মাতৃভাষার ঋণ
মাতৃভাষার ঋণ
বিধ্বস্ত হেরে যাওয়া শরীরটাকে একপ্রকার টেনে নিয়ে ঐশিক বেরিয়ে আসে শতাব্দী প্রাচীন বিদ্যালয়টার ভেতর থেকে। শেষ বারের মত একবার তাকায় কমলা রঙের দোতলা বাড়িটার দিকে, ঐ মাঠ, পুকুর, বাগান... কত স্মৃতি, ঝাপসা হয়ে আসে। ঠাকুর্দার দাদুর হাতে গড়া এ বিদ্যালয় থেকে একটা সময় এলাকার কত যশস্বী ছেলে মেয়ে বেরিয়েছে। এটাই এলাকার প্রথম অবৈতনিক বিদ্যালয় ছিল । ঐশিকের বাবার ছোটবেলায় যখন জমিদারি প্রথা উঠে গেছিল তখন সরকার এই স্কুলের দায়িত্ব নিয়েছিল। আজ সেই স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। গত পাঁচ বছরে ছাত্র ভর্তির হার এতটাই কম যে সরকার আর এ স্কুল চালাবে না। অনেক চেষ্টা করেছিল ঐশিক, কিন্তু এলাকার কেউ আর বাংলা মাধ্যমে বাচ্চাদের পড়াতে চাইছে না। পাড়ার মোড়ে মোড়ে গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোয় রঙিন প্রজাপতির মতো বাচ্চাদের ভিড়। দলে দলে চলেছে মায়েরা এসব স্কুলে বাচ্চা পড়াতে। শিক্ষার থেকেও এসব স্কুলে দেখনদারিটা বড্ড বেশি। ঐশিকের দাদার মেয়েরাও একটা ইংরেজি মিশনারী স্কুলে পড়ছে। ঠিক এই ভাবেই গত বছর বন্ধ হয়ে গেছিল ওদের পাশের পাড়ার দুটো স্কুল।
বাড়ি ফিরে সিঁড়ির ল্যান্ডিংএ দাদামশাইএর ছবিটার সামনে থমকে দাঁড়ায় ঐশিক। পারল না ও এ বাড়ির সম্মান রক্ষা করতে। ছবির দাদামশাই কি বুঝতে পারছে ও কতটা অপারগ। দোতলার কোনার লাইব্রেরী ঘরে গিয়ে দু হাতে মাথা টিপে বসে ঐশিক। মাত্র এগারো জন এবছর মাধ্যমিক দিয়েছে এ স্কুল থেকে। প্রতি ক্লাসে গড়ে পনেরো থেকে কমে ছাত্র সংখ্যা এখন দশের নিচে। রমাপদ মেমরিয়াল স্কুলের এসব বাচ্চাদের ত্রিধারা হিন্দু একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে সরকার থেকেই। ত্রিধারায় বাংলা হিন্দি ইংরেজি তিনটে মাধ্যমেই নাকি পড়ানো হয়। তবে বাংলা মাধ্যমে ছাত্র সেই হাতে গোনা।
ঐশিক শেষ বার বলতে চেয়েছিল এই স্কুলটাতেও যদি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ব্যবস্থা চালু করা যায়... পাত্তাই দেয়নি ডি আই অফিসের কর্মকর্তারা। সরকারি আমলাদের পিছনে কম ছোটাছুটি তো করল না ঐশিক।
-''কেউ যদি নিজের মাতৃভাষাকে ভালো না বাসে তুই কি করতে পারবি বাবু! মন খারাপ করিস না। " মায়ের কথায় সম্বিত ফেরে ঐশিকের।
-''আজকাল কেউ তো বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মেনে নিচ্ছে না। অথচ এই বাংলা মাধ্যমে পড়েই তোর বাপ দাদারা বিলেত গেছিল। ঐক্য নিজের মেয়েদের কি বাংলায় পড়াচ্ছে? ঘরের শিশুদের যদি আমরা মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে না শেখাই তবে বাইরের লোকের দোষ দিয়ে কি লাভ!" ছেলের মাথায় স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দেন অনিমা দেবী।
-''মা, খুব গ্ৰামের কথা মনে পড়ছে, চলো ঘুরে আসি কদিন।যাবে?''
বাকুড়ার কাছে মল্লপুরে ওদের একসময় বিশাল জমিদারি ছিল। এখনো বাড়িঘর রয়ে গেছে। রয়েছে কিছু জ্ঞাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ঐক্যয় দাদামশাইএর ভাই মণি দাদুর পরিবার এখনো রয়েছে ওখানেই।
-'' আমিও ভাবছিলাম গ্ৰামের কথা। চল ঘুরেই আসি।''
ফাগুনের ছোঁয়ায় পলাশ গাছগুলো লালে লাল, চারদিকে একটা সবুজের আবছা চাদর... গ্ৰামে এসেই মন ভালো হয়ে গেছিল ঐশিকের। প্রায় জল শুকিয়ে আসা পুকুরে কাদা মেখে খেলায় মেতেছে একদল কিশোর। পলাশ ফুল কুড়িয়ে খেলাঘর সাজাচ্ছে শিশুর দল। মাঠে গরু ছাগল আপন মনে চরছে। রাখালের বাঁশির সুরে মন ভালো করা তান। ওদের দেড়শ বছরের পুরানো বাড়িতে সদ্য রঙের পোচ পড়েছে।
মনি দাদু ওদের দেখেই ছুটে এসেছিল। বড় কাকি ছোট কাকিও খুব খুশি ওদের দেখে। মিতা, মনি দাদুর নাতনি এসেছে বিদেশ থেকে ছুটি কাটাতে। ওর চার বছরের যমজ ছেলে মেয়ে হেসে খেলে গান গেয়ে সারা বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে। মণি দাদুর ছোট ছেলে বাদলকাকা গ্ৰামের স্কুলের মাষ্টার। তার ছেলে ঋজু বিকেলে ওদের নদীর ধারে ঘুরিয়ে আনল।
সন্ধ্যায় খোলা ছাদে বসেছিল পারিবারিক আড্ডার আসর।
ঐশিক উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিল দূরের লাইব্রেরীটার দিকে, ঠাকুমার নামে ঐ লাইব্রেরী গড়ে দিয়েছিল ওর দাদামশাই। আলো জ্বলছে দোতলা বাড়িটায়। লোকজনের যাতায়াত দেখেই বোঝা যায় যে লোকে বই পড়ছে।
-'' কী অত ভাবছো ছোড়দাভাই?'' মিতা এসে দাঁড়ায় ওর পাশে।
-''ভাবছি বাংলা ভাষাটা এখনো বেচে আছে এই গ্ৰামে। আমাদের শহর থেকে তো হারিয়ে যেতে বসেছে।''
-''মাতৃভাষা কি অত সহজে হারিয়ে যায় ছোড়দাভাই? ''
-''আচ্ছা মিতা, তোর ছেলে মেয়ে কি কোনোদিন বাংলা শিখবে? তুই ওদের মাতৃভাষার স্বাদ চেনাতে পারবি?'' প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় ঐশিক।
-''আচ্ছা ছোড়দাভাই, ওদের তো দেখছো! ওরা কি তোমার কথা বুঝতে পারছে না? ''
-''বোঝা, দু একটা কথা বাংলায় বলা আয মাতৃভাষাকে জানা কি এক? ওরা রবীন্দ্রনাথ চিনবে না, নজরুল কে জানবে না। বাংলা সাহিত্যর স্বাদ পাবে না....''
-''ওয়েট ... দাভাই। কে বলেছে ওরা এসব জানবে না। আমি বিদেশে থাকি কিন্তু আমাদের বেঙ্গলী ক্লাবে প্রতি শনি রবি বাচ্চাদের নিজেদের কালচার শেখানো হয়। ভাষাটা তো বাড়িতে নিজেই শেখাবো আরেকটু বড় হলে। জানিস. . আগে শূধু ক্লাবের লাইব্রেরী তে বাংলা বই পেতাম। এখন ইবুক পড়তে পারি বাংলায়।''
-''কিন্তু মেজদাভাইএরর মেয়েরা বাংলা শেখেনি জানিস। ওদের দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি।''
-''সেটা বৌমণির জন্য দাভাই। বৌমণি আর মেজদাভাই চাইলেই শেখাতে পারত। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সবাই ইংরেজি স্কুলে পড়ায় মানছি। কিন্তু তা বলে আরেকটা ভাষা শেখা যায় না এটা মানতে পারলাম না। '' মিতার গলায় তাচ্ছিল্যর সুর।
-''আমাদের শহরের অর্ধেক বাচ্চাই বাংলা জানে না। কাকে দোষ দেবো?''
-''দোষ সে সব পরিবারের যারা মাতৃভাষা শেখাতে অক্ষম। বিদেশে কেউ নিজের মাতৃভাষাকে এভাবে অপমান করে না জানিস। একটা ভাষা বেশি শিখতে ক্ষতি কি?''
-'' আসলে এতো পড়ার চাপ...'' ঐশিকের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ওর ছোটকাকি উঠে এসেছিল ওদের কাছে। কাকি বলে -'' চাপ বলে কি মাতৃভাষাকে জানব না? সাওতালদের দেখো, আধুনিক হয়ে, শিক্ষিত হয়ে চাকরি করেও ওরা নিজেদের কালচারকে ধরে রেখেছে। ওদের পরব, উৎসব সব ওরা নিজেদের মত করে পালন করে। ঐক্যর বৌ তো শুনেছি জাপানি ফ্রেঞ্চ এসব শিখেছে। বিদেশি ভাষা শেখার যার এতো আগ্ৰহ সে মেয়েদের মাতৃভাষায় নিজের সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারছে না!''
-''আমার পাশের ফ্ল্যাটে এক বাংলাদেশি পরিবার রয়েছে। বাংলা ছাড়াও ওদের বাচ্চারা উর্দু আরবি সব শিখছে জানো? শেখার ইচ্ছাটাই আসল।'' মিতা বলে।
-''আমার গ্ৰামের স্কুলের ছেলে মেয়েরা কিন্তু অনেক প্রতিযোগিতা মূলক পরিক্ষায় শহরের থেকে এগিয়ে ঐশিক। সর্বভারতীয় পরিক্ষায় দেখবি এরাই বেশি এগিয়ে যায়। কারণ আমরা ওদের সেভাবেই তৈরি করি। '' বাদল কাকাও এসে যোগ দেয় ওদের আলোচনায়।
-''কিন্তু আমি তো পারলাম না আমাদের স্কুলটাকে টিকিয়ে রাখতে...'' ভেঙ্গে পড়ে ঐশিক।
-'' না, দোষ তোর নয়, বাংলা মাধ্যমেরও নয়। পড়ানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে দোষ। মাধ্যম যাই হোক না কেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে শিশুকে। বিষয়ের গভীরে গেছে য়ে পড়াতে হবে। আর এই যে একটা ধারণা যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেই সন্তান ভালো শিক্ষা পাবে এটাই ভুল। বাংলা মাধ্যমের ভালো স্কুল গুলোয় তো এখনো ভালো ছাত্র ছাত্রী তৈরি হচ্ছে। '' বাদল কাকা বলে।
-''দাদুভাই মায়ের দুধ কখনো খারাপ হয় না। অথচ একসময় অনেকেই শিশুকে স্তনপান করাতে চাইত না। আসলে জ্ঞান ছিল না। মাতৃভাষা তো মায়ের দুধের মতোই। যে ভাষায় শিশু প্রথম নিজের ভাব ব্যক্ত করে সে ভাষাতেই সব কিছু সব চেয়ে সহজে শিখবে। ভারতের অন্য প্রদেশের শিশুরা যে মাধ্যমেই পড়ুক মাতৃভাষা শিখতে বাধ্য। শুধু এ রাজ্যেই এমন নিয়ম নেই। দক্ষিণ ভারত গেলেই এই পার্থক্য চোখে পড়ে। তাই আগে নিজেদের চিন্তা ধারা বদলাতে হবে। তবেই বদল আসবে।'' মণি দাদুও এবার এসে যোগ দেয় ওদের আলোচনায়।
-''রিতাদি ব্যাঙ্গালোরে বাংলা ভাষার স্কুল খুলেছে জানিস। শনি রবি ওখানে বাচ্চাদের বাংলা শেখায়, আমাদের কালচার শেখায়। নাচ গান শেখায়। '' রিতা মিতার দিদি। ব্যঙ্গালোরে থাকে। মিতাই বলে ওর কথা।
ঐশিকের মনের মেঘ ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। বড় কাকিমা বলে -''আজকাল তো ফোনেও কত বাংলায় লেখা দেখি। আগে তো আমি ফোন ব্যবহারই করতে পারতাম না। এখন ছোটন আমায় বাংলায় সব শিখিয়ে দিয়েছে। '' ছোটন ওর নাতি।
-''সেটাই তো, বাংলা সফটওয়্যার এসেছে, বাংলা ভাষায় ইবুক হচ্ছে। লোকে আবার সিরিয়াল ছেড়ে বাংলা সাহিত্য পড়ছে, আর কি চাই। '' ছোটন বলে ওঠে। ও যে কখন উপরে উঠে এসেছে কেউ দেখেনি।
তিনটে দিন খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে ঐশিকের খুব ভালো লাগছে। অবশেষে ফেরার পালা। রাতের ট্রেনে বসে ঐশিক ভাবছিল এবার ফিরে অন্য ভাবে শুরু করতে । মাতৃভাষার প্রতি তার যে ঋণ তা তো আর অস্বীকার করা যায় না। প্রতিটা ইংরেজি স্কুলে যাতে বাংলা পড়ানো হয় সেটায় জোর দিতে হবে।
ভোর বেলায় স্টেশন থেকে বেরিয়ে গঙ্গার হাওয়ায় মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। হাওড়া ব্রীজ ধরে আ্যপ ক্যাবটা যখন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে ঐশিকের কানে ভেসে আসে এক সমবেত কন্ঠ।
'' আমি বাংলায় গান গাই আমি
বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই
বাংলায় খুঁজে পাই.....''
লাল পার সাদা শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি পরে একদল কিশোর কিশোরী চলেছে ব্রীজের ধার দিয়ে, ওদের হাতের পোষ্টারে লেখা ''মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা।''
ঐশিকের হঠাৎ মনে পড়ে আজ ভাষা দিবস। কে বলে মাতৃভাষা হারিয়ে যাবে! ঐ তো সদ্য যুবক থেকে কিশোর কিশোরী, ওরাই হাতে তুলে নিয়েছে এ কাজের ভার। ট্যাক্সি এগিয়ে গেলেও বাতাসে ভাসছে ওদের গলা।
-''আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন আমি
বাংলায় বাঁধি সুর আমি এই বাংলার মায়া ভরা পথে
হেঁটেছি এতটা দূর
বাংলা আমার জীবনানন্দ বাংলা
প্রাণের সুখ
আমি একবার দেখি বার বার
দেখি, দেখি বাংলার মুখ আমি বাংলায় কথা কই আমি
বাংলার কথা কই
আমি বাংলায় ভাসি বাংলায়
হাসি, বাংলায় জেগে রই.....''