Debdutta Banerjee

Tragedy Inspirational

4  

Debdutta Banerjee

Tragedy Inspirational

স্বর্গের উদ্যান ও একটি পারিজাত

স্বর্গের উদ্যান ও একটি পারিজাত

12 mins
2.6K


জানালা গলে চাঁদের আলো এসে পরেছে দুধ সাদা বিছানায়। মৃদু হাওয়ায় নেটের পর্দা উড়ছে। মাঝে মাঝে সে আলোছায়া আলপনা আকছে ঘুমন্ত ঋতের শরীরে। ঘুমালে ভীষণ মিষ্টি লাগে ঋতকে। একটা হালকা হাসি ওর চোখ মুখ জুড়ে থাকে। বড্ড নিষ্পাপ কোমল সে ছবি। ওর রোগে ভোগা ক্লান্ত শরীরটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে মিতুল। চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে বাগান। বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে নিজের শরীরটা সঁপে দেয় মিতুল। সারা বাগান জুড়ে ফুলের সমাহার। সবচেয়ে ভালো লাগে ঐ সাদা পিস লিলির ফুল গুলো। মালী বলে ওগুলো নলিন ফুল, পবিত্র ফুল ও বলে। ফুলে ওঠা কলি গুলো মৃদু হাওয়ায় মাথা নেড়ে নেড়ে গল্প করছে যেন। একসঙ্গে কয়েক হাজার নলিন ফুল ফুটবে। কলিতে গাছ গুলো ভরে গেছে।রোজ ফুটছে অল্প অল্প। সাদা ছাড়াও বেশ কয়েকটা রঙ আছে ওধারে। একটা ছোট্ট জলাশয়ে ওয়াটার লিলিও রয়েছে বেশ কিছু। এছাড়া নাম না জানা কত শত ফুল আর অর্কিড।


জ্যোৎস্না রাতে স্বর্গের উদ্যান মনে হয় এই বাগান কে। ঋতের কাশির আওয়াজে চমকে ওঠে মিতুল। ছুটে আসে ওর কাছে। পাশবালিশটা আকরে একটা পা তুলে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। ঠিক ওর বাবার মত। পরাগ ঠিক এভাবেই ঘুমায়। ঘুমন্ত ঋতের চোখে মুখে এসে পড়েছে কয়েকটা অবাধ্য। চুল। আলতো করে সেগুলো সরিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খায় মিতুল। মায়ের সাবধান বাণী মনে পড়ে। ঘুমন্ত শিশুকে আদর করতে নেই মা বলত। ওতে নাকি জেদ বাড়ে। নজর লাগে। মিতুল হেসে উড়িয়ে দিত। জেদ অবশ্য ঋতের তেমন নেই। এই সাত বছরের জীবনে প্রথম মিতুলের কাছে কিছু চেয়েছে সে। মাত্র তিনটে জিনিস চাইবে বলেছিল জন্মদিনে।


প্রথম দাবিটা মিতুল অনায়াসে মিটিয়ে দিয়েছে, দ্বিতীয়টা শুনে একটু দোনোমনা করলেও বাধ্য হয়েছে মেনে নিতে। অবশ্যে পরাগ রাজি হয়েছে বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। তৃতীয় টা ও এখনো বলে নি। ওটা নাকি দু জনকে একসঙ্গে বলবে।


দরজায় খুট করে শব্দে ফিরে তাকায় মিতুল। পরাগ এসে বসে ঘুমন্ত মেয়ের মাথার কাছে। অপলকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মিতুলকে বলে -"আমি থাকছি, তুমি একটু শুয়ে নাও। "


মিতুল বলে -"ঠিক আছে, তুমি বিশ্রাম করো। আমার অভ্যাস আছে। আমি এখানেই শোবো। "


পরাগ উঠে এসে বারান্দায় বসে। একটা মিষ্টি মন কেমন করা সুগন্ধ বাতাসে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় সব ক্লান্তি জুড়িয়ে যায়। মৃদু জ্যোৎস্নায় বাউন্ডারির বাইরে চা বাগান আর দূরের নীলচে পাহাড় যেন পটে আঁকা ছবি। হাওয়ায় কাঁপতে থাকা শেড ট্রি গুলো সে ভুল ভাঙ্গায়। পৃথিবীতে যে এত সুন্দর জায়গা আছে পরাগ জানতোই না। এমন সুন্দর জায়গায় দিনের পর দিন বসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। ভাগ্যিস ঋতের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। তাই তো এমন সুন্দর জায়গাটা দেখতে পেল।


কর্পোরেট জগত , কাজের চাপ আর টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে জীবনের সব আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছিল পরাগ বহু আগেই। সংসার মানেই একটা বোঝা মনে হত একসময়। গত পাঁচ বছরে বিজনেস ট্যুর ছাড়া কোথাও যায়নি পরাগ। কিন্তু উত্তরবঙ্গের এই চা বাগানের বাংলোতে বসে আজ খুব আফসোস হচ্ছে এভাবে এতগুলো দিন নষ্ট করার জন্য । কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। বুকের ভেতর একটা চাপা যন্ত্রণা, মিতুল আর ঋতের জন্য। পরাগ চাইলেই ওদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। কিন্তু কয়েকদিন আগে পর্যন্ত পরাগের জীবনে একটাই লক্ষ্য ছিল খ্যাতি আর অর্থ। প্রতিষ্ঠিত সে ছিলই, কিন্তু খ্যাতির চূড়ায় পৌছনোর লক্ষ্যে জীবনের সব কিছু বাজি রেখেছিল সে। আজ তার কাছে যা চেয়েছিল সব রয়েছে , তবুও নিজেকে একটা হেরে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছে। বিধাতার কাছে সে একটা পুতুল ছাড়া কিছুই না।


চোখটা লেগে এসেছিল ঠাণ্ডা হাওয়ায়। হঠাৎ গায়ে কম্বলের উষ্ণতায় তাকিয়ে দেখল মিতুল...!!


-"ভোরের দিকে এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে, তাই... তোমার তো আবার একটুতেই ঠাণ্ডা লাগে। "


বেশ লাগে পরাগের এই যত্ন টুকু। মিতুল মনে রেখেছে এই ছোটছোট জিনিস গুলো দেখে মনটা কেমন করে ওঠে। চলে যাচ্ছিল মিতুল। হাতটা ধরতে গিয়েও থেমে যায় পরাগ। কি মনে করে ঘুরে দাঁড়ায় মিতুল, বলে -"কফি খাবে? আমি খাবো একটু। "


দূরে কোথাও ঢং ঢং করে চারটে শব্দ জানিয়ে দেয় ভোর হতে চলেছে। একটা হাই তুলে পরাগ বলে -"নিয়ে এসো। "


একটু পরেই দামি বোন চায়নার টি সেটে কফি নিয়ে আসে মিতুল। কড়া ব্ল্যাক কফি চিনি ছাড়া এগিয়ে দেয় পরাগকে। নিজের দুধ চিনি দেওয়া ঘন লিকার টেনে নেয়। বিয়ের পরেই পরাগ বুঝেছিল মিতুলের সঙ্গে তার কিছুই মেলে না। মিতুল বড্ড উচ্ছল, চঞ্চল ঝরনার মতো। সারাক্ষণ বকবক করছে, এটা ভাঙছে, ওটা ফেলছে, ভীষণ অগোছালো। রান্না মানেই তেল ঝাল মশলা, তাছাড়া হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া, পার্টিতে যাওয়া বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড় এসব ছাড়া ও থাকতেই পারে না। অন্যদিকে পরাগ একটা শান্ত দীঘি যার গভীরতা বিশাল। ভীষণ গুছানো পরাগ বাড়ির হাল্কা রান্না ছাড়া খায় না। অফিসের বাইরে পার্টিতে যায় না। কাজের বাইরে ওর জীবনে কিছুই নেই। কথা বলে খুব কম, শোনার ধৈর্য নেই একদম। গান সিনেমা এসব নেই ওর জীবনে। বিয়ের কয়েকমাসের মধ্যেই দুজনেই বুঝে গেছিল ওরা ভিন্ন মেরুর বাসিন্দা। মিতুল তবু চেষ্টা করেছিল কিছুটা বদলানোর। কিন্তু জোর করে এতদিনের অভ্যাস বদলানো যায় না পরাগ বুঝেছিল। পরাগ চেষ্টাও করেনি কখনো নিজেকে বদলানোর। মিতুলকে সাহায্য ও করেনি। পরাগের মা সব কিছুতেই মিতুলের দোষ দেখতে পেত। ঋত হওয়ার পর পরিস্থিতি আরও বাজে হয়ে যায়। আসলে পরাগ এত তাড়াতাড়ি দায়িত্ব নিতে চায়নি। কিন্তু মিতুল চেয়েছিল কেউ আসুক ওদের মাঝে। মিতুলের একার ইচ্ছায় ঋত এসেছিল। ও যখন নিজের সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখবে বলে ঠিক করেছিল পরাগ বলেছিল ওকে কিছুতে জড়াতে না। মিতুল বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছিল সেই সময়। পরাগ কোনোদিন ডাক্তারের কাছে যায়নি মিতুলের সঙ্গে। মাঝে মাঝে মিতুলের স্ফীত পেটের দিকে তাকিয়ে খুব রাগ হত নিজের ওপর। মেয়েটা যেন ওকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইত ও একাই সব পারে। মা অবশ্যে সে সময় বোনের বাড়ি চলে গেছিল ঝামেলা এড়াতে।


 মুম্বাইতে অফিসের মিটিং এ যাচ্ছিল পরাগ। ভোরের ফ্লাইট ধরবে বলে বাথরুমে ঢুকেছিল। মিতুলের চাপা গোঙানোর আওয়াজ শুনে অবাক হয়েছিল। তবে কি সময় হয়ে গেলো!! রাগটা বাড়ছিল ক্রমশ। ডিম লাইটের মৃদু সাদা আলোয় মিতুলের নাইটিতে রক্তের দাগ দেখে মানবিকতার খাতিরেই ডাক্তার ডেকেছিল। ড্রয়ারে পেয়েছিল মিতুলের ডাক্তারের প্রেশকিপশন। তাই দেখে ওঁর পরিচিত হাসপাতালে নিয়ে গেছিল অচৈতন্য অবস্থায়। ফ্লাইট মিস করে নিজের ওপর রাগটা বেড়ে যাচ্ছিল যখন তখন ওটির বাইরে নার্স একটা কাপড়ের পুটলি নিয়ে এসে বলেছিল ওটা নাকি ওদের মেয়ে।


ছোট্ট লাল মাংসের পিণ্ডটা পিটপিট করে চাইছিল, পরাগের তখন অত ভাবার সময় নেই। পরের ফ্লাইটটা ধরেই ছুটতে হবে মুম্বাই। শুধু মিতুলের ভাইকে খবরটা দিয়ে চলে গেছিল ও। মিতুলকে একবার চোখের দেখাও দেখে নি।


অভিমানে অথবা জেদের বসে মিতুল মেয়ে নিয়ে ভাইয়ের কাছেই চলে গেছিল। চারমাস পর মায়ের অনুরোধে আর বোনের চাপে পরাগ গেছিল ওদের আনতে। মিতুল কোনো কথাই বলেনি, প্রতিবাদ ও করেনি। চলে এসেছিল চুপচাপ যেটা অবাক করেছিল পরাগকে। আসলে এই চারমাসে মিতুল বুঝেছিল ভাইয়ের সংসারে থাকার কষ্ট। এর চেয়ে স্বামীর ঘর ভালো। সেটা তো ঋতের নিজের ঘর এটা জানত মেয়েটা। মা নাতনীর নাম রেখেছিল পারিজাত, স্বর্গের অপ্সরাদের মতো গায়ের রঙ আর টানাটানা চোখ।এক মাথা কোঁকড়া চুল, হাত পা নেড়ে যখন খেলত পুতুলটা পরাগের মনটা কেমন উদাস হয়ে যেত। না, কখনো কোলে নেয় নি পরাগ। এভাবেই একদিন বসতে শিখল ঋত, তারপর দাঁড়ালো, হাটলো, আধো উচ্চারণে মায়ের আগে বাবা-বাবা বলতে শিখল। মাঝে মাঝে পরাগের ইচ্ছা হত কোলে নিতে। একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু কে যেন বারণ করত। ওর ভেতরে কে যেন ব্যঙ্গ করত। ও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকত। দূরত্ব বেড়েছিল মিতুলের সঙ্গেও। ঘর আলাদা হয়েছিল। কথা হতই না প্রায়। কিন্তু সমস্যাটা আস্তে আস্তে বাড়ছিল। ছোট্ট শিশু বুঝতোনা এসব। টলোমলো পায়ে বাবার ঘরে এসে অগোছালো করত গোছানো ঘর। কখনো দরকারি ফাইল টান দিত। কখনো বিছানা নোংরা করত। সে সময় অফিসে তুমুল চাপ। রাগের মাথায় মেয়ের উপর চিৎকার করত পরাগ। একদিন একটা দরকারি মেল টাইপ করছিল এমন সময় গুটিগুটি পায়ে এসে সিপিইউএর সুইচটা বন্ধ করেই খিলখিল করে হাসি। মাথা ঠিক রাখতে পারে নি পরাগ। ঠিক ছোট্ট মাথাটাই ছিল নাগালের মধ্যের। দু বছরের শিশুর মাথায় থাপ্পড়টা বেশ জোরেই পড়েছিল। ছিটকে পড়েছিল ঋত। কাঁদে নি। অবাক দুটো চোখে তাকিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। পরাগের চিৎকারেই ছুটে এসেছিল মিতুল । মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছিল। এর তিন দিন পর বাড়ি ছেড়েছিল ওরা। মিতুল নাকি একটা কাজ পেয়েছিল কল-সেন্টারে। ওর বান্ধবীর বাড়ি উঠে গেছিল। পরাগ খোঁজ নেয়নি আর। তখন সামনে ক্যারিয়ার আর টার্গেট। মা আর বোন ওদের দু পক্ষকেই বুঝিয়ে ক্লান্ত। এর ছমাস পর মায়ের চলে যাওয়ায় সামান্যতম যোগাযোগটাও ছিল না আর। আইনত ছাড়াছাড়ির জন্য কেউ চেষ্টা করেনি কখনো। পরাগ খরচ দিতে চেয়েছিল মেয়ের মিতুল নেয় নি। দীর্ঘ দু বছর পর শপিং মলে একবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু কথা হয়নি আর।


হঠাৎ একদিন বোন এসেছিল ঋতকে নিয়ে বাড়িতে। মিতুলকে না জানিয়েই এনেছিল। পাঁচ বছরের মেয়েটা অবাক হয়ে দেখছিল পরাগকে। সেই দু বছর বয়সের ঘটনাটা মনে পড়ে গেছিল পরাগের। বোন বলেছিল মিতুল হাসপাতালে, গল-ব্লাডার অপারেশন হয়েছে। -"নিজের সংসারটা গুছিয়ে নে দাভাই। বৌমনিকে নিয়ে আয়। এটা তোর মেয়ে। তোর রক্ত। প্লিজ দাভাই। " পারমিতার কথা গুলো শুনে পরাগ একবার মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল-"আমি কাউকে কোথাও যেতে বলিনি। নিজের ইচ্ছায় যে গেছে সে নিজেই ফিরবে। দরজা তো খোলাই আছে।"


মিতুলের মতোই টরটরি হয়েছিল মেয়েটা যদিও দেখতে পরাগের মতো । বলেছিল -"সব ফ্রেন্ডের বাবারা স্কুলে আসে, ঘুরতে নিয়ে যায়। তুমি কেমন বাবা? ইচ্ছা করে না আমার কাছে আসতে? তুমিও তো আসতে পারো। "


টুকটাক অনেক কথা হয়েছিল সেদিন। মিতুল ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। কাজের মেয়ের কাছে থাকত ঋত। ওদের সংসারের একটা আবছা ছবি দেখতে পেয়েছিল পরাগ। নিজের চূড়ান্ত গুছানো বাড়িটাকেও সেদিন ভীষণ ফাঁকা আর অগোছালো মনে হয়েছিল। এরপর মাঝে মাঝেই ঋতের ফোন আসত। শত ব্যস্ততাতেও পরাগ অপেক্ষা করে থাকত ঐ ফোনের। মাঝে মাঝে বড্ড অবাক লাগত নিজের এই বদল দেখে। ক্লান্ত দিনের শেষে ঋতের ঐ ফোন ছিল টাটকা অক্সিজেনের মতো। মিতুল জানতো এসব । কখনো বাঁধা দেয় নি মেয়েকে। মেয়ে যদি নিজেই নিজের বাবাকে চিনে নেয় এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে এটাই মনে হত ওঁর।


হঠাৎ করে পরপর দশদিন ফোন না আসায় বাধ্য হয়ে ফোন করেছিল পরাগ। শুনেছিল মেয়ে অসুস্থ। সে এক মাসের জন্য ইউএসএ যাচ্ছে জানিয়েছিল মিতুলকে। ফিরে মেয়ের সঙ্গে দেখা করবে ভেবেছিল।


ফিরেই পেয়েছিল খবরটা। ঋত আর মিতুলের যুদ্ধে যে পরাগ জড়িয়ে যাবে এভাবে ভাবে নি কখনো। মিতুল এসেছিল একদিন। একা, এই কয়েক বছরে ওর বয়স যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে। এই প্রথম মিতুল কিছু চেয়েছিল। জীবনে প্রথমবার, ঋতের জন্য... ওদের একমাত্র মেয়ের জন্য । কাঁপা কাঁপা হাতে এগিয়ে দিয়েছিল ডাক্তারের রিপোর্ট, আর ঋতের লেখা চিঠি।


 ঋতের প্রথম ইচ্ছা ও ওঁর সপ্তম জন্মদিন ঋত কাটাতে চায় স্বর্গের বাগানে। ও তো পারিজাত। সেটা তো স্বর্গের বাগানেই ফোটে। তাই একবার ও স্বর্গের বাগানে যেতে চায়।


তবে একা নয়, বাবা মায়ের সঙ্গে।ওঁর দ্বিতীয় ইচ্ছা কয়েকটা দিন ও বাবা আর মাকে একসঙ্গে চায় ওর জীবনে। যেমন ওর বন্ধুরা থাকে সেভাবেই ও স্বর্গের বাগানে বাবা মা এর সঙ্গে কাটাবে ওর জন্মদিন।


ছোট্ট দুটো চাহিদা, আর তৃতীয় উপহারটা ও চাইবে ওখানে গিয়ে, জন্মদিনের দিন।


 


জীবনে প্রথম পরাগের চোখ ভিজে উঠেছিল। ডাক্তারের রিপোর্ট আর এই চিঠি ওকে কাঁদতে শিখিয়েছিল। ছুটেছিল শহরের নাম করা কয়েকজন অঙ্কলজিষ্টের কাছে। মেল করেছিল বিদেশেও। ব্যাঙ্কে রাখা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা হেসেছিল ওর এই অপারগতায়। হেসেছিল বিধাতা। জীবনে প্রথম একটা কাঁধ খুঁজেছিল পরাগ। একটা আশ্রয়। একটু কাঁদার জন্য। পারিজাত যে ক্ষণজন্মা, পারিজাত আসলে কল্পনা, পারিজাতকে পাওয়া সহজ নয়। পেয়েছিল তারা, কিন্তু ইগোর লড়াই আর অর্থের মোহে হারাতে বসেছে।


পরাগের মনে পড়ছিল হাসপাতালের সেই মুহূর্ত, সাদা কাপড়ে জড়ানো এক মাথা কোঁকড়া চুল আর দুটো চোখ যেন হাসছিল। একটা টাটকা ফুলের মত। টলোমলো পায়ে বাবা-বাবা বলে ছুটে আসা একটা শিশু যাকে ছুঁতে পারেনি এই হাত। আঘাত করেছিল। ডাক্তার বলেছিল ও সব চিকিৎসার বাইরে। প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে ওর মাথার ভেতর টিউমার গুলো। জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন টিউমার। শেষ দিন এগিয়ে আসছে।অপারেশনের সময় নেই। সময় শেষ। চিকিৎসা বিজ্ঞান হার মেনেছিল।


ইচ্ছাপূরণের চাবিকাঠি খুঁজতে বসেছিল দুজন হেরে যাওয়া মা বাবা। কিন্নর থেকে কাশ্মীর, হিমাচল থেকে হিমালয়ের কোনা-খামচি কোথায় নিয়ে যাবে মেয়েকে ওরা।কোথায় আছে পারিজাত গাছ, স্বর্গের উদ্যান। পরাগ এসেছিল ঋতের কাছে, ল্যাপটপে একের পর এক পাহাড়ি রিসর্টের ছবি দেখাতে দেখাতে ঋত হঠাৎ এই ছবিটায় হাত রেখেছিল। লিলি ফুলের কেয়ারি করা লন, নাম না জানা ফুলের মেলা আর একটা ঝাঁকরা মান্দার ফুলের গাছ। যাকে অনেকেই পারিজাত বলে। কচি গলায় ঋত বলেছিল এই সেই জায়গা যা ও স্বপ্নে দেখে। এই সেই বাগান। ওখানেই যাবে ও। সঙ্গে সঙ্গে নেট সার্ফ করে পরাগ দেখেছিল এটা একটা চা বাগানের বাংলো, অবশ্য টুরিস্টদের থাকতে দেওয়া হয়।


 এরপর বুকিং আর ফ্লাইটের টিকিট করতে যা সময় লেগেছিল। বাগান আর বাংলোটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছিল ওদের। সত্যিই যেন এক টুকরো স্বর্গ। বসন্ত যেন এখানে বাঁধা পরেছে। পাখির ডাক আর প্রজাপতির ছুটোছুটি দেখে খুব খুশি ঋত। ওর চোখে মুখে সেই খুশির রেশ দেখে চোখের কোন ভিজে উঠেছিল পরাগ আর মিতুলের। যে মেয়ে কলকাতায় মাথা তুলতে পারছিল না সে এখানে এসে দুদিনেই বদলে গেছিল। কখনো বুনো খরগোসের পিছনে ছুটছে, কখনো মান্দার ফুল কুড়চ্ছে, কখনো নলিন ফুলের ঝোপে লুকোচুরি খেলছে। পরাগ আর মিতুল ও বদলে গেছিল । নলিন ফুল গুলো যখন তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে ফুটত এক এক করে ঋতের মুখে ছড়িয়ে পড়ত এক অপার্থিব হাসি যা ওর সব ক্লান্তি দূর করে দিত। ওঁর মুখে হাসি ফোটাতে ওঁর বাবা মা এখন সব করতে পারে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিচ্ছেদ ভুলে ওরাও কাছে এসেছিল আবার। পরাগ মেয়ের সঙ্গে থেকে দুদিনেই শিখে গেছিল বকবক করতে। ঋত একটা হালকা পালকের মতো ওদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল আনন্দের বন্যায়।


রাতে ক্লান্ত ঋতকে বিছানায় শুইয়ে দু ধারে বসে থাকত দুজন। দু জনেই ভাবত সময় কে যদি বেঁধে রাখা যেত!! প্রতিটা মুহূর্ত মেয়েটা এগিয়ে চলেছিল এক অন্ধকারের দিকে। অথচ ওরা লুকিয়ে চোখের জন ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারছে না।


সেদিন দোলনা দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়েছিল ঋত। ওর পালকের মত নরম হাল্কা শরীরটা তুলে ঘরে আনছিল পরাগ। হঠাৎ ছোটছোট হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ঋত বলে -"পরশু কিন্তু জন্মদিন। মনে আছে তো? "


মেয়ের কপালে স্নেহ চুম্বন দিতে দিতে এক ব্যর্থ পিতা বলে -"কি চাস তুই বল ? আমি দেবো। পৃথিবীর সব কিছু দেব তোকে আমি।“


চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক তুলে ঠোঁটে হাত দিয়ে চুপ করতে বলে ঋত। মিতুল এসে বলে -"এখন না বললে পাবে না যে। এই বাগান থেকে শহর বহু দূর। কি চাই বললে কাল এনে রাখতাম। "


-"না, পরশু বলবো। " বলে চোখ বোঝে মেয়ে।


ঘুমন্ত মেয়ের দু পাশে দু জন, যেন একটা নদীর দুই তীর....


পরদিন থেকে ঋত আরও দুর্বল। কাশির সঙ্গে নাক মুখ দিয়ে রক্ত আসছে। এক লোকাল ডাক্তার এসে কষ্ট কমানোর জন্য মরফিয়া দিয়েছিল। সারাদিন আচ্ছন্ন মেয়েকে নিয়ে দু জন বসা।কতো কথা ভিড় করে আসে মনের মাঝে। মিতুল ভাবে জন্মদিনটা পার করবে তো ঋত!!


মাঝ রাতে উঠে বসে ঋত। বাগানে ছেঁড়া ছেঁড়া জ্যোৎস্নার আলোয় দুধ সাদা নলিন ফুল মাথা নাড়ছে। টুপটাপ খসে পড়ছে মান্দারের পাপড়ি। পারিজাত !! স্বর্গের ফুল, কেউ চেনে না। বোধ হয় চোখ লেগে এসেছিল দু জনের। একাই বেড়িয়ে আসে ঋত। যেন স্বর্গের বাগানে ছোট্ট পরী। শিশির ভেজা ঘাসে পা ফেলে ছোট্ট প্রজাপতির মত উড়ে বেরায় সে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে খালি বিছানা দেখে চমকে ওঠে মিতুল । ওর মৃদু চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যায় পরাগের। দুজনেই বাইরে বেরিয়ে আসে। ভোরের আলোয় মান্দার যাকে অনেকে বলে পারিজাত সেই গাছের নিচে ফুলের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত ঋত। ঠিক যেন সদ্য ফোটা পারিজাত।


কোলে তুলতে গিয়ে কেঁপে ওঠে পরাগ।এতো ঠাণ্ডা শরীর!! থমকে যায় সময়।মিতুল না ধরলে হয়তো পড়েই যেত। মেয়েকে নিজের বুকের ওম দিয়ে গরম করতে টেনে নেয় মিতুল। বলে -"আজ যে ওর জন্মদিন। ও উপহার না নিয়ে যেতেই পারে না। ও তো এখনো বলল না কি চাই ওঁর!! "


ঘরে এনে বিছানায় শোওয়ায় ওঁরা মেয়েকে। জানালা দিয়ে সূর্যের প্রথম গোলাপি আলো এসে পড়ে ঋতের গায়ে। ওর মুখে এক পরিতৃপ্তির হাসি। সব দুঃখ কষ্ট কাটিয়ে চলে গেছে ও ধরা ছোঁওয়ার বাইরে। এক স্বর্গীয় অনুভূতি ওর চোখে মুখে। আলগা হাতের মুঠোয় চিরকুটটা প্রথম পরাগ দেখেছিল। ওটায় লেখা-"আমি আমার প্রতিটা জন্মদিন এখানেই কাটাতে চাই তোমাদের সঙ্গে। আরেকবার ছোট হয়ে তোমাদের ভালোবাসা পেতে চাই। বাবার হাত ধরে হাঁটা শিখতে চাই, মা আর বাবার গায়ের গন্ধ মেখে ঘুমোতে চাই। যা যা পাইনি এতদিন সব চাই। এটাই আমার আগামী জন্মদিনের উপহার। "


পরাগের চোখের জলে ঝাপসা হয়ে আসে লেখা গুলো। মিতুলকে আঁকড়ে ধরে পরাগ। দু জনের চোখের জল ঝরে পড়ে ওদের পারিজাতের উপর।


 


*******(এক বছর পর)


 পারিজাত গাছের নিচে ছোট্ট দোলনা, এক মাসের মেয়েটা শুয়ে দোল খাচ্ছে। টুপটাপ খসে পড়ছে ফুলের পাপড়ি। খিলখিল করে হাসছে ছোট্ট পরী। মিতুল আর পরাগ একটা মুহূর্ত মেয়েকে কাছ ছাড়া করে না। স্বর্গের সন্ধান তো মেয়ে দিয়েই গেছে। এবার শুধু হাতে হাত রেখে মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করবে ওরা। ওদের এই স্বর্গীয় মুহূর্তের সাক্ষী ঐ ফুল পাখি আর গাছ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy