরকার। "

"তুই আমার দিকে ঘুরে দাঁড়া না! পিছু ফিরে কেন!"

"না রে,আমার পিছনের দিকটাই ঠিক আছে, সামনেটা সহ্য করতে পারবি না,ভয়ে মরেই যাবি।"

"খুব ভয়ঙ্কর বুঝি!"অলোকের মুখ কেমন ভয়ে বিবর্ণ।

"ভয় পাস না। তোর কোন ক্ষতি আমি করব না।তোকে আজও খুব ভালোবাসি রে । আমার দুঃখ একটাই যদি জানতাম, আমার প্রতি তোর এত ভালোবাসা, আমি মরতাম না।"

"কেন কী ভাবে!"

"পুজোর সময় বড়দিদির বাড়ি যেতাম না। রোগটাই তাহলে হতো না। ছোটদি বর্ধমানে থাকে, ওখানেই যেতাম, তুই তোর বাড়ি থেকে বর্ধমান গেলে, কেন যাচ্ছিস কেউ জানত না।এ কদিন দুজনে দুপুরে কত সিনেমা দেখতাম, আর সন্ধের সময় দুজনে পাশাপাশি হেঁটে কত ঠাকুরের প্যান্ডল প্রতিমা ঘুরে ঘুরে দেখতাম, ফুচকা খেতাম। তুই রাতের বাস ধরে বাড়ি চলে যেতিস, আমি ছোটদির বাড়িতেই থেকে যেতাম। খুব কদিন আনন্দ হতো,"আফসোসে দুঃখে অর্পিতার গলা যেন জড়িয়ে যাচ্ছিল।

"তুই তো মরে গেলি, আমি তোর কথা যতদিন বাঁচব ভেবে দুঃখ পাবো, আর কাঁদব।"

"এই জন্যই আমার তোর কাছে আসা। আমি আর লৌকিক জগতে নেই, তোর ভালোবাসার মুল্য  কিছুই দিতে পারব না ,তাই বৃথা কেন আমায় ভেবে এত কষ্ট পাবি! তুই কষ্ট পেলে, আমিও কষ্ট পাবো। তুই আমাকে ভুলে গেলে আমার দুঃখ হবে, কিন্তু সে তো জীবিতকালে অনেক দুঃখ দিয়েছিস। এখন আমি মরেও যদি তোর ভালবাসায় পাগল থাকি, আমার মুক্তি হবে না। আর তুই আমায় ভুলে গেলে, আমারও তোর প্রতি মোহ কাটবে।এখন তো তোর অন্তরটাও সব বুঝতে পারছি।  আমি খুব বিচলিত হয়ে তোর কাছে এসেছি। তোর অসুস্থ শরীর, ভীষণ ক্ষতি হচ্ছে তো ! কেন এত দুঃখ করছিস!"

অলোক বলে," ইচ্ছা করলেই কী ভোলা যায় রে পাগল! তুই আমার অন্তরে, পারিস তো সামনে দিকের তোর ভয়ঙ্কর রূপটা আমাকে দেখা, যদি সত্যিই ভয়ে মরে যাই তো দুজনে একসাথে সুখে থাকব। "

কিছুটা হতাশায় আর কিছুটা ক্ষোভে অভিমানে এবার অর্পিতা বলে, "তুই বড় অবুঝ, আমি আর থাকব না, চলে যাচ্ছি,এ জগতটা যে খুব সুখের কী করে বুঝলি! ইহোলোক ছেড়ে পরলোকে যাবার এত শখ ছেড়ে দে, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাব।তোর যতদিন ইচ্ছা হয় আমাকে ভালোবাস। আমি আর কিছু বলব না। তোর এতো ভালোবাসা তো জীবিতকালে বুঝলাম না,এখন সব বুঝতে পারব, তাতেই আনন্দ, মুক্তি না হয় হোক, আমি চললাম আর আসব না।" আলোক দেখল বারান্দায় আর কিছুই দেখা যায় না।

আজ প্রায় চল্লিশ বছর পরেও অলোক বুঝতে পারে না, সেদিনের অর্পিতার অশরীরী আত্মার সাথে তার সাক্ষাৎ আর কথাবার্তা, তার অসুস্থ অবসন্ন শরীরে বিকারের কোন স্বপ্ন না সত্যি ঘটনা!অর্পিতার দেখা আর কোন দিন সে পায়নি।একথা সে কাউকে বলেনি ,আর সে বিয়েও করেনি। অর্পিতাকে সে আজও স্বপ্নে ভালোবাসে।সেদিনের তার মৃত্যুর পর নির্জন রাতের কথাবার্তায় গাঢ় নিবিড়তা , তার প্রেম ভালোবাসাকে যেন আরও গভীর করেছিল।

                          নমস্কার



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy