মিঠাই বিকেল
মিঠাই বিকেল
(১) "তোর জন্য হারলাম আজ ম্যাচটা। ফাঁকা গোলে শট মারলি, তাও বারের ওপর দিয়ে। ভাই এভাবে খেলতে হলে আমায় আর ডাকবি না।" ম্যাচটা হেরে গিয়ে বেজায় চটে আছে চয়ন। ও হারতে একদম পছন্দ করে না, সে বিষয় যাই হোক না কেন। এ বিশ্বে সবাই যেন ওর প্রতিদ্বন্দ্বী!! কিন্তু অমলকে ও তা মনে করে না। অমল হল ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু। অমল ছেলেটি ভীষণ সাধারণ , পৃথিবীর কোনো কিছুই যেন সে পারে না। ফুটবল হোক কিংবা লগারিদম, সবেতেই সে আস্ত গোল্লা। আর সেই কারণেই ও চয়নের এতটা কাছের। চয়নের সাথে ওর কোনো প্রতিযোগিতাই নেই। " আমি জানি যে তুই আমার মত ভালো খেলতে পারবি না, কিন্তু মোটামুটি চালানোর মত তো খেলবি নাকি?" চয়ন এখনো গজগজ করেই চলেছে। অমল ওর মেজাজটা হালকা করার জন্য হেসে বলল," ছাড়না। চল পুকুর পারে বসে হাওয়া খেতে খেতে আড্ডা দেব। কি সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে আজ।" অমলের এই প্রস্তাবটা খারাপ লাগলোনা চয়নের। সেও মৃদু হেসে বলল," চল তবে।" ওরা অভয় কাকুদের আম বাগানটা পেরিয়ে সরু সিমেন্টের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলো বাসুদের পুকুরটার দিকে। কিন্তু কিছুটা পথ যাওয়ার পরই হঠাৎ........... ********* এসো প্রাণো ভরনো দৈন হরনো হে বিশ্ব ভুবো পরমও স্মরণও হে এসো প্রাণো ভরনো দৈন হরনো হে। জ্যোতি-পূর্ণ কর হে গগনো সুধা গন্ধ্যে ভর হে পবনো গড়ো চিত্ত ভবনো শান্তি সদনো দুঃখ-বিঘ্ন তরনো হে। এসো প্রাণো ভরনো দৈন হরনো হে তব কৃপা করুণার কনিকা কর হে দান অন্তরো হোক অক্ষয়-ও-সখি চির সম্পাদও বার। প্রেম-ও-সিন্ধু হৃদয় আনন্দে চলুক বহিয়া ছন্দে ছন্দে হোক জীবনো ধন্য এসো অনন্য বলাও শান্ত চরণও হে।
************ "কে গাইছে রে এমন? " চয়ন জিগ্যেস করলো। মগ্ম অমল উত্তর দিল, " জানি না।" সত্যিই জানে না ও, এমনও কেউ গাইতে পারে!! এতটা স্নিগ্ধ, এতটা সুন্দর? মনটা হঠাৎ কেমন শান্ত হয়ে গেল!! প্রথম বার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চে গিয়েও ওর ঠিক এমনটাই লেগেছিল। " হ্যাঁ রে এটা ওই বই খাতার দোকানের বিকাশ কাকুর বাড়ি না?" চয়ন জিগ্যেস করলো আবার। অমল মৃদু স্বরে বলল, " হ্যাঁ।" ওই মুহূর্তে ওদের মধ্যে আর কোনো কথা হলোনা। গান শেষ হওয়ার পর একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওরা পারি দিল নিজেদের 'দুধ সায়রের দ্বীপ' এর উদ্দেশ্যে।
(২) সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে টিউশন যেতে একদম ভালোলাগেনা অমলের। মনেহয় পড়তে না গিয়ে আরেকটু বেশি ঘুমালেই বরঞ্চ ভালো হত। তবে আজ সকালটা বেশ মেঘলা, ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, হাঁটতে তাই মন্দ লাগছেনা। অবনী স্যারের বাড়ি বেশি দূর নয়, হেঁটে পনেরো মিনিট মত লাগে। প্রত্যেকদিন যাওয়ার পথে চয়নকে ওর বাড়ি থেকে ডেকে নেয় ও, আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। স্যারের বাড়ি পৌঁছে পড়ানোর ঘরে ঢুকতেই ওরা বেশ অবাক হলো নতুন একটি মুখ দেখে। হাফ ইয়ার্লি এক্সাম প্রায় চলে এল, সেসনের মাঝে তো স্যার এভাবে কাউকে নেন নাহ!! চয়ন নিজের জায়গায় বসে পাশে বসা পটলকে জিগ্যেস করলো," মেয়েটা কে রে?" পটল মুখ বেঁকিয়ে বলল, " স্পেশাল সুপারিশ। চক্রবর্তী বুক ডিপোর ভাগ্নি। নাম শ্রবণা। কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসেছে, তাও আবার মাঝ সেসনে। " চোখ টিপলো পটল। " তার মানে এই সেদিন গান গাইছিল!" চয়ন ফিসফিস করে বলল। " অ্যাঁ, গান?" পটলের উঁচু ভুরু আরো এক কাঠি উপরে উঠে গেল। চয়ন মুচকি হেসে বলল, "নাহ কিছুনা। " ইতি মধ্যে স্যার চলে এসেছেন ঘরে। এসেই উনি নবাগতার দিকে তাকিয়ে বললেন, " আমি এখনো অব্ধি যা যা করিয়েছি তুমি সবটা চয়নের থেকে নিয়ে নিও। ও আমার সব চেয়ে ভালো স্টুডেন্ট। " তারপর চয়নের দিকে তাকিয়ে বললেন," এই তুই ওকে দিয়ে দিস যা যা করিয়েছি, বুঝলি?" "আচ্ছা স্যার। " চয়ন মাথা নাড়লো। অমলের গোটা ব্যাপারটা বেশ মনোরম মনে হচ্ছিল। এমন সুন্দর একজন গায়িকার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলে মাঝেই মাঝেই কত সুন্দর সুন্দর গান শোনা যাবে বিনা টিকিটেই। ভেবেই মনটা খুশি হয়ে গেল ওর।। পড়া শেষ হওয়ার পর ওরা বেরিয়ে একসাথে হাঁটতে শুরু করলো। চয়ন আর শ্রবণা পড়ার ব্যাপারে কথা বলতে বলতে হাঁটছে সামনে, আর সামান্য পেছনে হাঁটছে অমল। " আচ্ছা পেছনের ছেলেটা তোমার বন্ধু? " শ্রবণা জিগ্যেস করলো চয়নকে। চয়ন মুচকি হেসে বলল, " ওই আরকি। গবেট একটা। আমায় ছাড়া ওর এক মুহূর্তও চলেনা, বেস্ট ফ্রেন্ড বলে আমাকে।" " তাই? আর তুমি?" হাসলো শ্রবণা। " আমিও বলি। কষ্ট পাবে নইলে। " "বাব্বা, অন্যের কষ্টের কথা কত্ত ভাবো, এত ভালো ছেলে তুমি?" "সেটা তো তুমি বলবে। নিজের মুখে নিজের ঢাক কি করে পেটাই বলোতো?" চয়ন হাসলো।তারপর পিছন ফিরে বলল, " আমি ওর সাথে একটু জেরক্সের দোকানে যাচ্ছি, তুই বাড়ি চলে যা। বিকেলে মাঠে দেখা করবো। ঠিক আছে?" " আচ্ছা।" বলে অমল আবার উলটো পথে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ আপন মনে গেয়ে উঠলো...... " বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরি, এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয় মাঝারে......"
(৩) ******** হিমেরো রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥ ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো-- "দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে। ********** অমল এখন রোজ আসে সন্ধ্যেবেলায়, বিকাশ কাকুদের বাড়ির সামনে। না এসে থাকতেই পারেনা ও। অদ্ভুত একটা টান অনুভব করে ও শ্রবণার গানের প্রতি। এমন মন ভালো করা গান ও বহুদিন শোনেনি। ওর মা গাইতো ছোটবেলায়, তখন ও অনেক ছোট। মা হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইতো আর ও অবাক হয়ে শুনতো মায়ের গান। মায়ের আচলের গন্ধ মেখে গান শোনার সন্ধ্যে গুলো যে আবার এভাবে ফিরে আসবে ভাবেনি ও। যে গান শুনে মায়ের কথা মনে পরে, সে গান না শুনে থাকা যায়! তাই তো রোজ ছুটে আসে ও মায়ের গন্ধটা ফিরে পেতে। ********** শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান, কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে। যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো-- জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥ দেবতারা আজ আছে চেয়ে-- জাগো ধরার ছেলে মেয়ে, আলোয় জাগাও যামিনীরে। এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো, জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥
*********** শ্রবণার গান শেষ হওয়া মাত্রই লোডশেডিং এ ঢেকে গেল গোটা পাড়া। গাড় অন্ধকারে টিপ টিপ করে জ্বলা মোমবাতির আলোয় পুরো পাড়াটাকে বিড়লা তাড়ামন্ডলের মত লাগছে অমলের। ও হাঁটতে শুরু করলো। লোডশেডিং এর সময় শব্দের তীব্রতা যেন কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। ছোটো বড়ো, কম বেশি,সব শব্দই তখন ভীষণ স্পষ্ট ভাবে কানে আসতে শুরু করে। এই যেমন এখন ও শুনতে পাচ্ছে, খেলার মাঠের বিচ্ছু ছেলে বাচ্চু নামতার বই নিয়ে পড়তে বসেছে। তপেন জেঠু নিজের ভাঙা রেডিওটা কানে নিয়ে শুনছেন ডার্বি ম্যাচের রিলে। বিধবা পুতুল পিসি হ্যারিকেনের আলোয় চালের কাকড় বাছতে বাছতে গাল পারছেন নিজের ভাগ্য কে। আরেকটু এগলেই পাড়ার বিখ্যাত গাঙ্গুলী বাড়ি। সেখানে গেলেই শোনা যায় দুই ভাই এই অন্ধকারেও চাঁদের আলোয় ঠক ঠক করে বল পিঠছে। শুধু কি এই? আরও কত শব্দ আরও কত কি!! তারা প্রত্যেকেই অমলের ভীষণ কাছের, ভীষণ চেনা। আর হবে নাইবা কেন? এই পাড়ার আনাচে কানাচেই তো রোজ অল্প অল্প করে বেড়ে ওঠা অমলের। এইসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে অমল এসে পৌঁছছে বাসুদের পুকুরটার সামনে, মানে ওদের দুধ সায়রের দ্বীপে। জ্যোৎস্নার রঙ গুলে আজ পুকরটাকে সত্যিই যেন দুধের সাগর বলে মনে হচ্ছে ওর। অমল পুকুরপাড়ে জামরুল গাছটার নিচে গিয়ে বসলো। কি অপূর্ব লাগছে আজ চাঁদটাকে। সৌন্দর্যের যে অনভ্যাস অমলের হয়েছে দিন দিন, তা ভাঙতেই যেন চাঁদের ছুটে আশা ওর কাছে। ও কি পারবে সুন্দরকে আগলে নিতে? সুন্দরকে ভালোবাসা যে বড্ড কঠিন, বড্ড কঠিন ...।।।
(৪) এই নিয়ে মোট চারবার পড়লো সাইকেলের চেনটা। দীপুদার এই সাইকেলটার সাথে নিজের ভীষণ মিল পায় অমল। দুটোই বেয়াড়া রকমের অপদার্থ। দীপুদাকে কতবার বলেছে ও, যে চেনটা দু ঘাট কাটিয়ে নাও, কে কার কথা শোনে। যাইহোক, করার তো কিছু নেই। এই ডানাকাটা পক্ষিরাজ দিয়েই কাজ চালাতে হবে।যদিও কাজ বলতে তেমন কিছুনা, ছোটোবাজার থেকে ১৫টা ডবল কুসুমের ডিম আনতে হবে।সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার ক্লাবে ফিস্ট আছে,সেখানে লাগবে।। কিন্তু দুবার প্যাডেল করলে যদি চারবার চেন পরে তাহলে আর কাহাতক পারা যায়!! কোনোরকমে হাতে কালিটালি মেখে, বিস্তর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চার নম্বরবার চেনটা তুললো ও। হাতের কালিটা মাথায় মুছে সাইকেলে উঠতে যাবে হঠাৎ, " আরে অমল না?" চমকে পেছনে তাকালো অমল। দেখলো শ্রবণা কাঁধে ব্যাগ,মাথায় ছাতা, চুলে বিনুনি আর ঠোঁটে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অমল ওকে দেখে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। "কেমন আছো? এদিকে কোথায়?" অমল জিগ্যেস করলো। " ভালো আছি। এই সামনে বাংলা পড়তে গেছিলাম, এখন বাড়ি ফিরছি। তুমি কোথায় যাচ্ছো সাইকেল নিয়ে?" শ্রবণা বলল। " ডিম কিনতে যাচ্ছি।" অমল বলল। " ওহ। বাড়ি কাজ করো তবে? আমি তো ভাবলাম তোমার খালি টোটো কম্পানি।" চোখ টিপলো শ্রবণা। "নানা, এটা বাড়ির জন্য নয়। পাড়ার ক্লাবে আজ ফিস্ট আছে, সেখানে লাগবে। তাই যাচ্ছি।" অমল বলল। " সামনে পরীক্ষা আর তুমি ফিস্ট করে বেরাচ্ছ? চয়ন ঠিকই বলে, তুমি একটা আস্ত গাধা।" " সেতো চয়ন ঠিকই বলে। যদিও আমি ফিস্ট করছিনা। এটা বড়োদের, আমার ভাগ্যে শুধু ডিম আনার দায়িত্ব টুকু পড়েছে। " "বুঝলাম। তা তোমার বন্ধুর কি খবর? পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছেনা? " " ও পরীক্ষার আগে বইখাতা সঙ্গে নিয়ে শীতঘুমে চলে যায়। বাড়ি থেকেই বেরোয়না, সারাদিন পড়ে। " " তুমি পড়োনা?" " পড়ি তো,তবে ওর মত পারিনা।" " কেন পারোনা? " " ইচ্ছেই করেনা। আমার মাথায় থাকেনা জানো। সবাই বলে আমার বুদ্ধি নাকি পুরো ঝামা হয়ে গেছে। " অমলের কথা শুনে শ্রবণা আবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। ও আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু এমন সময় একটা বাইক ঝড়ের বেগে ওদের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল ধূলোবালি,লতাপাতা সর্বস্ব উড়িয়ে। উলটো দিক থেকে এক সাইকেল আরোহী দাদু আসছিলেন রাস্তার ধার দিয়ে। বাইকের ফচকে ছেলেটা দাদুকে এমন চুককি দেখালে যে দাদু টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে পরলেন রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে। অমল নিজের সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে দৌড়ে গিয়ে দাদুকে আর দাদুর সাইকেলটাকে টেনে তুললো ঝোপ থেকে। তারপর ঝোপঝাড় থেকে দাদুর চটি জোড়া খুঁজে এনে পড়িয়ে দিল তার পায়ে। শেষে হাত-পা ঝেড়েটেড়ে দিয়ে বলল, "দাদু আপনার লাগেনি তো?" দাদু মাথা নেড়ে বলল, "না বাবা লাগেনি।" তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বলল," বড়ো উপকার করলে বাবা। তোমার মত মানুষ আজকালকার দিনে আর দেখাই যায়না। ভালো থেকো , খুব ভালো থেকো।" বলে দাদু সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। শ্রবণা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবটা। ঘটনাটি ভীষণ অবাক করলো ওকে। "মানুষ এমনও হয়?" শ্রবণা প্রশ্ন করলো নিজেকে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে ও বুকের ভেতর, যা অনেকটা ভালোলাগার মত। চয়ন বলে অমল নাকি ভীষণ বোকা। বোকা মানুষেরা সত্যি যদি ওর মত হয়, তবে সারা পৃথিবী যেন এমন বোকা মানুষেই ভরে যায়। " কি দেখছো ওভাবে??" অমল ইতিমধ্যে আবার শ্রবণার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রবণা আলতো হেসে বলল, " কিছুনা। বলছি আমি যাবো তোমার সাথে ডিম আনতে?" " যাবে? চলো। তোমার বাড়ি ফেরার তাড়া নেই?"অমল জিগ্যেস করলো। " নাহ। চলো না, তোমার সাথে ডিম টিম কিনে নিয়েই ফিরবো নাহয়।" শ্রবণার কথা শুনে বেশ খুশিই হলো অমল। একসাথে হাঁটলে আর সাইকেলের চেন পরার ভয় থাকবেনা। হলদেটে দুপুরের রঙিন রোদ মেখে বেগুনী ছাতার নিচে পাশাপাশি দুটি মাথা পেরিয়ে গেল কালো পিচের নীলনদ।
(৫) পরীক্ষা শেষের ঘন্টাটা পড়তেই যেন ধরে প্রাণ পেল অমল। এই পরীক্ষার সময়টা ওর একদম ভালোলাগে না।নিজেকে কেমন যেন আধমরা মনে হয় ওর। মাথাটা কেমন যেন ভারী হয়ে যায়। সাইন থিটা-কস থিটা, আলোর প্রতিফলন -প্রতিসরণ, শেরশাহ- আকবর এসব ছাতার মাথা কিছুই ওর মাথায় ঢোকে নাহ। কিন্তু তবুও পড়তে হয়, নইলে জেঠুরা তাড়িয়ে দেবে বাড়ি থেকে।তবে এখন আর সেসব ভাবনা নেই। রেসাল্ট অবধি বেশ শান্তিতে থাকা যাবে। অমল স্কুলের বারান্দা থেকে বেরিয়ে সামনের বটতলাটায় এসে বসলো। চয়ন বেরোয়নি এখনো। বেরলে একসাথে দুধসায়রে যাবে। তারপর গল্পটল্প সেরে একেবারে বাড়ি ফিরবে সেখান থেকে। অমল বসে অপেক্ষা করতে লাগলো চয়নের। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বেরলো চয়ন। বাকিদের সাথে প্রশ্নপত্র নিয়ে আলোচনা করতে করতে অমলকে যেন দেখতেই পেলনা। ওদের আলোচনার পর্ব শেষ হওয়ার পর অমল ডাকলো ওকে। " যাবি তো আজ দুধসায়রে?" অমল জিগ্যেস করলো। "নারে আজ শ্রবণার জন্মদিন। আমার নেমতন্ন আছে, তাই আজ আর থাকবোনা। কাল মাঠে দেখা করবো তোর সাথে। " বলেই চয়ন বেরিয়ে যাচ্ছিল স্কুলের গেট দিয়ে, হঠাৎ থমকে গিয়ে পেছন ফিরে বলল, " শুনলাম পরীক্ষার আগে তুই নাকি ওর পেছনে খুব ঘুরঘুর করেছিস!! শোন এসব করে কোনো লাভ নেই। ওকে আমার পছন্দ হয়ে গেছে। আর তুই জানিস যেটা আমার সেটা আমি কারোর সাথে ভাগ করিনা। তাই একটু খেয়াল রাখিস এবার থেকে। আর শ্রবণাও আমায় পছন্দ করে। ও নিজে বলেছে আমায়, তাই তো আজ নেমতন্ন করলো। বুঝলি?" বলেই হন হন করে বেরিয়ে গেল চয়ন। অমল কেমন যেন থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ওখানে কিছুক্ষণ। তারপর ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল স্কুলের কালো, জঙ্গধরা গেটটার দিকে। বুকের ভেতর তিতকুটে কষ্টটা ঠিক কেন হচ্ছে বুঝতে পারলোনা ও। শ্রবণা জন্মদিনে ডাকেনি বলে নাকি নিজের সব চেয়ে কাছের বন্ধুটা ওকে বিশ্বাস করেনা বলে?
(৬) "কি রে টুকি, সেই কখন দুধটা দিয়ে গেছি, এখনো খাসনি? ঠান্ডা জল হয়ে গেল তো পুরো!!" "আমার খেতে ভালোলাগছেনা মামী। তুমি নিয়ে যাও। " শ্রবণা ইতিহাস বইটা বন্ধ করে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মামী এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল একটু। " কি হয়েছে মা তোর? কাল থেকে কেমন মন মরা হয়ে আছিস? বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছে বুঝি?" শ্রবণা এবার মামীকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। " এই দেখো বোকা মেয়ের কান্ড। পাগলি মেয়ে কাঁদছিস কেন? কিচ্ছু হবেনা, সব ঠিক হয়ে যাবে। " শ্রবণা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মামীকে।" " আচ্ছা হয়েছে হয়েছে,এবার ছাড় আমায়। অনেক কাজ পড়ে আছে। আর শোন দুধটা আবার গরম করে পাঠাচ্ছি, এবার ঝটপট খেয়ে নিস, বুঝলি? " শ্রবণা ঘাড় নাড়লো।মামী টেবিল থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে চলে গেলেন। শ্রবণা আবার এসে পড়ার টেবিলে বসলো। কাল থেকে মন মেজাজ একদম ভালো নেই ওর। পড়াতেও মন বসছেনা। সব হয়েছে ওই বাজে ছেলেটার জন্য। এত অহংকার কিসের ওর? নিজের একটা যোগাযোগ করার মত ফোন নম্বর নেই, দেখাও পাওয়া যায়না দরকারের সময়। তাই তো জন্মদিনের নেমন্তন্ন করে চয়নকে দিয়ে ডেকে পাঠালো , তাও এলোনা। মুখের ওপর না বলে দিল, এতো বড়ো সাহস!! ওর জন্মদিন জেনেও এলোনা একবার। চয়ন ঠিকই বলে, অমলটা একটা অপদার্থ। শুধু তাই নয়, ও একটা বাজে, স্বার্থপর, শয়তান ছেলে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে মাথাটা আগুন হয়ে গেল শ্রবণার। ও দাঁতে দাঁত চেপে পড়ার টেবিল থেকে উঠে আলনা দিয়ে ওড়নাটা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল । আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে ও। অবাধ্য ছেলেপুলেদের কিভাবে সায়েস্তা করতে হয় ওর ভালো করে জানা আছে। কিন্তু কোথায় আছে অমল এখন? কিছুক্ষণ ভাবার পর ওর মনে হলো ও জানে এখন কোথায় পাওয়া যাবে অমলকে। ও আর দেরি না করে পা চালালো বাসুদের পুকুরটার দিকে, কিংবা বলা যায় অমলের দুধসায়রের দিকে।
(৭) "মিঠাই বিকেল"....... কথাটা অমল প্রথম শুনেছিল জয়দার কাছে। জয়দা বলত, " যখন দেখবি বিকেলেটা খুব কমলা ভীষণ, হাওয়ায় হাওয়ায় মৃদুমন্দ মন কেমন, গাছের পাতায় দোলদোলানি বাঁধনছাড়া, প্রান খুলে শ্বাস নিচ্ছে বুকের পাঁজর যখন, সেটাই হল "মিঠাই বিকেল" বুঝবি তখন।" আজ তেমনই এক মিঠাই বিকেলে বসে জয়দাকে খুব মনে পড়ছে ওর। একসময় জয়দার খুব ন্যাওটা ছিল ও। রোজ বিকেলে জয়দার বাড়ি যেত রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে। জয়দার কম্পিউটারে কত্ত রবীন্দ্র সঙ্গীত। আর অবাক বিষয় প্রত্যেকটা গানই ছিল দাদার জলের মত মুখস্থ। জয়দা মেঝেতে বসে একটা ডায়রীতে কিসব হিজিবিজি লিখতো, জিজ্ঞেস করলে বলতো," কবিতা লিখছিরে অমল, একদিন একটা কাব্যগ্রন্থ ছাপাবো।" অমল বসে বসে রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতো আর জয়দার কবিতা লেখা দেখতো। লিখতে লিখতে মাঝে মধ্যেই জয়দা গানের সাথে গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠতো, " হারে রেরে রেরে আমায় রাখবে ধরে কে রে? যেমন ছাড়া বনের পাখী মনের আনন্দেরে, হারে রেরে রেরে আমায় রাখবে ধরে কে রে?" পাড়ায় জয়দাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। আড়ালে নেকাকবি বলেও বিদ্রূপ করতো। এখন ভাবলেও অবাক লাগে, সেই জয়দাই আজ বাংলা সাহিত্যে, নতুন প্রজন্মের সেরা কবিদের মধ্যে একজন। প্রায় ১৭টা কবিতার বই বেরিয়েছে এখনো অবধি। এত বড়ো কবি হয়েও দাদা কিন্তু অমলকে ভোলেনি। যখনি নতুন কবিতার বই বেরয়, জয়দা পাঠিয়ে দেয় ওকে। জয়দাকে নিয়ে সবাই যখন ঠাট্টাতামাসা করতো, জয়দা কিচ্ছু বলতো না, খালি হাসতো। আর বলতো," জানিস অমল, এই পৃথিবীতে সবাই তো সব কিছু পারেনা, আর পায়ও না। কিন্তু তাবলে কখনো হতাশ হবিনা। সব সময় জানবি সবাই যে যার মত করে কিছু না কিছু জীবনে ঠিক করেই নেয়।"
আজকের এই মিঠাই বিকেলে জয়দার বলা সে সব কথা গুলো বারবার ফিরে আসছে ওর কাছে। জয়দার বিশ্বাস ছিল মিঠাই বিকেল গুলোতে নাকি সিনেমার শেষের মত সব ঠিক ভালো হয়ে যায়। কিন্তু অমল জানে ওর কিছুই কখনো ভালো হবেনা। বারংবার চেন পড়া সাইকেলের মত ওর জীবনে যে ভালো কিছু হতে নেই, কক্ষনো হতে নেই। অমল আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসলো মৃদু। " এই করেছ ভালো, নিঠুরও হে, নিঠুরও হে,এই করেছ ভালো!! এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো। আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছু নাহি ঢালে, আমার এ দ্বীপ না জ্বালালে দেয়না কিছুই আলো। এই করেছো ভালো, নিঠুরও হে,এই করেছো ভালো। যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার। অন্ধকারে মহি লাজে, চোখে তোমায় দেখি না যে, বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।। এই করেছ ভালো, নিঠুরও হে, নিঠুরও হে এই করেছ ভালো।" "নিঠুরটা কে আমি না তুমি?" চমকে উঠলো অমল। পেছন ফিরে দেখলো শ্রবণা দাঁড়িয়ে আছে। অমল বেশ গম্ভীর হয়ে জিগ্যেস করল, " তুমি এখানে?" " কেন জায়গাটা কি তোমার কেনা? যে তুমি ছাড়া কেউ আসতে পারবে না?" শ্রবণা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। " তুমি আমার সাথে কথা বলো এটা চয়ন পছন্দ করে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও প্লিজ।" " চয়নের নামে মিথ্যে বলতে লজ্জা করে না তোমার? চয়নকে দিয়ে যখন জন্মদিনের নেমন্তন্ন করে ডেকে পাঠালাম, এসেছিলে? মুখের ওপর তো না বলেছিলে!!" "তুমি আমায় ডেকেছিলে?" "থাক আর নেকা সাজতে হবে না .." "বিশ্বাস করো আমি এসব কিছুই জানতাম না, মানে চয়ন আমায় কিছুই জানায়নি।" গলাটা ভারী হয়ে এল অমলের। শ্রবণা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখলো অমলের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে কে যেন ছুটে আসছে। " কি রে ফটিক কি ব্যাপার, চিৎকার করছিস কেন ওরম পাগলের মত?" " শিগগিরি চল ভাই, চয়নের খুব বিপদ।" "মানে কি হয়েছে চয়নের?" " মান্না পাড়ায় ফুটবল খেলতে গেছিল। সেখানকার ছেলেদের সাথে খেলা নিয়ে কি ঝামেলা হয়েছে, সবাই মিলে ওকে খুব মেরেছে। তুই তাড়াতাড়ি চল। " ফটিকের কাছে সবটা শুনেই ছুট লাগালো অমল মান্না পাড়ার দিকে। যাওয়ার আগে শ্রবণাকে বলল, "পারলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মান্না পাড়ার মাঠে এসো।
(৮) চয়নকে যখন ওরা পাঁজাকোলা করে ট্যাক্সিতে তুললো, তখন ওর জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। ট্যাক্সিতে অমলের কোলে শুয়ে জড়ানো গলায় একটাই কথা বলছিল বারবার, " আমি হেরে গেলাম রে, আমি হেরে গেলাম।" অমল ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল, " এত সহজে কেউ হেরে যায় না ভাই। একদিন সবাই ঠিক জিতে যায়, যে যার মত করে। " হাসপাতালে পৌঁছতেই ওকে এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল প্রাথমিক ট্রীটমেন্ট এর জন্য। তারপর ডাক্তারবাবু দেখে ওকে বেডে ট্রান্সফার করলেন। কাকু কাকিমাও চলে এসেছেন ইতিমধ্যে। কাকিমার তো কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ পুরো ফুলে গেছে। " আমার ছেলেটা এখন কেমন আছে ডাক্তারবাবু?" " হি ইজ অল রাইট নাও। ডান পায়ে একটা ফ্র্যাকচার আছে। তাছাড়া কপালে তিনটে স্টিচ পড়েছে। এখন ঘুমের ওষুধ দিয়েছি, একদিন আমাদের এখানে থাকুক, কাল ওকে নিয়ে যাবেন। " " থ্যাংক ইউ ডাক্তারবাবু।" " থ্যাংক ইউ আমায় নয় আপনার ছেলের বন্ধুদের বলুন। ওরা ঠিক সময় ওকে এনেছিল বলেই কমের ওপর দিয়ে গেল আজ। মেজর ব্লাড লস হয়ে গেলে ব্যাপারটা ক্রিটিকাল হয়ে যেত। কাকিমা ফটিক, অমল, শ্রবণাকে জড়িয়ে ধরলেন কাঁদতে কাঁদতে। আরো কিছুক্ষণ হাসপাতালে থাকার পর কাকু কাকিমা ওদের বাড়ি ফিরতে বললেন। কাকু বললেন," আমরা তো আছি, তোমরা বাড়ি যাও। নইলে তোমাদের বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে। কাল ওর জ্ঞান ফিরলে সবাই মিলে এসো একবার। " কাকুর কথায় সম্মতি জানিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো সেখান থেকে। ফটিক বেরিয়েই অটো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা দিল,অটো ধরবে বলে। শ্রবণা অমলের দিকে তাকিয়ে বলল," আমরাও চলো অটোতেই যাই? " নাহ, আজ খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। আমি হেঁটেই ফিরবো। তুমি ররং অটোয় চলে যাও।" অমলের কথা শুনে শ্রবণা নাক ফুলিয়ে বলল," আমিও হেঁটেই যাব।" " যাবে? চলো তবে।" ওরা আবার পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করলো। মিঠাই বিকেল পেরিয়ে নেমে আসা সন্ধ্যের বুকে, অন্ধকার মেখে হেঁটে যাওয়া যায় অনেক খানি পথ। এ হাঁটায় ক্লান্তি নেই, কষ্ট নেই একটুও। " এই অমল এখান থেকে আমাদের দুধসায়র কতটা?" "এক আলোকবর্ষ দূর।" "হেঁটে পৌঁছনো যাবে?" " আলবাত যাবে।" " আচ্ছা অমল তোমার হাঁটতে বেশি ভালো লাগে, না সাইকেল চালাতে?" "হাঁটতে।" " কেন? " কারণ হাঁটলে আর সাইকেলের চেন পড়ার ভয় থাকেনা।" অমলের কথা শুনে মিষ্টি করে হাসলো শ্রবণা। তারপর নিজের ওড়না দিয়ে ঘেমো মুখটা মুছিয়ে দিল অমলের। আলতো করে হাতটা ছোঁয়ালো ওর হাতে। হাতে হাত রেখে ওরা মিশে গেল স্ট্রীটল্যাম্পের হলদেটে আলোটার সাথে। ******** মিঠাই বিকেলটা সত্যিই তবে সব ভালো করে দেয়, মিলিয়ে দেয় ভাগফলের মত সবটা। এখানে ভাগশেষের জটিলতা নেই। একদম শেষে ভাগশেষের কষ্টকোঠায় পরে থাকে শুধু শূন্য। এই মিঠাই বিকেল সবার জীবনেই আসে এক আঁধবার। তাই অপেক্ষা কোরো, ভাগটা এবার মিললো বলে।