Rohit Patra

Abstract Tragedy

3.9  

Rohit Patra

Abstract Tragedy

রামধনু

রামধনু

4 mins
334


আজকের দিনেও রাস্তায় দেখা যাচ্ছে ছেলেটাকে। আজকের দিন এর পরে "ও" কেনো যোগ করলাম ভাবছেন হয়ত সেটাই। সবুর করুন, বলছি। আজকে হলো আপনাদের কি যেনো একটা বিশেষ দিন। সবাই দেখছি উদযাপন করছে! দামি দামি গিফট কিনছে কেউবা কিনছে আবেগ। কেউ গিরগিটির মত রং বদলাচ্ছে কেউবা সব পেয়েছির দেশেও কিছু না পাওয়ার অভিযোগ জানাচ্ছে। মাঝখান থেকে কিছু দোকানদার পকেট ভর্তি করছে দামি কাগজের টুকরে। শুধু ওই ছেলেটাকেই কেউ দেখতে পাচ্ছে না। তার অস্তিত্ব আছে অথচ নেই। লাল রঙের বহু পুরনো শত সহস্র ছিন্ন একটা জামা তার গায়ে লেগে আছে কোনমতে। লজ্জা নিবারণের জন্য তা যথেষ্ট। কাঁধে একটা ঝোলা আর কাতর চোখে হিমালয় স্বপ্ন। শুধু এমাথা থেকে ওমাথা তার কৌতুহল ছুটিয়ে নিয়ে চলছে তাকে। ভিক্ষা কিন্তু সে করছে না। শুধু তথাকথিত মানব সভ্যতার মাঝে নিজের প্রাপ্য স্থান টা খুজে চলেছে এতকাল ধরে। তাকে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে আবার কিছু আঁতেল বলছে "এই বয়সে পড়াশোনা না করে ভিক্ষা করছিস? কিচ্ছু হবে না দেশটার। ভিখারী তে ভরে উঠেছে।" নানান কথা তার কানে বাজছে অফিস ছুটির সাইরেনের মত। সে শুধু তার অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছে এই শহরের করুন নেক্রপলিসে। তার সেই ছোটো চোখে সে দেখে ছাই উড়ছে আকাশে আর পোড়ার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। তবু কিসের যেনো একটা টান টেনে চলেছে এই জড়ো পদার্থগুলোকে। সবার চোখে সুখের অভাব আর বেঁচে থাকার হতাশা অথচ সবাই ছুটে চলেছে মরীচিকার পথে। গগন চুম্বি অট্টালিকা আর লাক্সারি কাচের দেয়াল এর গা প্রতিফলন ঘটায় সররৈখিক রামধনু কে। উষ্ণতার বাষ্পে কিছু ওষ্ঠাগত প্রাণ বাতানুকুল যন্ত্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেও দেহের পারদের কাটা কমাতে পারছে না। অথচ ছেলেটার নগ্ন দুটো পা এর পাতা দৃঢ়তার সাথে লড়াই করছে প্রতি নিঃশ্বাসে। বিশাল দাবানলের মাঝে সে খোঁজে অল্প কার্বন ডাই অক্সাইড। অক্সিজেন এর আশা তার ছিল না কখনোই।


শুধু এই ভদ্র সমাজের বুকে অক্সিজেনের ঘাটতি টাই তার চোখে পড়ে। বিষাক্ত নিকোটিনে অনুভূতি পুড়ছে আর ঠিক তার পরেই আবার মাথা চারা দেওয়া কিছু অভিমান ভিজছে খোঁড়ানো বৃষ্টির জলে। কিন্তু কি শীত কি বর্ষা কিংবা বসন্ত ছেলেটার কাছে সেই ঋতু নিছক কিছু বড়লোকি আনন্দ মাত্র। রাস্তার ধারে শুয়ে থাকা নেরি কুকুরটা তার অন্তরঙ্গ বন্ধু। দুজনের ই অস্তিত্ব অনেকটা knife শব্দে "k" এর মত উহ্য। দামি সররৈখিক স্বপ্নের ভিড়ে মিশে থাকা এই কিছু যথেচ্ছ প্যারাবলিক স্বপ্ন,কিছু সাবলীল আনন্দ, কিছু জীবনের সংকেত চাপা পড়ে যায়। হাটতে হাটতে জীবনের কিছু শুকনো বছর কেটে গেছে তার। ঘরে ঘরে মায়েদের আর্তনাদ শুনে থমকে দাড়ায় সে। মনে পড়ে তার মায়ের কথা। কিছু হারানোর ভয় ছিল না সেই রমণীর শুধু একমাত্র সম্বল টাকে সে আঁকরে রেখেছিলো এই হিংস্র শ্বাপদের থাবা থেকে। শুধু তার মনে পড়ে মায়ের গলায় শোনা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কবিতা। অভাবের সংসারে নিজে না খেতে পাওয়া মা "আমার খাওয়া হয়ে গেছে"র মিথ্যে অভিনয় করে তার ক্ষুদা নিবারণ করেছে। জর এ পোড়া তার শরীরে মায়ের হাতের ছোয়া প্রতিবার কাজ করেছে প্যারাসিটামলের চেয়েও বেশি। তাদের সেই বস্তির বস্তাপচা স্বপ্নের মধ্যে খুঁজে নিয়েছে দু মুঠো আনন্দ ।তারপর একদিন হঠাৎ করে সে বড় হয়ে যায়। পরিণত হয়ে ওঠে আচমকাই। তার মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না মাস কয়েক। তখন ছেলেটার বয়স বছর ছয়। মায়ের গলায় সে ধমক শোনে " দুর হ মুখপোড়া। কতদিন আর বসে থাকবি। কর্বিনি কিছু? ওই যে ঝোলাটা দেখছিস ওটাই তোর আমার আমাদের নিয়তি"। সেই প্রথম সে বেরোয় মান অভিমানের পরোয়া না করে নির্লজ্জের মত এই ভদ্র সমাজে। ভিক্ষা করতে সে চায়নি কখনো। সে জানতে চেয়েছিল আকাশের সব থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম, জানতে ছেয়েছিল সেই বস্তির বাইরের জগৎটাকে। যেদিন ঘরে ভিক্ষা আসতো না লাথি ঝাটা খেতে হতো। শেষের কিছু দিন আর কিছু বলেনি তার মা। তার শেষ কথাটা মনে পড়ে আজকে খুব "আমি তোর ভেতরেই আছি খোকা। শুধু কখনো নিজেকে বিক্রি করিসনে। এই ভদ্র সমাজটা আমাদের এই বস্তির পাকের থেকেও ঘোলাটে। ভগবান আছেন। থাকবেন" মিথ্যে বলেছিলো মা। কোথায় ভগবান? তিনি যদি থেকেই থাকেন তাহলে সেই বৃষ্টির রাতে রোগে ধুঁকতে থাকা মাকে কেউ বাঁচাতে আসেনি কেনো? রাগে অভিমানে কদিন সে শুধু ঘুরে বেড়ায় এদিক ওদিক। খাবার জোটেনা। একমাত্র পিছুটান কেটে যায়। চোখের ঝাপসা দৃষ্টি তখন হার মানে ক্ষুধার জ্বালায়।

এসব ভাবতে ভাবতে চোখ থেকে পড়া দুফোঁটা জল বাষ্প হয়ে মিলিয়ে যায়। 

ত্রি মাত্রিক দুনিয়ার দ্বিমাত্রিক দৃষ্টি মিলেমিশে মাত্রাছাড়া হয়ে দাড়ায়।

মায়ের আঁচলের প্রশ্রয়ে থাকা কিছু সন্তান অনলাইনে দামি গিফট কেনে আর মায়ের বকুনি খেয়ে বৃদ্ধাশ্রমের স্বপ্ন দেখে। সব পেয়েও অভাব খোঁজে তারা। তারপর একদিন শীতের ঝরা শুকনো পাতার মত বাদ দিয়ে দেয় জীবন থেকে। যে গাছের মূল থাকে না সেই গাছে ফুল ও ধরে না। বছরের একটা দিনে দুর্গা প্রতিমা র মত সম্মান দেখানো এই কিছু মানুষের দরদ উঠলে ওঠা মাতৃ প্রেম প্রতি বছর চাপা পরে যায় দামি গিফটের অত্যধিক ভিড়ে। 


কখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে জানেনা সে। পকেটে থাকা কুড়ি টাকায় একটা কেক কেনে আর কেনে চোলাই মদ। রোজ মনে পড়ে তার মাকে।

তার মায়ের শেষ স্মৃতি হিসাবে পড়ে থাকা সেই জীর্ণ শীতল সাদা কালো ছবি আর ধুলিমলিন সেই রুমালটা বের করে, মায়ের ছবির পাশে কেক রেখে চুম্বন করে সেই রুমালের শূন্যতাকে। রোজ মনে পড়ে তার মাকে। ঘরে ফেরার তাগিদ তার মারা যায়নি তার কাছে মৃত নয় সেই নারী। তিনি অজর, অমর, অক্ষয়। বছরের একদিন ঘটা করে পালন করা মাতৃ দিবস তার জন্য না। শুধু ভুলে থাকার ব্যর্থ প্রয়াস আর সস্তার রামের নেশাচ্ছোনতায় কাতরে উঠে রোজ সে ঘোরের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মাকে। তার কেনা সেই কেকের টুকরো বিশ্ব জয় করা পুরস্কারকে ও লজ্জিত করে আর নতুন দিনের দুঃস্বপ্নের অবসরে শুনতে পায় মায়ের গলায় সেই কবিতা "যেতে নাহি দিব'।  হায়, 


        তবু যেতে দিতে হয়" 


"। নেশায় বুদ হয় সে। সেই অন্ধকার রাতের গাঢ় ত্তে মিলিয়ে যায় শুধু দুর থেকে শোনা যায় আনন্দের আর্তনাদ আর মাতৃ দিবসের আড়ম্বর।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract