Rohit Patra

Abstract Tragedy Classics

5.0  

Rohit Patra

Abstract Tragedy Classics

দিগন্তের ওপার থেকে

দিগন্তের ওপার থেকে

10 mins
1.5K


আজকে বেশ রোমান্টিক একটা সন্ধ্যে। তাই না? একটু আগেই কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ায় ভেসে গেছে কত মুকুল আর অবাঞ্ছিত কিছু স্মৃতি ভেসে উঠেছে। অস্ফলটের রাস্তা ভিজেছে অকারণে। সিক্তত্তার মাঝে দূরের ওই মোটর গাড়ির আলো জোনাকির মত প্রতিবিম্ব তৈরি করেছে অস্পষ্টভাবে। অভিযোগ আর অজুহাত গুলো ঝাপসা হয়ে এসেছে এই মৃত্যু পুরীর বুকে। শুধু কিছু ছড়ানো লাশ নেক্রপলিস্টাকে আরও মজবুত করেছে। অজস্র মিথ্যে কথা গড়াগড়ি খাচ্ছে ধুলোয়। আর যন্ত্রণা গুলো এখনও খুঁজছে নির্বাণ। শুধু নির্বাক শুন্যতার ভিড়ে পায়ের শব্ধ শোনা যাচ্ছে। দ্রুত অথচ মৃদু। জানলা খুলে দেখছি এসব। চোখ টা জ্বলছে, বাইরের এই আগুনের আঁচ ঘরে আসছে আর একটা শীতল উষ্ণতা শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। 


কি ভাবছেন কি সুন্দর ব্যাপার। বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি? কোথায় বৃষ্টি? আরে মশাই এসব কাব্য করতে গেলে একটু ভাষা আনতে হয়। বোঝেন ই তো। যতই হোক লেখনী বেচে পেট চলছে। আর বাইরের কোথায় কি হচ্ছে তাতে কজনের কি এসে যাচ্ছে? এতো লেখক লিখছে। বিদ্রোহ গুলো ওই ক্ষত স্থান থেকে চুইয়ে পড়া লসিকার মতন। একবার ঘা দিন। ঘা টা দগদগে হয়ে উঠবে। রক্ত ঝরবে। কষ্ট পাবেন। তারপর কিছুদিন সময় দিন। সেরে যাবে ক্ষত টা। দাগ টারও অস্তিত্ব থাকবে না। ওই কি যেনো মলম আছে না। পারলে প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে নেবেন নাহয়। কিন্তু মনের ও কি কোনো সার্জারি হয় নাকি? আমি তো জানি না। যদিও কোনো ডাক্তার না। খুবই বেনামী লেখক আমি। লিখি তাই লেখক বললাম। নামের পিছনে কোনো স্ট্যাম্প মারা নেই কিন্তু। তো আমাকে আবার সাহিত্যিক ভেবে বসবেন না। আপনাদের ওই ধরা বাঁধা জীবনের বৃত্তাকার গণ্ডিতে সবাইকে ধরে রাখতে পারেন নি কিন্তু আপনারা। কেউ কেউ ওই এক মুঠো বালির মত হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে অজান্তেই। আই পি এল এ আপনাদের টিম হারলে দুঃখ হয় না খুব? কিংবা ওই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রেমিক প্রেমিকার বিচ্ছেদের গল্প পড়ে কেঁদে ফেলেন, তারপর ফেইসবুকে দুঃখের স্ট্যাটাস দেন। খুব কষ্ট হয়। জানি জানি। আরে ব্যাপার কি বলুন তো মানুষ ট্রাজেডি ভালো গেলে। আবার সেটা যদি কেউ রসিয়ে রসিয়ে লেখে তাহলে তো বেশ কিছু নমিনিও পেয়ে যেতে পারে সে। আর তার সাথে যদি একটু জ্ঞানের কথা লেখেন তাহলে তো জমে ক্ষীর। 


আপনারা দেখতে পাবেন না। তবুও চোখ টা একবার বন্ধ করুন। হ্যাঁ আমি বলছি বলেই। যদিও কোনো জোর যার নেই। কেই বা আমি বলার। তবুও... ওই ওখানে হ্যাঁ ওই ঘুমটি মত দোকানটা দেখতে পাচ্ছেন? আরে বাবা চা এর দোকান টা? হ্যাঁ ওটাই। কি সুন্দর আড্ডা জমেছে না? বিকেল বেলা, ক্ষীরের মত দুধ চা, সঙ্গে কিছু আঁতেল মানুষ আর যেকোনো একটা বিষয় বলার মত। বড় বড় বই পড়ে আপনি যে জ্ঞান পাবেন না সেটা এখানে পেলেও পেতে পারেন। বব ডিলান, ম্যাডোনা থেকে শুরু করে মারাদোনা কিংবা ওই আরে ওই মেয়ে গুলোর কথাও উঠে আসে। আরে নাহলে আলোচনা রসালো হবে কিকরে? 


আরে ধুর মশাই। এসব সরকারের দোষ। টাকাটা ভালো কাজে মানে কত গরীব আছে দেশে তাদের সেবা করতে... যাহোক... ভিখারি তে তো ভরে গেলো। কি আর করবেন বলুন। কিছু বলতে গেলেই তো সবাই তেড়ে আসবে। বড়দের সম্মান করতে জানে নাকি ওরা? এই তুই আবার এসেছিস? অ্যা এইটুকু বয়স। ভিক্ষে করছিস? যা যা ভাগ। তোদের জন্য ফ্রি তে সব কিছু দিচ্ছে। কাজে লাগে সেগুলো। তা নয়। ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। -- বলে হালকা একটা ধক্কা মারেন হারান জেঠা ছেলেটাকে। 


কি তেদর দেখেছো? এই পা ধরবি না। নোংরা জিনিস আমার ভালো লাগে না। ধ্যার আবার বাড়ি ফিরে স্নান করতে হবে। এই নে... বলে 2 টাকা হাতে দিয়ে... ভাগ এবার এখান থেকে শুয়োরের বাচ্চা। অবশ্য কার বাচ্চা সেটা... বলে হাসতে থাকেন হারান জেঠা। সঙ্গে আরও কয়েকটা গলা যুক্ত হয়। 


দূরে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটা। হাতের মুঠো শক্ত করে আর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা চোখের জল সেই জং ধরা কয়েনে। তবুও কিসের যেনো একটা অদম্য ইচ্ছা আর আগ্রহ তাকে মরিয়া করে তোলে। ফোস্কা পড়া পায়ের তলা একবার দেখে নিয়ে নিজের নিয়তিকে খুজে পায় আবার। তার থামলে চলবে না। তার অনুভূতি র মূল্য কেউ... থুড়ি অনুভূতি তো এদের নেই। এদের অভ্যাস হয়ে গেছে। দেখেন না। রোদে জলে পুড়েও এদের রোগ হয় না। সামর্থ্য না দিলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা টা তো দিয়েছে। তাইনা? এদের কে লাথি মারুন এরা আবার আসবে লেজ নাড়তে নাড়তে। সত্যি বলতে কি এদের কুকুর এর সাথে নেরি কুকুরের সাথে তুলনা করা যায়। এটা আপনার ওই রোমান্টিক প্রেমিকা না। তাকে মেরে দেখুন না একবার লাথি। মানে এ লাথি সে লাথি না। আরে দেখুন না একবার। এবাবা ব্রেকআপ করে দেবে যে আর বউ হলে ডিভোর্স এর পেপার ধরিয়ে দেবে। কই তাদের তো লাথি মারেন না। ভালোবাসেন যে। অজস্র অবহেলা সত্বেও তো তাই তুমিই শ্রেয় বলে ওঠেন। আর ওরা? রাস্তার ছেলে মেয়ে। ওদের ভালোবাসা যায় না। তাতে আপনার ভালোবাসা দূষিত হয়ে পড়বে যে। স্ট্যাটাস থাকবে না। কি বলবে লোকে? ছি ছি। 


শুনবেন নাকি একটা গল্প? বিশ্বাস করুন। বর্ষাকালে আষাঢ়ে গল্প লিখতে ইচ্ছা করছে না। 

ছেলেটাকে রোজই দেখি এই রাস্তায়। তা আজ অনেক বছর হলো। অফিস যাবার পথে প্রায়শই দেখা হয় তার সাথে। মাঝে মাঝে ওই চায়ের দোকানে বসি। ছেলেটা পছন্দ করে আমাকে। তাই আমাকে দেখলেই ছুটে আসে। কিন্তু কোনোদিনও একটা টাকাও চায়নি । আমিই যাবার সময় তাকে অল্প কিছু দিয়ে আসি। না আছে তার গগনচুম্বী স্বপ্ন, না আছে বিলাসিতার ক্ষুদা। শুধু একটু ভালোবাসা। ব্যর্থ হবে জেনেও মরিয়া প্রেমিকের মতো খুঁজে বেড়ায় সে রোজ। কখনো ভালোবাসা তাকে ধরা দেয়না, লোভ দেখিয়ে পালিয়ে আসে আর তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় তার বুকে হাহাকার ধ্বনি বেজে ওঠে। খুবই চুপ খুবই শান্ত সেই আওয়াজ। আমি আপনি বুঝবো না সেটা। শুধু মাঝে মাঝে তার চোখে চোখ পড়লে ভয় লাগে। বুকের ভেতরটা আঁতকে ওঠে। এতো গভীরতা এত ব্যপ্তি যে কয়েকশ ব্রহ্মাণ্ড গ্রাস করবে সে। হয়তো কৃষ্ণ গহ্বরের শূন্যতা ও এর কাছে ম্রিয়মাণ। ক্ষুধা এই দুই অক্ষরের খিস্তি টা শুনে চটে যায় সে বার বার। তবুও মাঝে মাঝে শ্রান্ত পিচের রাস্তা দিয়ে হেটে যায় ধ্রুবতারার সন্ধানে। পথ শেষ হয়না। শুধু সরলরেখা টা কখন বক্ররেখা হয়ে যায় আর শেষ হয় তার সেই পছন্দের ঠিকানায়। ঘরে মানুষ বলতে তার ছোট একটা বোন আর তার বৃদ্ধ বাপ। নেরী কুকুর একটা সেখানেই মাথা গুজেছে কোনো রকমে। ভিক্ষে করে যা আসে তাতে কোনো রকমে ও পেট চলেনা তিনটে প্রাণীর। 


এইতো সেদিন অফিস যাচ্ছি। আবার দেখা তার সাথে। "কীরে কদিন তোকে দেখছি না যে। সব ঠিক তো?" 

কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। দু একটা শুকনো পাতা খসে পড়ে।

কীরে? বল

বাবার জ্বর এসেছে। তাই আসিনি এদিকে আর। কিকরে ছেড়ে আসি বলুন বাবু? ধ্যামনা টা তো মরতে ও চায় না। শুধু কষ্ট দেয় আমাদের। বুড়োটাকে কষ্ট পেতে দেখে আমারও... থেমে যায় সে। চোখের কোনটা ছলছল করে ওঠে। দুঃখ... এর চেয়ে বড় ছোঁয়াচে রোগ আর নেই। আমার বুকের ভেতর তাও কিরকম করে ওঠে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় রুমেলার কথা। সেও তো আমাকে না বলেই... যাক গে সেকথা নাহয় অন্যদিন বলবো। 


জানি দেরি হবে। অফিসের বস তেড়ে আসবে আমার দিকে। বাক্যবাণে বিদ্ধ করবে। কিন্তু তাও ডাকলাম তাকে। এই আয় এদিকে। বস এখানে। একটা জিনিস দেখবি? একটা লেখা লিখেছি। শুনবি? আসলে ওই আমার একজনই শ্রোতা। জানি হয়তো সেই বস্তা পচা শব্দের ভিড়ে সে হারিয়ে ফেলে না নিজেকে। প্রতিটা শব্দ যদি খাদ্য হত হয়তো সে গ্রাস করতো সবটাই। তবুও প্রতিবার সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফেলিয়ে। শেষে বলে ওঠে " এই তোমার লেখা বই আছে?" হেসে মাথা নারাই। 

কি যে লেখো তুমি কিছুই মাথায় ঢোকে না। মাথা চুলকে বোকা বোকা হাসিটা দিয়ে আবার বলে ওঠে

" তুমি কি ওই রবির মত? ওই যে বুড়োটা হিজিবিজি লেখে। জানো আমার মা ওর অনেক লেখা পড়ে শোনাত। ভালো লাগতো না। কিসব । ধুর ছাই। কিন্তু তারপর তো মায়ের খুব শরীর খারাপ হলো। একদিন সকালে উঠে দেখি সবাই মাকে কোথায় একটা নিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে মনে পড়ছে না মুখ টা। কিন্তু আমি বলেছিলাম ওদের কে... আমাকে যেতে দিল না ওর সাথে। তারপর আর ফেরেনি... বাবা বলে মা নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছে একটা ভালো জায়গায়। এই তুমি জানো জায়গা টা? জানলে একবার নিয়ে যেও তো। তোমাকে টপা কুল খাওয়াবো। খেয়েছো আগে?" হাতটা কেপে ওঠে। গলার কাছটা ভারী লাগে। তাকে বলি, " তোর মা যেখানে আছে আমি জানি। তবে আমার বলা বারণ আছে।" মুখ গোমড়া করে বসে থাকে। আমি তাকে ভোলানোর জন্য লেখা টা পড়তে শুরু করি..


" একটা ছেলে ঘর পালানো ধ্রুবতারার আশায়

শহর জুড়ে শীতল হাওয়া শীতল কিছু হৃদয় 

নষ্ট নীড়ে কিসলয়ের ছন্দপতন ঘটে 

প্রকৃতি তুমি কদাকার ছবি একেছ জীবন পটে

একটা ছেলে দুরন্ত খুব সন্ধানী তার চোখ

ভিজে পথের শুকনো ধুলো উড়িয়ে চলে রাতে

মৃত্যুর কাছে আশ্রয় চায় একটা শালিক পাখি

দুঃখ তুমি ভুলিয়ে দিও আমার কলবসেখি।"


আমার দিকে হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে সে। তার চোখে একটা অদ্ভুত দীপ্তি। আগে দেখিনি কোনোদিনও। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। ব্যাঙ্গের না। 

" আমি আজকে চলি। বুড়োটা আবার খিট খিট করবে। তুমি খুব ভালো লেখো। বুঝিনা। তাও মনে হয়। আমার মায়ের জন্য লিখবে কিছু? লিখলে পড়ে শুনিয়। " 

আমি বসে থাকি। মেঘ জমেছে আকাশে। বৃষ্টি কি হবে? মন্দ হয় না। ঝাপসা চোখে দেখি তার পায়ের ছাপ মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। আর ল্যাম্পপোস্ট গুলো তাকে সেলামী দিচ্ছে মাথা নত করে।


 আমার জীবন তাও ওই অনন্তের পথে এগিয়ে চলেছে। এক পৃথিবী স্বপ্ন চোখে, ভেবেছিলাম লেখক হব। পারিনি। কে পড়বে আমার লেখা? আপনি? আমার লেখার যে শেষটা ভালো হয় না। তবু পড়বেন? অনেক ধৈর্য আপনার। শুনুন তাহলে। 


সেদিনের পর অনেকটা সময় চলে গেছে। বাড়ি থেকে সেরকম বেরোই না। মনটা ভালো নেই। ছেলেটার সাথে দেখা হয়নি দীর্ঘদিন। কি মনে হতে বেরোলাম রাস্তায়। চায়ের দোকানে বসে থেকে উঠে পড়লাম। তার দেখা পেলাম না। সেই রাস্তায় হেটে গেলাম। দিগন্তের বুকে যেনো হঠাৎই বিলীন হয়ে গেছে সে। কিছুদূর যেতেই একটা জায়গা তে কিছু লোকের ভিড় দেখলাম। এগিয়ে গেলাম... কিন্তু... 


" কীরে হারামজাদা কিছু জুটেছে? এতদিন তো তোদের খ্যাটের জোগাড় করেছি। তোর মায়ের মত তুইও পলকা। কিছু হবে না তোকে দিয়ে। শরীর টা নেহাত সায় দিচ্ছে না। নাহলে..." বুড়ো লোকটা চেঁচিয়ে ওঠে 


অত দম থাকলে নিজে করে নাও। পারবো না আমি। মাকে নিয়ে একটা কথাও বলবি না কুত্তার বাচ্চা। তুই আমার বাপ? তুই মরিস না কেনো? একেবারে চলে যেতে পারিস তো। আমি আর আমার বোন একটু শান্তি পাই। জন্মই হয়েছে সালা এরকম ঘরে। এতো সৌভাগ্য আছে নাকি? তুই মরবি না তো। কষ্ট দিয়ে মারবি আমাদের সবাই কে। " ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে ছেলেটা।


 " রেগে গেলি খোকা? মাথার ঠিক থাকেনা রে এখন আর। কি বলতে কি বলে ফেলি। এই বাবু! কাদিস না। কদ্দিন কিছু খাইনি তো। তাই আরকি। দুটো পেট ঠিক করে চলে না। তার ওপর তোর ছোট বোন। কি করবি? না খেয়ে সবাই মরবো। কদিন চলবে এভাবে? 


আমি আমার মায়ের কাছে চলে যাবো আমার বোনকে নিয়ে। পড়ে পড়ে পচবি তুই। 


না রে। তোর মা চায় তোরা কিছু করিস। আমাকে ডাক দিয়েছে। যেতে হবে আমাকে। অনেক দিন হলো রে তোর মায়ের হাতের রান্না খাইনি। আর কটা দিন। কাউকে আর জ্বালাবো না। 


তারপর দিন কয়েক ভিক্ষা মেলেনি। ক্ষুধার্ত পেটে কয়েকটা রাত কেটেছে দুর্বিষহ। ছোট বোনের চিল চিৎকার তার কাছে হায়নার হাসি মনে হয়। পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়ায়। পেটের পিত্তি পড়া বন্ধ হয়েছে কবেই। বুড়ো বাপের শরীর টা মুষড়ে পড়ে। ছেলেটার জ্বর এসেছে। চোখের সামনে আবছা দেখছে সে। মা মা মুখে এই শব্দটা ভেসে আসছে গোঙানির মত। 


খুব ভালবাসিস না তোর মা কে? জানি। কিছুই করতে পারলাম না তোদের জন্য। চোখের সামনে তোরা না খেয়ে মরবি? না না । নিজের মনেই বির বির করে ওঠে। আমার আর বেশিদিন না। কিন্তু তোদের এই শুরু। এই লড়াইটা চালিয়ে যাস। থামবি না। তোদের মধ্যে আমি জেগে উঠবো নতুনভাবে। পরের জন্মে আমি তোর ভালো বাবা হব... অনুরণন ঘটে শেষ শব্ধ গুলোর। জ্বরের ঘোরে ছেলেটা দেখে একটা লোক দূরে চলে যাচ্ছে আর পায়ের শব্দটা মিশে যাচ্ছে মায়ের নূপুরের সাথে। মা.. মা.. কয়েকবার বলেই চোখ বোজে সে। 


মাঝরাতে এক মেয়ের গলা শোনে। বারিন.. বারীন.. আমি এসেছি। খিদে পেয়েছে না তোর। জানি রে। আসলে আমার অনুমতি নেই। নাহলে কবেই...

কে? কে? গোঙ্গিয়ে ওঠে ছেলেটা

আমি তোর মা বারীন। কত বড় হয়ে গেছিস তুই। কি ফুটফুটে লাগছে তোর বোন কে। কিন্তু গাল গুলো ওরকম শুকিয়ে কোনো? সাদা হয়ে গেছে তোর মুখ টা। 


ঘোরের মধ্যে সে বলে ওঠে কে মা? আমার কোনো মা নেই তো। কবে ছেড়ে চলে গেছে আমাকে। কোনদিনও আসেনি তো আমাকে দেখতে। আমাদের দেখতে। বুড়োটা খুব জ্বালায়। গেছিলে যখন ওকে নিয়ে যেতে পারতে সাথে। এখন কোনো এসেছো? তোমাকে দেবার মত কিছু নেই আমার। এসো না। চলে যাও। 


মৃদু একটা হাসি শুনতে পায় সে। আচ্ছা বারীন আমি চললাম। যদি কোনোদিন চোখের সামনে টা লাল দেখিস যদি দেখিস বুকের বোঝায় মাথা তুলতে পারছিস না, যদি অসহ্য লাগে নিজেকে, ডাক দিবি। আমি আসবো। নূপুরের আওয়াজটা মিলিয়ে আসে। 


চোখ খুলতে গিয়েও আবার চোখ বোজে। অচেতন দেহটা জেগে ওঠে চিৎকারে। দুঃস্বপ্ন! ঘরের সামনে দেখে খাবার রেখে গেছে কেউ। অনেক খাবার। পুরো জীবন টা ই যার দুঃস্বপ্ন তার কাছে এরকম একটা সকাল খুব ই অপ্রত্যাশিত। আওয়াজটা আসছে, জোর শোনা যাচ্ছে। কয়েকটা লোক কথা বলছে। 


" কি জানি বাবা। পাগল ছাগল লোক। নেশা করেছিল হয়তো। টলতে টলতে রাস্তা পার করছিল ।হঠাৎ করে এসে গেছিলো হয়তো সামনে। লরির চাকা... 


আর কিছু মাথায় ঢোকে না। ছুটে যায় সে। দুচোখ ভর্তি শ্রাবণের ধারা অস্ফালতের রাস্তাকে অভিশাপ দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে। আর ভীষন লজ্জায় ঠান্ডা পিচ গলে যাচ্ছে। নিজের বলা কথা গুলো মাথার মধ্যে ঘুরছে তার। সে চায়নি এরকম... এক নাগাড়ে ছুটে হোচট খেয়ে পড়ে। সামনে দেখে বুড়োটার নিথর দেহ। মুখে একটা তৃপ্তির হাসি। 


তোমাকে ঘেন্না করি আমি! তুমি সার্থপর। তুমিও ছেড়ে চলে গেলে। আমাদের ঘারে সব দায় দিয়ে তুমি... কোনো গেলে? রাগে দুঃখে অভিমানে ভেঙে পড়ে বজ্র কঠিন ছেলেটা। হিংস্র এক দৃষ্টি নিয়ে এই ভদ্র সমাজকে খিস্তি দেয়। "ভদ্র" এর চেয়ে বড় খিস্তি হয় নাকি? জানা নেই। 


তারপর বহু বছর কেটে গেছে। কেউ খোঁজ রাখেনি। হাজারো মানুষের ভিড়ে অজস্র অসহায় প্রাণ কাতরাতে কাতরাতে হারিয়ে গেছে চির তরে।

দাগ রেখে যায়না কেউ। ওসব তো বড়লোকদের বিলাসিতা। এসব তুচ্ছ গল্প থাকনা আমার কাছে ই শুধু আমার হয়ে।


বলেছিলাম গল্পের শেষটা আমার ভালো হয়না। কি ঠিক বলেছিলাম তো? মন দিয়ে শুনেছেন দেখছি। আপনি না শুনলেও ,তুমি শুনেছ মা। আমি জানি তুমি শুনেছ। বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করে খুব। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আমার লেখা ছেপেছে। নাম হয়েছে অল্প বিস্তর। তাও বুকের ভেতর টা শিউরে ওঠে। খুব ইচ্ছে করে তোমার নূপুরের শব্দ শুনতে। আমি কি পেরেছি মা? তুমি বলেছিলে তুমি দেখা দেবে আমাকে। ফিরে আসবে। জানি তুমি দেখছো আমাকে। হয়তো বাবা আর রাগ করে নেই আমার ওপর। ধরো যদি হঠাৎ ইচ্ছা করে ওই দিগন্তের অনন্তে মিশে যেতে তোমার সাথে আমি ডাক দেবো তোমাকে এক পাতা ঝরার মরশুমে। আসবে তো? 


  






   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract