সম্পূর্ণা
সম্পূর্ণা
শীতের দুপুরের মিষ্টি রোদ গায়ে মেখে ছোট্ট বাগানটায় বসে একটা কবিতার বই পড়ছিল শ্রেয়া, হঠাৎ পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরল পুপু।
-''আরে, নিশ্চই কোনো ভালো খবর। নতুন চাকরিটা হয়ে গেছে নিশ্চই?'' হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে শ্রেয়া।
-''সব তুমি আগেই টের পেয়ে যাও মামনি, ধুর..'' ছদ্ম অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে পাশে এসে বসে পুপু।
-''তুই খুশি হলেই এভাবে ছুটে আসিস। সেই ছোট থেকেই দেখছি। তোর জড়িয়ে ধরা মানেই খুশির খবর। সেই যে বার স্কুলে প্রথম হলি... তারপর জেলায় প্রথম.... কলেজে ফাষ্টক্লাস... '' একে একে শ্রেয়ার মনে পড়ে বিগত দিন গুলোর কথা। পুপু, তিতি, কুহু ওদের যুদ্ধের কথা। নাজমার কথা। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
-''ঐ দেখো, এমন আনন্দের দিনে আবার হিরা মুক্তার বর্ষণ কেনো ? ওঠো তো, এদিকে চল। অনেক কাজ আছে। '' শ্রেয়ার চোখের থেকে গরিয়ে পড়া জলের ফোঁঁটা মুছিয়ে ওকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায় পুপু। তিতি একটা বড় কেক সাজিয়েছে টেবিলে। কুহু খাবার সাজাচ্ছে প্লেটে।
-''করেছিস কি তোরা ? এ তো রিতিমত পার্টি!!'' শ্রেয়া ওদের কান্ড দেখে বলে।
-''পার্টি হবে না !! আজ কত আনন্দের দিন বলতো? পুপুর এত ভালো চাকরি, দিদির প্রমোশন সব সেলিব্রেট হবে আজ। এসো, কেকটা কেটে ফেলো এখন ।'' কুহু বলে।
-''কিন্তু কেক আমি কেন কাটবো ? ওটা ওরা কাটবে ...''
তিন জোড়া চোখ একসাথে শ্রেয়ার দিকে তাকায়।
-''তুমিই কাটবে, এ তোমার সাফল্য, তোমার কৃতিত্ব, এসো '' দু জন ওকে টেনে নিয়ে যায় টেবিলের কাছে।
আবার অবাধ্য বারিধারা নেমে আসে দু গাল বেয়ে। বাবা আর নাজমাটা দেখে গেলো না!! দেওয়ালে ওদের বড় ছবি, মনে হল হাসছে।
****
-''দেখো বৌমা, সায়ক যখন তোমায় বিয়ে করবে বলেছিল আমরা এক কথায় মেনে নিয়েছি। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তোমাকেও আমাদের কথা ভাবতে হবে এবার। '' মনিদীপা দেবীর কথায় কেঁপে উঠেছিল তেইশ বছরের মেয়েটা। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেছিল মুহূর্তে। সায়কের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল শুধু শ্রেয়া। জোর করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল তার এত বছরের ভালোবাসার মানুষটা। হঠাৎ করেই মানুষটা বড্ড অচেনা হয়ে উঠেছিল।
দীর্ঘ তিন বছরের প্রেমের পর তিন বছর হল বিয়ে হয়ে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিল শ্রেয়া। শাশুড়ি, মাসী শাশুড়ি আর এক ছেলের ছোট্ট সংসারে আদর যত্ন ভালোবাসা সবই পেয়েছিল শ্রেয়া। কিন্তু বিধাতা বোধহয় সবাইকে সুখ দেয় না। শাশুড়ি আর স্বামীকে সন্তানসুখ দিতে পারে না যে নারী সমাজে তার স্থান হয় না একথা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সময়। ডাক্তার যখন জানিয়েছিল শ্রেয়া অসম্পূর্ণা, কখনই মা হতে পারবে না সায়ক ওর হাতটা ধরে নি আর। মা ডেকে যাকে আপন করে নিয়েছিল সেই মা ওর মা না হতে পারার অপরাধে ওকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। আর মায়ের ইচ্ছাকে বৈধ্যতা দিতে সারা জীবনের জন্য যে হাত ধরেছিল সে ওর হাতে ধরিয়েছিল কোর্টের কাগজ। ছয় বছরের সম্পর্ক শেষ হয়েছিল একটা কাগুজে সইএর মধ্যস্থতায়। মাসি শাশুড়ির ইন্ধন ও ছিল কিছুটা।
সায়ক টাকা দিতে চেয়েছিল, নেয়নি শ্রেয়া। বাবার ছোট্ট বাড়িটা আর মায়ের গহনা কটাই ছিল ওর সম্বল। মাথা উঁচু করেই বাঁচতে চেয়েছিল চিরকাল। অনেকেই সহানুভূতি দেখিয়ে দত্তক নেওয়ার কথা বলেছিল, অনেকে ওকে কেস লড়তে বলেছিল। ওর কানে লেগেছিল মনিদীপাদেবীর কথাগুলো, নাড়ীছেড়া ধন, বংশের রক্ত, পেটে না ধরলে নাকি মা হওয়া যায় না, এমন আরো কত কি !! দিনের পর দিন ওদের দুই বোনের কাছে অপমানিত হতে হতে ওর নারীসত্তা পাথর হয়ে গেছিল। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল ও এক খোলসের ভেতর।
বাবা ছিল মাথার উপর ছাতার মত। বৃদ্ধ লোকটা দুঃখ পেলেও ওকে বুকে টেনে নিয়েছিল। ওকে বুঝিয়েছিল জন্ম দিলেই শুধু মা হওয়া যায় না। যশোদার গল্প নতুন করে শুনিয়েছিল।
নাজমা যখন পুপু আর তিতি কে নিয়ে কাজে আসত, ওরাও গল্প শুনত বুড়ো দাদুর কাছে বসে, তিতি তখন চার বছর আর পুপু দেড় বছর। দুই মেয়ের মা হওয়ার অপরাধে নাজমার কপালে রোজ জুটত মার। পেট ভরে খেতে পেত না বাচ্চা দুটো। এ বাড়িতে এলে ভালো মন্দ খেতে পেত শিশু দুটো।
এমনি এক শীতের রাতে কাঁঁদতে কাঁঁদতে এসেছিল নাজমা ঘুমন্ত পুপুকে নিয়ে। ওর বর আমজাদ পুপু আর তিতিকে বিক্রি করে দিতে চাইছে মাত্র দশ হাজার টাকায়। পেছন পেছন এসেছিল আমজন। শয়তানের নতুন রূপ সেদিন দেখেছিল শ্রেয়া, জন্মদাতা পিতা সন্তানকে পন্য বানিয়ে ব্যবসায় নেমেছিল। আর এক অসম্পূর্ণা নারী বাধ্য হয়েছিল সেদিন বাচ্চা দুটোকে বাঁচাতে। পনেরো হাজার টাকায় আমজাদ কে ফেরত পাঠালেও শ্রেয়া জানত ও আবার আসবে। টাকার দরকার হলেই আসবে। অনেক বুঝিয়ে নাজমাকে ও নিয়ে গেছিল থানায়।সন্তান সম্ভবা নাজমা অনাগত সন্তানের কথা ভেবে আর বাকি দুজনের মুখ চেয়ে আমজাদের নামে রিপোর্ট করেছিল সেদিন। কেস মিটতেই ঝামেলা এড়াতে নাজমা ও ওর সন্তানদের নিয়ে বাবার সাথে শ্রেয়া চলে এসেছিল গ্ৰামের বাড়ি। এরপর এসেছিল কুহু, নাজমা কুহুকে প্রথম দিনই শ্রেয়ার হাতে তুলে দিয়েছিল। ঐ নরম মাংসপিন্ডকে বুকে চেপে ধরে সেদিন কেঁদেছিল শ্রেয়া। ঐ ধুকপুক করতে থাকা প্রাণকে আঁকড়ে নতুন করে বেঁচে উঠেছিল আবার ও। পূর্ণতা পেয়েছিল ওর নারীত্ব।
*****
আজ শ্রেয়া তিন সফল সন্তানের মামনি। ওর তিন মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ আর ওর দিকে আঙ্গুল তোলে না। শ্রেয়া একটা এনজিওর সাথে কাজ করে পথ শিশুদের উপর। শিশুদের জামা কাপড় খাবার শিক্ষা এসব দেয় ওর সংস্থা। বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্থাও করেছে ওরা। বাবার বাড়িটায় একটা বৃদ্ধাবাস করেছে শ্রেয়া। নির্যাতিতা বৃদ্ধাদের মাথার উপর একটু ছাদের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। ওর মেয়েরাও ওকে সাহায্য করে সব সময়। তিন মেয়ে মিলে ওর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে ধীরে ধীরে।
*****
-''মামনি, কুহু কাল ষ্টেশনের কাছ থেকে একটা বুড়িকে তুলে এনেছে। সকাল থেকে বুড়িটা শুধু ভুলভাল বকছে, থাকতে চাইছে না। তুমি চল তো একবার। '' তিতির কথায় শ্রেয়া তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে। এমন মাঝে মাঝেই হয়। পরিবার যখন বৃদ্ধ বয়সে এদের রাস্তায় ফেলে যায় এদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তেইশ বছর বয়সে গৃহহারা হয়ে শ্রেয়া বুঝেছিল সে যন্ত্রনা। বাবা ছিল বলে ওকে পথে দাঁড়াতে হয়নি। কিন্তু একটা নিশ্চিত আশ্রয়, একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপের থেকে বেরিয়ে আসার যন্ত্রনা যে কি ও জানত।
বৃদ্ধাবাসের বারান্দায় জুবুথুবু হয়ে কুকড়ে বসে রয়েছে বুড়িটা। শীতটা বড্ড বেশি এ বছর। এই শীতের মধ্যে বুড়িকে ষ্টেশনে ফেলে গেছিল ওর নিজের লোকেরা।
ভেঙ্গে পড়া চেহারা আর বলিরেখায় কুচকানো মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে শ্রেয়া। বৃদ্ধা ছানি পড়া চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকে, অতীত হাতরে কিছু খুঁজতে চায়।
-''মামনী, ও বার বার কেমন অসংলগ্ন কথা বলে চলেছে। '' কুহু বলে ওঠে।
-'' তুমি... এভাবে ? এখানে ...?'' শ্রেয়া বৃদ্ধার পাশেই বসে পড়ে।
-''কে ... কে তুই ?'' কাঁপা গলায় বৃদ্ধা প্রশ্ন করে।
-''তোমাকে .....তোমার ছেলে কোথায় ?'' শ্রেয়া বৃদ্ধার হাতের উপর একটা হাত রাখে।
-''চলে গেছে, বৌএর সাথে .... ওদের নতুন ফ্ল্যাট, নাতির বিয়ে দেবে। আমায় আর রাখবে না। আমার বোনটা মরে বেঁচেছে। আমি মরি না কেনো ?'' বৃদ্ধার দু চোখ দিয়ে প্লাবন নামে।
-''তুমি পুলিশে যাবে ? খবর দেবো থানায়? ওরা তোমাকে রাখতে বাধ্য। '' শ্রেয়া বলে।
-''না, ওখানে আর ফিরবো না। তার চেয়ে ফুটপাতে থাকবো। ভিক্ষা করবো। আমায় ছেড়ে দাও। '' বুড়ি উঠে পড়ে আবার।
-''কিন্তু কেনো ? তোমার অধিকার ....?'' শ্রেয়া প্রতিবাদ করতে চায়।
-''এ সব আমার পাপের ফল। ঘরের লক্ষ্মীকে ঘর ছাড়া করেছিলাম। ...'' বুড়ি যেন এক ঘোরের মধ্যে বিড়বিড় করে।
-''এখন থেকে আমাদের এখানে থাকবে তাহলে ....'' চোখ মোছে শ্রেয়া।
-''বংশধর নয় সাপ... কাল সাপ... মা আর ছেলে সব শেষ করল। '' বিলাপ করে বৃদ্ধা।
ভেজা চোখে শ্রেয়া বৃদ্ধাকে ভেতরে নিয়ে যায়। বৃদ্ধা বারবার শ্রেয়ার দিকে তাকায় আর চোখ ডলে, হঠাৎ ওর হাতটা চেপে ধরে বলে -''সত্যি করে বল তুই কে ? এমন চেনা লাগে কেনো ?''
তিতি আর কুহুকে কাছে টেনে নেয় শ্রেয়া। বলে -''আমি ওদের মা, আমার তিন মেয়ের সাথে তোমাকেও রাখবো আমার কাছে।থাকবে আমার মেয়ে হয়ে। মনে করো আমি তোমার মা। '' নিজেকে ভীষণ হাল্কা লাগে হঠাৎ করে। এত বছরের দুঃখ, রাগ, অপমান কোনো বোধ আর নেই বুকের ভেতর। আছে শুধুই স্নেহ। পরম যত্নে বৃদ্ধাকে ভেতরে নিয়ে যায় এক মা।