মৃগনয়নী
মৃগনয়নী
বসন্তের রঙ লেগেছে গাছের ডালে ডালে। অশোক আর কিংশুকের রঙে সেজে উঠেছে বনানী। বহুদিন পর আজ একা বেরিয়েছেন রাজা মান সিং, শিকার খেলবেন বলেই অরণ্যে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু এই অপরূপ শোভায় মন ভরে উঠেছে। কে যেন মুঠো মুঠো ফাগ ছড়িয়ে দিয়েছে বনে বনে।গোয়ালিওরের চারদিকের রূক্ষ প্রকৃতিতেও যে বসন্তের ছোঁঁয়া লেগেছে বোঝা যাচ্ছ। এই গহীন বনেও শোনা যাচ্ছে কোকিলের কুহু তান, চঞ্চলা তটিনীর তীরে ক্রিয়া মত্ত হরিণের ঝাঁক, শীতের দু একটা পরিয়ায়ী পাখি এখনো রয়ে গেছে পথ ভুলে। একটা বড় পাথরের উপর বসে এই রূপ সুধা পান করতেই ব্যস্ত রাজা মানসিং।
কিন্তু হঠাৎ নৃত্যের মাঝে ছন্দপতনের মতন একটা কালো উল্কার মত কী যেন ছুটে গেলো ওদিক দিয়ে। চকিত বিহ্বলতা কাটিয়ে নিপুন শিকারীর দৃষ্টি চিনে নিতে চাইল সেই কালো বিদ্যুতকে। বন্য শুকর নাকি অন্য কিছু। ধনুর্বাণ হাতে নিতেই মান সিংকে আরেকবার অবাক করে ছুটে এলো একটা তীর, পেছনে রেশম সুতার ঝালর দেওয়া। নিপুন নিশানায় তা গিয়ে গেঁঁথে গেল শিকারের গায়ে। কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়েছে শিকার। না, মানসিংহর তীর জ্যা মুক্ত হয়নি। তার আগেই... চট করে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন রাজা মান সিং। এই গোয়ালিয়রের অধিপতি। তাঁঁর এলাকায় এতো নিপুন শিকারী কে রয়েছে দেখতে উৎসুক তিনি। গুনির কদর করতে জানে গোয়ালিয়রাধিপতি। একটা মাত্র তীরের সাহায্যে অত বড় শিকারটাকে ঘায়েল করা খুব সহজ নয়। এক তীরের ঘায়েই লুটিয়ে পড়েছে বেশ বড় বন্য শুকর।
নীল একটা কাপড় সর্বাঙ্গে জড়ানো, ছিপছিপে এক অবয়ব বেরিয়ে এল ওধার থেকে, মুখ কাপড়ে ঢাকা, দুই চোখের কাজল কালো দৃষ্টিতে কৈশরের চপলতা। কাজল কালো দু নয়ন খুঁজছে আহত বা নিহত পশুটাকে। শুকরটা দেখতে পেয়ে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ালো দু দণ্ড। তারপর অবলীলায় পিঠে তুলে নিল।
মান সিং বেরিয়ে এসেছিলেন গাছের আড়াল থেকে, ঠিক তখুনি মুখের কাপড়টা সরে গেলো, আর বিস্ময়ে কথা বলতেই ভুলে গেলেন গোয়ালিয়র নরেশ।
মৃদু হাওয়ায় কাপড়টা সরে যেতেই একগুচ্ছ চুল কাপড়ের বাঁঁধন থেকে মুক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কাধের উপর, কিশোর নয় এ যে কিশোরী। ভিরু হরিণীর মত স্ত্রত দৃষ্টিতে একবার মুখ তুলে চাইল মেয়েটি। পরক্ষণেই বিদ্যুৎ বেগে ছুটে ঢুকে গেলো ঐ সবুজ বনানীর ভেতর।
অস্ফুটে মান সিংএর মুখ দিয়ে শুধু একটাই শব্দ বের হল 'মৃগনয়নী'।
এক পক্ষ কাল পার হয়েছে, মন বড়ই বিক্ষিপ্ত। কিছুই ভালো লাগছে না মান সিংএর। সেদিন সেই অরণ্যে ঐ চঞ্চলা কিশোরীর চোখ দুটো শুধু বারবার ভেসে ওঠে মানসপটে। রাজকার্যে মন নেই । আরো দুদিন গেছিলেন ঐ অরণ্যে, কিন্তু আর দেখা পাননি তার। এখনো মাঝে মাঝেই চমকে উঠছেন মানসিং। সেদিন ঐ সময়টুকু কেমন যেন ছবির মত আঁকা হয়ে গেছে মানসপটে। চোখ বুঝলেই দেখতে পাচ্ছেন তিনি সেই কিশোরীকে।
প্রতিহারির ঘোষণায় চমক ভাঙ্গে, এক অমাত্য দর্শন অভিলাষী। মনে পড়ল আজ রাজ্যের প্রান্তরে গুর্জরদের যে বসতি রাই গ্ৰাম সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। বিক্ষিপ্ত মনেই চললেন অমাত্যর সঙ্গে । রাই গ্ৰামের কাজ সেরে গ্ৰাম প্রধানের সঙ্গে মন্দিরে এসেছিলেন মহারাজ। হঠাৎ কানে ভেসে এলো মধুর সঙ্গীত। রাজা মান সিং বরাবর সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোশক। এতো সুমিষ্ট স্বরে কে গাইছে প্রভ
ু বন্দনা!
সঙ্গীতের সমাপ্তির পরেও রেশ রয়ে যায় মনের মাঝে। গ্ৰাম প্রধান জানালেন পুরোহিতের পালিতা কন্যা অনাথা নিন্নি গাইছিল আপন খেয়ালে। মেয়েটি বড় ভালো।
হঠাৎ বাইরে থেকে একটা মৃদু কোলাহল ভেসে আসে। গ্ৰাম প্রধান অতিথিদের নিয়ে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই দেখতে পায় এক উন্মত্ত মহিষ ছুটে আসছে ওধার থেকে আর পথ মধ্যে খেলছে একটি শিশু। সবাই চিৎকার করছে। কিন্তু বোধহীন শিশুর সেদিকে খেয়াল নেই। কেউ ছুটে এসে শিশুকে সরিয়েও নিচ্ছে না।রাজা মান সিং চিৎকার করে ওঠেন। চকিত এক বিদ্যুৎ রেখা যেন ছুটে গেল। শিশুকে ছুড়ে দিল মায়ের কোলে, কিন্তু ততক্ষণে সাক্ষাৎ যমরাজের উন্মত্ত বাহন তার সামনে। অসম্ভব ক্ষিপ্ততায় মহিষের সিংদুটো দু হাতে চেপে ধরেছে সেই ত্রান কর্তা, সর্ব শক্তি দিয়ে মহিষটিকে পরাস্ত করতে সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু অবাক মহারাজ দেখছেন সেই ত্রাতার ভূমিকায় তাঁঁর রাজ্যের কোন পুরুষ নয় এক নারী। না নারীও নয় এক কিশোরী, পরণে শক্ত করে জড়ানো পোশাক, লম্বা বিনুনি চাবুকের মত ঝুলছে পিছনে। রাজ্যের পুরুষেরা দূর থেকে দেখছে এ অসম লড়াই। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কয়েকটা মুহূর্ত, যেন অনন্তকাল, হাতের তালু ঘেমে উঠছিল রাজা মান সিংএর। ও কি পারবে? নাকি পারবে না!
বিস্ময়ে হতভাগ মহারাজ। কিন্তু কয়েক মিনিটের ভেতর ক্ষেপা মহিষকে হারিয়ে দিল ঐ মেয়ে। উন্মত্ত জনতার গলায় জয়জয়কার। আর রাজা মান সিং অস্ফুটে বললেন -'মৃগনয়নী।'
চারচোখের মিলন আগেই হয়েছিল, হৃদয় হারিয়েছিলেন গোয়ালিয়রনরেশ। পুরোহিতের আশ্রিতা কন্যা নিন্নির রূপে গুনে মুগ্ধ নরেশ নিন্নির পানীপ্রার্থী।কিন্তু কিশোরী নিন্নি রেখেছিল তিনটি শর্ত।
তার জন্য আলাদা মহল চাই, গ্ৰামের রাইন নদীর জল যেন সে মহলে পৌঁছে যায়।
বাকি রাণীদের মত পর্দার আড়ালে না থেকে সে ক্ষত্রিয়দের মত যুদ্ধে যাবে রাজার সঙ্গে।
সঙ্গীত তার প্রাণ। সঙ্গীত চর্চায় যেন কোনো বাধা না আসে।
প্রেমিক মান সিং নতজানু হয়ে মেনে নিয়েছিলেনসব শর্ত। গুর্জর মহল আজও সেই ইতিহাসের সাক্ষী। এর অপূর্ব অলঙ্করণ, দেওয়াল চিত্র মৃগনয়নী আর মান সিং তোমরের প্রেমের নীরব সাক্ষী। বৈজু বাওরা স্বয়ং গান শেখাতেন রাণীকে।সেতার বাদনে মৃগনয়নী ছিল সেরা। রাগ টোড়ীর সঙ্গে গুর্জরী সঙ্গীতের মেল বন্ধনে রাণী তৈরি করেছিল গুর্জরী টোড়ী রাগ, যা মৃগনয়নীর নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে। আর সব রকম আরাম বিলাসিতা ছেড়ে যুদ্ধে সে ধনুর্ধর হাতে থাকত মহারাজের পাশে। বাকি রাণীরা মেনে নেয়নি এই গুর্জর নারীকে। অবজ্ঞা ও লাঞ্ছনা করেই তারা আনন্দ পেতো। কিন্তু সেসবে আমল দিত না এই মহান নারী। মান সিং এর সবটুকু ভালোবাসা পেয়েছিল মৃগনয়নী। চাইলে ছিনিয়ে নিতে পারত সিংহাসন। কিন্তু সঙ্গীত আর সৃজনের বাইরে আর কিছুই চায়নি সে। রাজাকে বলেছিল জ্যষ্ঠ রাজপুত্র হবে সিংহাসনের আসল হকদার। আজো গোয়ালিয়রের ভগ্ন প্রাসাদে কান পাতলে শোনা যায় মৃগনয়নী আর মান সিং এর প্রেমালাপ। পূর্ণিমার রাতে সেতার বাদনের মিষ্টি সুর ভেসে আসে গুর্জর মহল থেকে। চাঁদনী রাতে দুটো অবয়ব ছাদের অলিন্দে বসে আজো কত স্বপ্নর জাল বোনে। মৃগনয়নী আর মান সিংএর গল্প লেখা রয়েছে গোয়ালিয়রের কেল্লায়। ভালোবাসা থেকে যায়। অমর হয়ে ওঠে এভাবেই।