Rohit Patra

Abstract Children Stories Tragedy

4.0  

Rohit Patra

Abstract Children Stories Tragedy

সান্তা ক্লজ

সান্তা ক্লজ

6 mins
246


এবারের শীতটা জমিয়ে পড়েছে। ডিসেম্বরে শহরটার সেই শীতলতা কাটিয়ে দেখা যায় আলোর রোশনাই। আর দূরে ভেসে ওঠা কোনো বিরোহিনির গলায় শোনা যায় গানের দুকলি। জীর্ণ গাছ পাতা ঝরিয়ে যায় শীতঘুমে। আর কমে আসে পাখিদের কোলাহল। যানবাহনের অত্যধিক চিৎকারও উষ্ণতা দেয় এই নেক্রপলিস্টাকে। ল্যাম্পপোস্ট গুলো লাজে মাথা নত করে আলো ছড়ায় রাস্তায়। আর কিছু প্রেমিক প্রেমিকা পাতা ঝরা গোলাপের সুবাসে প্রেম আবিষ্কার করে নতুনভাবে। ঠাণ্ডা পড়েছে অনেক। যদিও বরফ পড়ছে না, না চড়ছে থার্মোমিটারের কাটা। একটা ট্রাম বেরিয়ে যায় নিঃশব্দে আর কিছু নিত্যযাত্রী ছুটে যায় তার পিছে। সাদা দাড়ি গোঁফ পরে একটা মানুষ দাড়িয়ে থাকে রাস্তার মোড়ে।


যেই আসে তাকে মেরি ক্রিসমাস বলে আর হাতের ঘন্টাটা বাজায় ঢিমেতালে। ছেলে মেয়েদের রূপকথার সান্তা কে দেখে ভীড় বাড়ে আর বাড়ে কৌতূহল। ভিড়ের মাঝে এক বাচ্চা বলে ওঠে

"সান্তা তুমি সব ইচ্ছা পূরণ করতে পারো?" কথাটা প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে যায় শূন্যতায় আর অনন্ত কোলাহলের মাঝে খুঁজে পায়না তাকে সান্তা। নিত্য দিনের অলসতা আর সৌখিনতার মাঝে যাযাবর সান্তা ঘুরে বেড়ায় রাস্তায় রাস্তায়। কখনও মাথার টুপি খুলে দাড়ায়, দু চার টাকা যা আসে তাতে দিন চলে যায় কোনমতে। আবার কখনও ওই বেঞ্চের শীতলতা কে আশ্রয় করেই উষ্ণতার দেশে পাড়ি দেয়। শহর ডুবে যায় লেপের আড়ালে। শান্ত হয় কোলাহল। ধোঁয়াশার প্রলেপ গাঢ় হয় আর আলো আঁধারিতে রাস্তায় বেরোয় রাতের পথিক। ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসে পাউরুটির টুকরো। রাস্তা থেকে অতি যত্নে কুড়ায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলোয় মলিন মাফলার। উষ্ণতার কনিকামাত্র কেই আকড়ে বাঁচার চেষ্টা করে।


রাত কেটে দিন আসে রোজ। ডিসেম্বরের শহরে সান্তা রোজ বেরোয় রাস্তায়। কয়েক বছর কেটে গেছে তার ছেলেটা মারা যায় ক্যান্সার এ। পাগলের মত ঘুরেছে সে এদিক ওদিক। কোনো ডাক্তার ই তাকে বাঁচাতে পারেনি। তার শেষ ইচ্ছা ছিল সান্তা আসুক তার কাছে। বেশ মোজায় ভরে গিফট আনবে সান্তা তার জন্য। সে বলবে "মেরি ক্রিসমাস "।


বছর কয়েক কেটে গাছে। সান্তা আসেনি। মোজা তে মাকড়সা বাসা করেছে । ছেলে মারা যাবার পর তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায় বহুদূরে। নিজের বলতে পড়ে থাকে তার ছেলে রবিন আর স্ত্রী কমলিনির সাথে তার একটা ছবি। ছেলের ইচ্ছা পূরণ তার করা হয়নি। তাই প্রতি শীতে এই ভিড়ের মাঝে খোঁজে সে তার ছেলেকে সান্তা র বেশে। যদি ভেসে আসে তার গলা একটি বারের জন্য। সে বলবে "বাবা তুমি আমাকে নিয়ে যাবে সান্তা র কাছে?" চোখের লবণে গাল সিক্ত হয় তার। তাই সেদিন সেই বাচ্চাটার কথা শুনে ক্ষণিকের আশায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার মুখ। পর মুকুর্তেই আবার মনে পড়ে যায় তার। যে যায় সে যায়। ফিরে আসেনা কখনও। প্রলাপের ভিড়ে কেটে যায় দিনের পর দিন। কখনও বাড়ি ফেরে কখনো হারিয়ে যায় মানুষের ভিড়ে। পিছুটান আর নেই তার কিছুতেই। মাঝে মাঝে সে ভাবে ঝাঁপ দেবে আজ রেল লাইনে। কিন্তু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোকে দেখে তার খুব মনে পড়ে রবিনের কথা। ঘর আলো করে তার সারাদিন দৌরাত্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছিল সে। হঠাৎ করে একদিন কি যে হলো... চোখের সামনে ছেলেটা শুকিয়ে যেতে থাকলো আস্তে আস্তে, তার সেই দৌরাত্তি থেমে যায়, কদিন যাবত আর কিছু খেতে চায়না সে। তারপরে একদিন সে শোনে " I'm sorry। 4th stage." .... এসব ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধে নেমে আসে তার জীবনে টের পায়না সে। আজ আবার তাকে বেরোতে হবে রাস্তায়।

সান্তা র সাজে। মুখে মেকাপ করে নোনার দাগ ঢাকে।


ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর এসে পড়ে সে। রাস্তার ধারে কিছু ভিখারী জড়াজড়ি করে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে নেরি কুকুর গুলোর সাথে। রোজ রোজ সে দেখে তাদের। কারোর গা এ জামা নেই তো কারোর নেই লজ্জা ঢাকার বস্ত্র। গন্ডারের চামড়া এদের। এদের রোগ নেই ব্যাধি নেই নেই রুচিবোধ। দু মুঠো খাবারের জন্য কুকুরের সাথে মরিয়া সংগ্রামে লিপ্ত করে নিজেদের। দেখতে দেখতে কিছুদূর এগিয়ে আসে। শুনতে পায় কিছু গলায় অস্পষ্ট আওয়াজ। "বাবা বাবা ঠাণ্ডা লাগছে খুব। ও বাবা তুমি কথা বলছো না কেনো?" প্রত্যুত্তরে ভেসে আসে একটা ভারী গলায় গোঙানি। এদের আগেও দেখেছে সে। প্রতিবার মনে হয়েছে তাদের কাছে গিয়ে দিয়ে আসবে কিছু গরম পোশাক। কিন্তু হয়ত এই সমাজের বুকে থাকতে থাকতে পাসান হয়েছে তার হৃদয়। তার নিজের খারাপ সময়ে কাউকে পায়নি সে। তাই কারোর দুঃখে কিছু এসে যায় না আর তার। নিজের মনে এসব কথাই ভেবে ভেবে মিনিট খানেক কেটে যায় তার। নিজেকে ধিক্কার জানায় "না আশুতোষ তোর কি এতটাই মানবিকতার অবনতি হয়েছে? মেরে ফেলেছিস নিজেকে?" কথা গুলো নিজের মনেই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে তার কাছে।


এগিয়ে আসে সে। দেখে ছোট একটা ত্রিপল খাটিয়ে কোনো রকমে মাথা গুঁজেছে তিনটে প্রাণী। এক বছর পাঁচের ছেলে তার বাবা আর একটা নেরী কুকুর। ছেলেকে জড়িয়ে বাবা তার হৃদয়ের উষ্ণতাকে নিঃস্ব করে শীতলতার কোলে ঢলে পড়ছে। ছেলেটা অনবরত ছটফট করছে আর তার বাবা অস্পষ্ট সরে বলছে "কিছু হয়নি বাবা। এইতো সকাল হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে"। ছেলেটার চোখে সেই প্রাণচ্ছল আবেগ আর দুরন্ত ভাব তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় তার অতীতের কবরখানায়। এগিয়ে যায় আরো বেশ কিছুটা। নিজের গায়ের লাল উলের কোটটা খুলে ফেলে তারপর সেটা আলতো করে চাপিয়ে দেয় সেই প্রাণীগুলোর গায়ে। কুকুরটা কেউ কেউ করে ওঠে আর অন্ধকারের চাদরের মাঝে বাচ্চাটার চোখ গুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে। থেমে গেছে তার কান্না হঠাৎ করেই। আবার সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে নড়ে ওঠে একটা দেহ। গোঙানির সুরে আবার বলে ওঠে

"এসেছ তুমি প্রিয়ানজলী? তোমার ছেলে কাদঁছে অনেক.... কথা বলছো না কেন? আচ্ছা বুঝেছি... রাগ করেছো আমার ওপর। ঠিক আছে বোলো না কথা। থাকো আমার কাছে কিছুটা। তারপর নাহয় ফিরে যেও। অনেক দূরে... বহুদূরে... তোমার কবরে।"


শেষের কথাগুলো শুনতে পায় না সে স্পষ্টভাবে। চেনা একটা নিকোটিনের স্বাদ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। আর নোনা ধরা শহরের বুক চিরে এক বাবার আর্তনাদ ক্ষীণ হয়ে চাপা পরে যায় ধরণিতলে। কান্না থামে, গোঙানি কমে আসে। ধীরে ধীরে সরে আসে আশুতোষ। চোখের কোনটা এখনও স্বাদ পাচ্ছে বিষাদের। এই প্রথমবার আশুতোষ ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া ছুটে চলে কি এক অজানা আনন্দে। গায়ে তার পোশাক নেই। তবু তার আনন্দের চিৎকার শুনে শীতে ভেজা শহর তাকে কুয়াশার চাদরের আশ্রয় দেয় আর মিলিয়ে আসে তার গলা।


সেই রাতে সে অনেকদিন পর বাড়ি ফেরে। কেউ বসে নেই তার অপেক্ষা করে। চোখ পড়ে তাদের ছবিটায়। শীতল সেই বিছানায় সে শুয়ে অনুভব করে ক্ষীণ উষ্ণতা। ধরফরিয়ে উঠে বসে। দেখে তার ছেলে তার পাশে বসে হাসছে খিল খিলিয়ে। " বাবা তুই এসেছিস? এত কষ্ট কেন দিলি আমাকে? কেন গেছিলিস ছেড়ে?" কিসের এক নেশায় পেয়ে বসেছে আজ তাকে। তার মনের ভুল কে সে ধিক্কার জানতে চায় না। শেষবারের মত হলেও তার ছেলেকে সে জড়িয়ে ধরতে চায় বুকে। হাত বাড়ায়... রবিন বলে ওঠে "গেছিলাম আমি সান্তা র কাছে। তুমি যাবে না?" দুচোখে আশুতোষ এর শ্রাবণের ধরা বয়ে যায়।


আজ খবরে জানা যাচ্ছে শহরের পারদ ছুঁয়েছে দু ডিগ্রী। এত ভয়াবহ শীতে কাহিল মানুষ রাস্তায় বেরোনো বন্ধ করেছে। বেশ কিছু দূরে পাওয়া গেছে সাদা দাড়ি গোঁফ পড়া একজনের দেহ। অতিরিক্ত শীতে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকায় কিছু মানুষ তাকে চিনতে পেরেছে। পার্ক স্ট্রিটের সেই সান্তা। যোগাযোগ করার চেষ্টা চলছে তার পরিবারের সাথে...

দমকা হাওয়ার সাথে মিলিয়ে যায় হারু কাকার দোকানের রেডিওর কণ্ঠ। 


ঝরা পাতা আর মাফ্লারের প্রশ্রয়ে আবার কেটে যাবে একটা শীত। কত অজানা গল্প ঢাকা পড়ে থাকবে শীতল অন্ধকারে। গাছে নতুন পাতা আসবে পাখিরা গান গাইবে। মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় পরাজয় স্বীকার করে বেরিয়ে আসবে সূর্যি মামা। আবার আসবে সান্তা ফিরে ফিরে চেনা শহরের অচেনা গলিতে। সেই বাবা ছেলেকে জীবন উপহার দিয়ে আবার স্লেজ এ চেপে পাড়ি দেবে অন্তহীন এর দেশে। সান্তা আসবে আবার। আড়ম্বরের সাথে পালিত হবে সকলের প্রিয় বড়দিন। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract