Rohit Patra

Abstract Romance Tragedy

4.0  

Rohit Patra

Abstract Romance Tragedy

অসমাপ্ত

অসমাপ্ত

12 mins
528


আচ্ছা কখনো ওই একলা দুপুরে বসে কিংবা আরামকেদারায় পা নাচিয়ে ভেবেছেন মানুষ কেনো ছুটছে উন্মাদের মত? কখনো ভেবেছেন বসন্তের পাখিরা গান গেয়ে বেড়াচ্ছে আর তার জন্য বুকের কাছটা কিরকম করে উঠছে বার বার আপনার অজান্তেই? শেওলা ধরা ওই বেঞ্চের ধারে দাঁড়িয়ে কখনো দেখেছেন আপনার অলীক মনের সৃষ্ট নামহীন দুই চরিত্রকে? কখনো বলেছেন নিজের মনের কথা আবার কিছু পরে নাটকীয় ভাবে জবাব দিয়েছেন সেটার নিজেই। হয়তো হেসেছেন অল্প। লজ্জা পেয়েছেন। জানেন মাঝে মাঝে ভাবী ওই পড়ে থাকা ভাঙ্গা সাইকেলটা কত কিছুর সাক্ষী। কত সম্পর্কের মাঝে এসেছে সে। সঙ্গী হয়েছে কত মুহূর্তের। তবুও তার শেষটা দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছে কত অপরিণত সম্পর্ককে। পেরেছে কি? কে জানে। ভাবছেন আমি এতো বিজ্ঞের মত কথা বলছি, প্রেম কি এসেছে আমার জীবনে? নাকি কোনো বস্তাপচা সিনেমার প্লট বলছি। সবুর করুন তাহলে। হয়তো আপনি ঠিক নাও হতে পারেন। 


সময়টা শীতের শেষ। দীপ্তর কলেজের পরীক্ষা ইতি টেনেছে কিছুদিন আগেই। ক্লান্ত দুপুরের অবসাদে ভোগা সেই ছেলেটা তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে। প্রেম খোঁজেনা। খোঁজার চেষ্টাও করেনি কখনো। প্রেমে ব্যর্থ হয়েছে সে? না সেসব কিছুই না। আসলে... আচ্ছা প্রথম থেকেই বলি। মধ্যবিত্ত বাড়ির বস্তাপচা স্বপ্নের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া অসংখ্য মৃতদেহের স্তুপের একজন হলো দিপ্তজিত। চোখে হিমালয় স্বপ্ন আর পকেটে কিছু দশ টাকার নোট নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যাওয়া এই ছেলেটার কথাই বলছি। ছোট বেলায় বাপ মারা যাওয়ায় মাথায় ভেঙে পড়া আকাশের ভার নেয় তার মা। ছোট্ট একটা কাপড়ের দোকান থেকে যা আয় হোয় তার বেশিরভাগ তাই চলে যায় খরচের খাতায়। হাতে যা পরে থাকে তাতে ওই বার কোয়েক চায়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া যায়।


ছেলে ডাক্তার হতে চায়। অনেক বড়ো ডাক্তার। কিন্তু বই কেনার মতো পয়সা তার নেই। তাই ওই বাচ্চাদের পড়িয়ে হাত খরচের টাকাটা জোগাড় করে অনেক কষ্টে। তার বয়স হবে তখন একুশ। নিত্যদিনের ইদুর দৌড়ে ক্লান্ত দেহ নিয়ে কখনো তার মায়ের সেবা করে। মা ঘুমালে বইএর স্তুপে ডুব দেয়। পড়তে পড়তে রাত কেটে কখন ভোর হয় জানতে পারে না। পাখির ডাক তাই মাঝে মাঝে বিরক্তিকর লাগে তার কাছে। তিন কুলে সেরকম কেউ নেই ওই একজন মামা ছাড়া। সে ও বছরে ওই দুবার আসে নামকেওয়াস্তে। তাতে কদিনের জন্যে তাদের খরচা বাড়ে শুধু। সাহায্যের হাত সর্বদা শূন্য থাকে সেই মামার। মুখে আশ্বাস আর অনুপ্রেরণা দিয়েই খালাস তিনি। এসবের মাঝে দীপ্ত তার বানানো সেই ইউটোপিয়া য় হারিয়ে যায় মাঝে মাঝে। মায়ের কোলে মাথা রেখে কখনো হাসে কখনো কাদে। কপালে স্নেহ চুম্বনের পরশ আর ছলছল চোখে ছেলের মুখ চেয়ে রাত জেগে ঘুম পারান তাকে। ধ্রুবতারা মিলিয়ে যায় সূর্যের তেজে। কলেজের ক্যাম্পাসে একা একা ঘুরে বেড়ায় আর তাকিয়ে দেখে বড়লোকি আলোচনা। বন্ধু বলতে নেই সেরকম কেউ। পাত্তাও দেয়না। জীবনে এই প্রথম সে একাকিত্ব কে বন্ধু করে নিজের। অবসাদে ডুবে যায় দুচোখ।


এর ওপর প্রেম? আশেপাশে সে শুধু বিচ্ছেদ দেখেছে। এইতো সেদিন তাকে সায়ক জিজ্ঞাসা করলো "কীরে দীপ্ত? সোজা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এর তালে আছো নাকি বৎস? বয়স তো হলো ভালই। কলেজ ও শেষ হবে হবে করছে। প্রেমটা এবার কর। আর কবে করবি ভাই?"

জবাবে সে বলে " কেনো? না প্রেম করলে কি বাঁচবো না? খেতে পাবো না? হাপিয়ে মারা যাবো নাকি? ওসব আমার আসে না। মিথ্যে কথার পাহাড় মাথায় বইতে আমার আপত্তি আছে। আর যদিও বা কেউ থাকে সেরকম সেও বদলে যাবে সময়ের সাথে। বুঝলি? ওসব মরীচিকার পিছনে ছুটি না আমি।"


কোনোদিন যদি কেউ তোকে প্রপোজ করে তাহলে কি করবি? খিস্তি মেরে ভাগিয়ে দিবি? যদি সে ভালো হয়?


আহা খিস্তি দেবো কেনো? বুঝিয়ে বলবো যে এসব আমার দ্বারা হবে না। আর তাকেও বলবো এসব না করতে।


হায় ভগবান। তোকে বলাটাই বৃথা।


হাল ছেড়ে দেয় সায়ক। কি? মনে হচ্ছে যে ছেলেটা খুব শক্ত মনের? এসবে বিশ্বাস করে না? না সত্যিই হয়তো করতো না যদি সেবারের সেই দিনটা না আসতো তার জীবনে। হয়তো এই ভুল ধারণা নিয়েই বেঁচে থাকত সে। প্রেম মানে কি শুধুই যন্ত্রণা? নাকি তার থেকেও উর্ধ্বে কোনো অনুভূতি যা সবাই ছুঁতে পারে না। কিংবা ছুঁয়েও অধরা হয়েই থেকে যায় অনেকের কাছে?


হঠাৎ একদিন কলেজ ফিরতি পথে বৃষ্টি নামে। বজ্রপাতে ভেঙে পড়ে আকাশ। বর্ষাতি নেই তার। মাথায় ব্যাগ চাপা দিয়ে বাসষ্ট্যান্ডে আসে কোনো রকমে। চোখের লবণ মেশে বৃষ্টির জলে। দূর থেকে সে দেখে কোনো এক নাম না জানা বিরহিনী দাড়িয়ে আছে কিছু দূরে। বিসন্ন মুখে তাকিয়ে সে আকাশের দিকে। এই প্রথমবার সে একটু অপ্রস্তুত বোধ করে। মিনিটখানেক কাটার পর মেয়েটা তাকে লক্ষ করে আবছা চোখে। "আপনিও কি ছাতা আনতে ভুলে গেছেন? নাকি বৃষ্টি ভালো লাগে?" তার এই হঠাৎ প্রশ্নে ঘাবরে গিয়ে দীপ্ত মাথা নাড়ায় দুপাশে। বলে " বর্ষাকালে বৃষ্টি কে অনুভব করার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ আছে।"

"তারপর নিউমোনিয়া হলে ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকার আনন্দটাও আলাদাই। কি তাইতো?"

দীপ্তর মুখে মৃদু হাসি দেখে সে আবার বলে" হাসছেন যে? আপনি কি লেখক নাকি? নাকি অঞ্জন দত্ত? ওই যে কি একটা গান আছে না? একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে?

দীপ্ত আবার হেসে ওঠে। আচ্ছা আপনি যে একজন অচেনা মানুষের সাথে কথা বলছেন , আপনার ভয় করছে না? ধরুন আমি যদি আপনাকে কিডন্যাপ করি? কি করবেন?

"মুখের অবস্থা দেখে তো মনে হয় না সাহস আছে কিডন্যাপ করার। তবুও যদি করেন তাহলে কি আর করবো? এমনিতেও বাড়িতে থাকতে মন চায় না। যাইহোক নিজের নামটা তো বললেন না? আমি নীহারিকা।"

দীপ্ত জিৎ।

আচ্ছা মিস্টার দীপ্তজিত তাহলে আপনি কি করছেন এখানে? কিডন্যাপ করার তালে আছেন?

- আমি ওই কলেজের সামনে বাদাম বিক্রি করি।

মেয়ে টা খিলখিল করে হেসে ওঠে। সেই প্রথমবার দীপ্তর মাথা থেকে সব ফিজিক্স কেমিস্ট্রি অঙ্কের জটিল সূত্র জট পাকিয়ে যায়। প্রেমে না পড়ার প্রতিজ্ঞা টা বোধয় আলগা হয়ে আসে। তবুও নিজেকে সামলাতে চায় বারবার। বৃষ্টি আর তার হৃৎপিন্ডে গরম রক্তের শব্দ জলতরঙ্গ তৈরি করে সেই বিকেলে। কিছুক্ষন এর নিরবতা। সেই দুটো প্রাণের উষ্ণতা রামধনু তৈরি করে। ভেজা রাস্তা আর সব কিছু মিলে মিশে যায়। রং ধুয়ে যায়। দীপ্তর বুকের কাছে আর পেটটা এরকম হচ্ছে কেনো? তবে কি সে? না যে ছেলেটা প্রেম শব্দে ঘেন্না করতো আজ সেই দীপ্তর চোখে এখন শুধু নীহারিকা র দীপ্তি। এই অসমাপ্ত বিকেলের মৃদু আলোয় বৃষ্টি কমে আসে আর অল্প আলোয় সে দেখে তার মুখে মৃদু হাসি উদ্ভাসিত করে তুলেছে প্রকৃতি কে। 

"কি আজকে কি এখানেই দাড়িয়ে থাকবেন নাকি? নাকি বাদাম বিক্রি করবেন আবার?" হেসে ওঠে সে।

প্রাণ চঞ্চল এক হাসি অজান্তেই বেরিয়ে আসে দীপ্তর ঠোঁটের কোণে। তারপর... তারপর আর কি? আগুনে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করেও প্রতিজ্ঞা ভাঙতে হয়।

সেই ক্ষণিকের আলাপ আর বাক্য বিনিময় ঘনীভূত হয় মাস্কয়েকের মধ্যে। যে ছেলেটার ফোনে মাছি ভনভন করতো, যে ছেলে জামার হাতা গোটাতে জানত না ঠিক করে সে একদিন নিজেকে সোপে দিল সেই নীহারিকার কাছে। মুঠোফোন হাতে চেপে ধরে প্রতীক্ষা করতো কিসের আশায়। হয়তো ফোনে হঠাৎ করে বেজে উঠবে "মেরে মেহবুব কয়ামাত হোগী"। আর একরাশ আনন্দে স্ক্রিনটা ভরে উঠবে। একটা মৃদু হাসিতে প্রসারিত হবে ঠোঁটের কোনটা। তার মা বুঝতে পারেন। মনে মনে তিনিও খুশি হন। শেষ অবধি ছেলেকে তিনি হাসতে দেখে চোখের কোন ভিজে যায়।


রাতে সেদিনের মত অনেক কথা হলো তাদের। তবে তারপর যে বদলে যাবে সব ভাবেনি সে আগেও।


আচ্ছা মিস্টার দীপ্ত। আপনার প্রেম টেম ভালো লাগে না? মানে কি এক্সাইটিং ব্যাপার না? বেশ রোমান্টিক। তাই না? বলে ওঠে নীহারিকা


অন্যমনস্ক দীপ্ত তাকিয়ে থাকে সিলিং এর দিকে। তার ধাতানি খেয়ে বলে " প্রেম মানে যন্ত্রণা। কাউকে আমি প্রেম করে ভালো আছে দেখিনি। এই ধরো, মানে সিরিয়াসলি নিও না কিন্তু। জাস্ট বলছি। ধরো তোমাকে আমি সব বলে দিলাম, তুমি ও রাজি হয়ে গেলে। তারপর অনেক কথা হলো। অনেক গল্প হলো। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে তুমি চলে গেলে আমাকে না বলে। তখন? তাই এসব মনে আনতে চাই না। যন্ত্রণা কি কেউ নিজের থেকে ডেকে আনে? "


আচ্ছা আর ধরো যদি মেয়েটা তাকে আগলে রাখে। তার এই বস্তাপচা ধারণাটা বদলে দেয়? তাহলেও কি আমাকে সরিয়ে দেবে দীপ্ত? হাতটা চেপে ধরবে না আমার?


কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়। নীরবতা আরও বাড়তে থাকে। দীপ্ত কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। সে কি ঠিক শুনলো? মানে নীহারিকা কি তাকে?


চুপ করে রইলে যে?


জবাব দিতে পারেনি সেদিন সে। তবে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা হতে চলেছে। হয়তো নিরালায় সে খুব চেয়েছে নীহারিকাকে। মন তাকে না বললেও এবার সে আর সেসব ভাববে না। দেখাই যাক না একবার খরস্রোত এ গা ভাসিয়ে। নাহয় বইয়ে নিয়ে যাবে তাকে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য করে। পথের শেষে হয়তো খাদ থাকবে না।


তারপর হাতের গোলাপ টা দীপ্তর থেকে নিয়ে সে গুজলো তার একরাশ চুলের খোঁপায়। "আচ্ছা মিস্টার দীপ্ত এবার যে আমাকে রোজ বাদাম ভাজা খাওয়াতে হবে আপনাকে। আপত্তি নেই তো?"

দীপ্ত জিতের চোখে এখন আর কোনো স্বপ্ন নেই। শুধু তার কালো দুটো মনিতে বিরাজ করছে নীহারিকা এক আর অনন্ত ভাবে। ফাঁকা রাস্তায় কয়েকটা পাতা পড়ে। হামিং বার্ড টা কয়েকবার ডেকে উরে যায়। নতুন একটা উপন্যাসের সূচনা হয় আর দুটো ঠোঁট এগিয়ে আসে খুব কাছে।


তারপর থেকে পাঁচ বছর কেটে গেছে। দীপ্ত ডাক্তার হোয়েছে। ছেলেকে দুহাত ভরে আশীর্বাদ করে পরলোক গমন করেছেন তার মা। তিনি সুন্দরবন যেতে চেয়েছিলেন। শেষ কয়েকটা দিন শরীরের যন্ত্রণায় কাতরেচ্ছেন আর দীপ্ত সদ্য শেখা ডাক্তারি তে ব্যর্থ চেষ্টা করে গেছে। তারপর একদিন মায়ের হাতের কাছে মাথা দিয়ে শুয়ে উঠে দেখে তিনি চলে গেছেন অনেক দূরে। মুখের মৃদু হাসিটা মনে পড়ে তার আজও। সুন্দরবন যাওয়া হয়নি তার। তিন রাত ডুকরে কেঁদেছে সে। নিজের ওপর অসহ্য ঘৃণায় ছুড়ে ফেলেছে বইগুলো।


জলে ঢিল পড়ে। বিশাল একটা ঢেউ ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে আবার মিলিয়ে আসে সমান্তরালে। শুধু সেই ঢিল টা পড়ে থাকে অতল গর্ভে। কখনো সূর্যের আলোয় সেই চকমকি পাথর জলে উঠে মিলিয়ে যায় আবার। এত কিছুর মাঝে নীহারিকা তার হাত টা চেপে রেখেছে শক্ত করে। তার ভালোবাসা ধীরে ধীরে বদলেছে দীপ্তকে। পাঁচ বছর আগের যে ছেলে ভালোবাসার নাম শুনলে ছুটে যেত বহু যোজন দূরে সেই এখন আঁকড়ে বাঁচতে চায় তাকে। মাঝে মাঝে দুজনে পরন্ত বিকেলে কফি হাতে বসে মনে করে বছর কয়েক আগের সেই বৃষ্টিভেজা দিন টার কথা। এই আট বছরে কত কিছু বদলেছে। কত ঝগড়া করেছে তারা। তারপরেই আবার ডুবে গেছে একে অপরের মধ্যে। দীপ্ত এখন বড়ো ডাক্তার। অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছে মৃত্যুর হাত থেকে। কিন্তু কিছু পুরানো স্মৃতি তাকে মাঝ রাতে জাগিয়ে তোলে। তখন পাশে দেখে নীহারিকার তন্দ্রাচ্ছন্ন হাসিমুখটা।


পালিয়ে বিয়ে করতে হয়নি তাদের। আগে না জানলেও এখন সবাই জানে। নীহারিকা যাযাবর হতে ছেয়েছিল। তবে সে এই ছোট্ট সংসার এ খুঁজে নিয়েছে তার গোটা বিশ্বকে। সময় পেলেই দুজনে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে অদৃষ্টের সন্ধানে। কেটে যায় আরো কয়েক্ বছর। জার্নালিজম এ অনেক নাম করেছে সে। আর দীপ্ত পেয়েছে অনেক পুরস্কার। কত ঝড় ঝঞ্ঝাট এর মধ্যে থেকেও ভালোবাসায় টান পড়েনি তাদের।

কিন্তু শনির দৃষ্টি কেউ ই পারেনি, কেউ ই পারেনা এড়াতে। নীহারিকা ই হলো তার শিকার। শরীর টা ভালো যাচ্ছে না তার কয়েক মাস ধরে। অল্পতেই যাচ্ছে মেজাজ বিগড়ে। কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে যাচ্ছে তার। ভুলে যাচ্ছে অনেক কথা। মনে পড়ছে না কিছুতেই।


কাজ করতে গিয়ে অফিসের বদলে চলে গেছিলো কাফে তে। সেবারের সেই বড় প্রোজেক্ট টা আর জমা দেওয়া হয়নি তার। ক্ষমা চেয়েছিল সে। কিন্তু বার বার এক ঘটনা ঘটে। কাজে যাওয়া বন্ধ হয় তার। এত বড়ো ডাক্তার হয়েও দীপ্ত বুঝতে পারে না কিছু। হসপিটালে ছুটি নিয়ে পালিয়ে আসে সে। নীহারিকার মাথার কাছে বসে থাকে সারাদিন, হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়। আর তাকে বলে সেই পুরানো কথা গুলো। "আচ্ছা তোমার সেই প্রথম আলাপ টা মনে আছে? আমি কিরকম ক্যাবলার মতো দাড়িয়ে ছিলাম? আর তুমি দাড়িয়ে হাসলে?"

"কবে বলতো? মনে পড়ছে না তো ঠিক করে। আমাদের দেখা তো হয়েছিল পার্কে । তোমার কি মনে পড়ছে না?"

আঁতকে ওঠে দীপ্ত। রসিকতা ভেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েও সে পারে না। মনের মধ্যের একটা আশঙ্কা বাড়তে থাকে কানসারের মতো।

একদিন একদিন করে সপ্তাহ খানেক কেটে যায়। নীহারিকা এখন আর সব কথার উত্তর দেয় না। মনে করতে পারে না অনেক ঘটনা। দীপ্ত বলে " তোমার মনে আছে আমাদের প্রথম সিনেমা দেখতে যাওয়া? তুমি তো ডিরেক্টরকে কি গালাগালি টাই না দিয়েছিলে। তোমার একদম ভালো লাগেনি সিনেমাটা। মনে পড়ছে? "

"কিসব বলছো? আমরা সিনেমা কবে দেখতে গেলাম? আমার মনে পড়ছে না তো কিছু। আমার সাথে রসিকতা করো না। আমরা কোথাও ই সিনেমা দেখতে যাইনি এত বছরে।" বিরক্তির সুর স্পষ্ট তার গলায়।


দীপ্ত বুঝতে পারে তার আশঙ্কাই ধীরে ধীরে বাড়ছে। তাহলে কি নীহারিকা? নাহ। মরিয়া হয় ওঠে সে। নীহারিকা কে সুস্থ করার চেষ্টায় দেশ বিদেশ ঘোরে পাগলের মত। মুখ ভর্তি দাড়ি আর চোখ এ আবছা দৃষ্টি তার। দিন যায় সপ্তাহ যায়। গাছের থেকে এক এক করে কিশলয় ঝরে পড়ে মাটিতে। নীহারিকার স্মৃতি আস্তে আস্তে অসাড় হতে থাকে আর অশ্বত্থ গাছের একটা করে পাতা ঝরতে থাকে শীতের দুপুরে উত্তুরে হাওয়ায়।

নীহারিকা মাঝে মাঝে চিৎকার করে ওঠে দীপ্তকে দেখে। হয়তো তার না কামানো দাড়ি আর পাগলের মত বেশ ভুসা চিন্তিত করে তাকে। "দীপ্ত, দীপ্ত!" শুধু এই শব্দটাই বলে যায় সারাদিন। দীপ্তকে চেনার ক্ষমতা আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলে সে। তবু তার ভালোবাসাটা রয়ে যায় অক্ষুণ্ণ হয়ে। ওই একজনকে সে আঁকড়ে বাঁচতে চায়। চোখের সামনে তার একটা নাম ভেসে ওঠে বার বার। সামনে থাকা আয়না দেখে দীপ্তকে বলে "আপনি খুঁজে দিন আমার দীপ্তকে। জানেন খুব ভালোবাসি পাগলটাকে। কিন্তু কোথায় যে চলে গেলো কে জানে... আর এই মেয়েটা কে বলুন তো? এরকম ভাবে বসে ক্যানো? দেখুন দেখুন কিরকম অসুস্থ রুগীর মত লাগছে। দীপ্ত থাকলে সব ঠিক করে দিত।

দীপ্তর চোখ আবছা হয়ে আসে। জড়িয়ে ধরতে যায় নীহারিকাকে। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে তার যে সে তো তাকে চিনতে পারবে না। চোখের সামনে একটা মানুষ, যে তাকে বদলে দিয়েছে তিলে তিলে আজ সেই... এই জন্যই ভালোবাসতে চাইনি তোমাকে নীহারিকা। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। তুমি দেখতে পাচ্ছো না? এখন তুমি চেপে ধরবে না আমার হাত টা? নিজের মনে বলে ওঠে দীপ্ত। চোখে নোনার দাগ গাল বেয়ে নেমে আসে।

আর বেশিদিন হাতে নেই তাদের। বুঝতে পারে দীপ্ত। শেষ কয়েকটা দিন নিজেকে আর চিনতে পারে না নীহারিকা। শুধু একটা কি গানের সুর গুন গুন করে সারাদিন ধরে। দীপ্ত তার জন্য একটা রেডিও কিনে এনেছে। রবীন্দ্র সংগীত খুব ভালোবাসে সে। রেডিও চলে আর তার গুন গুন করে গান " কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে"। বুকে চাপা পাথর নিয়ে দীপ্ত তাকে নানা রকম গল্প শোনায়। হসপিটালে আর যায়না সে। ইস্তফা দিয়েছে। সারাদিন সে কাটায় নীহারিকার সাথে। "আচ্ছা আপনি যে এত বড়ো ডাক্তার বলেন নিজেকে, আপনি সব রোগ সারাতে পারেন? আমার এই পুতুলের খুব কষ্ট হচ্ছে। আপনি সারাতে পারবেন না? " হাতের সামনে থেকে একটা পুতুল এগিয়ে দেয় দীপ্তর হাতে বাচ্চাদের মত।

দীপ্ত সেটা হাতে নিয়ে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকে আর দুফোঁটা চোখের জল মাটিতে পড়ে বাষ্প হয়ে যায়। " একি কাদছেন কোনো? সারাতে পারবেন না ওকে? ও তাহলে মরে যাবে?" বলে বাচ্চাদের মত মুখ ভার করে থাকে। দীপ্ত তার হাত চেপে ধরে। তাকে আশ্বাস দেয়। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি জেনেও তার হৃৎপিণ্ড আবার কেপে ওঠে সেই প্রথম দিনের মতো।

পরদিন সকাল থেকে নীহারিকা কিছু খেতে চায় না। রেডিও চালিয়ে সে গুনগুন করে গান করে "এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়"

দীপ্ত গলা মেলায় " আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে"। তারপর মূহূর্তে হঠাৎ করে নীহারিকা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। দীপ্ত এগিয়ে যায়। তার রসিকতা ভেবে তাকে চিমটি কাটে। চিৎকার করে তার নাম ডাকে। কিন্তু সে আর কোথায়। তার বুকের ওপর শুয়ে সে তার হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ শুনতে যায়। রেডিও তে আবার গান বাজে...


দীপ্ত চোখ বোজে। নীহারিকা র যাযাবর হওয়া হোয়না আর। নীহারিকার দীপ্তি নিভে আসে। তারপর কেটে যায় আরো কিছু বছর। ধীরে ধীরে আবছা হয় সব। সুন্দরবন যাওয়া এখনও হয়ে ওঠেনি দীপ্তর। এখন সে আর বুঝতে পারে না কিছু। ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছে কবেই। শুধু গালাগালি দেয় নিজেকে আর প্রলাপ বকে। গরাদ ধরে দেখে সে বাইরের দৃশ্য আর দেখে নীহারিকার প্রতিচ্ছবি। ভালোবাসা তার কাছে ছিল মরীচিকা। পালিয়ে বেরিয়েছে সে প্রতিদিন। কিন্তু নীহারিকা... এই একটা নাম সংজ্ঞা বদলেছে তার। তাকে হয়তো সে হারিয়েছে, হয়তো প্রতিটা শ্বাস এ সে অনুভব করে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা। নাই ভালোবাসতে পারতো সে। জেদ নিয়েই থাকত হয়তো। তাহলে তো আর আজকের দিনটা... না আর ভাবতে পারে না সে। হয়তো এটাই ভালোবাসা, তার একান্ত আপন। শুধু তার অধিকার আছে সেটার ওপর।


হঠাৎ করে তার চিন্তায় বাধা পড়ে। পাগলাগারদে র বাইরে থেকে তার নাম ধরে ডেকে ওঠে একটা মেয়ে "দীপ্ত বাদাম কিনে দেবে আমাকে?" 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract